বনদাই বীচে লেখক
(গত সংখ্যার পর)
ব্লু মাউনটেইনস দেখে মহা আনন্দে ‘মিন্টে’র বাসায় ফিরলাম।
চাচি বললেন, তন্ময় না যেয়ে মিস করেছে।
কাহিনী সত্য। কোনো কোনো জায়গা বা সঙ্গের সাথে মিশে শ্রেষ্ঠ বিরিয়ানী খেতেও অভক্তি হয়। বিস্বাদ লাগে। আবার কোনো কোনো স্থান বা কারো সাথে মিশে সাধারণ পান্তা ভাতও মনে হয় অসাধারণ। অমৃত। আমাদের ব্লু মাউনটেইনস সফরটা ছিলো সেরকম। পান্তা ভাত। কিন্তু অমৃত। কত কিছুই না দেখলাম।
তন্ময় জিজ্ঞাসা করলো, কোথায় কোথায় গেছেন আপনারা?
কাকু বললেন, ব্লু মাউনটেইনস, থ্রি সিস্টারস… সব ঘুরেছি।
স্কাইওয়ে দিয়ে আকাশে হেঁটেছো?
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি–বলে কী!
উত্তর দিলাম না।
বিশ্বের সবচেয়ে steepest (খাড়া) রেইলে উঠেছেন? কাকু ও চাচির দিকে তাকিয়ে বললো, রেলে ওঠোনি?
না।
এনশিয়েন্ট রেইন ফরেস্টে ঢুকেছো?
না।
তোমরা তো তাহলে ব্লু মাউনটেইনস-এ কিছুই দেখোনি। খামোখা সময় নষ্ট করেছো।
তন্ময়ের কথা শুনে আমি মোটামুটি বাকহারা হয়ে গেলাম। অজ্ঞতাই আমাকে এত আনন্দিত করেছে…! সিডনি ভ্রমণে তন্ময়কে সাথে নেওয়া ওয়াজিব হয়ে গেলো।
রাতেই ঠিক হলো পরের দিন সী বীচে যাবো। আমি প্রস্তাব করলাম সবাই যাবে। সবাই মানে তন্ময়সহ পরিবারের সবাই।
অস্ট্রেলিয়াকে ক্যাঙ্গারুর দেশ বলে কেন কে জানে! আমার কাছে অস্ট্রেলিয়া নীল পাহাড়ের দেশ। নীল সমুদ্রের দেশ। যার চারদিক ঘিরে আছে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি। হাজার হাজার কিমি সী বীচ। অজস্র পাহাড়। দেশটির সৌন্দর্য হচ্ছে এই নীল পাহাড় এবং সী বীচ।
নানা একটু গাইগুই করছেন। বললেন, আমার যাওয়ার কী দরকার! তোমরা যাও। তন্ময় তিন তারিখে (৩ মার্চ ২০১১) ড্রাইভিং লাইসেন্স পাক–তারপর একসাথে যাবো নে। এখন এত লোক একসাথে কীভাবে যাবো?
নানার বয়স পচাত্তর। ‘বিক্রমপুরের পোলা’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। নিজেকে এখনো দাবি করেন আশি টাকা তোলা বলে। কথা বলেন খাস বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। আমি নিজেও তার দেশী মানুষ। আসার পরে নানার সাথে ব্যাপক গল্প হয়েছে। দুনিয়া ঘোরা লোক। প্রচুর অভিজ্ঞতা। তিনি সবার কাছে বলেন, সিডনিতে মেয়ে-জামাইয়ের কাছে বেড়াতে এসেছেন। চাচি তার বড় কন্যা।
কিন্তু আসল ঘটনা অন্য। নানা চেইন স্মোকার। সিগারেট ছাড়ার চিকিৎসায় অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তারের অধীনে আছেন। তারই অংশ হিসাবে কিছু বিশেষ ঔষধ খাচ্ছেন। এটি তার ইচ্ছাবিরুদ্ধ। চাচি পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন। সুতরাং মেনে না নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। পিতার কাছে ‘কন্যার আব্দার’ কঠিন জিনিস।
সিগারেট না খেতে পেরে এবং ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বর্তমানে তিনি অর্ধ পাগল অবস্থায় আছেন। এটি তার স্বীকারোক্তি।
নানা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। বড় বড় পদে চাকরি করেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কী করেন?
