Pages

Saturday, January 9, 2016

টমাস ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা

trans.jpgকবি টমাস ট্রান্সট্রয়মারের জন্ম স্টকহোমে ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল আর প্রয়াণ এ বছরের ২৬ মার্চ। ছাত্রজীবন থেকেই সুইডেনের সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে ১৭টি কবিতা (17 Dikter) শিরোনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সুইডিশ ভাষার একজন শক্তিমান কবি হিসেবে আবির্ভূত হন। লেখালেখির শুরুর সময়ে তিনি সুইডেনের আধুনিকতাবাদী কবিদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষার বিপরীতে সহজ ভাষা ও সরল রচনাশৈলী ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন যা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানানসই। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে অতীতের সুইডিশ কবিতা থেকে ভিন্নতর। ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার বড় অংশ জুড়ে স্থান পায় প্রকৃতি ও সঙ্গীত। সমগ্র লেখালেখিতে ট্রান্সট্রয়মার বোধের অতিপ্রাকৃত গভীরতা, প্রজ্ঞা আর পৃথিবীকে উপলব্ধি করায় আচ্ছন্ন ছিলেন। বিশ্বের ৭০টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয় তাঁর কবিতা। তিনি দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। উত্তর ইউরোপের জীবন ও প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে কবি টমাস ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে তুলনীয়। অনুবাদও তেমনি দুরূহ। তাই, অনুবাদগুলো মূল সুইডিশ থেকে করা হলেও রবিন ফালটনের ইংরেজি ভাষান্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া হয়েছে। অনুবাদের অনুমতি প্রদানের জন্যে ট্রান্সট্রয়মারের সহধর্মিনী মনিকা ট্রান্সট্রয়মার এবং বর্তমান অনুবাদকর্মটির ক্ষেত্র তৈরি করে দেবার জন্যে উপসালা সাহিত্য কেন্দ্র এবং সুইডিশ আর্টস কাউন্সিল-এর কাছে অনুবাদকদ্বয় কৃতজ্ঞ।
…………………………………………………………………

অনুবাদ করছেন মুহাম্মদ সামাদ ও আনিসুর রহমান

…………………………………………………………………
আবহাওয়া বৃত্তান্ত
অক্টোবরে সমুদ্রের হিম পৃষ্ঠদেশ মাছের ডানায়
মরীচিকার মতোন চকচক করে।

নৌকাবাইচের শুভ্র বিহ্বলতা;
স্মৃতিচারণের আর কিছু নেই।

অ্যাম্বারের আলো বিচ্ছুরিত হয় গাঁয়ের ওপর
এবং সকল শব্দ ম্রিয়মাণ হয়ে আসে।

কুকুরের ঘেউঘেউ যেন বাগানের হাওয়ায়
অঙ্কিত প্রাচীন মিসরের চিত্রলিপি।

সেখানে হলদে ফল তার গাছটিকে
প্রজ্ঞায় পরাস্ত করে আর স্বেচ্ছায় ঝরে যায়।


খোলা জানালা

এক সকালে বাড়ির
একতলায় দাঁড়িয়ে খোলা জানালায়
শেভ করতে করতে
আমি গুনগুন শুরু করলাম।
শেভের ফ্যাঁসফ্যাঁসানি
বাড়তে বাড়তে গর্জনে-চিৎকারে
হয়ে গেলো এক হেলিকপ্টার।
চেঁচামেচিতে পাইলটের কান
ঝালাপালা হয়ে উঠছিল
‘তোমার চোখকে খোলা রাখো
তুমি সবকিছু দেখছো শেষবারের মতো…!’
আমরা সকলে উঠে দাঁড়ালাম
যেভাবে মানুষ ওড়ে পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে।

আমার অনেক কিছু প্রিয় তার প্রভাব কতটা?
ঢের কথাবার্তা হয় সবুজে সবুজে; আর
কাঠের বাড়ির দেয়ালের লাল রঙে।
গোবরের পিঠে সূর্যের আলোয় চকচক করছিল কাঁচপোকা।
বাতাসে উৎপাটিত শিকড়ের সঙ্গে বের হয়ে এলো
মাটির নিচের ভাঁড়ারেরা।
হামাগুড়ি দিলো ছাপাখানা।
সে মুহূর্তে একমাত্র মানুষেরা
ছিল শান্ত, স্থির; তারা
এক মিনিটের নীরবতা পালন করলো।
ফটো তোলার আশায় যেমন শৈশবে বালকেরা
বসে থাকে গাঁয়ের গির্জার কবরখানার
মৃতেরা তেমনি স্থির হয়ে রইলো; এবং
আমি ঘাড় ঘুরাতেই যুগল ঘোড়ার মতো
একদৃষ্টে দেখলাম নিচ দিয়ে উড়ে যেতে!
আমি জানি না কোথায়!

