শেষ পর্যন্ত “ভিক্ষাবৃত্তি: প্রাগৈতিহাসিকের পরে” নামটিই সাব্যস্ত হলো
নাজমা আক্তারের পিএইচডি’র বিষয়। ওর স্বামী ভদ্রলোক যে কতোটা ক্ষমতাবান তা
আবারও প্রমাণ করে দিলেন নাজমার সামনে ওকে দেশের বিখ্যাত পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি করে দিয়ে। নাজমা অবশ্য
আরেকটি বিশ্ববিদ্যাল থেকে বাংলায়ই মাস্টার্স করেছিল, তখন ওর স্বামীর
পোস্টিং ছিল দেশের উত্তর দিককার শহরে। এখন ঢাকায়, সরকারের প্রায় সর্বোচ্চ
পদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন তিনি, অতএব তার ক্ষমতাও বেড়েছে। তাছাড়া তিনি
নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ থেকেই বেরিয়েছেন, অতএব শিক্ষকরাও তার
অত্যন্ত আপনজন, চাকুরিতে থাকা অবস্থাতেই তিনিও একটি পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন
করেছেন, বিষয় “বাংলা কবিতায় প্যাঁচাদের আচরণ”; সগর্বে তিনি তার ডক্টরেট
পরিচয়টি নামের আগে ঘোষণা করে থাকেন সর্বত্র। স্ত্রীকে ভর্তি করার ব্যবস্থা
করেই ভদ্রলোক বলে দিলেন, “আমার কাজ শ্যাষ, এইবার তুমি যেইভাবে পারো পিএইচডি
শ্যাষ করো। আমার চাকরি থাকতে থাকতে কইরো, নাইলে কিন্তু জীবনেও শ্যাষ করতে
পারবা না”। নাজমা আক্তার বরাবরের মতো, চুপচাপ শুনেছেন তার সরকারী কর্মকর্তা
স্বামীর কথা, কোনো উত্তর দেননি।
কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হলো, পিএইচডি’র বিষয়টি নাজমা আক্তারের খুব পছন্দ হয়েছে। এমনিতেই মাণিক বন্দপাধ্যায়ের “প্রাগৈতিহাসিক” ওর খুব প্রিয় একটি গল্প, তার ওপর এই গল্পের চরিত্রদের এখনও ও রাস্তাঘাটে ঘুরতে ফিরতে দেখে, এখন তাদের ওপরই গবেষণা করতে পারবে ভেবে নাজমা আক্তার আনন্দিত হয়ে ওঠেন। নিজের জীবনে আনন্দিত হবার মতো ঘটনা নাজমা আক্তারের খুব বেশি নেই। দুই পুত্র-কন্যা এবং তাদের পিতার সঙ্গে নাজমা আক্তারের মানসিক দূরত্ব কতোটা বিশাল তা তিনি নিজেও মেপে উঠতে পারেন না ঠিক। কিন্তু এই দূরত্ব কিংবা এর চেয়েও বেশি দূরত্ব নিয়েই তো এদেশে মানুষ আজীবন সংসারধর্ম পালন করে থাকে। নাজমা আক্তারও তাদের একজন। তাই এরকম একটি পছন্দের কাজ পেয়ে নাজমা আক্তার আনন্দিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
ছেলেমেয়ে দু’জনেই স্কুল-কলেজ পেরিয়েছে, তাই বাচ্চা সামলানোর ঝামেলা নেই। উচ্চপদের কর্মকর্তা হিসেবে বিশাল বাড়ির সঙ্গে সংসারের প্রতিটি সেক্টরেই একজন করে লোক নিয়োগ করার ক্ষমতাও রাখেন নাজমা আক্তারের স্বামী। বাংলায় এমএ ডিগ্রী নিয়ে এতোদিন তিনি ঘরে বসেছিলেন কেবলমাত্র ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য, যে কারণে ওর স্বামী ওকে কোনো চাকরি নিতে দেননি। কিন্তু এখন যেহেতু সে ঝামেলা আর নেই সেহেতু নাজমা আক্তার পুরোদমে পিএইচডি করায় মনোযোগ দিলেন। উদ্যোমী শিক্ষকরা এগিয়ে এলেন নাজমা আক্তারকে সাহায্য করার জন্য কিন্তু বেশিরভাগেরই কোনো না কোনো তদ্বীর থাকে ওর স্বামীর কাছে। তারা বাড়ি অবধি এসে ওর সঙ্গে দেখা করে যান, কথা বলতে চান এবং কথার ফাঁকে নিজেদের কাজটুকুর জন্য তদ্বীর করে যান।
তারপরও নাজমা আক্তার কাজ শুরু করতে পারলেন। এরই মধ্যে একজন শিক্ষক তার তদ্বীর পেশের আগে তাকে পরামর্শ দিলেন, বিভিন্ন বয়সের এবং ভিন্ন ভিন্ন লিঙ্গের অন্ততঃ ত্রিশ-চল্লিশ জন ভিক্ষুকের সাক্ষাতকার গ্রহণ করার জন্য। বললেন, “শোনেন নাজমা, পিএইচডি এমন কঠিন কিছু না, কঠিন হইলো লেগে থাকা। তিন-চারটা বছর এই কয়টা শব্দের ওপর লেগে থাকার ধৈর্য সবার থাকে না, বুঝলেন? আপনি লেগে থাকতে পারলে এই ইন্টারভিউগুলা থেকেই বার হয়ে আসবে আপনার তথ্য-উপাত্ত্ব, তারপর আপনি খালি সেইগুলা সাজাইয়া-গুছাইয়া লেইখা ফেলবেন। আর আমরা আপনারে পিএচডি দিয়া দিব, বুঝলেন ম্যাডাম?” নাজমা আক্তার ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গি লক্ষ্য করছিলেন, প্রমিত এবং কথ্য দু’য়ের মিশ্রণে তিনি এমন এক ভাষা সৃষ্টি করেছেন যা নিশ্চয়ই ছাত্ররা খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারে। ভাষা ব্যবহারের এই পদ্ধতি নিশ্চয়ই খারাপ নয়, নাজমা আক্তার মনে মনে ভাবেন এবং সিদ্ধান্ত নেন কালকে থেকেই তিনি এই সাক্ষাতকার গ্রহণের কাজে নেমে পড়বেন। কিন্তু সাক্ষাতকারের প্রশ্নগুলো কেমন হবে? তিনি একটু কুন্ঠা নিয়েই প্রশ্নটা শিক্ষক ভদ্রলোককে করে ফেলেন। “আরে ম্যাডাম, প্রশ্ন খুউব সোজা, আপনি তার জীবন কাহিনী শুনতে চাইবেন। জন্ম কোথায়? ছোটবেলা কোথায় কাটছে? বাবা-মা কী করতো? তারপর এক লাফে আসবেন, ভিক্ষায় জুটলো কেমনে? এখনতো প্রত্যেক ভিখারিই কোনো না কোনো ভিক্ষুক-কোম্পানীর এমপ্লয়ী, প্রশ্ন করবেন, ডেইলি কতো বেতন পায়? এইসব আর কি। আপনি প্রশ্নগুলো লেইখা আপনার গাইডরে দিয়া এ্যাপ্রুভ করাইয়া নিবেন, তাইলেই হবে। বিদেশে হইলে আপনারে নানান এথিক-ফেথিকের ঝামেলায় পড়তে হইতো, আমরা সেইসবের ধার ধারি না। ভিক্ষুকদের সঙ্গে আবার কিসের এথিক দেখাইবেন কন? হা হা হা”। ভদ্রলোক হাসতে হাসতে নিজের কথায় ফিরে যান, তার মেয়েটি এবার বিসিএস দিতে যাচ্ছে, একটু যদি সহযোগিতা করেন নাজমা আক্তারের স্বামী, তাহলে খুবই উপকার হয়। ভদ্রলোককে কিংবা তার মেয়েকে সাধ্যমতো সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন নাজমা আক্তার।
ইদানীং প্রাগৈতিহাসিক গল্পটি নাজমা আক্তার পারলে দিনে কয়েকবার করে পড়েন। গল্পের মূল চরিত্র ভিখুর ভিক্ষাজীবন শুরুর আগ পর্যন্ত যে জীবন, তা নিয়ে ওর কোনোই আগ্রহ নেই এখন আর, কিন্তু ভিক্ষাজীবন শুরুর পরে তার চলাফেরা, কথা বলা, আচরণ এবং ভিখুর সঙ্গে সম্পর্কিত পাঁচি ও বসিরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নাজমা আক্তার ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেন। আর রাস্তায় বেরুলেই এই তিনজনের আদলে কাউকে পাওয়া যায় কিনা তা খেয়াল করেন। এরকম ভাবেই একদিন বেইলি রোডে তিনি মোসলেম সর্দারকে পেয়ে যান। ভিখুর একটি হাত অকেজো হয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার শরীর-স্বাস্থ্য ছিল অটুট, ভিখুর বয়স সম্পর্কে গল্পে খুব বেশি কিছু বলা নেই কিন্তু নাজমা ভাবতে ভালোবাসেন যে, ভিখুর বয়স হলেও পেটানো শরীরে চওড়া বুকের ছাতি আর মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া কাঁচা-পাকা চুল, মুখে দাঁড়ি থাকলেও থাকতে পারে, যেমন মোসলেম সর্দারের আছে। কিন্তু মোসলেম সর্দারের ভেতর সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় যা, তাহলো, ওর দু’চোখের গর্তে লাল দগদগে মাংস বেরিয়ে আছে, কেউ চোখের গোলক দু’টি তুলে নিয়ে গেছে, এটা বোঝা যায়। নাজমা আক্তার ধরেই নিয়েছিলেন যে, ডাকাতি কিংবা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় ক্ষুব্ধ মানুষ ওর চোখ দু’টি তুলে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সাধারণত, এরকমটাইতো হয়, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পেও এরকমটিই পড়েছিলেন বলে মনে করতে পারেন নাজমা আক্তার।
টাঙ্গাইল শাড়ি কূটির থেকে শাড়ি কিনে বেরুতেই মোসলেম সর্দারের সামনে পড়েছিলেন নাজমা আক্তার এবং চমকে উঠেছিলেন প্রাগৈতিহাসিকের ভিখুকে সামনে দেখে। ড্রাইভারের হাতে শাড়ির প্যাকেটগুলি দিয়ে নাজমা আক্তার মোসলেম সর্দারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “নাম কি আপনার? বাড়ি কোথায়?”
মোসলেম সর্দার চোখে না দেখলেও ঠিক টের পান কোন্ দিক থেকে আওয়াজ আসছে, কখনও কখনও ভুলও হয়, অন্য অন্ধদের ক্ষেত্রে যেমন হয়, কিন্তু মোসলেম সর্দার স্পষ্ট করে নিজের নাম বলেন, পরের প্রশ্ন বাড়ি কোথায়, সে উত্তর দেন না। নাজমা আক্তার আবারও জিজ্ঞেস করেন, “বাড়ি কোথায় বললেন না?”
“বাড়ি যে কুথায় ছিল সেইটাতো মা মনে নাই। এ্যাহন ঢাকা শহরই আমার বাড়ি-ঘর, স্থায়ী নিবাস”- মোসলেম আবারও গোটা গোটা করে বলেন।
“কোথায় থাকেন সর্দার সাহেব? পুরোনো ঢাকায়? ওইখানেতো অনেক সর্দার আছে বলে জানি, আপনি কি তাদের বংশধর?”
“না মা, আমি তাদের বংশধর না। আমি কারো বংশের কেউ না”- এটুকু বলেই মোসলেম সর্দার নতুন করে পথচারীদের আকর্ষণ করতে শুরু করেন যেমনটি এর আগে করছিলেন “কিছু সাহায্য করেন আপামণিরা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমারে কিছু সাহায্য করেন খালাম্মা, আমি দ্যাশ স্বাধীন করছি”। নাজমা আক্তার বুঝতে পারেন, মোসলেম সর্দারের এখন পিক টাইম, এখন তার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করায় মোটেও আগ্রহী নন তিনি। কিন্তু নাজমাও জানেন কী করে আগ্রহী করতে হয়, বলেন, “সর্দার সাহেব, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনার সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার সময় হবে একটু? আপনার সময়ের মূল্য আমি দিবো সর্দার সাহেব”।
“সময়ের কি মূল্য হয় মা? সময়ের মূল্য হয় না। যা দেখা যায় না, তার কোনো মূল্যও নাই বুঝলেন?” মোসলেম সর্দার আবারও তার পুরোনো আহ্বানে ফিরে যান। “আমারে কিছু দিয়া যান মামণিরা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা”।
“মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিচ্ছেন কেন সর্দার সাহেব? আপনি কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?” নাজমা আক্তার একটু বিরক্ত নিয়েই প্রশ্নটা করেন। তিনি মিথ্যেকে প্রশ্রয় দিতে চান না বরাবরই।
“ক্যান মা, আমারে দেখলে মুক্তিযোদ্ধা মনে হয় না? মুক্তিযোদ্ধা কি আলাদা কইরা চিনা যায়? যায় না”।
মোসলেম সর্দারের এই কথায় নাজমা আক্তার একটু চমকান, তারপর বলেন, “ঠিক আছে সর্দার সাহেব, বলুন তাহলে, কালকে আমার ড্রাইভার আপনাকে এখান থেকে তুলে নিতে আসবে? আপনার সঙ্গে আমি ঘন্টা খানেক কথা বলবো, তার জন্য আপনাকে প্রতি ঘন্টায় আমি শ’দুয়েক যাহোক টাকা দেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমি যেসব প্রশ্ন করবো, তার উত্তর আপনাকে দিতে হবে সর্দার সাহেব”।
“মা, আপনি কি সাংবাদিক?”