তিনি পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলেন। ইংরেজিতে তার নাম লেখা ‘ড. মতিউর রহমান’। কার্ডের চার কোনায় ক্রসভাবে লেখা: NO JOB, NO MONEY, NO HOPE, NO HOME।
নানার কার্ড আমাকে মুগ্ধ করলো। জীবনে এরকম ভিজিটিং কার্ড দেখিনি। যিনি এরকম কথা লিখে ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে পারেন, তার সঙ্গ মিস করা বোকামি।
চাচিকে বললাম, নানাকে আপনি বলেন যেন আমাদের সাথে বীচে যায়।
চাচি বললেন, আব্বা চলেন। ঘুরে আসলে আপনার ভালো লাগবে।
নানা মুহূর্তেই শুধু রাজি হলেন না, জিজ্ঞাসা করলেন, ড্রেস কী হবে? সুইমিং কস্টিউম তো মনে হয় সাথে নাই। কোন টিশার্ট পরবো? বীচে যাবো…
নানা পোশাকে মডার্ন। এবার আমি ভাবনায় পড়লাম নিজের ড্রেস নিয়ে। কাকু তার টিশার্ট বের করে দিলেন পরার জন্য।
চাচি ভেতরে গেছেন রেডি হতে। নানা যাবেন, কিন্তু এত ফখরণ করলেন কেন? জানতে চাইলাম, ঘটনা কী?
তিনি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে নিজেই বলতে লাগলেন, আমি কোথায় যাই, কী করি, কী পোশাক পরি, কার সাথে কথা বলি, এইসব খবরই গোপনে ঢাকা পাচার হয়।
পাচার হলে অসুবিধা কী?
অসুবিধা হলো সেইসব খবর যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঢাকা থেকে আক্রমণ আসে!
কে আক্রমণ করে?
নানা গোপন ভঙ্গিতে তাকিতুকি করছেন। কিছু বলবেন, তখনই তন্ময় এসে তাড়া দিলো, সবাই রেডি। দ্রুত বের হওয়া দরকার। ওয়েদার রিপোর্ট ভালো না। বৃষ্টি হতে পারে।
কাকুদের গাড়ি দুইটা। চাচির পাজারো এবং তন্ময়ের Holden কমোডর। লাইসেন্স সাসপেন্ডেড থাকায় তন্ময় গাড়ি চালাতে পারছে না। পাজেরো গাড়িতে পাঁচ জনের বেশি ওঠা যাবে না। এখানে আইন কঠোর। গাড়ি আরেকটা লাগবে।
কাকু জানালেন সেই ব্যবস্থা হয়েছে। এক গাড়িতে এত লোক যাওয়া যাবে না। কিন্তু কোনো সমস্যাও নেই। আমাদের সফরসঙ্গী হচ্ছেন রকিব আঙ্কেল এবং নার্গিস আন্টি। কাকুর বাসার পাশেই উনাদের বাড়ি। রকিব আঙ্কেল কাকুর কলেজ জীবনের বন্ধু। ভালো বন্ধু।
সী বীচে ভ্রমণ উপলক্ষে সকালে উলওর্থস-এ (Woolworths) যাওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং চেইন মল এটি। কাকু এবং তন্ময়ের সাথে আমিও ছিলাম। ব্যাপক কেনাকাটা হয়েছে। ফল-চিপস-সফ্ট ড্রিংকস কেনা হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বিরাট এক বাক্স বরফের টুকরাও কেনা হয়েছে। সফট ড্রিংকস এবং পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার গরম বড় তেজস্বী।
বাইরে এলাম।
সাবৃনা শ্যারনকে নিয়ে গাড়ির কাছে ছবি তুলছে। চাচি বললেন, তোমরা দুজন একসাথে দাঁড়াও। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।
বাইরে ঝলমলা রোদ। চিরল বাতাস। গ্যারাজের কাছে কাকু গাড়িতে বরফ তুলতে তুলতে বললেন, আজ বৃষ্টি হবে। ওয়েদার ফোরকাস্টিং ব্যাড।
ট্রিপল ডাব্লু (www) অর্থাৎ ওয়েদার, উইমেন অ্যান্ড ওয়ার্ক কোনো কালেই নিশ্চিত কোনো বিষয় না। সুতরাং দুঃশ্চিন্তা করে লাভ নেই।
চাচি আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছেন। সাবৃনার সাথে একটার বেশি ছবি তোলা হলো না। আমার মোশন এবং পোজ নাকি ছবির বিউটি নষ্ট করে ফেলছে। এমনিতে আমার ভুরি নেই। কিন্তু ক্যামেরা ধরলে পেট ফোলা দেখা যায়। বিখ্যাত ফটোগ্রাফাররা বলেন, দুজনের চোখে কিছুই ফাঁকি দেয়া যায় না। ঈশ্বরের চোখ এবং ক্যামেরার চোখ।
কথাটি যে ভুয়া আমি নিজেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ক্যামেরা এবং ছবি যে সবসময় ঠিক কথা বলে না, এটি তার জীবন্ত প্রমাণ।
