মা
একবার ভাবলাম আম্মুর কম্পিউটারে খুজে দেখি। একটা ছবি থাকতে পারে, কয়দিন আগেই তো আম্মুর সাথে একটা ছবি তুললাম। নাহ, সেটা করলেও কেমন যেন দেখায়। ভাবখানা অনেকটা এমন সারা বছর খেয়াল নেই, এখন মা দিবসে ভাব মারছে ! খুব চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম, আসলে আমার মার সাথে আমার কোন ছবিই নেই !
ছোট বেলায় মার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। বাবা অনেক আগেই ভাগ্য অন্বেষণ করতে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এজন্য মা ই ছিল আমার সব, আমার বাবা, আমার বন্ধু সব কিছু। মা আমাকে শিখিয়েছিল কোন রকম দ্বিধাদন্দ না করে তাকে সব কথা খুলে বলা । তাই হয়ত যেদিন আমার জীবনের সব চাইতে খারাপ ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছিল, আমি সবার আগে আমার মা কে বলেছিলাম। আমার একদম ভয় লাগেনি। কারন আমি জানতাম, আর কেউ থাকুক না থাকুক আমার মা আমার পাশে থাকবে। হ্যাঁ, সেদিনও আমার মা আমাকে নিরাশ করেনি। শক্ত হাতে আমার হাত ধরেছিল।
অবশ্য মা যে সব সময় তার কথা রেখেছিল না নয়। মা সেদিন তার বন্ধু সুলভ আচরণ দেখাতে পারেনি যেদিন আমি তাকে আমার মনের মানুষটির কথা বলেছিলাম। সেদিন আমার মা অন্যরুপে আবির্ভূত হল। মার সেই মূর্তির নাম যে কি দেব আজ পর্যন্ত ভেবে পাইনা। দ্বজ্জাল… ? জানিনা। অনন্ত তখন তো মনে মনে তো তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ মনে হয়, মা ছিল বলেই সেদিন অনেক বড় একটা ভুল করা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলাম।
অবশ্য মায়ের সেই দিনের আচরণের একটা সুনিদিষ্ট কারন ছিল। আসলে ততদিনে আমাদের জীবনে অনেক চেঞ্জ এসে গিয়েছে। তখন আর আমরা বাংলাদেশে থাকিনা। বাবা আমাদেরকে ফ্রান্সে নিয়ে এসেছে। আমি নির্বাসিত হয়েছি একটা রুমে, আর আমার মা আমার বাবার গোঁড়ামির বেড়াজালে। ধীরে ধীরে আমার সাথে মার দূরত্ব বাড়ল। ছবি তো দুরের কথা, মাকে যে কতদিন মা বলে ডাকিনী তাই বা কে জানে…. একসময় আমি আর মা দুজনেই হাফিয়ে উঠলাম আমার বাবা নামক প্রাণীটির দেওয়া যন্ত্রণায়। একদিন দুজনে বেরিয়েও আসলাম সেই যন্ত্রণা থেকে। অনেক সময় লাগল আমাদের মানসিক ভাবে স্বাভাবিক হতে। কিন্তু মা খুব দ্রুতই নিএজেক সামলে নিল, কারন উপায় নেই। অজানা অচেনা এই দেশে সে একা নয়, তার সাথে আছে তার একমাত্র সন্তান, যাকে সে জন্ম থেকে নিজের হাতে গড়ে আসছে, মাঝে কিছুদিন পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, তো কি হয়েছে ! এখন আবার তাকে হাত ধরে টেনে তোলার সময় !
আমি কিন্তু পুরপুরি ঠিক হলাম না। যখনই বাসায় কোন সমস্যা হত, মার উপর খেপে যেতে শুরু করলাম। কেন ? কারন ওই একটাই, এখান থেকে ১০ বছর আগে সে কেন ফ্রান্সে এসেছিল ! এই দোষে দোষারোপ করতে করতে মাকে আমি অতিষ্ট করে তুললাম। এমন যে শুধু তখন করছিলাম তা না, আগেও করতাম। কিন্তু তখন মা এত কষ্টে জর্জরিত ছিল যে আমার করা জুলুম খুব একটা আমলে নিতো না। এখন নেয়, নিতে সে বাধ্য। এজন্যই মন খারাপ হলে সাথে সাথে আমার মন ভাল করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
মার সাথে আমার বর্তমান ঝগড়াঝাঁটি এবং তার অবসানের নমুনা অনেকটা নিম্নরূপ:
আমি হয়ত দুইএক দিন ধরে মার সাথে কথা বলছিনা। দুইদিনের দিন পর মা আমাকে ডাকবে, শিমুল, এদিকে এস তো !