“না, আমি সাংবাদিক নই। আমি একজন….নাজমা আক্তার কথা হাতড়ান এবং বলেন, “আমি আসলে ভিক্ষার ওপর আরো লেখাপড়া করতে চাই। তাই আপনাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, বুঝলেন?”
“না বুঝি নাই ভালো কইরা। আর বেশি বুঝবারও চাই না। তয়, কাইল আমি এহেনে থাকবো নানে, কুহানে থাকবো তাও কবার পারি না”- মোসলেম সর্দার নাজমা আক্তারকে এড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তিনিও কম জান না, “আপনার মোবাইল আছে? পাঞ্জাবীর পকেটেতো মনে হয় মোবাইল ফোন আছে। নাম্বারটা দেবেন? আপনি যেখানেই থাকেন সেখান থেকেই আমার ড্রাইভার গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে” - নাজমা আক্তার মরিয়া হয়ে ওঠেন মোসলেম সর্দারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ভাবেন শেষাবধি এতেও রাজি না হলে পুলিশের ভয় দেখাবেন, দরকার হলে তার স্বামীর সঙ্গে যে পুলিশটি সব সময় থাকে তাকে বলবেন মোসলেম সর্দারকে ধরে আনতে। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না, তার আগেই কোন্ অজানা ইতিহাস থেকে এসে নাজমা আক্তারের সামনে দাঁড়ালো এক নারী। সাধারণ বাঙালি মেয়ের তুলনায় বেশ লম্বা, একটা ফুলছাপ সূতি শাড়ি পরনে, অল্প কিছু চুল মাথার পেছনে কাঁকড়া দিয়ে আঁটকানো, তবে মাথাটা তার বেশ বড়, কিংবা অপুষ্ট শরীরে মাথাতো এমনিতেই বড় দেখায়। নাজমা আক্তারের দিকে তাকিয়ে সরাসরি সে নারী ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে আফা? উনারে কী জিগান?”
নাজমা আক্তার তাকালেন, প্রশ্নকারিনীর বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন, যেমনটি হয়, পারলেন না, ভাবলেন, “এদের বয়স আন্দাজ করা মুস্কিল, হয় সত্যিকারের বয়সের চেয়ে এদেরকে বড় দেখাবে, নয় ছোট দেখাবে”, তিনি নারীটিকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীতে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কে হন ওনার? আপনার নাম কি?”
নারী কোনো রকম জড়তা ছাড়াই বললেন, “উনি আমার জামাই। আমার নাম আমেনা”। প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই বোঝা যাচ্ছিলো যে, এই নারী বেশি কথায় আগ্রহী নন। যতোটুকু প্রশ্ন, ঠিক ততোটুকুই উত্তর, নাজমা আক্তারের ভালো লাগলো আমেনার এই তরিকা। তিনি স্মরণ করলেন প্রাগৈতিহাসিকের পাঁচীকে, এরকমই সটান কথায় ও কাজে বিশ্বাসী পাঁচী, একটি ঘা-ময় পা’কে সম্বল করে ভিক্ষেয় নেমেছিল, যে ঘা সে আর সারাতে চায় না, কারণ ওইটুকুই তার পুজি এই ব্যবসায়। নাজমা আক্তার আশ্চর্য হলেন ভেবে যে, মোসলেম সর্দারের মতো একজন ভিখুর সঙ্গে আমেনা নামের একজন পাঁচিও জুটে গেলো কী করে? তিনি একটু আপ্লুত হয়েই বললেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। ভিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। আপনার স্বামীর কাছ থেকে তাই সময় নিতে চেয়েছিলাম। আমি সেজন্য মূল্য দিতে রাজি আছি, একথা উনাকে বলেছি।”
ভালো করছেন, কিন্তু আমরা কিছু কবার চাই না। এই যে চলেন, আইজকা বাড়িত যাইগা - বলেই আমেনা মোসলেম সর্দারের হাত ধরে হাঁটার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু নাজমা আক্তারতো আর এতো সহজে প্রাগৈতিহাসিকের দু’দু’টি চরিত্রকে এভাবে হারাতে দিতে পারেন না, তিনিও একটু শক্তি যোগ করে বলেন, “দেখুন, আপনাদেরকে কিছু প্রশ্ন করবো কেবল, এর বেশি কিছু না। আপনার স্বামীকে আমি বলেছি যে, আমি সাংবাদিক নই। তাই আপনাদের কোনো গোপন কথা প্রকাশ হওয়ার ভয় নেই। আমি একটা গবেষণা করছি ভিক্ষুকদের নিয়ে, সে কারণেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলা। গবেষণা, গবেষণা মানে বুঝেছেন তো?” যার দিকে তাকিয়ে তিনি এই প্রশ্ন করেছেন সেই আমেনা তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নাজমা আক্তারের মনে একটু আশা জাগলো, হয়তো কাজ হতেও পারে। তিনি তাই এবার আমেনাকেই বললেন, “আমেনা, আপনারা দু’জনে যদি কয়েকদিন আমার সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে আপনাদের প্রতিদিন যা আয় হতো তার দ্বিগুণ টাকা আমি দেবো। কতো আয় হয় দিনে?” নাজমা আক্তার আন্দাজে একটা কথা বলে ফেলেছেন, এখন সেটা ফেরত নেওয়া যাবে না, তাই দিনে কতো টাকা আয় করে সেটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
আমেনা বললেন, “কতো আর? দিয়া-থুয়্যা আমাগো থাহে তিন চাইরশো টাহা। তার ডাবল আটশ, পারবেন দিতি?”
নাজমা আক্তারের সে সামর্থ আছে, তার কাছে টাকা পয়সা বেশ ভালোই থাকে, কিন্তু মেয়েটাতো মিথ্যে কথা বলছে, এতো টাকা কি রোজগার হয় ভিক্ষে করে? তারপরও তিনি ভাবলেন, তিনি দেবেন। বাজার খরচা থেকে বাঁচিয়েই তিনি একটি প্লটের বায়না করেছিলেন উত্তরায়, তাও অনেকদিন আগে, এখন সেখানে বাড়ি উঠছে ছ’তলা। বাড়ি অবশ্য তারা করছেন না, করছে ডেভলপার। নাজমা আক্তার বললেন, “অসুবিধে হবে না আমেনা, এবার বলেন, আপনাদেরকে পাবো কী করে? ঠিকনা বা ফোন নাম্বার কিছু আছে? আমার ড্রাইভার গিয়ে আপনাদের নিয়ে আসবে, বুঝলেন?”
“ঠিকানা আবার কি? মালিবাগ রেলক্রসিং থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের দিকে যাবার সময় রাস্তার বাম দিকির কুইড়ার সামনে গিয়া উনার নাম করলি পিরা পাত্থরডাও দেহাইয়া দিবেনে, তয় মুবাইলও আছে” - আমেনা তরতর করে বলে ফেলে এসব, মোসলেম সর্দার তখনও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি কূটির থেকে বেরুনো নারীদের কাছ থেকে ভিক্ষে চাইছেন। নাজমা আক্তারের ওদের দু’জনকেই ভিখু ও পাঁচীর মতোই প্রফেশনাল মনে হলো, আবারও। তিনি খুবই খুশী হলেন। ব্যাগ থেকে দু’টো একশ টাকার নোট বের করে আমেনার হাতে দিলেন। বললেন, “আগামিকাল সকাল নয়টায় আপনাদের আনতে পাঠাবো, আমার ড্রাইভারের নাম জাকির। ও আপনাকে ফোন করবে, ওকে আপনার নাম্বারটা দিন, এই জাকির, আমেনার নাম্বারটা তোমার মোবাইলে সেভ করে রাখো, কাল নয়টায় গিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসবে, বুঝলে?” নাজমা আক্তার একসঙ্গে দু’জনকেই নির্দেশ দিলেন, দু’টো কাজের। কর্তৃত্বময়ী হিসেবে নাজমা আক্তারের সুনাম আছে বেশ। কিন্তু ভয় লাগলো এটা ভেবে যে, যদি আমেনা ওর ঠিকানা ভুল দিয়ে থাকে? এদেরকেতো বিশ্বাস করা যায় না। কাজের মানুষ খোঁজার অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, এইখানের নাম বললে থাকবে ঠিক তার উল্টো কোনো দিকে, আজকে আসার কথা বললে তিনদিন পর এলেও আসতে পারে, না এলে নেই। মোবাইল নাম্বার দিলে সেটা বেশিরভাগ সময়ই কাজ করবে না, কাজ করলেও কোনো কর্কশ গলার পুরুষ ওদিক থেকে বলবে, “ক্যাডা আফনে? কারে চান?”, যখন সেই নামটি বলা হবে তখন সেই কর্কশ গলার পুরুষটি বলবে, “ওই মাগির খবর আমরা কি জানি? কার লগে ভাগছে ক্যাডা জানে?”, বেশিরভাগ সময়ই এরকম অশালীন কথাবার্তা শোনার পর নাজমা আক্তার ফোনটা নামিয়ে রাখেন কিন্তু দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই ওই নাম্বারটি থেকে মিস কল আসতে শুরু করে। একটি রিং হয়েই কেটে যায়। তারপর রিং ব্যাক করলে একটি মিহি নারী কন্ঠ হয়তো জিজ্ঞেস করে, “এইডা কোন্ জায়গা?” নাজমা আক্তার এরকম প্রশ্নের বহুবার সম্মুখীন হয়েছেন বলে, ইদানীং উত্তর দেন, “এটা মঙ্গল গ্রহ, আপনি কি বুধ চান? নাকি শুক্র?” প্রায় সময়ই নাজমা আক্তারকে অবাক করে দিয়ে মিহি নারী কন্ঠ বলে ওঠে, “ম্যাডাম, আমারে চিনছেন? আমি মইরম বা শাহিদা, আপনার বাসায় কাজ করার কথা ছিল”। নাজমা আক্তার তখন রেগে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলান, বলেন, “এতোদিন পর কী মনে করে মরিয়ম? তুমিতো বলেছিলে যে কাল আসবে, সেই কালতো আর এলো না, এখন কী চাও?” এরপর একথা-সেকথার পর মরিয়ম কিংবা মরিয়মের মতো কেউ সেই পুরোনো কথায় ফিরে যায়, প্রতিশ্রুতি দেয় আসার, সেদিন কিংবা তার পরের দিন, কেউ আসে কেউ আসে না। এভাবেই চালিয়ে নিয়েছেন নাজমা আক্তার, এখন অবশ্য মালি, কুক, গাড়িচালক ইত্যাদি প্রতিটি পদেই সরকারী লোকজন নিয়োগ করা রয়েছে আর এর বেশি লাগলে অফিস থেকে পাঠিয়ে দেন তার স্বামী; সে ক্ষমতা অবশ্য বহুদিন থেকেই নাজমা আক্তারের সরকারী কর্মকর্তা স্বামীর ছিল।
সংশয় নিয়েই আমেনাকে প্রশ্ন করেন নাজমা আক্তার, “সত্যিই আসবেন তো কাল? নাকি ফাঁকি দেবেন?” প্রশ্নের শেষে একটু হেসে ফেলেন তিনি। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরদাতা আমেনার মুখে হাসি নেই, বলেন, “আপনি টাহা না দিলিও আসতাম আফা। আপনেরে আমার বালো লাগছে। কি সুন্দর কইরা কথা হন, আমাগো তো কেউ আপনে কইরা কতা কয় না, তুই-তোকারি করে। আপনি আমাগো লগে আপনি আপনি কইরা কতা কইছেন, এইডার মূল্যু দিমু না? কী কন আপনে? আমরাতো মানুষ, নাকি?” একটু আগেই নাজমা আক্তারের মনে আসা শ্রেনীকরণে আমেনা নিজেই নিজেকে আলাদা করে ফেলে দেখে নাজমা আক্তারের ভালো লাগে খুউব। তিনি বলেন, “সে তো অবশ্যই। আমার কাছে ধনী-দরিদ্র কোনো ব্যাপার নয় বুঝলেন আমেনা, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি”। বলেই মনে হলো, কথাটা কতোটা বানানো আর কতোটা সত্যি? তিনি বেশিক্ষণ সময় নিলেন না ভাবতে, আবারও বললেন, “তাহলে ওই কথাই রইলো, দেখা হবে কালকে আপনাদের সঙ্গে। কিন্তু সর্দার সাহেব আবার বিগড়ে যাবেন নাতো?” এইবার আমেনা হেসে দিলেন একটু, খুব সামান্য সে হাসি, ঘন চুলে ফাঁক দিয়ে যেমন তালু দেখা যায় তেমনই সে হাসির রেখা, বোঝা যায় আবার বোঝা যায়ও না, বললেন, “এই অন্ধের আর যাওনের কুনো জায়গা নাই আফা। আমার কতা না হুনলে, পুলিশে ধরাইয়া দিমু, হে জেলরে খুব ডরায়, খুবই ডরায় বুঝলেন? কাইল জাকির বাইরে পাডায়া দিয়েন সকাল সকাল”।