সাবৃনা নিজের রূপ সৌন্দর্য নিয়ে মহা ব্যস্ত। শ্যারন তার বোনের কর্মকাণ্ডে খুবই মজা পাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণেই হাসছে। আমার সাথে দৃষ্টিবিনিময় হওয়া মাত্রই সেই হাসি দমকা দিয়ে বেরুচ্ছে।
রকিব আঙ্কেল এবং আন্টি গাড়ি বের করে দাঁড়ালেন।
সিডনিতে সমুদ্র সৈকতের অভাব নেই। অসংখ্য বীচ। কোন বীচে যাবো সেটা দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ালো। পাম বীচ, কলারয় বীচ এগুলো ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযোগী–এরকম কথা শোনা যাচ্ছে।
মুরব্বিদের মধ্যে ঘুসুর-ফুসুর চলছে। কাকু, রকিব আঙ্কেল এবং নার্গিস আন্টির মধ্যে সিদ্ধান্তমূলক মিটিং চলছে রাস্তায় দাঁড়িয়েই।
ওয়েদার রিপোর্টে বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় অনেক বীচেই আজ লোক যাবে না। এই তথ্য দিলেন চাচি।
নিরিবিলি পার্ক ভালো লাগে। সমুদ্রে ভালো লাগে জনসমাগম। প্রথমবার ইউরোপ ভ্রমণে স্পেনের বিলবাও এবং স্যান সিবাস্তিয়ান গিয়ে বিরাট উত্তেজনার মধ্যে পড়লাম। আটলান্টিক মহা সাগরের পানি ছুঁবো। টিভিতে যে প্রাণোচ্ছল রঙ্গিন সমুদ্র সৈকত দেখি, বাস্তবে সেটা উপভোগ করবো। মাহমুদ আঙ্কেলের নেতৃত্বে যথারীতি বিরাট দলসহ হাজির হলাম সৈকতে। গিয়ে মহা হতাশ। শীতের কারণে বীচগুলোতে লোক নেই। প্রায় নির্জন। কুকুর-বিড়াল নিয়ে কিছু নর-নারী ঘোরাফেরা করছে। মানুষ নেই। পশুরাই তাদের সঙ্গী। বন্ধু। মনটাই দমে গেলো।
আমি বললাম, সিডনির যেই বীচে লোক সবচেয়ে বেশি সেই বীচে যাবো।
তন্ময় তার থামা থামা বাংলায় বললো, বনদাই বীচে গেলেই ভালো হয়। বনদাই চলো।
বনদাইয়ের নাম শুনে রকিব অঙ্কেল এবং আন্টি চমকে উঠলেন। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
আন্টি বললেন, ফ্যামিলি নিয়ে কি ওই বীচে যাওয়া যাবে?
সমস্যা কী?
উত্তর দিলেন নানা। উনি এর আগে বনদাই বীচে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়াতে এটি তার দ্বিতীয় ভ্রমণ। বললেন, বনদাই বীচ থেকে একবার চার বাঙালীকে একটি গাছের ওপর থেকে ঝাঁকি জালি দিয়ে ধরা হয়েছিলো।
জাল দিয়ে মাছ ধরে, মানুষ ধরবে কেন?
কারণ ঐ মানুষরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বনদাই বীচের নগ্ন নর নারীর নানা কর্মকাণ্ড উপভোগ করতো। গোপনে ছবি তুলতো।
রকিব আঙ্কেল আন্টি কেন অস্বস্তি বোধ করছিলেন এখন বুঝলাম।
কাকু আবার বললেন, ওয়েদার খারাপ হবে। জোরে বৃষ্টি নামবে। চলো আমরা দ্রুত রওয়ানা হই।
সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত–আমরা বনদাই বীচেই যাচ্ছি।
Lets go to Queen Elizabeth Drive Bondi Beach.
বনদাই(BONDI) বীচ
সাবৃনা, শ্যারন, চাচি এবং কাকু আর নানা বড় গাড়িতে উঠলেন। আমি আর তন্ময় উঠলাম রকিব আঙ্কেলদের কার-এ।
সিডনিতে প্রায় যে কোনো গন্তব্যে যেতেই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের ড্রাইভ।
গাড়ি চলছে। রকিব আঙ্কেল শান্ত প্রকৃতির মানুষ। চুপচাপ ড্রাইভ করছেন। আন্টি বাংলা ফোক গান শুনছেন। গাড়ি মটর ওয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছে। আমি তন্ময়ের সাথে গল্প করছি। ওর কথা বলার গতি ধীর। নিচু কণ্ঠ। শান্ত ভঙ্গি। জিজ্ঞাসা করলাম, বনদাই (BONDI) মনে কী? এটা কি ইংরেজী শব্দ?
না। এটা অ্যাবরিজিনাল। আদিবাসীদের শব্দ। বনদাই মানে হচ্ছে ঢেউয়ের আওয়াজ!
’ঢেউয়ের আওয়াজ’–কী সুন্দর নাম!
যেই বীচের নাম এত সুন্দর–সেখানে অসুন্দর কিছু থাকতে পারে না।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তার দুই পাশে ঝকঝকা শহর। খুবই উপভোগ্য দৃশ্য।
তন্ময় যোগ করলো, গরমের সময় বনদাই বীচে লক্ষের ওপর পর্যটক হয়। আজ বৃষ্টির কারণে কম হতে পারে। তবু ইয়াংরা এখানে সবসময়ই আসে।
তুমি যাও নাই?