আমি মার ঘরে যাব।
মা বলবে, ব্যাপার কি ? তোমার দুইদিন ধরে দেখছি মনটা খারাপ খারাপ ? কি হয়েছে ?
আমি প্রথমে বলব, নাহ… তেমন কিছুনা।
কিন্তু মা কিছুক্ষন সাধাসাধি করার পর আমি শুরু করব, হ্যাঁ ! সেদিন দেখলাম তুমি এই করেছ, সেই করেছ, কেন করলে, কেন বললে, তোমার আক্কেল জ্ঞান বলতে কিছু নেই… ইত্যাদি ইতাদি ! আমার কথার মূলত সারাংশ হল সব দোষ আমার মার আর মার দোষেই আমার মন খারাপ !
ধীরে ধীরে মার অভ্যাস হয়ে গেল। মন খারাপ হলে তাকে আর খুব বেশী চিন্তা করতে হতনা। আমাকে ডেকে বলত, কি হল শিমুল, আমি কি এমন কিছু করেছি যা তোমার খারাপ লেগেছে ?
একদিন হতাশ হয়ে মা আমাকে বলল, শিমূল, খারাপ লাগলে তুমি বলনা কেন আমাকে? আমরা মাত্র দুজনম মানুষ, আমাদের এমন ঠাণ্ডা যুদ্ধ করার মানে হয় ? মার কাছ থেকে এমন উৎসাহ পেয়ে আমিও রেগুলার ঝগড়া শুরু করলাম ! এবং ঝগড়ার শেষে আমি স্বাভাবিকও হই। কারন জয়ী তো আমি !
আমার কেন যেন মনে হত মা আমাকে ভালবাসেনা। কারন আমরা তো খালি ঝগড়াই করি। কিন্তু আম্মুর ভালবাসা আমি সেদিন বুঝতে পারলাম যেদিন আমি দুইমাসের জন্য অ্যামেরিকা যাচ্ছি। আমার যাওয়ার আগের দিন মা আমাকে বলল, শিমুল, আমি নাহয় তোমার সাথে ইয়ারপর্টে যাব ? আমি বললাম, ধুর ! ঝামেলা করার দরকার কি ! পরে দেখা যাবে তুমি বাসায় ফিরতে হবে কিভাবে বুঝতে পারছনা ! আর আমি তখন থাকব প্লেনে ! তোমাকে তো আর প্লেন থেকে নেমে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবনা ! এর চাইতে ষ্টেশন পর্যন্ত এসো ! এই অনেক। পরদিন আম্মু ষ্টেশন পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে আসল। আম্মু বোধহয় খুব কষ্ঠে অনেক্ষন ধরে নিজেকে সামলে রেখেছিল। কারন আমি ট্রেনে ওঠার সাথে সাথে আম্মুর ভাঙা কলাগাছের মত আমার উপর পড়ল ! আমার তো আক্কেলগুড়ুম ! আমার মা কাঁদছে ?! তাও আবার আমার জন্য ? ! এও কি সম্ভব ?! ওদিকে ট্রেনের ঘণ্টা বেজে গেছে। স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হবে। আমি আম্মুকে সান্ত্বনা টান্তনা দিয়ে একটা সিটে বসলাম। এবার আমি লক্ষ্য করলাম আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে !!! আরে! আজ এসব কি হচ্ছেটা কি ! আশ্চর্য !!