আমেনার কথায় নাজমা আক্তার চমকে ওঠেন। তিনি প্রাগৈতিহাসিকের চেয়েও জটিল ও গভীর কোনো গল্পের সন্ধান পান সে কথায়। তিনি আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গাড়িতে ওঠার আগে আরো একবার জিজ্ঞেস করে নেন, ঠিক কোন্্ জায়গাটায় ওরা থাকে, জাকিরকে জিজ্ঞেস করেন, ও চিনতে পেরেছে কিনা জায়গাটা, এইসব। তারপর বাড়ি ফিরে তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। তাড়াতাড়ি একটা মোটাসোটা খাতা নিয়ে বসেন প্রশ্ন তৈরি করতে। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ওদের কথা লিখে রাখবেন নাকি রেকর্ড করবেন সেটা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, রেকর্ড করা দেখলে ওরা যদি কথা বলতে রাজি না হয়? কিংবা কথা বলতে আড়ষ্ট বোধ করে? তাহলে নাজমা আক্তার যা খুঁজছেন তাতো জানা হবে না? তিনি ফোন করেন সেই শিক্ষক ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক বলেন, “অবশ্যই টেপ করবেন ম্যাডাম। এবং প্রতিদিন টেপ করার আগে আপনার নিজের গলায় ওদের নাম, পরিচয়, তারিখ এবং স্থানের কথা টেপ করতে ভুলবেন না। প্রতিটি টেপের ওপর নাম লিখে রাখবেন, একটা আলাদা খাতায় টেপে কী কথা বলেছে সেটা সামান্য হলেও লেইখা রাখবেন, নাইলে টেপ অনেক সময় খারাপ হয়ে গেলেও আপনার অসুবিধে হবে না, বুঝলেন? টেপ রেকর্ডার আছে? না পাঠায়ে দিবো একটা?” নাজমা আক্তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নেন না একটুও, বলেন, “খুব ভালো হয় একটা পাঠিয়ে দিলে, কিছু টেপও দিয়ে দেবেন, আমি পয়সা দিয়ে দেবো আপনাকে এরপর যেদিন দেখা হবে”। ভদ্রলোক গদগদ হয়ে বলেন, “আরে কী যে বলেন ম্যাডাম, আপনার কাছ থেকে পয়সা নেবো? তাও একটা টেপ রেকর্ডার আর কিছু টেপের জন্য? কী বলেন এইসব আপনে? পাগল না মাথাখারাপ? হা হা হা। আপনি ড্রাইভার পাঠাবেন নাকি আমি কাউরে দিয়া পাঠাবো সেইটা কন”। নাজমা আক্তার ঝুঁকি নিতে চান না, তিনি জাকিরকেই পাঠিয়ে দেন ভদ্রলোকের বাড়িতে। সন্ধ্যের মধ্যেই নাজমা আক্তার সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যান প্রাগৈতিহাসিকের পরের ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কথা বলার জন্য। তিনি তার রুল করা খাতাটির ওপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখেন, “প্রাগৈতিহাসিক ২০১৬, মোসলেম সর্দার ও আমেনা-পর্ব”। লিখেই মনে হলো, এখনতো ২০১৫, তাহলে তিনি ২০১৬ লিখলেন কেন? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেও পেলেন না। তবে রাতে শুতে যাবার আগে নাজমা আক্তারের মনে হলো, ওদের বাড়ি যশোরের ওদিকে নয়তো? কথায়তো মনে হলো যশোরের টান আছে, তিনি নিজে অবশ্য উত্তরবঙ্গের, কিন্তু নাটক-ফাটক দেখে তিনি যশোর-খুলনার টানটা ভালোই বুঝতে পারেন। তিনি সে রাতে ঘুমুতে পারলেন না, উত্তেজনায়।
ভোর বেলা এই বিশাল বাড়িটা খুব অদ্ভূত লাগে নাজমা আক্তারের কাছে। এমনিতে পুরোনো বাড়ি, তারওপর এতো গাছগাছালি যে, পেছন দিকটায় একেবারেই আলো পড়ে না। পাশেই রমনা পার্ক, এমনিতেই এই এলাকাটা গাছগাছালিতে ছাওয়া। অন্ধকার কেটে কখন সকাল হয় ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে ঠাহর করা যায় না। অতো ভোরে উঠে তাই নিজেরই অস্বস্তি হতে থাকলো নাজমা আক্তারের, ঘড়ির দিকে বার বার তাকিয়ে শেষে জাকিরকে ডেকে পাঠালেন। খুব ভোরে ভোরে না পাঠালে যদি আবার ওরা ভিক্ষেয় বেরিয়ে যায়? মাধুকরীতে বেরুনোর উপযুক্ত সময় নাকি কাকভোর, কোথায় যেনো পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু আবার তার স্বামী অফিসে না বেরুনো অবধি জাকির যেনো ওদেরকে বাসায় না নিয়ে আসে, সেটাও পঁই পঁই করে জাকিরকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর দিনের শুরুর যেটুকু কাজ তাকে করতে হয় সেগুলো করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাজ করায় যে তার মন নেই সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন বেশ। সময়ের জন্য যতো অপেক্ষা করা যায় সময় যেনো ততোই পেছায়, এটা তিনি বহুবার প্রমাণ পেয়েছেন। আজ আবার পেলেন। একসময় নাজমা আক্তারের স্বামী অফিসে চলে গেলেন, ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে গেলো, বাড়িটা একেবারেই নীরব হয়ে গেলো, এমনিতে যতোটা নীরব থাকে তার চেয়েও। আর তখনই জাকির ওদেরকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। দু’জনকেই বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হলো কালকের চেয়ে, নাজমা আক্তার গাড়ি বারান্দায় এগিয়ে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে এলেন ভেতরে। বললেন, “নাশতাতো করা হয় নাই নিশ্চয়ই? নাশ্তা খেয়ে তারপর আমরা কথা বলবো, কেমন?”
নাজমা আক্তারের কথায় মোসলেম সর্দারের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই, কিন্তু আজকে আমেনার চেহারা যেনো আরো খোলতাই হয়েছে, একটু যেনো ঝলমলও করছে। আমেনা কি চোখে কাজল দিয়েছে? নাজমা আক্তার বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বাড়্রি কাজের মেয়েটাকে নাশতা দিতে বললেন ওদেরকে। নিজের জন্য টেবিলে শুধু এক কাপ চা পাঠাতে বললেন। একবার মনে হয়েছিল ওদেরকে নিয়ে টেবিলে বসে নিজেও নাশ্তা করে নেবেন, কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরে শ্রেনীচেতনাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, তিনি পারলেন না। মনে মনে ভাবলে, এটা বেশি হয়ে যাবে, কখনও যদি তার স্বামী ব্যাপারটা জানতে পারেন তাহলে তাকে আরো কথা শুনতে হতে পারে, বিষয়টা মোটেও সহজভাবে উনি নিতে পারবেন না, নাজমা আক্তার সেটা ভালো ভাবেই জানেন। নাশতা শেষ হলে ওরা যখন এসে তার সামনে দাঁড়ালো তখন নাজমা আক্তারের মনে হলো, এদের নিশ্চয়ই পরিচিত আরো ভিখিরি থেকে থাকবে, বস্তিতে পাশের ঘরের বা তার পাশের ঘরের মানুষগুলোর সঙ্গে যদি ওরাই পরিচয় করিয়ে দেয় তাকে তাহলে বেশ হবে, একবারে অনেকজনের সাক্ষাতকার তিনি নিয়ে নিতে পারবেন। চিন্তাটা মাথায় রাখলেন তিনি, ওদেরকে কিছুই জানালেন না। বাড়ির পেছন দিককার বারান্দায় যেখানে নাজমা আক্তার প্রায়ই বসে বসে বই পড়েন, যেখানে আর কেউ বড় বেশি আসে না, সেখানেই ওদেরকে নিয়ে গেলেন তিনি। তারপর শুরু করলেন। খুব সোজা সাপ্টা প্রশ্ন দিয়েই। সময় যতোই যেতে লাগলো, নাজমা আক্তার ততোই অবাক বিস্ময়ে ওদের জীবনের ভেতর ঢুকে যেতে লাগলেন। প্রাগৈতিহাসিক-এর ভিখু, পেহলাদ, বসির আর পাঁচির জীবনের গল্পের সঙ্গে এদের গল্পের মিল-অমিল খোঁজার বিষয়টি আর তার মনেই রইলো না।
দুই.
শুরু হলো নতুন গল্প। এই গল্প প্রাগৈতিহাসিক-এর পরের গল্প। নাজমা আক্তার তার খাতায় যেভাবে ওদের গল্প তুলেছেন, আমরা সেভাবেই শুনতে পারি, তাতে গল্পের রস বাড়বে বৈ কমবে না। তাছাড়া গল্প মুখ বদলালে গল্পের মৌলিক চরিত্রও বদলে যেতে পারে, তাই নাজমা আক্তারের বয়ানটিই এখানে তুলে ধরা যাক।
আমার সঙ্গে ওদের পরিচয়টা যেমন আকস্মিক ঠিক তার উল্টোটা ঘটলো ওদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সেটা ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগলো, বিশেষ করে আমেনার সঙ্গে। মহিলা অদ্ভূত, নিজের বয়স সম্পর্কে জানাশোনা নেই ওর, মিলিটারির বছর ওর মাকে যখন ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন ও সবকিছু বুঝতে পারে বলে আমাকে জানিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সালটা অনেকের কাছেই মিলিটারির বছর বা গ-গোলের বছর, আমার হাসব্যান্ড এই বছরকে উল্লেখ করেন লিবারেশন পিরিয়ড বলে। তার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আছে, তিনি যুদ্ধ করেছেন কিনা জানি না। কিছুদিন পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধে লেখালেখিও হয়েছিল যে, এই সার্টিফিকেট ভূয়া। আমার যদিও এসব জানার কথা নয়, সার্টিফিকেট ভূয়া কি আসল। তিনি অবশ্য বাড়িতে আমাদের সবাইকে ডেকে প্রমাণ দিয়েছিলেন নানা কাগজপত্র দেখিয়ে। ছেলেটা এসব নিয়ে আগ্রহী নয়, মেয়েটা আগ্রহী ছিল জানতে কারণ আমার মেয়ের বিয়ে যার সঙ্গে ঠিক হয়ে আছে, ওর নিজেরই পছন্দে সেই ছেলে নাকি জানতে চেয়েছে এইসব সংবাদ প্রকাশের পর। নিজের গল্প থাক, ওদের গল্প বলি।