অনেকবার। আমার কাছে এটা এখন পুরানো জায়গা।
বনদাই বীচে পৌঁছলাম দুইটায়।
অস্ট্রেলিয়ায় জমি অফুরন্ত। গাড়ি শস্তা। কিন্তু পার্কিং দুর্লভ। বাংলাদেশের মতো যত্রতত্র গাড়ি রাখার অশ্লীল চর্চা সভ্য দুনিয়ায় সম্ভব না। বৃটিশদের মতো অস্ট্রেলিয়ানরাও ফাইন করে দেয়। রকিব আঙ্কেল গাড়ি পার্ক করলেন পাঞ্চ মেশিনে। অর্থাৎ কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট করে গাড়ি পার্ক করতে হলো। সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তিনটা ২০ মিনিট পর্যন্ত এই চার্জ-এ গাড়ি রাখা যাবে। দেরি হলে ফাইন।
ঢাকাতেও গাড়ি পার্কিং-এর জন্য চার্জ বসানো শুধু উচিত না, জরুরি। চার্জ না থাকায় যত্রতত্র গাড়ি রাখায় রাস্তায় তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে। ফি এবং ফাইন সিস্টেম চালু হলে জমিদারি স্টাইলে রাস্তা দখল করে গাড়ি পার্ক করে রাখার প্রবণতা কমবে। ফাইন কঠিন জিনিস।
বনদাই এলাকাটা জমজমাট। প্রচুর লোকের ভিড়। অসংখ্য দেশি-বিদেশী পর্যটক। কাকুর গাড়ি বীচের কাছে চলে এসেছে। তাদের খুঁজতে তন্ময়-আমি নিচে নেমে এলাম। বনদাই প্যাভিলিয়নে লিপটন-এর গ্রীন আইস টি বিতরণ করা হচ্ছে। ফ্রি। তন্ময় এক গ্লাস হাতে নিয়ে বললো, খেয়ে দেখেন ভায়া। মজা। (তন্ময় ‘ভাইয়া’ বলতে পারে না। বলে ‘ভায়া’)
আমিও আইস টি নিলাম।
দুজন আইস টি খেতে খেতে শাওয়ার জোনে চলে এলাম। পিচ্ছাবের উৎকট গন্ধ আসছে। নানাকে দেখি দুই পাশে দুলতে দুলতে একই পথে এগুচ্ছেন। তার পরনে হাফ প্যান্ট এবং নীল শার্ট। পায়ে কেডস। টয়লেটে যাবেন।
পশ্চিমাদের কিছু টয়লেট ম্যানেজমেন্ট বড় অস্বস্তিকর। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এদের মধ্যে পাক-নাপাকের বিষয়টি দুর্বল। ইহুদিদের অবস্থা আবার ভিন্ন। তারা খাদ্যে হালাল-হারাম এবং পাক-নাপাকে বড় সচেতন। প্যারিস থেকে আমস্টারডামগামী টিজিভি ট্রেনে আমার একই বগিতে কিছু ইহুদি যাত্রী ছিলো। ১২০০ কেলোমিটারের পথ। চার ঘণ্টার যাত্রা। এই সময়ে তারা টয়লেটে গিয়ে পাক হতে যেয়ে টিসু পেপারে দরজা ভরে ফেলেছিলো।
তন্ময় একটি আশ্চর্যকর তথ্য দিলো। জাতি হিসাবে অস্ট্রেলীয়রা প্রতি দশ জনের মধ্যে নয়জনই এখনো টয়লেট শেষ করে সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। এটি স্ট্যাটিস্টিকাল রিপোর্ট। সোর্সটা ওর মনে নেই।
সাবৃনা এবং শ্যারন শাওয়ার হল থেকে ফিরেই বললো, আইস টি খাবো।
ফ্রি আইস টি সবাই খাচ্ছে। খেতে খেতে ছবিও তোলা হচ্ছে।
প্রচুর পর্যটক আসছেন। তরুণ-তরুণীরাই সংখ্যায় অধিক। অনেকে সমুদ্র স্নান সেরে ফিরবেন। ফেরার আগে শাওয়ার হল থেকে গোসল সারছেন। পোশাক বদল করছেন। ওয়েদারের ব্যাড রিপোর্টের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
চাচি বললেন, বেলা কিন্তু অনেক হয়েছে। চলো নিচে নামি।
…….. বীচ প্যাভিলিয়নে ফ্রি আইস টি খাওয়ার পরে তন্ময়, সাবৃনা ও শ্যারন
………
আমরা বীচের দিকে নামছি। রোদ ঝলমল করছে। সমুদ্রপ্রেমী মানুষের ভিড়। অধিকাংশই যুগল। পরিবার কম। বালির ওপর অনেকেই জোড়া বেঁধে শুয়ে আছে। প্রকৃতি আর প্রেমের স্পর্শ-আনন্দে তারা মাতোয়ারা। প্রশান্ত মহা সাগরের শান্ত ঢেউয়ে জলকেলি করছে অনেকেই। প্রায় সকলের পরনেই ন্যূনতম সংক্ষিপ্ত পোশাক। বহু রঙের। নানা বর্ণের। প্রাণবন্ত। সুন্দর। ‘উপলব্ধি’ করার মতো। মানুষের কাছে বিদেশের সমুদ্র নিয়ে অনেক রকম কথা শুনেছি। যার বড় অংশই শ্লীল না। যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, সৈকতের এই দৃশ্যাবলী একবারেই অশ্লীল মনে হচ্ছে না। আসলে ‘অশুদ্ধ’ অন্তর অশ্লীল চিন্তা করে। ‘বিশুদ্ধ’ হৃদয় শুভ কামনা করে। আর ‘পরিশুদ্ধ’ অন্তর উপলব্ধি করে।