আমি এখন আগের চেয়ে বেশ « বড় » হয়েছি ! এখন অ্যামেরিকা যেতে গেলে কোন প্ল্যান প্রোগ্রাম লাগেনা, যখন ইচ্ছা করে টিকেট কেটে প্লেন ধরি। কিন্তু প্রথম অ্যামেরিকা যাওয়ার অভিজ্ঞতার পর থেকে মায়ের সাথে ঝগড়া করা কমিয়ে দিয়েছি, বলতে গেলে এখন আর ঝগড়া হয়ই না ! আমরা যে কত সুন্দর সময় একসাথে কাটাই, হাসাহাসি করি তা বলার বাইরে! কিন্তু সেই দূরত্বটা এখনও থেকে গেছে। আজ পুরনো এই কথা গুলো উপলব্ধি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত না খারাপ ব্যাবহার করেছি মায়ের সাথে, কত দোষারোপ করেছি তাকে বিনা দোষে, অথচ মা উত্তরে দিয়েছে মিষ্টি একটা হাসি ! সকালের নাস্তা করতে করতে আমি এসব চিন্তা করছিলাম। নাস্তার পর নিজেরঘরে এসে দরজা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম… হঠাৎ দরজায় নক পড়ল।
আমি মার আওয়াজ শুনতে পেলাম, শিমূল ?
আমি বললাম, মা দরজা খোলা আছে, আসতে পার। (আমি ফ্রান্সে আসার পর থেকে নিজের দরজা তালা দিয়ে রাখি)
মা ভেতরে ঢুকল, আমার বিছানার উপরে বসল, তারপর জিগ্যেস করল, কি করছ ?
আমি বললাম, এই তো… একটা ফাইল তৈরি করছিলাম।
ও আচ্ছা।…. কিছুক্ষণ থেমে মা আবার বলল, শিমূল, তোমার কি মন খারাপ ? মানে আমি কি কিছু করেছি আবার ? …
আমি অবাক হয়ে মার দিকে তাকালাম, কেন মা ?
সকাল থেকে দেখছি তোমার মুখটা কেমন ভার ভার। কথা বলছনা।
এর পরের ঘটনা, কাল্পনিক এবং যা আমার করতে মন চাইল :
আমি মার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম, যেভাবে আমি অ্যামেরিকা যাওয়ার দিন সে আমার উপর পড়েছিল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললাম, মা তুমি অনেক ভাল মা ! আর আমি খুব খারাপ ! আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দেই মা, কারন আমার তো কষ্ট দেওয়ার মোট আর কেউ নেই! কি করব বল ! কিন্তু আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালবাসি মা ! অনেক বেশি ভালবাসি !
মা আমাকে বুকে টেনে নিল।
বাস্তব :
আমি মাকে বললাম, কই না তো… আসলে পরিক্ষার টেনশনে মেজাজ টা খারাপ লাগছে। মা, তুমি না বলছিলে বাজারে যাবে ?
হু, যাওয়ার তো দরকার…
চল আমিও সাথে যাই…
মা সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বাজারে যাবে ?
হু, ভারী মাল টানলে না তোমার ঘাড় ব্যাথা হয় ! তাই।
ও আচ্ছা … চল তাহলে।
আমি মার পেছন পেছন নিচে নামলাম। সেখানে আমাদের প্রতিবেশী জোয়াকিম দেখি ববিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। ববি হল জোয়াকিমের অতি আদরের ৭ বছরের কুকুর। জোয়াকিম বলল, কি ব্যাপার কোথায় বেরচ্ছ ?
আমি বললাম, এই তো মর্নিং ওয়াক সাথে টুকটাক বাজার !
জোয়াকিম এবার দুষ্টামি করে আমার কানে কানে বলল, আজ মা দিবস ! জানো তো !
আমি বললাম, অবশ্যই জানি ! তাই তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা টিকে নিয়ে বেরলাম সকাল সকাল !
জোয়াকিম খুশি হয়ে বলল, তাই বলি ! আজ এত সকাল সকাল কোথায় চললে ! তুমি না শিমূল খুব ভাল, মায়ের কত খেয়াল রাখ !
সংগত কারনেই আমি জোয়াকিমের কথা শুনে খুব লজ্জা পেলাম…
আমরা একটু হেসে আবার হাটা শুরু করলাম।
আমার মা অবাক হয়ে আমাকে জিগ্যেস করল, শিমূল ! আজ মা দিবস ?!
এতদিনের করা অপরাধেই বোধহয় আমি মাথা নিচু করে বললাম, হুম….
মা আর কিছু বল্লনা, এক হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে তার মাথা দিয়ে আমার মাথায় একটা টোকা দিল !
No comments:
Post a Comment