প্রথমে মোসলেম সর্দারের কথা বলি। লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত এবং লাজলজ্জাহীন। মুখে তার কোনো লাগাম নাই, কিন্তু মাঝে মাঝে বেশ ফিলোসফিক্যাল কথা বলে। যেমন, আমার বাসায় প্রথমদিন এসেই বলেছিল, “আপনার মনে হয় করার মতোন কোনো কাম-কাইজ নাই, তাই না? আজাইরা মাইনষের মাতায় ম্যালা চিন্তা ঘুরপাক খায়, আপনারেও পাইছে আজাইরা কামে”। আমি মোসলেম সর্দারের কথার কোনো উত্তর দেই নাই, কারণ তার কথা পুরো সত্য না হলেও কিছুটা তো সত্য। যাহোক, আমি তার সঙ্গে কথা চালিয়ে গেছি। কিন্তু আমার কেন যেনো মনে হয়েছে, মোসলেম সর্দার কোনো কারণে নিজেকে শুধু আড়াল করতে চায়। মিথ্যেও বলে। আর ঠিক তখনই আমেনা ধমক দেয় মোসলেম সর্দারকে। ব্যাপারটা বেশ মজার, ধমক খেয়ে মোসলেম সর্দার তার বক্তব্য পুরোপুরি পাল্টায়ে ফেলে। যেমন, আমি জানতে চাইলাম, “সর্দার সাহেব, গ্রামের বাড়ি কই?” একগাল হেসে মোসলেম সর্দার বললো, “এইতো মৈনসিং”। ঠিক তখনই আমেনা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, “মিছা কতা কন ক্যান? না আফা উনার বাড়ি ফরিদপুর।” তখন আবার সর্দার মুখটা হাসি হাসি করে বলবে, “ওইতো ফরিদপুরও যা মৈনসিংও তাই, কানার আবার দিক-বিদ্বিক কি?” আমি লক্ষ্য করেছি, কথা বলার সময় মোসলেম সর্দারের চেহারায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আসে না, এটা কি তার চোখ নেই বলে? কথা বলার সময় মানুষ কি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে তার চোখ? আর চোখের কারণেই মানুষের চেহারার এক্সপ্রেশন বদলায়? আমেনার দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝেছি, ও চোখমুখভুরু সবকিছু দিয়ে কথা বলে, অথচ মোসলেম সর্দার কথা বলে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে, চেহারার আর কোনো কিছুই সে ব্যবহার করে না।
আমি যদি জানতে চাই “কি সর্দার মিথ্যা কথা বললেন কেন?” তখন সর্দার মুখটা অন্যদিকে ঘুরায়ে রাখবে, ইচ্ছা হলে উত্তর দেবে, নাইলে দেবে না। তারপরও তার কাছ থেকে যতোটুকু বের করা গেছে এবং আমেনার কাছ থেকে জানা গেছে, দু’জনের তথ্য মিলিয়ে মোসলেম সর্দারের গল্পটা এরকম:
মোসলেম সর্দারের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা থানায়। সত্তর কি আশির দশকেও এই থানা বা এর আশেপাশের অনেক থানার প্রান্তসীমায় থাকা গ্রামগুলি অত্যন্ত দুর্গম ছিল। তখনও এখানে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল অনেক। পুলিশ দেখলে লোকে ভয়ে অজ্ঞান হতো। আর মোসলেম সর্দার ঠিক এই সময়টাতেই ওইসব এলাকায় কুখ্যাত ডাকাত হিসেবে নাম করে। একথা মোসলেম স্বীকার করেনি, আমেনা বলেছে। ওর নিজস্ব কোনো দল ছিল না, কুটি ডাকাতের সঙ্গে ডাকাতি করতো কিন্তু ও এক সময় কুটি ডাকাতকে খুন করে আমেনাকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু ডাকাত দলের প্রধান হিসেবে মোসলেম ভালো ছিল না, আর কুটি ডাকাতকে খুন করার কারণে দলের বাকিরা ওকে একটুও ভালো নজরে দেখতো না। তাই ওই এলাকার নামকরা ধনী মীরের বাড়ি ডাকাতি করতে গেলে বাড়ির সবাইকে যখন লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় তখন পেছন থেকে দলের বাকিরা মোসলেম সর্দারকে একা রেখে পালায়। গ্রামবাসী ততোক্ষণে জেগে গেছে আর মোসলেম সর্দারকে ঘেরাও করে ফেলেছিল। পালানোর কোনো পথই আর ছিল না।
মোসলেম সর্দার ধরা পড়ে। প্রথমে তাকে এমন মার দেয় গ্রামের সবাই যে অন্য কেউ হলে ঠিক মরে যেতো। কিন্তু মোসলেম সর্দার বলে কথা। এতো মারের পরেও যখন মরছে না তখন তার চোখ দু’টি তুলে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। খেঁজুরের কাঁটা দিয়ে মোসলেম সর্দারের চোখগহ্বর থেকে দু’টি গোল গোল বলের মতো জিনিস বের করতে আনতে নাকি সময় নিয়েছিল মাত্র কয়েক মিনিট। মোসলেম সর্দারও খুব বেশি ব্যাথা পায় নাই তাতে, আসলে তখন শরীরে আর ব্যাথা বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
তিন চারদিন পর অন্ধ মোসলেম সর্দার যখন ওর গ্রামে ফিরলো তখন সবাই ওকে ডাকা শুরু করলো “কানা মোসলেম”, একসময়কার নামকরা ডাকাত, যার নাম শুনলে গর্ভপাত হওয়ার জোগাড় হতো পোয়াতি নারীর, বাচ্চারা বিছানা নষ্ট করতো ভয়ে সেই লোককে রাস্তায় লোকজন ইঁট ছুঁড়ে মারে, কেউ গোবর মাখিয়ে দেয়, কেউ বা মানুষের গু। কিন্তু মোসলেম সর্র্দারের ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীর কি হলো? তারা মোসলেম সর্দারকে আর পরিচয় দিতে চাইলো না। এটা মোসলেম সর্দারের ভাষ্য। আমেনা ছাড়াও মোসলেম সর্দারের স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। ডাকাতির বাইরে মোসলেম সর্দারের সাধারণ গ্রাম্য গৃৃহস্থ পরিচয়ও ছিল। কিন্তু চোখ তুলে ফেলার পর সেই পরিচয় আর থাকলো না। পরিচয় বেঁচে রইলো কেবল কানা মোসলেম হিসেবে।
এতোদিন তাহলে আমেনা কোথায় ছিল?
“আফা হে কতা আর কইয়েন না। হেই রাইতি যহন উনারে থুইয়া হোগ্গুলি ফিরা আইলো আমি যা বুজার বুজলাম। তারপর তিন/চাইরদিন দইরা ওরা আমার শইলডারে আফা শোরকি দিয়া কুবাইলো মনে করেন। আমার হুশ নাই, গিয়ান নাই, মনে অয় মইরা যাইতাছি। কিন্তু একদিন রাইতি ওরা গুমানোর পরে দিয়া নিজেরে তুইল্যা লইয়া নামলাম পানিতি। আফা সমুদ্দুরির নাহান বিল, চাইরদিক খালি পানি আর পানি। পাহাড়ের মতোন কচুরির জাঙ্গাল, দলঘাস, আরালি-দুরালির ঝাপ, আমার পাও আটকাইয়া যায়, পানির তলে টাইন্যা নিয়া যায়, আমি আবার হুশ্্ কইরা ভাইসা উডি। কতোক্ষুণ হাতরাইছি কবার পারবো নানে আফা, মনে হয় ভুর-বিয়ানে গিয়া গ্রামের ছাইচি ঠেকছি। শইলি কাপড়-চোপড়ের ঠিক নাই। কিন্তু বাইচা আছি এইডা বুঝছিলাম, তহনই ভাবছিলাম উনার খুঁজে আমার যাইতি অবে, নাইলে বাঁইচা থাহার দাম নাই। ওই বিয়ানের স্যার বিয়ানে কারো উডানে কাপড় ম্যালা নাই যে, চুরি কইরা পইরা ফালামু, খ্যাড়ের গাদার মদ্যি পলাইয়া ছিলাম, তারপর দুইফরের পরে যখন বউ-ঝিরা ঘাটের পাশেই কাপড় মেইলা বাড়ি গেলো তহন একখান কাপড় চুরি কইরা শইলি জড়াইয়া আবার আডা দিলাম। আফারে প্যাডের মইদ্যি খিদায় আমারে ছাট্্ মারে, মাইনষির বাড়ির শুষাডা, ড্যাড়সডা খাইলাম চুরি হইরা। তারপর গিয়া উডলাম উনাগো গ্রামে, হুনলাম সব কতা। উনাগো গ্রামে আমার ফুফু বাড়ি, এমুন ভাব দরলাম য্যান বেড়াবার আইছি। কিসির কি বেড়ানি আফা, আমি তলে তলে উনারে তালাশ করি। একদিন পাইলাম, রাস্তায় পোলাপাইন উনারে গিরা দরছে, মাথায় গু মাহাইয়া দেছে। আমি গিয়া আতখান দরলাম, উনি কুহাইয়া উইড্ডা কয়, আমেনারে আমারে নিয়া চল কুনোহানে, এইহানে থাকলি আমি বাঁচপান নানে। আমারও মনে ওইলো এই এ্যাকখান কাপড় আর শইলডা নিয়া আমিও এইহ্যানে থাকবার পারবান নানে বেশিদিন। তাই হেইদিন রাইতিই বাইর ওইলাম দুইজনে। সবডা মনে নাই আফা, কতোকাল আগের কতা। সারারাইত আডাইছে আমারে। কইছে বাইটকামারীর দিক যা। তারপর কইছে, বরইতলা যা। আমি কি জানি বরইতলা কই? মাইনষেরে জিগাইয়া জিগাইয়া গেছি, আর চোক্ষু দুইডা দিয়া রক্ত ঝরতেই আছে, ঝরতেই আছে। উনার কাছে টাহা-পয়সা আছিলো আফা। খুতির মদ্যি ম্যালা টাহা ছিল। আমার কাছে কিছু দিছিলো, আমি হেইগগুলান দিয়া নাও ভাড়া করছিলাম, আমারে কইছিলো পাঞ্জাবীর আতা ছিড়া তার চোখ বাইন্ধা দিতে। আমি দিছিলাম। তারপর মাঝিরে কইলো, গরুতি গুতা দিয়া চোখ নষ্ট কইরা ফালাইছে। ফরিদপুর নিয়া যাইতি অবে ডাক্তার দেহানোর লাইগ্গা। ডাক্তার দেহাইয়া হাসপাতালে থাকলাম দুই তিনদিন। আমারে কাপর-চোপর কিনার টাহা দিলো। কিনলাম। একদিন দুইজনে ঢাকার বাসে উডলাম আফা। আর যাই নাই কুনোদিন ওই দিকি। এই শহরডাই আমাগো দ্যাশ-বাড়ি আফা”।
আমেনার গল্প শেষ হওয়ার আগেই মোসলেম সর্দার বলে ওঠে, “অর এ্যাহন আর আমারে বালো লাগে না, বোজলেন? নতুন নাঙ ধরবার চায়। ও ভাবছে আমি বুড়া ওইয়া গেছি। আমিও কইছি, এক কোপ দিয়া দুই ভাগ কইরা ফালামু, মোসলেম সর্দার কানা অবার পারে খুনির নিশা মোসলেম সর্দারের এ্যাহনও যায় নাই, ওরে বুঝাইয়া দ্যান আপনে, আমি কিন্তু মিছা কথার মানুষ না”।
আমি মোসলেম সর্দারের কথা শুনে হাসি। ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন অনেক সহজ, অনেক স্বাভাবিক। ওরা আরো অনেক ভিক্ষুককে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। একেকজনের একেক রকম গল্প। কিন্তু আজকাল সকল ভিক্ষুকই কোনো না কোনো ভিক্ষা-কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত। দিনে যা আয় হয় তার অর্ধেক নিজে রেখে বাকিটা কোম্পানীকে দেয়। আর কোম্পানী ওদেরকে নিরাপত্তা দেয়। শুধু ঈদে-চান্দে ঢাকা শহরে ভিক্ষুকরা গ্রাম থেকে এসে জড়ো হয়, তাদেরকে ঢাকা শহরের স্থায়ী ভিক্ষুকরা দুই চোখে দেখতে পারে না, ওদের আয়ে টান পড়ে বলে খুনোখুনিও হয়ে যায় কখনও কখনও। কিন্তু আমেনা কি সত্যিই মোসলেম সর্দারকে ছেড়ে আর কারো দিকে নজর দিয়েছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করি আমি। বসিরকে ছেড়ে ভিখুর কাছে পাঁচী আসেনি, তাকে জোর করে নিয়ে এসেছিল ভিখু, বসিরকে খুন করে। কিন্তু আমেনাকে সেরকম মনে হয়নি আমার, তাই একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলি, “কি আমেনা, মোসলেম সর্দারকে সত্যিই আর ভালো লাগে না তোমার?”