বালিতে হাঁটার সময় কাকু বললেন, কেউ খালি পায়ে হেঁটো না।
কেন? সমুদ্র সৈকতে তো খালি পায়েই হাঁটতে হয়।
তন্ময় বললো, এডিকটেড লোকজন অনেক সময় তাদের ব্যবহৃত সিরিঞ্জ বা সুঁই বালিতে ফেলে রাখে। একবার একজনের পায়ে সেই সুঁই বিঁধেছিলো। সেটা নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড। কারণ এই ধরনের ব্যবহৃত সুঁই থেকে এইডসের জীবানু ছড়িয়ে যেতে পারে।
রকিব আঙ্কেল এবং আন্টি গাড়ির পার্কিং বদল করতে গেছেন।
চাচি নানাকে নিয়ে বালিতে চেয়ার পেতে বসেছেন।
তন্ময় জানালো, সে পানিতে নামবে না। এর মধ্যে শ্যারন এবং কাকু সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝাপাঝাপি শুরু করে দিয়েছে।
আমি হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছি। সাবৃনা ডুবেছে কোমর পর্যন্ত। সে আমার হাত ধরে আছে। সাগরের ঢেউ তীরে ছুটে আসছে। যখন বড় ঢেউ আসে, সেই ঢেউয়ের সাথে খরগোশের মতো সে লাফ দেয়ার চেষ্টা করছে। পর মুহূর্তেই তন্ময়কে বলছে, ছবি তোলো। ছবি তোলো।
তন্ময় তীরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব পালন করছে।
আমাদের সামনে এক যুগল এলো। তরুণ-তরুণী। ছেলেটি অসম্ভব লম্বা। দুজনেরই পরনে সাতার পোশাক। একটা ঢেউ আসছে। ছেলেটি তার গার্ল ফ্রেন্ডকে পাজা কোলে তুলে ঢেউয়ের মধ্যে জাম্প করলো। একটু পরে উঠে চুমু খেলো। তারপর আবার অপেক্ষা করতে লাগলো আরেকটা ঢেউয়ের জন্য। খুবই মজার খেলা।
…….. পুতুলের মতো দুই বাচ্চা নিয়ে সমুদ্রে এসেছেন এক বাবা।
……..
এক বাবা পুতুলের মতো তার দুই বাচ্চা নিয়ে পানিতে নেমেছে। ঢেউয়ের ধাক্কা খেয়ে সেই বাচ্চা কান্না শুরু করলো। বাবা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কোনো লাভ হচ্ছে না। আরেকটা ঢেউ আসার আগেই সেই বাচ্চা দৌড়ে তীরে উঠে এলো।
খনিক দুরেই লাইফ গার্ডের স্পিড বোট চাক্কর দিচ্ছে। তীরেও লাইফ গার্ডের লোকজন প্রস্তুতিসহ নানা জায়গায় অবস্থান করছে। তন্ময় বললো, এখানে শার্ক বা হিংস্র হাঙরও আছে। কিন্তু এই বীচ ওয়েল নেটিং করে সিকিউরড করা।
আমার সামনে দুই তরুণী এসে দাড়ালো। পরণে স্নানের পোশাক। বৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি। তবু দুজনের হাতেই ছাতা। অগ্রিম সতর্কতা। কিন্তু খালি পা। চেহারা এশীয়। সম্ভবত তারা জাপানিজ। মেয়ে দুজনকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে।
…….. ঢেউয়ের ভয়ে ভীত বাচ্চা সমুদ্রে থাকতে চাচ্ছে না। বাবা তাকে বোঝাচ্ছেন।
……..
নতুন ঢেউ আসায় সাবৃনা আবার লাফ দিলো। পুরো পানিতে না নামলেও হাইটের কারণে সে অনেকখানি ভিজে গেছে।
দুরে সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের সাথে শ্যারন ডিগবাজি খাচ্ছে। তার সাহস এবং কসরৎ দেখবার মতো।
রকিব আঙ্কেল এবং আন্টি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন পোশাক বদল করে।
আমরা বীচে উঠে ছবি তুলছি। তারা তখন পানিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখছি। মানুষের এই ভিড়ের মধ্যে এক সী-গাল পাখি নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে গভীর আগ্রহে মানুষের কাজ কারবার পর্যবেক্ষণ করছে।
…….. লেখককে ধরে সমুদ্রে নিয়ে চলেছেন সাবৃনা
……..
