Pages

Friday, January 1, 2016

ইত্তেফাকের জন্ম রহস্য

logo-ittefaq.gif
একটা সময় বলা হতো বাংলাদেশে তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে। আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী ও ইত্তেফাক। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত ইত্তেফাক। কিন্তু ইত্তেফাকের ইতিহাস নিয়ে আছে ধোয়াশা। এর প্রকৃত মালিকানা নিয়েও অনেক গল্প চালু আছে। পত্রিকাটির ভূমিকা নিয়েও আছে নানা আলোচনা। ইত্তেফাকের জন্ম নিয়ে এই পোস্ট।

অভিভক্ত বাংলায় শেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। সে সময়ে মুসলিম লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল হলেও এর মধ্যে দুটি গ্রুপ ছিল। একটির নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন, আরেকটির নেতা সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। নির্বাচনের পর সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ শক্তিশালী হয় এবং তিনিই অভিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। এসময় তিনি কলকাতা থেকে বের করেন একটি পত্রিকা, ইত্তেহাদ। পত্রিকাটি বের করতে হয়, কারণ আজাদ তখন খাজা নাজিমুদ্দিনকে সমর্থন দিতো। ইত্তেহাদের প্রথম সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। বলা হয়, ইত্তেহাদের জন্য প্রেস কিনে দিয়েছিলেন রণদাপ্রসাদ সাহা।
দেশ ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। মতার পালাবদল হয়। কোনঠাসা হয় সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ। নেতৃত্বে আসেন খাজা নাজিমুদ্দিন। এসময় আজাদ পত্রিকাও ঢাকায় আসে। কিন্তু অনুমোদন দেওয়া হলো না ইত্তেহাদকে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে পত্রিকাটির প্রবেশও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দীকেও অনেকদিন কোলকাতায় থাকতে হয়।
মুসলিম লীগ জনপ্রিয়তা হারালে গঠন করা হয় নতুন একটি দল, আওয়ামী মুসলিম লীগ। নতুন দলের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি পত্রিকা। কিন্তু ইত্তেহাদ প্রকাশে অনুমতি না দেওয়ায় নাম কিছুটা বদলে রাখা হয় ইত্তেফাক। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক বের করার এই উদ্যোগটি ১৯৪৯ সালের। মওলানা ভাসানী এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম ছাপা হয়, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ও ফজলুর রহমান খাঁ সম্পাদক। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান চাঁদা তুলে ইত্তেফাক চালাতেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। ১৯৫৩ সালের ২৪ বা ২৫ ডিসেম্বর প্রথম দৈনিক হিসেবে আÍপ্রকাশ করে ইত্তেফাক।
তাহলে তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) ইত্তেফাকের মালিক হলো কিভাবে? মনিক মিয়া চাকরি করতেন বরিশালে, কালেক্টটের অফিসের একজন সামান্য কেরানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রোপাগান্ডা অফিসার হয়ে কাজ করতেন। এসময়ই তাঁর পরিচয় হয় সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। তিনি তাকে কলকাতায় নিয়ে যান, এবং চাকরি দেন দৈনিক ইত্তেহাদে। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন মানিক মিয়া। তখন তিনি বিয়ে করেছেন, নিদারুণ অর্থ কষ্টে আছেন। সরকার তখন ইনফরমেশন অফিসার নিয়োগ করছে। এই চাকরির আশায় ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ঢাকায় আসলেও হোটেলে থাকার অর্থ ছিল না। ঢাকার মোগলটুলীতে তখন ছাত্রলীগের অফিস। এই অফিসে রাতে থাকতে চলে আসেন মানিক মিয়া। ঐ রাতে গোপন বৈঠক চলছিল ছাত্রলীগ অফিসে। খবর পেয়ে পুলিশ শেষরাতে হানা দেয় এবং ধরে নিয়ে যায় মানিক মিয়াকে। পরেরদিন যখন মুক্তি পান তিনি, তখন চাকরির ইন্টারভিউর সময় শেষ। হতাশ মানিক মিয়াকে তখন ইত্তেফাকে নিয়ে আসেন শেখ মুজিব. দায়িত্ব দেন ইত্তেফাকের। সম্পাদক হন তিনি। বরিশাল থেকে স্ত্রী কন্যা নিয়ে এসে কমলাপুর বস্তিতে উঠেন।
তখন মুসলিম লীগের নুরুল আমীন ক্ষমতায়। সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা কলাম লেখা শুরু করেন মানিক মিয়া, মোসাফির ছদ্মনামে। অনেকটাই গ্রাম্য ভাষায় লেখা সেই কলাম দারুণ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ইত্তেফাকের অগ্রযাত্রাও শুরু হয়।
১৯৫৪ এর নির্বাচনে মুসলীগ লীগ বিরোধী জোট যুক্তফ্রন্ট জিতে ক্ষমতায় বসে। কিন্তু মন্ত্রীত্ব নিয়ে শুরুতেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ভাসানী, ফজলুল হক (শেরে বাংলা) এবং সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়ে ইত্তেফাকেও এর প্রভাব পরে। মুখ্যমন্ত্রী তখন সোহরাওয়ার্দী। তাঁর নির্দেশে ১৯৫৪ সালের ১৪ মে ঢাকার জেলা প্রশাসন থেকে ইয়ার মোহাম্মদ খানের জায়গায় মানিক মিয়ার নাম প্রিন্টার ও পাবলিশার করা হয়। একই সময়ে মওলানা ভাসানীর নাম প্রতিষ্ঠাতার বদলে পৃষ্ঠপোষক ছাপা হতে থাকে। জানা যায়, এ নিয়ে ভাসানী মামলা করার কথা ভাবলেও দলীয় ভাবমূর্তির কারণে আর সে পথে জাননি। তারপর একদিন প্রতিষ্ঠাতার জায়গার মানিক মিয়ার নাম ছাপা হতে শুরু করে। ভাসানী নাম আর কোথায় রইলো না তারপর থেকে।
১৯৬৯ সালের ৩১ মে রাওয়ালপিন্ডিতে মানিক মিয়া মারা যান। শুরুতে মানিক মিয়া খানিকটা চীনপন্থী হলেও পরবর্তীতে একদমই মার্কিনপন্থী হয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে। তাঁর মৃত্যুর পর ইত্তেফাক মানিক মিয়ার দুই ছেলের হাতে চলে যায়। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী পিপল, সংবাদ ও ইত্তেফাক পুড়িয়ে দেয়। তবে যুদ্ধের মধ্যেই ইত্তেফাক আবার প্রকাশিত হয়। বলা হয়, টিক্কা খান মোটা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন।
MiltonUK_1233572352_2-photo9.gif.jpg
এই ছবিটি সামুর সেলটিক সাগরের পোস্ট থেকে নেওয়া

তথ্য সূত্র:
১. বাংলাদেশের রাজনীতি, ১৯৭২-৭৫। হালিম দাদ খান। আগামী প্রকাশনী
২. ইতিহাসের রক্তপলাশ, পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর। আবদুর গাফফার চৌধুরী।

No comments:

Post a Comment