“আরে আফা আপনেও পাগল হইলেন? ব্যাটা মানুষেরতো আর কুনো কাম নাই, খালি সন্দ করে। আমি মরি আমার জ্বালায়, মরণ রোগে দরছে আফা। এই যে দ্যাহেন” - বলে আমেনা ওর বুকের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে ব্লাউজের হুক খুলে ডানদিকের স্তনটা দেখায়। ফোঁড়া পেকে গেলে যেমন টকটকে লাল দেখায় তেমন লাগে আমার কাছে। আবার ব্লাউজের হুক লাগাতে লাগাতে আমেনা বলে, “ব্যাথায় মাঝে মাঝে মনে অয় নিজির গলা নিজি পোচাইয়া কাইডালাই। কিন্তুক ওই কানা ব্যাডার কতা মনে ওইলে হেইডাও পারি না। ডাক্তারে কইছে লক্ষণ বালা না। মরণ বেশিদিন দুরি নাই, বুহির মদ্যি ছড়াইয়া গেলেই মেত্যু। উনারে ধরবার দেই না, তাই ভাবে আমি আর তারে ভালো পাই না। এইডা ওইলো কারণ। কিন্তু একটা কাম ওইছে আফা” - বলতে বলতে আমেনা ওর স্বভাবের বাইরে এসে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। আমি ওর স্তনটা দেখে এমনিতেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, এখন ওর হাসি দেখে অবাক হতে পারি না যদিও, তারপরও ওর দিকে গভীর ভাবে তাকাই। আমেনা বলে, “এ্যাহনতো ভিক্ষায় বাইর ওই নাই। তাই এই বিলাউজ পইরা আইছি। আইজকাইল ভিক্ষায় বাইর হওনের আগে একটা এসপেশাল বিলাউজ পরি আফা, একডা বুক কাডা, আর বুকডার উপর তেতুল ছেইনা মাহাইয়া তারপর বাইর ওই। উনারে কুথাও দাঁড় করাইয়া দিয়া তারপর আমি যাই রাস্তায়, জ্যামে গাড়ি আটকাইয়া থাকলে জানালার সামনে দাঁড়াইয়া খালি কাপড়ডা সরাই। আফা বিশ্বাস করেন, কেউ ফিরায় না, হোগ্গুলি এইডা দেইহা পয়সা দেয়। শুধু মাজে মাজে দুই একজন পুরুষ মানুষ এই পচা বুকডার দিকিও এমুন ভাবে চাইয়া থাকে, কী কবো আফা; পুরুষ মাইনষের চউখতো আমরা কমবেশি সবাই চিনি, চিনি ন্যা, কন?”- আমেনা আবারও হাসতে হাসতে গলে পড়ে, যেটা আসলেই ওর স্বভাবের সঙ্গে একদম বেমানান।
কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হলো, পিএইচডি’র বিষয়টি নাজমা আক্তারের খুব পছন্দ হয়েছে। এমনিতেই মাণিক বন্দপাধ্যায়ের “প্রাগৈতিহাসিক” ওর খুব প্রিয় একটি গল্প, তার ওপর এই গল্পের চরিত্রদের এখনও ও রাস্তাঘাটে ঘুরতে ফিরতে দেখে, এখন তাদের ওপরই গবেষণা করতে পারবে ভেবে নাজমা আক্তার আনন্দিত হয়ে ওঠেন। নিজের জীবনে আনন্দিত হবার মতো ঘটনা নাজমা আক্তারের খুব বেশি নেই। দুই পুত্র-কন্যা এবং তাদের পিতার সঙ্গে নাজমা আক্তারের মানসিক দূরত্ব কতোটা বিশাল তা তিনি নিজেও মেপে উঠতে পারেন না ঠিক। কিন্তু এই দূরত্ব কিংবা এর চেয়েও বেশি দূরত্ব নিয়েই তো এদেশে মানুষ আজীবন সংসারধর্ম পালন করে থাকে। নাজমা আক্তারও তাদের একজন। তাই এরকম একটি পছন্দের কাজ পেয়ে নাজমা আক্তার আনন্দিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
ছেলেমেয়ে দু’জনেই স্কুল-কলেজ পেরিয়েছে, তাই বাচ্চা সামলানোর ঝামেলা নেই। উচ্চপদের কর্মকর্তা হিসেবে বিশাল বাড়ির সঙ্গে সংসারের প্রতিটি সেক্টরেই একজন করে লোক নিয়োগ করার ক্ষমতাও রাখেন নাজমা আক্তারের স্বামী। বাংলায় এমএ ডিগ্রী নিয়ে এতোদিন তিনি ঘরে বসেছিলেন কেবলমাত্র ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য, যে কারণে ওর স্বামী ওকে কোনো চাকরি নিতে দেননি। কিন্তু এখন যেহেতু সে ঝামেলা আর নেই সেহেতু নাজমা আক্তার পুরোদমে পিএইচডি করায় মনোযোগ দিলেন। উদ্যোমী শিক্ষকরা এগিয়ে এলেন নাজমা আক্তারকে সাহায্য করার জন্য কিন্তু বেশিরভাগেরই কোনো না কোনো তদ্বীর থাকে ওর স্বামীর কাছে। তারা বাড়ি অবধি এসে ওর সঙ্গে দেখা করে যান, কথা বলতে চান এবং কথার ফাঁকে নিজেদের কাজটুকুর জন্য তদ্বীর করে যান।
তারপরও নাজমা আক্তার কাজ শুরু করতে পারলেন। এরই মধ্যে একজন শিক্ষক তার তদ্বীর পেশের আগে তাকে পরামর্শ দিলেন, বিভিন্ন বয়সের এবং ভিন্ন ভিন্ন লিঙ্গের অন্ততঃ ত্রিশ-চল্লিশ জন ভিক্ষুকের সাক্ষাতকার গ্রহণ করার জন্য। বললেন, “শোনেন নাজমা, পিএইচডি এমন কঠিন কিছু না, কঠিন হইলো লেগে থাকা। তিন-চারটা বছর এই কয়টা শব্দের ওপর লেগে থাকার ধৈর্য সবার থাকে না, বুঝলেন? আপনি লেগে থাকতে পারলে এই ইন্টারভিউগুলা থেকেই বার হয়ে আসবে আপনার তথ্য-উপাত্ত্ব, তারপর আপনি খালি সেইগুলা সাজাইয়া-গুছাইয়া লেইখা ফেলবেন। আর আমরা আপনারে পিএচডি দিয়া দিব, বুঝলেন ম্যাডাম?” নাজমা আক্তার ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গি লক্ষ্য করছিলেন, প্রমিত এবং কথ্য দু’য়ের মিশ্রণে তিনি এমন এক ভাষা সৃষ্টি করেছেন যা নিশ্চয়ই ছাত্ররা খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারে। ভাষা ব্যবহারের এই পদ্ধতি নিশ্চয়ই খারাপ নয়, নাজমা আক্তার মনে মনে ভাবেন এবং সিদ্ধান্ত নেন কালকে থেকেই তিনি এই সাক্ষাতকার গ্রহণের কাজে নেমে পড়বেন। কিন্তু সাক্ষাতকারের প্রশ্নগুলো কেমন হবে? তিনি একটু কুন্ঠা নিয়েই প্রশ্নটা শিক্ষক ভদ্রলোককে করে ফেলেন। “আরে ম্যাডাম, প্রশ্ন খুউব সোজা, আপনি তার জীবন কাহিনী শুনতে চাইবেন। জন্ম কোথায়? ছোটবেলা কোথায় কাটছে? বাবা-মা কী করতো? তারপর এক লাফে আসবেন, ভিক্ষায় জুটলো কেমনে? এখনতো প্রত্যেক ভিখারিই কোনো না কোনো ভিক্ষুক-কোম্পানীর এমপ্লয়ী, প্রশ্ন করবেন, ডেইলি কতো বেতন পায়? এইসব আর কি। আপনি প্রশ্নগুলো লেইখা আপনার গাইডরে দিয়া এ্যাপ্রুভ করাইয়া নিবেন, তাইলেই হবে। বিদেশে হইলে আপনারে নানান এথিক-ফেথিকের ঝামেলায় পড়তে হইতো, আমরা সেইসবের ধার ধারি না। ভিক্ষুকদের সঙ্গে আবার কিসের এথিক দেখাইবেন কন? হা হা হা”। ভদ্রলোক হাসতে হাসতে নিজের কথায় ফিরে যান, তার মেয়েটি এবার বিসিএস দিতে যাচ্ছে, একটু যদি সহযোগিতা করেন নাজমা আক্তারের স্বামী, তাহলে খুবই উপকার হয়। ভদ্রলোককে কিংবা তার মেয়েকে সাধ্যমতো সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন নাজমা আক্তার।
ইদানীং প্রাগৈতিহাসিক গল্পটি নাজমা আক্তার পারলে দিনে কয়েকবার করে পড়েন। গল্পের মূল চরিত্র ভিখুর ভিক্ষাজীবন শুরুর আগ পর্যন্ত যে জীবন, তা নিয়ে ওর কোনোই আগ্রহ নেই এখন আর, কিন্তু ভিক্ষাজীবন শুরুর পরে তার চলাফেরা, কথা বলা, আচরণ এবং ভিখুর সঙ্গে সম্পর্কিত পাঁচি ও বসিরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নাজমা আক্তার ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেন। আর রাস্তায় বেরুলেই এই তিনজনের আদলে কাউকে পাওয়া যায় কিনা তা খেয়াল করেন। এরকম ভাবেই একদিন বেইলি রোডে তিনি মোসলেম সর্দারকে পেয়ে যান। ভিখুর একটি হাত অকেজো হয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার শরীর-স্বাস্থ্য ছিল অটুট, ভিখুর বয়স সম্পর্কে গল্পে খুব বেশি কিছু বলা নেই কিন্তু নাজমা ভাবতে ভালোবাসেন যে, ভিখুর বয়স হলেও পেটানো শরীরে চওড়া বুকের ছাতি আর মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া কাঁচা-পাকা চুল, মুখে দাঁড়ি থাকলেও থাকতে পারে, যেমন মোসলেম সর্দারের আছে। কিন্তু মোসলেম সর্দারের ভেতর সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় যা, তাহলো, ওর দু’চোখের গর্তে লাল দগদগে মাংস বেরিয়ে আছে, কেউ চোখের গোলক দু’টি তুলে নিয়ে গেছে, এটা বোঝা যায়। নাজমা আক্তার ধরেই নিয়েছিলেন যে, ডাকাতি কিংবা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় ক্ষুব্ধ মানুষ ওর চোখ দু’টি তুলে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সাধারণত, এরকমটাইতো হয়, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পেও এরকমটিই পড়েছিলেন বলে মনে করতে পারেন নাজমা আক্তার।
টাঙ্গাইল শাড়ি কূটির থেকে শাড়ি কিনে বেরুতেই মোসলেম সর্দারের সামনে পড়েছিলেন নাজমা আক্তার এবং চমকে উঠেছিলেন প্রাগৈতিহাসিকের ভিখুকে সামনে দেখে। ড্রাইভারের হাতে শাড়ির প্যাকেটগুলি দিয়ে নাজমা আক্তার মোসলেম সর্দারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “নাম কি আপনার? বাড়ি কোথায়?”
মোসলেম সর্দার চোখে না দেখলেও ঠিক টের পান কোন্ দিক থেকে আওয়াজ আসছে, কখনও কখনও ভুলও হয়, অন্য অন্ধদের ক্ষেত্রে যেমন হয়, কিন্তু মোসলেম সর্দার স্পষ্ট করে নিজের নাম বলেন, পরের প্রশ্ন বাড়ি কোথায়, সে উত্তর দেন না। নাজমা আক্তার আবারও জিজ্ঞেস করেন, “বাড়ি কোথায় বললেন না?”
“বাড়ি যে কুথায় ছিল সেইটাতো মা মনে নাই। এ্যাহন ঢাকা শহরই আমার বাড়ি-ঘর, স্থায়ী নিবাস”- মোসলেম আবারও গোটা গোটা করে বলেন।
“কোথায় থাকেন সর্দার সাহেব? পুরোনো ঢাকায়? ওইখানেতো অনেক সর্দার আছে বলে জানি, আপনি কি তাদের বংশধর?”
“না মা, আমি তাদের বংশধর না। আমি কারো বংশের কেউ না”- এটুকু বলেই মোসলেম সর্দার নতুন করে পথচারীদের আকর্ষণ করতে শুরু করেন যেমনটি এর আগে করছিলেন “কিছু সাহায্য করেন আপামণিরা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমারে কিছু সাহায্য করেন খালাম্মা, আমি দ্যাশ স্বাধীন করছি”। নাজমা আক্তার বুঝতে পারেন, মোসলেম সর্দারের এখন পিক টাইম, এখন তার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করায় মোটেও আগ্রহী নন তিনি। কিন্তু নাজমাও জানেন কী করে আগ্রহী করতে হয়, বলেন, “সর্দার সাহেব, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনার সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার সময় হবে একটু? আপনার সময়ের মূল্য আমি দিবো সর্দার সাহেব”।
“সময়ের কি মূল্য হয় মা? সময়ের মূল্য হয় না। যা দেখা যায় না, তার কোনো মূল্যও নাই বুঝলেন?” মোসলেম সর্দার আবারও তার পুরোনো আহ্বানে ফিরে যান। “আমারে কিছু দিয়া যান মামণিরা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা”।
“মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিচ্ছেন কেন সর্দার সাহেব? আপনি কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?” নাজমা আক্তার একটু বিরক্ত নিয়েই প্রশ্নটা করেন। তিনি মিথ্যেকে প্রশ্রয় দিতে চান না বরাবরই।
“ক্যান মা, আমারে দেখলে মুক্তিযোদ্ধা মনে হয় না? মুক্তিযোদ্ধা কি আলাদা কইরা চিনা যায়? যায় না”।
মোসলেম সর্দারের এই কথায় নাজমা আক্তার একটু চমকান, তারপর বলেন, “ঠিক আছে সর্দার সাহেব, বলুন তাহলে, কালকে আমার ড্রাইভার আপনাকে এখান থেকে তুলে নিতে আসবে? আপনার সঙ্গে আমি ঘন্টা খানেক কথা বলবো, তার জন্য আপনাকে প্রতি ঘন্টায় আমি শ’দুয়েক যাহোক টাকা দেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমি যেসব প্রশ্ন করবো, তার উত্তর আপনাকে দিতে হবে সর্দার সাহেব”।
“মা, আপনি কি সাংবাদিক?”
“না, আমি সাংবাদিক নই। আমি একজন….নাজমা আক্তার কথা হাতড়ান এবং বলেন, “আমি আসলে ভিক্ষার ওপর আরো লেখাপড়া করতে চাই। তাই আপনাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, বুঝলেন?”