ভ্রমণ
রঙিন বাতির ম্রিয়মাণ আলোর ভিতরে
গাদা গাদা প্ল্যাকার্ডের ভিড়ে
পাতাল রেলের প্লাটফর্মে হইহল্লা।

রেলগাড়ি এসে মুখগুলো আর
বাক্স-পেঁটরা তুলে নিলো।

অতঃপর অন্ধকার!
ঘোড়াগাড়িতে মূর্তির মতো বসলাম;
একটানে নিয়ে চললো গভীর গিরিগুহা
পেরিয়ে স্বপ্নকে টেনে ধরে…

তারা অন্ধকারের খবর বিক্রি করে
সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের স্টেশনে;
মানুষেরা বিষণ্নতা নিয়ে চুপি চুপি
চলাচল করে ঘড়ির কাঁটার নিচে।

রেলগাড়ি বয়ে নিয়ে গেলো
আত্মা আর বহির্বাসগুলো।

পাহাড় পেরিয়ে এই ভ্রমণে আমরা
সবদিকে এক পলক তাকাই।
কোথাও তেমন অদলবদল নেই!

এমনকি মৌমাছিদের মৃদুমন্দ
গুঞ্জন ও স্বাধীনতা নেই।
আমরা মাটিতে নেমে পড়লাম।

পৃথিবী একদা তার ডানাকে আঘাত করে
স্থির হয় আমাদের নিচে
আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজে।

হঠাৎ শস্যের মঞ্জরি গজিয়ে ওঠে
প্লাটফর্মের ওপরে।

আমরা সীমানা নির্দেশক প্রস্তরখণ্ডের
দিকে এগোলাম
কয়জন ছিল এখানে আমার সঙ্গে?
চার, পাঁচ বা তারও কিছু বেশি।

বাড়িঘর, পথঘাট, পর্বত এবং আকাশ
তাদের জানালা খুলে দিলো।

ভোরের পাখিরা
আমি গাড়িটাকে ধোয়া-মোছা করি;
যার জানালার কাচ ফুলের রেণুতে ঢাকা পড়ে;
আমি সানগ্লাস পরে নিই।

পাখিদের গানে গানে এখানে আঁধার নামে।
এ সময় কেউ একজন
রেলস্টেশনে পত্রিকা কিনে;
কাছেই মরচে পড়ে লাল হওয়া
বিরাট এক মালগাড়ি
রোদে চিকচিক করে।

এখানে কোথাও কোনো শূন্য স্থান নেই।
বসন্তের উষ্ণতায় সোজা ঠাণ্ডা করিডোর ধরে
কেউ একজন দৌড়ে এসে
বলে হেড অফিস কীভাবে তাকে
মিথ্যা অপবাদ দেয়!

নৈসর্গের দরজা দিয়ে
দোয়েলেরা ঢুকে পড়ে
সাদা আর কালো।
কালো পাখিটি অনেক দ্রুত দূরে ছুটে যায়
যতক্ষণ না সব কিছু হয়ে ওঠে কাঠকয়লার চিত্রকর্ম;
একমাত্র ধোবার ঘরের সাদা কাপড় ব্যতীত;
আর মল্লযুদ্ধের কোরাস ছাড়া
এখানে কোথাও কিছু নেই।

যেভাবে আমার কবিতারা বেড়ে ওঠে
ভাবতে দারুণ লাগে!
আমি নিজে সঙ্কুচিত হই।

কবিতারা আরও মহৎ হয়;
তারা আমাকে ছাড়িয়ে যায়
ধাক্কা মেরে পাশে ঠেলে দেয়;
তারা নীড় থেকে আমাকে বাইরে ছুড়ে মারে
আর নিজেরা দাঁড়িয়ে যায়।

শোকগাথা
আমি প্রথম দরজা খুলি।
সূর্য-করোজ্জ্বল বিশাল ঘর।
একটি ভারী যান সড়ক পেরিয়ে যায়
আর চীনামাটি কেঁপে ওঠে।

আমি দ্বিতীয় দরজা খুলি।
বন্ধুরা, তোমরা পান করলে অন্ধকার
আর দৃশ্যমান হলে।

তিন নম্বর দরজা। সরু একটি
হোটেল কক্ষ
রাস্তার পিছন দিকে মুখ করা।

আলকাতরার ওপরে বাতির স্ফুলিঙ্গ
অভিজ্ঞতার সুন্দর মরিচা।

No comments:

Post a Comment