বনদাই বীচে বিপুল জনসমাগম। লাইফ এখানে অনেক কালারফুল, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বীচ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো দীর্ঘ না। স্লবিও (ঢালু) না। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, অস্ট্রেলিয়ার সম্মিলিত সমুদ্র সৈকতেও তা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালুতে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর ১৫ ভাগ ব্লাক গোল্ড। এই ব্লাক গোল্ড মহা মূল্যবান। কক্সবাজার সৈকতের বালুকাবেলায় প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের মধ্যে আছে জিরকন, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটসহ প্রায় আট ধরনের উপাদান, যা রত্নের চেয়ে মূল্যবান। অথচ অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সৈকতে এই ধরনের ব্লাক গোল্ডের পরিমাণ শতকরা ৫ ভাগ। তাই নিয়ে অস্ট্রেলিয়া খনিজ শিল্পে ব্লাক গোল্ড রপ্তানি করে বিদেশের চাহিদার ৯০ ভাগ পূরণ করছে। অথচ ১৫ ভাগ ব্লাক গোল্ড নিয়ে আমরা চুপচাপ বসে আছি। আমাদের সম্পদ রয়েছে। কিন্তু আমরা ব্যবহার করি না। করতে জানি না। সম্ভবত সদ্ব্যবহার করতেও চাই না।
১৮৫ কিমি-এর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত থাকা সত্ত্বেও বনদাই বীচের মতো টুরিস্টরা আমাদের কক্সবাজার বীচ-এ চাইলেও আসতে পারেন না। সেই সুবিধা আমরা তৈরি করিনি। আমি ভাবছি এবং আফসোস করছি।
…….. পানিতে ঝাপাঝাপি শেষে ওঠার পরে সাবৃনা, কাকু ও শ্যারন
………
পানিতে ঝাপাঝাপি করে সবারই খিদে লেগেছে। ড্রেস বদল করতে শাওয়ার রুমে রওয়ানা হলাম। সামনেই একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে ভিড় করে সিরিয়ালে সবাই ছবি তুলছে। ছবি তোলার আগে পোজ দিচ্ছে।
চাচি আমাদের বললেন, তোমরাও যাও, ছবি তোলো। সামনে একটা ফ্রেম। ফ্রেমের মধ্যে গলা বসানের জায়গা। আমি, সাবৃনা গলার পোজ দিলাম। তন্ময় একটা ছবি তুলে পজিশন বদল করতে বললো। এবার আমি ডান দিকে, সাবৃনা বাম দিকে গেলো।
তন্ময় ছবি তুলে স্ক্রীনে দেখছে। বললো, বিউটিফুল।
সাবৃনা ছুটে গেলো। আমিও গেলাম। একজন উন্নত বক্ষা রমণীর কার্টুন ছবির গলায় আমার মাথা বসানো। (ছবি-২১) দুলাভাইয়ের সাথে শ্যালক হিসাবে তন্ময় যে এই জটিল রসিকতাটা করতে পারে ধারণা ছিলো না। গহনার মধ্যে বালা, আর কুটুমের মধ্যে শালা…। নো প্রবলেম। মজা পেয়েছি।
……… লেখকের শ্যালকের রসিকতা–নারী-কার্টুনের মুখটি লেখকের, আর পুরুষ-কার্টুনের গলায় সাবৃনার মুখ
………
পরমুহূর্তে দেখি নানা একই জায়গায় উঠে ছবি তুললেন শ্যারনকে নিয়ে। কাকু আর চাচির পোঁজ দেয়া ছিলো সবচেয়ে সুন্দর।
সবাই ক্ষুধার্ত। এখানে বারবিকিউ করার প্রচুর জায়গা আছে। ইলেকট্রিক গ্রীল আছে। যে কেউ চাইলে জিনিসপত্র নিয়ে এসে কাবাব বানিয়ে খেতে পারে। অনেকেই খাচ্ছে। সমুদ্রকে যতভাবে উপভোগ করা যায়, তার সব আয়োজনই বনদাই বীচে আছে ।
বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের বসিয়ে রেখে আমরা পুরুষরা গেলাম লাঞ্চের জোগারে, পিৎজা আনতে। কাছে-ধারে পিৎজা হাট নেই। যেসব দোকান আছে–গলাকাটা দাম। অগ্নিমূল্য। আরেকটু এগিয়ে সামনে এক দোকানে এসে অর্ডার দেয়া হলো। পিৎজা তৈরিতে সময় লাগে।
আমরা অপেক্ষা করছি।
রেস্টুরেন্টে লোক কম। পার্সেল অর্ডার বেশি। ফলে দেরি হচ্ছে।
তন্ময়ের ফোনে বার বার মেসেজ আসছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কী?