“না বুঝি নাই ভালো কইরা। আর বেশি বুঝবারও চাই না। তয়, কাইল আমি এহেনে থাকবো নানে, কুহানে থাকবো তাও কবার পারি না”- মোসলেম সর্দার নাজমা আক্তারকে এড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তিনিও কম জান না, “আপনার মোবাইল আছে? পাঞ্জাবীর পকেটেতো মনে হয় মোবাইল ফোন আছে। নাম্বারটা দেবেন? আপনি যেখানেই থাকেন সেখান থেকেই আমার ড্রাইভার গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে” - নাজমা আক্তার মরিয়া হয়ে ওঠেন মোসলেম সর্দারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ভাবেন শেষাবধি এতেও রাজি না হলে পুলিশের ভয় দেখাবেন, দরকার হলে তার স্বামীর সঙ্গে যে পুলিশটি সব সময় থাকে তাকে বলবেন মোসলেম সর্দারকে ধরে আনতে। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না, তার আগেই কোন্ অজানা ইতিহাস থেকে এসে নাজমা আক্তারের সামনে দাঁড়ালো এক নারী। সাধারণ বাঙালি মেয়ের তুলনায় বেশ লম্বা, একটা ফুলছাপ সূতি শাড়ি পরনে, অল্প কিছু চুল মাথার পেছনে কাঁকড়া দিয়ে আঁটকানো, তবে মাথাটা তার বেশ বড়, কিংবা অপুষ্ট শরীরে মাথাতো এমনিতেই বড় দেখায়। নাজমা আক্তারের দিকে তাকিয়ে সরাসরি সে নারী ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে আফা? উনারে কী জিগান?”
নাজমা আক্তার তাকালেন, প্রশ্নকারিনীর বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন, যেমনটি হয়, পারলেন না, ভাবলেন, “এদের বয়স আন্দাজ করা মুস্কিল, হয় সত্যিকারের বয়সের চেয়ে এদেরকে বড় দেখাবে, নয় ছোট দেখাবে”, তিনি নারীটিকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীতে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কে হন ওনার? আপনার নাম কি?”
নারী কোনো রকম জড়তা ছাড়াই বললেন, “উনি আমার জামাই। আমার নাম আমেনা”। প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই বোঝা যাচ্ছিলো যে, এই নারী বেশি কথায় আগ্রহী নন। যতোটুকু প্রশ্ন, ঠিক ততোটুকুই উত্তর, নাজমা আক্তারের ভালো লাগলো আমেনার এই তরিকা। তিনি স্মরণ করলেন প্রাগৈতিহাসিকের পাঁচীকে, এরকমই সটান কথায় ও কাজে বিশ্বাসী পাঁচী, একটি ঘা-ময় পা’কে সম্বল করে ভিক্ষেয় নেমেছিল, যে ঘা সে আর সারাতে চায় না, কারণ ওইটুকুই তার পুজি এই ব্যবসায়। নাজমা আক্তার আশ্চর্য হলেন ভেবে যে, মোসলেম সর্দারের মতো একজন ভিখুর সঙ্গে আমেনা নামের একজন পাঁচিও জুটে গেলো কী করে? তিনি একটু আপ্লুত হয়েই বললেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। ভিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। আপনার স্বামীর কাছ থেকে তাই সময় নিতে চেয়েছিলাম। আমি সেজন্য মূল্য দিতে রাজি আছি, একথা উনাকে বলেছি।”
ভালো করছেন, কিন্তু আমরা কিছু কবার চাই না। এই যে চলেন, আইজকা বাড়িত যাইগা - বলেই আমেনা মোসলেম সর্দারের হাত ধরে হাঁটার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু নাজমা আক্তারতো আর এতো সহজে প্রাগৈতিহাসিকের দু’দু’টি চরিত্রকে এভাবে হারাতে দিতে পারেন না, তিনিও একটু শক্তি যোগ করে বলেন, “দেখুন, আপনাদেরকে কিছু প্রশ্ন করবো কেবল, এর বেশি কিছু না। আপনার স্বামীকে আমি বলেছি যে, আমি সাংবাদিক নই। তাই আপনাদের কোনো গোপন কথা প্রকাশ হওয়ার ভয় নেই। আমি একটা গবেষণা করছি ভিক্ষুকদের নিয়ে, সে কারণেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলা। গবেষণা, গবেষণা মানে বুঝেছেন তো?” যার দিকে তাকিয়ে তিনি এই প্রশ্ন করেছেন সেই আমেনা তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নাজমা আক্তারের মনে একটু আশা জাগলো, হয়তো কাজ হতেও পারে। তিনি তাই এবার আমেনাকেই বললেন, “আমেনা, আপনারা দু’জনে যদি কয়েকদিন আমার সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে আপনাদের প্রতিদিন যা আয় হতো তার দ্বিগুণ টাকা আমি দেবো। কতো আয় হয় দিনে?” নাজমা আক্তার আন্দাজে একটা কথা বলে ফেলেছেন, এখন সেটা ফেরত নেওয়া যাবে না, তাই দিনে কতো টাকা আয় করে সেটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
আমেনা বললেন, “কতো আর? দিয়া-থুয়্যা আমাগো থাহে তিন চাইরশো টাহা। তার ডাবল আটশ, পারবেন দিতি?”
নাজমা আক্তারের সে সামর্থ আছে, তার কাছে টাকা পয়সা বেশ ভালোই থাকে, কিন্তু মেয়েটাতো মিথ্যে কথা বলছে, এতো টাকা কি রোজগার হয় ভিক্ষে করে? তারপরও তিনি ভাবলেন, তিনি দেবেন। বাজার খরচা থেকে বাঁচিয়েই তিনি একটি প্লটের বায়না করেছিলেন উত্তরায়, তাও অনেকদিন আগে, এখন সেখানে বাড়ি উঠছে ছ’তলা। বাড়ি অবশ্য তারা করছেন না, করছে ডেভলপার। নাজমা আক্তার বললেন, “অসুবিধে হবে না আমেনা, এবার বলেন, আপনাদেরকে পাবো কী করে? ঠিকনা বা ফোন নাম্বার কিছু আছে? আমার ড্রাইভার গিয়ে আপনাদের নিয়ে আসবে, বুঝলেন?”
“ঠিকানা আবার কি? মালিবাগ রেলক্রসিং থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের দিকে যাবার সময় রাস্তার বাম দিকির কুইড়ার সামনে গিয়া উনার নাম করলি পিরা পাত্থরডাও দেহাইয়া দিবেনে, তয় মুবাইলও আছে” - আমেনা তরতর করে বলে ফেলে এসব, মোসলেম সর্দার তখনও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি কূটির থেকে বেরুনো নারীদের কাছ থেকে ভিক্ষে চাইছেন। নাজমা আক্তারের ওদের দু’জনকেই ভিখু ও পাঁচীর মতোই প্রফেশনাল মনে হলো, আবারও। তিনি খুবই খুশী হলেন। ব্যাগ থেকে দু’টো একশ টাকার নোট বের করে আমেনার হাতে দিলেন। বললেন, “আগামিকাল সকাল নয়টায় আপনাদের আনতে পাঠাবো, আমার ড্রাইভারের নাম জাকির। ও আপনাকে ফোন করবে, ওকে আপনার নাম্বারটা দিন, এই জাকির, আমেনার নাম্বারটা তোমার মোবাইলে সেভ করে রাখো, কাল নয়টায় গিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসবে, বুঝলে?” নাজমা আক্তার একসঙ্গে দু’জনকেই নির্দেশ দিলেন, দু’টো কাজের। কর্তৃত্বময়ী হিসেবে নাজমা আক্তারের সুনাম আছে বেশ। কিন্তু ভয় লাগলো এটা ভেবে যে, যদি আমেনা ওর ঠিকানা ভুল দিয়ে থাকে? এদেরকেতো বিশ্বাস করা যায় না। কাজের মানুষ খোঁজার অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, এইখানের নাম বললে থাকবে ঠিক তার উল্টো কোনো দিকে, আজকে আসার কথা বললে তিনদিন পর এলেও আসতে পারে, না এলে নেই। মোবাইল নাম্বার দিলে সেটা বেশিরভাগ সময়ই কাজ করবে না, কাজ করলেও কোনো কর্কশ গলার পুরুষ ওদিক থেকে বলবে, “ক্যাডা আফনে? কারে চান?”, যখন সেই নামটি বলা হবে তখন সেই কর্কশ গলার পুরুষটি বলবে, “ওই মাগির খবর আমরা কি জানি? কার লগে ভাগছে ক্যাডা জানে?”, বেশিরভাগ সময়ই এরকম অশালীন কথাবার্তা শোনার পর নাজমা আক্তার ফোনটা নামিয়ে রাখেন কিন্তু দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই ওই নাম্বারটি থেকে মিস কল আসতে শুরু করে। একটি রিং হয়েই কেটে যায়। তারপর রিং ব্যাক করলে একটি মিহি নারী কন্ঠ হয়তো জিজ্ঞেস করে, “এইডা কোন্ জায়গা?” নাজমা আক্তার এরকম প্রশ্নের বহুবার সম্মুখীন হয়েছেন বলে, ইদানীং উত্তর দেন, “এটা মঙ্গল গ্রহ, আপনি কি বুধ চান? নাকি শুক্র?” প্রায় সময়ই নাজমা আক্তারকে অবাক করে দিয়ে মিহি নারী কন্ঠ বলে ওঠে, “ম্যাডাম, আমারে চিনছেন? আমি মইরম বা শাহিদা, আপনার বাসায় কাজ করার কথা ছিল”। নাজমা আক্তার তখন রেগে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলান, বলেন, “এতোদিন পর কী মনে করে মরিয়ম? তুমিতো বলেছিলে যে কাল আসবে, সেই কালতো আর এলো না, এখন কী চাও?” এরপর একথা-সেকথার পর মরিয়ম কিংবা মরিয়মের মতো কেউ সেই পুরোনো কথায় ফিরে যায়, প্রতিশ্রুতি দেয় আসার, সেদিন কিংবা তার পরের দিন, কেউ আসে কেউ আসে না। এভাবেই চালিয়ে নিয়েছেন নাজমা আক্তার, এখন অবশ্য মালি, কুক, গাড়িচালক ইত্যাদি প্রতিটি পদেই সরকারী লোকজন নিয়োগ করা রয়েছে আর এর বেশি লাগলে অফিস থেকে পাঠিয়ে দেন তার স্বামী; সে ক্ষমতা অবশ্য বহুদিন থেকেই নাজমা আক্তারের সরকারী কর্মকর্তা স্বামীর ছিল।
সংশয় নিয়েই আমেনাকে প্রশ্ন করেন নাজমা আক্তার, “সত্যিই আসবেন তো কাল? নাকি ফাঁকি দেবেন?” প্রশ্নের শেষে একটু হেসে ফেলেন তিনি। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরদাতা আমেনার মুখে হাসি নেই, বলেন, “আপনি টাহা না দিলিও আসতাম আফা। আপনেরে আমার বালো লাগছে। কি সুন্দর কইরা কথা হন, আমাগো তো কেউ আপনে কইরা কতা কয় না, তুই-তোকারি করে। আপনি আমাগো লগে আপনি আপনি কইরা কতা কইছেন, এইডার মূল্যু দিমু না? কী কন আপনে? আমরাতো মানুষ, নাকি?” একটু আগেই নাজমা আক্তারের মনে আসা শ্রেনীকরণে আমেনা নিজেই নিজেকে আলাদা করে ফেলে দেখে নাজমা আক্তারের ভালো লাগে খুউব। তিনি বলেন, “সে তো অবশ্যই। আমার কাছে ধনী-দরিদ্র কোনো ব্যাপার নয় বুঝলেন আমেনা, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি”। বলেই মনে হলো, কথাটা কতোটা বানানো আর কতোটা সত্যি? তিনি বেশিক্ষণ সময় নিলেন না ভাবতে, আবারও বললেন, “তাহলে ওই কথাই রইলো, দেখা হবে কালকে আপনাদের সঙ্গে। কিন্তু সর্দার সাহেব আবার বিগড়ে যাবেন নাতো?” এইবার আমেনা হেসে দিলেন একটু, খুব সামান্য সে হাসি, ঘন চুলে ফাঁক দিয়ে যেমন তালু দেখা যায় তেমনই সে হাসির রেখা, বোঝা যায় আবার বোঝা যায়ও না, বললেন, “এই অন্ধের আর যাওনের কুনো জায়গা নাই আফা। আমার কতা না হুনলে, পুলিশে ধরাইয়া দিমু, হে জেলরে খুব ডরায়, খুবই ডরায় বুঝলেন? কাইল জাকির বাইরে পাডায়া দিয়েন সকাল সকাল”।
আমেনার কথায় নাজমা আক্তার চমকে ওঠেন। তিনি প্রাগৈতিহাসিকের চেয়েও জটিল ও গভীর কোনো গল্পের সন্ধান পান সে কথায়। তিনি আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গাড়িতে ওঠার আগে আরো একবার জিজ্ঞেস করে নেন, ঠিক কোন্্ জায়গাটায় ওরা থাকে, জাকিরকে জিজ্ঞেস করেন, ও চিনতে পেরেছে কিনা জায়গাটা, এইসব। তারপর বাড়ি ফিরে তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। তাড়াতাড়ি একটা মোটাসোটা খাতা নিয়ে বসেন প্রশ্ন তৈরি করতে। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ওদের কথা লিখে রাখবেন নাকি রেকর্ড করবেন সেটা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, রেকর্ড করা দেখলে ওরা যদি কথা বলতে রাজি না হয়? কিংবা কথা বলতে আড়ষ্ট বোধ করে? তাহলে নাজমা আক্তার যা খুঁজছেন তাতো জানা হবে না? তিনি ফোন করেন সেই শিক্ষক ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক বলেন, “অবশ্যই টেপ করবেন ম্যাডাম। এবং প্রতিদিন টেপ করার আগে আপনার নিজের গলায় ওদের নাম, পরিচয়, তারিখ এবং স্থানের কথা টেপ করতে ভুলবেন না। প্রতিটি টেপের ওপর নাম লিখে রাখবেন, একটা আলাদা খাতায় টেপে কী কথা বলেছে সেটা সামান্য হলেও লেইখা রাখবেন, নাইলে টেপ অনেক সময় খারাপ হয়ে গেলেও আপনার অসুবিধে হবে না, বুঝলেন? টেপ রেকর্ডার আছে? না পাঠায়ে দিবো একটা?” নাজমা আক্তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নেন না একটুও, বলেন, “খুব ভালো হয় একটা পাঠিয়ে দিলে, কিছু টেপও দিয়ে দেবেন, আমি পয়সা দিয়ে দেবো আপনাকে এরপর যেদিন দেখা হবে”। ভদ্রলোক গদগদ হয়ে বলেন, “আরে কী যে বলেন ম্যাডাম, আপনার কাছ থেকে পয়সা নেবো? তাও একটা টেপ রেকর্ডার আর কিছু টেপের জন্য? কী বলেন এইসব আপনে? পাগল না মাথাখারাপ? হা হা হা। আপনি ড্রাইভার পাঠাবেন নাকি আমি কাউরে দিয়া পাঠাবো সেইটা কন”। নাজমা আক্তার ঝুঁকি নিতে চান না, তিনি জাকিরকেই পাঠিয়ে দেন ভদ্রলোকের বাড়িতে। সন্ধ্যের মধ্যেই নাজমা আক্তার সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যান প্রাগৈতিহাসিকের পরের ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কথা বলার জন্য। তিনি তার রুল করা খাতাটির ওপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখেন, “প্রাগৈতিহাসিক ২০১৬, মোসলেম সর্দার ও আমেনা-পর্ব”। লিখেই মনে হলো, এখনতো ২০১৫, তাহলে তিনি ২০১৬ লিখলেন কেন? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেও পেলেন না। তবে রাতে শুতে যাবার আগে নাজমা আক্তারের মনে হলো, ওদের বাড়ি যশোরের ওদিকে নয়তো? কথায়তো মনে হলো যশোরের টান আছে, তিনি নিজে অবশ্য উত্তরবঙ্গের, কিন্তু নাটক-ফাটক দেখে তিনি যশোর-খুলনার টানটা ভালোই বুঝতে পারেন। তিনি সে রাতে ঘুমুতে পারলেন না, উত্তেজনায়।
