গারথিয়া লোরকার জিপসি বালাদ : নিশিডাকের গান
লোরকা ১৮ টি জিপসি বালাদ (Romancero Gitano) লিখেছিলেন। এগুলো জিপসি জীবনের কাহিনী ভিত্তিক কবিতা। ছন্দোবদ্ধ, ৮ মাত্রার কাহারবায় – এগুলো গাওয়াও হয় ফ্লামেঙ্কো স্টাইলে। আমি একটির অনুবাদ নিচে প্রকাশ করলাম। বোরহেস এগুলোকে গেঁয়ো মনে করেছিলেন, অন্য স্পানীশভাষী কবিরা তা মনে করেন না, অন্তত আলবের্তি, আলেহান্দ্রে এবং নেরুদা তো নয়ই। এগুলোর শিকড় আবহমান লোকজ কাহিনী-গান। একটা প্রতি তুলনার কথা মনে এসেছে– রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলীর শিকড়ও কবির, তুলসীদাস ইত্যাদির আবহমান লোকজ ভক্তিগীতিতে। কিন্তু তাঁর প্রকরণ, রস, ভাষাশৈলী অন্য মেজাজের। একটা কারণ অবশ্যই তাঁর উপনিষদ মর্মগ্রাহীতা। দ্বিতীয়ত, লোকজ হলেও তাঁর বিষয় ধর্মবোধ। অন্য দিক দিয়ে লোরকা অনেকটা জসীমুদ্দিনের কাছের। কিন্তু জসীমুদ্দিন প্রকরণে আধুনিক নন। লোরকা ইমেজারি ব্যবহারে পুরো আধুনিক, তা ছাড়া রহস্য এবং “দুয়েন্দে” (সাঙ্গীতিক তীব্র দরদ) তৈরী করতে পারঙ্গম।বাংলায় অনেকে অনুবাদ করেছেন। কাহিনী বোঝা যায়, কিন্তু সুরটা পাওয়া যায় না।
এখানে পাঠের নমুনাঃ
সবুজ তোমারে চাই, / তোমারে সবুজ, //
শাখারা সবুজ আর / হাওয়ারা সবুজ – //
একা তরী সাগরের পার, //
এবং একলা ঘোড়া / একা-একা পাহাড়ে। //
নিশিডাকের গান
সবুজ তোমারে চাই, তোমারে সবুজ,শাখারা সবুজ আর হাওয়ারা সবুজ –
একা তরী সাগরের পার, এবং
একলা ঘোড়া একা-একা পাহাড়ে।
রূপসী স্বপ্ন দ্যাখে ব্যালকনি ব’সে,
কোমরে ঝুঁকেছে ছায়া।
অঙ্গ সবুজ আর চুলেরা সবুজ
আঁখি দুটি হিমেল রূপোর।
সবুজ তোমারে চাই, তোমারে সবুজ,
বেদের চাঁদের তলে
পৃথিবী সে রূপ দ্যাখে,
কিন্তু সে দ্যাখে না তো আর!
সবুজ তোমারে চাই, তোমারে সবুজ।
আঁধারিয়া আনে মাছ, যারা
খুলে দ্যায় পথ প্রভাতীর ।
হাওয়ায় শিরীষ মাজে ডুমুরের ডাল,
বুনো বাঘ পাহাড়ে ঘষছে নখ-ধার।
কে আসবে? কোন পথে?
ব্যাল কনি ব’সে তার অপেক্ষা –
মাংশ সবুজ তার চুলেরা সবুজ
খোয়াবেরা নোনা দরিয়ার।
“- বদলাবো দুল্দুল, হে বন্ধু-
বিনিময়ে বাড়িটি তোমার দিও;
তোমার আয়না নিই, ঘোড়ার রেকাব দিই,
কাঁথার বদলে দিই এই তলোয়ার।
খুনে লাল, এসেছি এই যে দ্যাখো,
কাব্রার গিরিপথ ধেয়ে।“
“- লেন-দেন সবই হতো, বুঝলে তরুণ,
যদি পাত্তাম। জানো তো হে,
আমি তো সে নই আমি আর
বাড়িটিও নয় আর আমার বাড়ি।“
“- মরণেরে শান্তিতে চাই! যাই জোটে
মেহগিনি খাটে– মেশেদের চাদরের
পরে। দেখছো বুকের থেকে
গর্দানে খুন!”
“-কালো তিনশো গোলাপ
শাদা কামিজে তোমার পড়ে।“
“-তবু আমি তো হে নই আর আমি
বাড়িটিও নয় আর আমার বাড়ি।“
“-শুধু বারান্দা উঠে আসি –
উঠে আসি, চ’লে আসি
সবুজ বারান্দায় –
চান্দের ব্যালকনি
যেখানে ঝরনা-জল ধ্বনি।“
দু-জন সুহৃদ উঠে গ্যালো
উঁচু সিঁড়ি বারান্দা পথে,
রক্তের রাহা এঁকে –
অশ্রুর পথ এঁকে।
ছাদে-ছাদে দুলছিলো
শার্সির লন্ঠন – ভাঙছিলো ভোর
এক-হাজার মঞ্জীরা স্ফটিকের।
সবুজ তোমারে চাই, তোমারে সবুজ
শাখারা সবুজ আর হাওয়ারা সবুজ।
দু-জন সুহৃদ উঠে গ্যালো
দূরের বাতাস মুখে জাগালো
জর্দা-মেথি–কর্পূর স্বাদ।
“-বন্ধু, সে কই, বলো –
তোমার সে নোনা মেয়ে।“
“-কতোকাল তোমারই অপেক্ষায় ছিলো,
কতোদিন তোমারই অপেক্ষায় –
মুখ হিম, কালো চুল,
সবুজ এ ব্যালকনি পরে।“
তনুটি সবুজ তার চুলেরা সবুজ
আঁখি দুটি হিমেল রূপোর।
চাঁদের বরফ তারে
জলেতে ভাসায়ে রাখে
রাত্রি নিবিড় হয়
রাস্তার তেমাথার মতো।
মাতাল সান্ত্রী এসে
দরোজায় কড়া নাড়ে।
সবুজ তোমারে চাই, তোমারে সবুজ,
শাখারা সবুজ আর হাওয়ারা সবুজ–
একা তরী সাগরের পার, এবং
একটি ঘোড়া একা-একা পাহাড়ে।
No comments:
Post a Comment