হিমুর ভাষায় মিষ্টি !
আমার বর্তমান অবস্থাঃ
পরনে পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী, পায়ে একজোড়া জুতা (এই জুতা আমার কেনা না। ফ্রান্সে আসার আগে মাজেদা খালা কোথা থেকে যেন এই আপদটা যোগাড় দিয়েছিলেন।
শুধু যোগাড় করেই খ্যান্ত হননি। তিনি নিজের হাতে এই জুতা আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। এটার বিশেষত্ব হল এটা এমনি এমনি খোলা যায়না। এক বালতি উষ্ণ গরম পানির মধ্যে ১৫ মিনিটের মত পা দুবিয়ে রাখলে আস্তে আস্তে খুলে যায়। ১৫ মিনিট ধরে এই তপস্যা করার সাধ্য আমার নেই। কাজেই গত ৩দিন ধরে আমি দিব্যি জুতা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি !)
আমার অবস্থানঃ প্যারিসের এর এক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট
আমার ডান পাশে এক ফরাসী সুন্দরী, খুব মজা করে ডাল ভাত জাতীয় কিছু খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে বলে উঠছে, « উমম ! সে থ্র বোঁ ! » !
আমার বাম পাসে একটি খালি চেয়ার, পেছনে আধভাঙ্গা একটি টয়লেট, আর সামনে মিষ্টি !
না, আমি রসগোল্লা, বা মোহনভোগের কথা বলছিনা। মিষ্টি হল একটি মেয়ের নাম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত আমি মেয়েটিকে দেখছি। কালও একবার ওকে এখানে দেখেছি। এই দুইবারে, আর যাই হোক এর মধ্যে মিষ্টি জাতীয় কিছু আমার চোখে পড়লো না।
সবার নামের পেছনে যে কোন সার্থকতা থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। বাংলাদেশে প্রচুর কুচকুচে কালো রঙের ধলা মিয়া আছে, আবার দুধে আলতা রঙের কালা মিয়াও আছে। সুতরাং যার নাম মিষ্টি তাকে যে মিষ্টিই হতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু মিষ্টির নাম নিয়ে এত গবেষণা করার কারন হল মেয়েটির আসল নাম মিষ্টি বলে মনে হচ্ছেনা। ওকে যতবারই মিষ্টি বলে ডাকা হচ্ছে ততবারই কপট রাগ দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে হয়ত একটু অসোয়াস্তির মধ্যেও পড়ছে বাঙালি পাড়ায় নিজের গুণকীর্তন শুনে।
মিষ্টিকে দেখে বেশ মিশুকই মনে হল। বেশ আহ্লাদী গলায় অর্ডার দিল, আঙ্কেল ! একটা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা ! কালও একই জিনিস খেতে দেখেছিলাম ওকে। চা কি ওর খুব পছন্দ ?
মিষ্টির আহ্লাদ কমে গেল অর্ডার দিয়ে পেছনে ঘুরে দাঁড়ানোর পর। ওর মধ্যে এবার কেমন একটা অসহায় অসহায় ভাব দেখা যাচ্ছে। আজ সকালে ট্রেন ধরার সময় এমন ভাব দেখেছিলাম আরেকটি মেয়ের মুখে। মেয়েটি দক্ষিন এশিয়ার কোন দেশের, ছোটখাট গড়ন, গায়ের রঙ কুচকুচে কাল, কিন্তু মায়াকড়া চেহারা। গাড় করে চোখ এঁকেছে, দেখলেই আপনাআপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি !
সে যাই হোক, আমার কৃষ্ণকলি তখন নিজের মনে মোবাইলে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিল। এমন সময় আরেক ভারতীয় আঙ্কেল মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করা শুরু করল। প্রথমে খুব আস্তে তার নিজের ভাষায় কিছু একটা বলল। কিন্তু কানে যন্ত্র থাকা কৃষ্ণকলি কিছুই শুনতে পেলনা। এবার লোকটি কৃষ্ণকলির চোখের সামনে মাছি তাড়ানোর মত একটা ভঙ্গী করল। এবার কৃষ্ণকলি মাছি তাড়ুয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। মাছি তাড়ুয়া আবারো কিছু বলল, যা ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না। উত্তরে কৃষ্ণকলি আরও অবাক হয়ে বলল বলল, « নো ! » এই বলে ও দ্রুত আবার নিজের কানে যন্ত্র ঢুকিয়ে দিল।
মাছি তাড়ুয়ার খুব সম্ভবত একজায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকার ধৈর্য নেই। তাই তিনি আবারো কৃষ্ণকলির সামনে মাছি তাড়ালেন এবং আবারো অত্যান্ত অবোধগম্য ভাষায় কিছু একটা বললেন। কৃষ্ণকলির মুখে এবার একটা ভয়, বিরক্তি এবং অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। সে খুব সম্ভবত বুঝে উঠতে পারছেনা যে কিভাবে সে মাছি তাড়ুয়াকে দূর করে চুপচাপ তার গান শুনবে।
কৃষ্ণকলির হাতে একটি বই দেখলাম। বইয়ের টাইটেল হল, the aspern papers। সাদা মলাটের বইয়ের এক কোনায় কলম দিয়ে লেখা « n{eye}na ». আজকালকার ছেলে মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি । তাদের নিজের নাম যাই হোক না কেন, এটার আগে পিছে কিছু একটা লাগিয়ে ওটাকে « রকিং » করে ফেলা। বাদল কে দেখেছিলাম নিজের নাম লিখছে « Bad-Owl » যার অর্থ « খারাপ পেঁচা ! »। আমি বাদলকে বললাম, কিরে ! তুই « খারাপ পেঁচা ! » ! বাদল বলল, « আরে হিমুদা ! দিস ইজ স্টাইল ! » কি করা, হিমু না হলে হয়ত আমিও নিজের নামে একটু «স্টাইল» ঢুকিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন ওসব চিন্তা করার সময় না। আমি চিন্তা করছি কিভাবে এই কৃষ্ণকলিকে মাছি তাড়ুয়ার হাত থেকে উদ্ধার করব। মাজেদা খালা আমি আসার আগে আমার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বইয়ের নাম « ফরাসী শিখুন »। কৃষ্ণকলিকে তো বাঙালি বলে মনে হচ্ছেনা । আর আমার দ্বারা অন্য কোন ভাষায় কথা বলা সম্ভব না। সুতরাং, « ফরাসী শিখুন » থেকে শেখা অল্প ফরাসী বিদ্যার উপর ভর করে, বেশ চেনা চেনা গদ গদ ভাব নিয়ে কৃষ্ণকলির কাছে গিয়ে বললাম, « ভুনেত পা ন্যায়না পারাসার্ ?! »
কৃষ্ণকলি চমকে উঠল, কিন্তু এবার বেশ সহজ হয়ে গেল। বেশ হাসি হাসি ভাব নিয়েই বলল, «উই ! ভু মোঃ কনেসে ?! »
আমি এই প্রশ্নের আগা মাথাও বুঝলাম না, কিন্তু সুন্দরীকে উদ্ধার করতে নেমেছি, এখন ঘোমটা তো দিলে তো চলবেনা ! তাই আমি মুখে ফরাসীদের মত চরম উল্লাসের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললাম, «উই ! উই ! একজ্যাক্তমো ! একজ্যাক্তমো ! »
ন্যায়না (ওর নাম আসলেই ন্যায়না) এবার ততোধিক ফরাসী উল্লাশ দিয়ে বলল, «আহ ! ম্যারদ ! জোমো রাপেল প্লু দো ভু ! ওঁফেত ওঁসে ভু উ এক্সাক্তমো ! … শে স্তিফেন পোতেত্র ? »
কি জ্বালায় পড়লাম ! কি বলে এসব ! হাবিজাবি, হুদামুদা ! এইসবের মানে কি ! হিমুদের হিমুগিরি করতে বলে হয়েছে, খাল কেটে কুমির আনতে বলা হয়নি! ধুর !
আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়, আমি নাহয় একটু ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই।
মুহূর্তে আমি ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম। ন্যায়না বা কৃষ্ণকলির সাথে আমার কথপকথন ছিল নিম্নরূপঃ
« আরে ! আপনি না ন্যায়না ?! »
« জী! কিন্তু আপনি কি আমাকে চেনেন ! »
« জী জী ! ঠিক তাই! ঠিক তাই ! »
আমার সমস্যা হল, এবারের বাক্যটি নিয়ে,
« ম্যারদ» এর খাঁটি বাংলা হল, «বিষ্ঠা» বা «গু» যা কিনা আমরা ইংরেজিতে অতি স্টাইল মেরে, «শিট ! » বলে থাকি !
«রাপেল» মানে হল «মনে করা»। আমাকে ন্যায়নার মনে রাখার কোন কারন নেই, কারন আমাকে ও আগে কখনও দেখেনি। এর অর্থ এটাই হতে পারে যে ন্যায়না আমাকে বলছে য, «গু/ বিষ্ঠা/ শিট ! আমার তো আপনার কথা একদম মনে পড়ছেনা ! »
«ওঁ ফেত ওঁসে ভু উ এক্সাক্তমো ! » নাহ ! অসম্ভব, এটা অননুবাদিতই থাক !
… «শে স্তিফেন পোতেত্র ? » «স্তিফেন » মনে হয় ওর কোন বন্ধু। আর «শে» মানে হল «এ», অমুকের বাড়িতে, তমুকের বাড়িতে, সেই এ। অর্থাৎ, ন্যায়নার পুরো কথাটি এমন দাঁড়ায়ঃ গু/ বিষ্ঠা/ শিট ! আমার তো আপনার কথা একদম মনে পড়ছে না ! [অনুবাদহীন বাক্য]…. স্তিফেনের বাড়িতে কি !?
এবার আমি একটু কম এক্সপ্রেশন দিয়ে, কোন রকম রিস্ক না নিয়ে বললাম, « উইই !!! »
« আহ ওকে !! »
আমাদের অবোধ্য ভাষার সমারোহে বোধয় মাছি তাড়ুয়া খুব বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, যার জন্য তিনি জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন।
মিষ্টিকে এখন দেখতে অনেকটা ন্যায়নার কৃষ্ণকলি পর্বের মত লাগছে। ঠিক সেই রকম দ্বিধাদন্দ, বিরক্তি আর ভয় ফুটে উঠেছে ওর মুখে। কিন্তু এবার মেয়েটির মুখে যেন একটু স্নিগ্ধ ভাবও চলে এসেছে। হয়তবা সানগ্লাসটা খোলার জন্যই। কাল ওর চোখে মোটা করে কাজল দেওয়া ছিল। আজ আর চোখে কাজল নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে, এই মেয়ের চোখে কাজলে দেওয়ার দরকারও নেই। মেয়েটি জন্ম কাজল পরে জন্মেছে। ওর বাম চোখটা বোধয় ডান চোখের চাইতে একটু ছোট। এটা ওর স্নিগ্ধতাকে কমিয়ে না দিয়ে দিয়ে বরং আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, দুই চোখ সমান হলে এই মেয়েটিকে এত একদম ভাল দেখাতনা!
আমি বসে মিষ্টি কে বিশ্লেষণ করছি, পাসে ফরাসী সুন্দরী এবার লাচ্ছিড় গ্লাস হাতে নিয়েছে, কিন্তু মিষ্টির অসোয়াস্তি ভাব কাটলনা। দোকান ভর্তি লোকজন, সবই বাঙালি আঙ্কেল। ও খুব সম্ভবত ন্যায়নার মত কোন মাছি তাড়ুয়া বা কাক তাড়ুয়ার হাতে পড়তে চায়না, এজন্যই একটা খালি টেবিল বা কোন মেয়ে বসে আছে এমন টেবিল খুঁজছে। সেই অর্থে আমার টেবিল টা ঠিক আছে। আমার পাসে বসে থাকা ফরাসী সুন্দরী আমার পুরুষত্বের মধ্যে অনেকটাই মনুষ্যত্ব ভরে দিয়েছে! এজন্যই বোধয় মিষ্টি আস্তে আস্তে আমার সামনের চেয়ারটিতে এসে বসল…..
No comments:
Post a Comment