শ্যারন মেসেজ দিচ্ছে। খিধার যন্ত্রনায় নানা পাগলামি করছে।
ফিরে এসে দেখি আশপাশে বারবিকিউ হচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে এরকম কাবাবের ঘ্রাণ সহ্য করা কঠিন। সাধারণ ক্ষিদাও এখানে পাগলা ক্ষিধা হতে বাধ্য।
…….. নানা পোজ দেয়ার সময় জানালেন বিমানের এয়ারহোস্টেজ তাকে বেবি এলিফ্যান্ট বলে ডেকেছিলো–লেখক
………
নানা বললেন, আমাদের দেরি দেখে তিনি তার NO JOB, NO MONEY, NO HOPE, NO HOME ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। বারবিকিউঅলাদের কাছে যাওয়ার এরাদা করেছিলেন। এই কার্ড দেখালে যে কেউ ভিক্ষা হিসাবেও কাবাব না দিয়ে পারতো না।
নানার আইডিয়াটা ভালো। তবে আমি তার চেয়েও অগ্রবর্তী।
প্রথমবার প্যারিস সফরেই সেখানকার বাঙালীরা আমাকে অনুরোধ করেছিলো প্যারিসে থেকে যেতে । আমি থাকলে না-কি প্রচুর ইনকাম করতে পারবে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী কারণে?
তারা জবাবে বললো, প্যারিসে বিশেষ চেহারার লোক ছাড়া ভিক্ষা করে সফল হওয়া কঠিন। আমার চেহারায় না-কি ভিক্ষুকের সেই বিশেষ লুক আছে। প্যারিসের মেট্রো নেটওয়ার্ক ইউরোপের মধ্যে সর্ববৃহৎ। যে কোনো স্টেশনে সর্বোচ্চ কামাই এই বিশেষ চেহারার লোকদের জোটে।
তাদের এই মন্তব্যের যথার্থতা কী, জানি না। তবে প্যারিস থেকে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম যাওয়ার পথে ট্রেনে এক ডাচ কাম ফরাসি নারীর সাথে পরিচয় হলো। বয়স্ক। ফরাসিরা ইংরেজি বলতে অপছন্দ করে। ইনি সেই দলের না। ভদ্রমহিলা যাবেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি রটারড্যাম-এ। ট্রেন থেকে নামার আগে আমার হাতে এক গিল্ডার (ডাচ মুদ্রা) দিয়ে বললেন, আমস্টারডাম নেমে কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করো।
টাকাটা হাতে নিয়েই আমার ভিক্ষুকের বিষয়টা মনে হলো।
ভদ্র মহিলাকে বললাম, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি–কসম করেন, সত্যি উত্তর দিবেন।
উনি বললেন, কসম।
তোমার সাথে মিথ্যা কেন বলবো?
আপনি আমাকে যে ডাচ মুদ্রা দিলেন, এটা কি ভিক্ষা হিসাবে দিয়েছেন? আপনার সাথে তো আমার আর দেখা হবে না; এই টাকা ফেরত দিবো কীভাবে?
তিনি কিড়া কসম করেই উত্তর দিলেন, তোমাকে ভিক্ষা দেইনি। যেহেতু তোমার কাছে ডাচ মুদ্রা নেই, আমস্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে সমস্যা হতে পারে। ফোন করতে হতে পারে–তখন এই গিল্ডারটা তোমার উপকারে লাগবে। তোমার সাথে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। সেই ভালোবাসা থেকেই তোমার জন্য এটি আমার শুভেচ্ছা। এটা ভিক্ষা না। ভালোবাসা।
এই লেখার মাধ্যমে আমি ভদ্রমহিলার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি।
আমাদের সামনে তিন ধরনের বিশাল পিৎজা। চিকেন, বিফ এবং সীফুড মিক্সড। সবাই মজা করে খাচ্ছে। বরফের কোল্ড বক্স থেকে কোক বের করলো তন্ময়। সাবৃনা কাকুকে বললো, খাবারের ছবি তুলে দিতে। বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু হয়েছে।
চাচি বললেন, তাড়াতাড়ি ওঠো।
আমরা এখন কোথায় যাবো?
লাইট হাউস, ওয়াটসন বে… তবে সবার আগে দেখবো মাল্টি মিলিওনিয়ারদের হাউস।
সরল বাংলায় অস্ট্রেলিয়ার কোটিপতিদের বাড়ি।
আমরা বনদাই ছেড়ে গাড়িতে উঠলাম আরেক গন্তব্যেও উদ্দেশ্যে।
(গত সংখ্যার পর)
ব্লু মাউনটেইনস দেখে মহা আনন্দে ‘মিন্টে’র বাসায় ফিরলাম।
চাচি বললেন, তন্ময় না যেয়ে মিস করেছে।
কাহিনী সত্য। কোনো কোনো জায়গা বা সঙ্গের সাথে মিশে শ্রেষ্ঠ বিরিয়ানী খেতেও অভক্তি হয়। বিস্বাদ লাগে। আবার কোনো কোনো স্থান বা কারো সাথে মিশে সাধারণ পান্তা ভাতও মনে হয় অসাধারণ। অমৃত। আমাদের ব্লু মাউনটেইনস সফরটা ছিলো সেরকম। পান্তা ভাত। কিন্তু অমৃত। কত কিছুই না দেখলাম।
তন্ময় জিজ্ঞাসা করলো, কোথায় কোথায় গেছেন আপনারা?