ভোর বেলা এই বিশাল বাড়িটা খুব অদ্ভূত লাগে নাজমা আক্তারের কাছে। এমনিতে পুরোনো বাড়ি, তারওপর এতো গাছগাছালি যে, পেছন দিকটায় একেবারেই আলো পড়ে না। পাশেই রমনা পার্ক, এমনিতেই এই এলাকাটা গাছগাছালিতে ছাওয়া। অন্ধকার কেটে কখন সকাল হয় ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে ঠাহর করা যায় না। অতো ভোরে উঠে তাই নিজেরই অস্বস্তি হতে থাকলো নাজমা আক্তারের, ঘড়ির দিকে বার বার তাকিয়ে শেষে জাকিরকে ডেকে পাঠালেন। খুব ভোরে ভোরে না পাঠালে যদি আবার ওরা ভিক্ষেয় বেরিয়ে যায়? মাধুকরীতে বেরুনোর উপযুক্ত সময় নাকি কাকভোর, কোথায় যেনো পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু আবার তার স্বামী অফিসে না বেরুনো অবধি জাকির যেনো ওদেরকে বাসায় না নিয়ে আসে, সেটাও পঁই পঁই করে জাকিরকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর দিনের শুরুর যেটুকু কাজ তাকে করতে হয় সেগুলো করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাজ করায় যে তার মন নেই সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন বেশ। সময়ের জন্য যতো অপেক্ষা করা যায় সময় যেনো ততোই পেছায়, এটা তিনি বহুবার প্রমাণ পেয়েছেন। আজ আবার পেলেন। একসময় নাজমা আক্তারের স্বামী অফিসে চলে গেলেন, ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে গেলো, বাড়িটা একেবারেই নীরব হয়ে গেলো, এমনিতে যতোটা নীরব থাকে তার চেয়েও। আর তখনই জাকির ওদেরকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। দু’জনকেই বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হলো কালকের চেয়ে, নাজমা আক্তার গাড়ি বারান্দায় এগিয়ে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে এলেন ভেতরে। বললেন, “নাশতাতো করা হয় নাই নিশ্চয়ই? নাশ্তা খেয়ে তারপর আমরা কথা বলবো, কেমন?”
নাজমা আক্তারের কথায় মোসলেম সর্দারের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই, কিন্তু আজকে আমেনার চেহারা যেনো আরো খোলতাই হয়েছে, একটু যেনো ঝলমলও করছে। আমেনা কি চোখে কাজল দিয়েছে? নাজমা আক্তার বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বাড়্রি কাজের মেয়েটাকে নাশতা দিতে বললেন ওদেরকে। নিজের জন্য টেবিলে শুধু এক কাপ চা পাঠাতে বললেন। একবার মনে হয়েছিল ওদেরকে নিয়ে টেবিলে বসে নিজেও নাশ্তা করে নেবেন, কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরে শ্রেনীচেতনাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, তিনি পারলেন না। মনে মনে ভাবলে, এটা বেশি হয়ে যাবে, কখনও যদি তার স্বামী ব্যাপারটা জানতে পারেন তাহলে তাকে আরো কথা শুনতে হতে পারে, বিষয়টা মোটেও সহজভাবে উনি নিতে পারবেন না, নাজমা আক্তার সেটা ভালো ভাবেই জানেন। নাশতা শেষ হলে ওরা যখন এসে তার সামনে দাঁড়ালো তখন নাজমা আক্তারের মনে হলো, এদের নিশ্চয়ই পরিচিত আরো ভিখিরি থেকে থাকবে, বস্তিতে পাশের ঘরের বা তার পাশের ঘরের মানুষগুলোর সঙ্গে যদি ওরাই পরিচয় করিয়ে দেয় তাকে তাহলে বেশ হবে, একবারে অনেকজনের সাক্ষাতকার তিনি নিয়ে নিতে পারবেন। চিন্তাটা মাথায় রাখলেন তিনি, ওদেরকে কিছুই জানালেন না। বাড়ির পেছন দিককার বারান্দায় যেখানে নাজমা আক্তার প্রায়ই বসে বসে বই পড়েন, যেখানে আর কেউ বড় বেশি আসে না, সেখানেই ওদেরকে নিয়ে গেলেন তিনি। তারপর শুরু করলেন। খুব সোজা সাপ্টা প্রশ্ন দিয়েই। সময় যতোই যেতে লাগলো, নাজমা আক্তার ততোই অবাক বিস্ময়ে ওদের জীবনের ভেতর ঢুকে যেতে লাগলেন। প্রাগৈতিহাসিক-এর ভিখু, পেহলাদ, বসির আর পাঁচির জীবনের গল্পের সঙ্গে এদের গল্পের মিল-অমিল খোঁজার বিষয়টি আর তার মনেই রইলো না।
দুই.
শুরু হলো নতুন গল্প। এই গল্প প্রাগৈতিহাসিক-এর পরের গল্প। নাজমা আক্তার তার খাতায় যেভাবে ওদের গল্প তুলেছেন, আমরা সেভাবেই শুনতে পারি, তাতে গল্পের রস বাড়বে বৈ কমবে না। তাছাড়া গল্প মুখ বদলালে গল্পের মৌলিক চরিত্রও বদলে যেতে পারে, তাই নাজমা আক্তারের বয়ানটিই এখানে তুলে ধরা যাক।
আমার সঙ্গে ওদের পরিচয়টা যেমন আকস্মিক ঠিক তার উল্টোটা ঘটলো ওদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সেটা ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগলো, বিশেষ করে আমেনার সঙ্গে। মহিলা অদ্ভূত, নিজের বয়স সম্পর্কে জানাশোনা নেই ওর, মিলিটারির বছর ওর মাকে যখন ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন ও সবকিছু বুঝতে পারে বলে আমাকে জানিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সালটা অনেকের কাছেই মিলিটারির বছর বা গ-গোলের বছর, আমার হাসব্যান্ড এই বছরকে উল্লেখ করেন লিবারেশন পিরিয়ড বলে। তার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আছে, তিনি যুদ্ধ করেছেন কিনা জানি না। কিছুদিন পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধে লেখালেখিও হয়েছিল যে, এই সার্টিফিকেট ভূয়া। আমার যদিও এসব জানার কথা নয়, সার্টিফিকেট ভূয়া কি আসল। তিনি অবশ্য বাড়িতে আমাদের সবাইকে ডেকে প্রমাণ দিয়েছিলেন নানা কাগজপত্র দেখিয়ে। ছেলেটা এসব নিয়ে আগ্রহী নয়, মেয়েটা আগ্রহী ছিল জানতে কারণ আমার মেয়ের বিয়ে যার সঙ্গে ঠিক হয়ে আছে, ওর নিজেরই পছন্দে সেই ছেলে নাকি জানতে চেয়েছে এইসব সংবাদ প্রকাশের পর। নিজের গল্প থাক, ওদের গল্প বলি।
প্রথমে মোসলেম সর্দারের কথা বলি। লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত এবং লাজলজ্জাহীন। মুখে তার কোনো লাগাম নাই, কিন্তু মাঝে মাঝে বেশ ফিলোসফিক্যাল কথা বলে। যেমন, আমার বাসায় প্রথমদিন এসেই বলেছিল, “আপনার মনে হয় করার মতোন কোনো কাম-কাইজ নাই, তাই না? আজাইরা মাইনষের মাতায় ম্যালা চিন্তা ঘুরপাক খায়, আপনারেও পাইছে আজাইরা কামে”। আমি মোসলেম সর্দারের কথার কোনো উত্তর দেই নাই, কারণ তার কথা পুরো সত্য না হলেও কিছুটা তো সত্য। যাহোক, আমি তার সঙ্গে কথা চালিয়ে গেছি। কিন্তু আমার কেন যেনো মনে হয়েছে, মোসলেম সর্দার কোনো কারণে নিজেকে শুধু আড়াল করতে চায়। মিথ্যেও বলে। আর ঠিক তখনই আমেনা ধমক দেয় মোসলেম সর্দারকে। ব্যাপারটা বেশ মজার, ধমক খেয়ে মোসলেম সর্দার তার বক্তব্য পুরোপুরি পাল্টায়ে ফেলে। যেমন, আমি জানতে চাইলাম, “সর্দার সাহেব, গ্রামের বাড়ি কই?” একগাল হেসে মোসলেম সর্দার বললো, “এইতো মৈনসিং”। ঠিক তখনই আমেনা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, “মিছা কতা কন ক্যান? না আফা উনার বাড়ি ফরিদপুর।” তখন আবার সর্দার মুখটা হাসি হাসি করে বলবে, “ওইতো ফরিদপুরও যা মৈনসিংও তাই, কানার আবার দিক-বিদ্বিক কি?” আমি লক্ষ্য করেছি, কথা বলার সময় মোসলেম সর্দারের চেহারায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আসে না, এটা কি তার চোখ নেই বলে? কথা বলার সময় মানুষ কি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে তার চোখ? আর চোখের কারণেই মানুষের চেহারার এক্সপ্রেশন বদলায়? আমেনার দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝেছি, ও চোখমুখভুরু সবকিছু দিয়ে কথা বলে, অথচ মোসলেম সর্দার কথা বলে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে, চেহারার আর কোনো কিছুই সে ব্যবহার করে না।
আমি যদি জানতে চাই “কি সর্দার মিথ্যা কথা বললেন কেন?” তখন সর্দার মুখটা অন্যদিকে ঘুরায়ে রাখবে, ইচ্ছা হলে উত্তর দেবে, নাইলে দেবে না। তারপরও তার কাছ থেকে যতোটুকু বের করা গেছে এবং আমেনার কাছ থেকে জানা গেছে, দু’জনের তথ্য মিলিয়ে মোসলেম সর্দারের গল্পটা এরকম:
মোসলেম সর্দারের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা থানায়। সত্তর কি আশির দশকেও এই থানা বা এর আশেপাশের অনেক থানার প্রান্তসীমায় থাকা গ্রামগুলি অত্যন্ত দুর্গম ছিল। তখনও এখানে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল অনেক। পুলিশ দেখলে লোকে ভয়ে অজ্ঞান হতো। আর মোসলেম সর্দার ঠিক এই সময়টাতেই ওইসব এলাকায় কুখ্যাত ডাকাত হিসেবে নাম করে। একথা মোসলেম স্বীকার করেনি, আমেনা বলেছে। ওর নিজস্ব কোনো দল ছিল না, কুটি ডাকাতের সঙ্গে ডাকাতি করতো কিন্তু ও এক সময় কুটি ডাকাতকে খুন করে আমেনাকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু ডাকাত দলের প্রধান হিসেবে মোসলেম ভালো ছিল না, আর কুটি ডাকাতকে খুন করার কারণে দলের বাকিরা ওকে একটুও ভালো নজরে দেখতো না। তাই ওই এলাকার নামকরা ধনী মীরের বাড়ি ডাকাতি করতে গেলে বাড়ির সবাইকে যখন লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় তখন পেছন থেকে দলের বাকিরা মোসলেম সর্দারকে একা রেখে পালায়। গ্রামবাসী ততোক্ষণে জেগে গেছে আর মোসলেম সর্দারকে ঘেরাও করে ফেলেছিল। পালানোর কোনো পথই আর ছিল না।
মোসলেম সর্দার ধরা পড়ে। প্রথমে তাকে এমন মার দেয় গ্রামের সবাই যে অন্য কেউ হলে ঠিক মরে যেতো। কিন্তু মোসলেম সর্দার বলে কথা। এতো মারের পরেও যখন মরছে না তখন তার চোখ দু’টি তুলে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। খেঁজুরের কাঁটা দিয়ে মোসলেম সর্দারের চোখগহ্বর থেকে দু’টি গোল গোল বলের মতো জিনিস বের করতে আনতে নাকি সময় নিয়েছিল মাত্র কয়েক মিনিট। মোসলেম সর্দারও খুব বেশি ব্যাথা পায় নাই তাতে, আসলে তখন শরীরে আর ব্যাথা বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
তিন চারদিন পর অন্ধ মোসলেম সর্দার যখন ওর গ্রামে ফিরলো তখন সবাই ওকে ডাকা শুরু করলো “কানা মোসলেম”, একসময়কার নামকরা ডাকাত, যার নাম শুনলে গর্ভপাত হওয়ার জোগাড় হতো পোয়াতি নারীর, বাচ্চারা বিছানা নষ্ট করতো ভয়ে সেই লোককে রাস্তায় লোকজন ইঁট ছুঁড়ে মারে, কেউ গোবর মাখিয়ে দেয়, কেউ বা মানুষের গু। কিন্তু মোসলেম সর্র্দারের ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীর কি হলো? তারা মোসলেম সর্দারকে আর পরিচয় দিতে চাইলো না। এটা মোসলেম সর্দারের ভাষ্য। আমেনা ছাড়াও মোসলেম সর্দারের স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। ডাকাতির বাইরে মোসলেম সর্দারের সাধারণ গ্রাম্য গৃৃহস্থ পরিচয়ও ছিল। কিন্তু চোখ তুলে ফেলার পর সেই পরিচয় আর থাকলো না। পরিচয় বেঁচে রইলো কেবল কানা মোসলেম হিসেবে।
এতোদিন তাহলে আমেনা কোথায় ছিল?
“আফা হে কতা আর কইয়েন না। হেই রাইতি যহন উনারে থুইয়া হোগ্গুলি ফিরা আইলো আমি যা বুজার বুজলাম। তারপর তিন/চাইরদিন দইরা ওরা আমার শইলডারে আফা শোরকি দিয়া কুবাইলো মনে করেন। আমার হুশ নাই, গিয়ান নাই, মনে অয় মইরা যাইতাছি। কিন্তু একদিন রাইতি ওরা গুমানোর পরে দিয়া নিজেরে তুইল্যা লইয়া নামলাম পানিতি। আফা সমুদ্দুরির নাহান বিল, চাইরদিক খালি পানি আর পানি। পাহাড়ের মতোন কচুরির জাঙ্গাল, দলঘাস, আরালি-দুরালির ঝাপ, আমার পাও আটকাইয়া যায়, পানির তলে টাইন্যা নিয়া যায়, আমি আবার হুশ্্ কইরা ভাইসা উডি। কতোক্ষুণ হাতরাইছি কবার পারবো নানে আফা, মনে হয় ভুর-বিয়ানে গিয়া গ্রামের ছাইচি ঠেকছি। শইলি কাপড়-চোপড়ের ঠিক নাই। কিন্তু বাইচা আছি এইডা বুঝছিলাম, তহনই ভাবছিলাম উনার খুঁজে আমার যাইতি অবে, নাইলে বাঁইচা থাহার দাম নাই। ওই বিয়ানের স্যার বিয়ানে কারো উডানে কাপড় ম্যালা নাই যে, চুরি কইরা পইরা ফালামু, খ্যাড়ের গাদার মদ্যি পলাইয়া ছিলাম, তারপর দুইফরের পরে যখন বউ-ঝিরা ঘাটের পাশেই কাপড় মেইলা বাড়ি গেলো তহন একখান কাপড় চুরি কইরা শইলি জড়াইয়া আবার আডা দিলাম। আফারে প্যাডের মইদ্যি খিদায় আমারে ছাট্্ মারে, মাইনষির বাড়ির শুষাডা, ড্যাড়সডা খাইলাম চুরি হইরা। তারপর গিয়া উডলাম উনাগো গ্রামে, হুনলাম সব কতা। উনাগো গ্রামে আমার ফুফু বাড়ি, এমুন ভাব দরলাম য্যান বেড়াবার আইছি। কিসির কি বেড়ানি আফা, আমি তলে তলে উনারে তালাশ করি। একদিন পাইলাম, রাস্তায় পোলাপাইন উনারে গিরা দরছে, মাথায় গু মাহাইয়া দেছে। আমি গিয়া আতখান দরলাম, উনি কুহাইয়া উইড্ডা কয়, আমেনারে আমারে নিয়া চল কুনোহানে, এইহানে থাকলি আমি বাঁচপান নানে। আমারও মনে ওইলো এই এ্যাকখান কাপড় আর শইলডা নিয়া আমিও এইহ্যানে থাকবার পারবান নানে বেশিদিন। তাই হেইদিন রাইতিই বাইর ওইলাম দুইজনে। সবডা মনে নাই আফা, কতোকাল আগের কতা। সারারাইত আডাইছে আমারে। কইছে বাইটকামারীর দিক যা। তারপর কইছে, বরইতলা যা। আমি কি জানি বরইতলা কই? মাইনষেরে জিগাইয়া জিগাইয়া গেছি, আর চোক্ষু দুইডা দিয়া রক্ত ঝরতেই আছে, ঝরতেই আছে। উনার কাছে টাহা-পয়সা আছিলো আফা। খুতির মদ্যি ম্যালা টাহা ছিল। আমার কাছে কিছু দিছিলো, আমি হেইগগুলান দিয়া নাও ভাড়া করছিলাম, আমারে কইছিলো পাঞ্জাবীর আতা ছিড়া তার চোখ বাইন্ধা দিতে। আমি দিছিলাম। তারপর মাঝিরে কইলো, গরুতি গুতা দিয়া চোখ নষ্ট কইরা ফালাইছে। ফরিদপুর নিয়া যাইতি অবে ডাক্তার দেহানোর লাইগ্গা। ডাক্তার দেহাইয়া হাসপাতালে থাকলাম দুই তিনদিন। আমারে কাপর-চোপর কিনার টাহা দিলো। কিনলাম। একদিন দুইজনে ঢাকার বাসে উডলাম আফা। আর যাই নাই কুনোদিন ওই দিকি। এই শহরডাই আমাগো দ্যাশ-বাড়ি আফা”।
আমেনার গল্প শেষ হওয়ার আগেই মোসলেম সর্দার বলে ওঠে, “অর এ্যাহন আর আমারে বালো লাগে না, বোজলেন? নতুন নাঙ ধরবার চায়। ও ভাবছে আমি বুড়া ওইয়া গেছি। আমিও কইছি, এক কোপ দিয়া দুই ভাগ কইরা ফালামু, মোসলেম সর্দার কানা অবার পারে খুনির নিশা মোসলেম সর্দারের এ্যাহনও যায় নাই, ওরে বুঝাইয়া দ্যান আপনে, আমি কিন্তু মিছা কথার মানুষ না”।
আমি মোসলেম সর্দারের কথা শুনে হাসি। ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন অনেক সহজ, অনেক স্বাভাবিক। ওরা আরো অনেক ভিক্ষুককে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। একেকজনের একেক রকম গল্প। কিন্তু আজকাল সকল ভিক্ষুকই কোনো না কোনো ভিক্ষা-কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত। দিনে যা আয় হয় তার অর্ধেক নিজে রেখে বাকিটা কোম্পানীকে দেয়। আর কোম্পানী ওদেরকে নিরাপত্তা দেয়। শুধু ঈদে-চান্দে ঢাকা শহরে ভিক্ষুকরা গ্রাম থেকে এসে জড়ো হয়, তাদেরকে ঢাকা শহরের স্থায়ী ভিক্ষুকরা দুই চোখে দেখতে পারে না, ওদের আয়ে টান পড়ে বলে খুনোখুনিও হয়ে যায় কখনও কখনও। কিন্তু আমেনা কি সত্যিই মোসলেম সর্দারকে ছেড়ে আর কারো দিকে নজর দিয়েছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করি আমি। বসিরকে ছেড়ে ভিখুর কাছে পাঁচী আসেনি, তাকে জোর করে নিয়ে এসেছিল ভিখু, বসিরকে খুন করে। কিন্তু আমেনাকে সেরকম মনে হয়নি আমার, তাই একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলি, “কি আমেনা, মোসলেম সর্দারকে সত্যিই আর ভালো লাগে না তোমার?”
“আরে আফা আপনেও পাগল হইলেন? ব্যাটা মানুষেরতো আর কুনো কাম নাই, খালি সন্দ করে। আমি মরি আমার জ্বালায়, মরণ রোগে দরছে আফা। এই যে দ্যাহেন” - বলে আমেনা ওর বুকের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে ব্লাউজের হুক খুলে ডানদিকের স্তনটা দেখায়। ফোঁড়া পেকে গেলে যেমন টকটকে লাল দেখায় তেমন লাগে আমার কাছে। আবার ব্লাউজের হুক লাগাতে লাগাতে আমেনা বলে, “ব্যাথায় মাঝে মাঝে মনে অয় নিজির গলা নিজি পোচাইয়া কাইডালাই। কিন্তুক ওই কানা ব্যাডার কতা মনে ওইলে হেইডাও পারি না। ডাক্তারে কইছে লক্ষণ বালা না। মরণ বেশিদিন দুরি নাই, বুহির মদ্যি ছড়াইয়া গেলেই মেত্যু। উনারে ধরবার দেই না, তাই ভাবে আমি আর তারে ভালো পাই না। এইডা ওইলো কারণ। কিন্তু একটা কাম ওইছে আফা” - বলতে বলতে আমেনা ওর স্বভাবের বাইরে এসে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। আমি ওর স্তনটা দেখে এমনিতেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, এখন ওর হাসি দেখে অবাক হতে পারি না যদিও, তারপরও ওর দিকে গভীর ভাবে তাকাই। আমেনা বলে, “এ্যাহনতো ভিক্ষায় বাইর ওই নাই। তাই এই বিলাউজ পইরা আইছি। আইজকাইল ভিক্ষায় বাইর হওনের আগে একটা এসপেশাল বিলাউজ পরি আফা, একডা বুক কাডা, আর বুকডার উপর তেতুল ছেইনা মাহাইয়া তারপর বাইর ওই। উনারে কুথাও দাঁড় করাইয়া দিয়া তারপর আমি যাই রাস্তায়, জ্যামে গাড়ি আটকাইয়া থাকলে জানালার সামনে দাঁড়াইয়া খালি কাপড়ডা সরাই। আফা বিশ্বাস করেন, কেউ ফিরায় না, হোগ্গুলি এইডা দেইহা পয়সা দেয়। শুধু মাজে মাজে দুই একজন পুরুষ মানুষ এই পচা বুকডার দিকিও এমুন ভাবে চাইয়া থাকে, কী কবো আফা; পুরুষ মাইনষের চউখতো আমরা কমবেশি সবাই চিনি, চিনি ন্যা, কন?”- আমেনা আবারও হাসতে হাসতে গলে পড়ে, যেটা আসলেই ওর স্বভাবের সঙ্গে একদম বেমানান।
No comments:
Post a Comment