কাকু বললেন, ব্লু মাউনটেইনস, থ্রি সিস্টারস… সব ঘুরেছি।
স্কাইওয়ে দিয়ে আকাশে হেঁটেছো?
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি–বলে কী!
উত্তর দিলাম না।
বিশ্বের সবচেয়ে steepest (খাড়া) রেইলে উঠেছেন? কাকু ও চাচির দিকে তাকিয়ে বললো, রেলে ওঠোনি?
না।
এনশিয়েন্ট রেইন ফরেস্টে ঢুকেছো?
না।
তোমরা তো তাহলে ব্লু মাউনটেইনস-এ কিছুই দেখোনি। খামোখা সময় নষ্ট করেছো।
তন্ময়ের কথা শুনে আমি মোটামুটি বাকহারা হয়ে গেলাম। অজ্ঞতাই আমাকে এত আনন্দিত করেছে…! সিডনি ভ্রমণে তন্ময়কে সাথে নেওয়া ওয়াজিব হয়ে গেলো।
রাতেই ঠিক হলো পরের দিন সী বীচে যাবো। আমি প্রস্তাব করলাম সবাই যাবে। সবাই মানে তন্ময়সহ পরিবারের সবাই।
অস্ট্রেলিয়াকে ক্যাঙ্গারুর দেশ বলে কেন কে জানে! আমার কাছে অস্ট্রেলিয়া নীল পাহাড়ের দেশ। নীল সমুদ্রের দেশ। যার চারদিক ঘিরে আছে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি। হাজার হাজার কিমি সী বীচ। অজস্র পাহাড়। দেশটির সৌন্দর্য হচ্ছে এই নীল পাহাড় এবং সী বীচ।
নানা একটু গাইগুই করছেন। বললেন, আমার যাওয়ার কী দরকার! তোমরা যাও। তন্ময় তিন তারিখে (৩ মার্চ ২০১১) ড্রাইভিং লাইসেন্স পাক–তারপর একসাথে যাবো নে। এখন এত লোক একসাথে কীভাবে যাবো?
নানার বয়স পচাত্তর। ‘বিক্রমপুরের পোলা’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। নিজেকে এখনো দাবি করেন আশি টাকা তোলা বলে। কথা বলেন খাস বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। আমি নিজেও তার দেশী মানুষ। আসার পরে নানার সাথে ব্যাপক গল্প হয়েছে। দুনিয়া ঘোরা লোক। প্রচুর অভিজ্ঞতা। তিনি সবার কাছে বলেন, সিডনিতে মেয়ে-জামাইয়ের কাছে বেড়াতে এসেছেন। চাচি তার বড় কন্যা।
কিন্তু আসল ঘটনা অন্য। নানা চেইন স্মোকার। সিগারেট ছাড়ার চিকিৎসায় অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তারের অধীনে আছেন। তারই অংশ হিসাবে কিছু বিশেষ ঔষধ খাচ্ছেন। এটি তার ইচ্ছাবিরুদ্ধ। চাচি পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন। সুতরাং মেনে না নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। পিতার কাছে ‘কন্যার আব্দার’ কঠিন জিনিস।
সিগারেট না খেতে পেরে এবং ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বর্তমানে তিনি অর্ধ পাগল অবস্থায় আছেন। এটি তার স্বীকারোক্তি।
নানা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। বড় বড় পদে চাকরি করেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কী করেন?
তিনি পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলেন। ইংরেজিতে তার নাম লেখা ‘ড. মতিউর রহমান’। কার্ডের চার কোনায় ক্রসভাবে লেখা: NO JOB, NO MONEY, NO HOPE, NO HOME।
নানার কার্ড আমাকে মুগ্ধ করলো। জীবনে এরকম ভিজিটিং কার্ড দেখিনি। যিনি এরকম কথা লিখে ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে পারেন, তার সঙ্গ মিস করা বোকামি।
চাচিকে বললাম, নানাকে আপনি বলেন যেন আমাদের সাথে বীচে যায়।
চাচি বললেন, আব্বা চলেন। ঘুরে আসলে আপনার ভালো লাগবে।
নানা মুহূর্তেই শুধু রাজি হলেন না, জিজ্ঞাসা করলেন, ড্রেস কী হবে? সুইমিং কস্টিউম তো মনে হয় সাথে নাই। কোন টিশার্ট পরবো? বীচে যাবো…
নানা পোশাকে মডার্ন। এবার আমি ভাবনায় পড়লাম নিজের ড্রেস নিয়ে। কাকু তার টিশার্ট বের করে দিলেন পরার জন্য।
চাচি ভেতরে গেছেন রেডি হতে। নানা যাবেন, কিন্তু এত ফখরণ করলেন কেন? জানতে চাইলাম, ঘটনা কী?
তিনি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে নিজেই বলতে লাগলেন, আমি কোথায় যাই, কী করি, কী পোশাক পরি, কার সাথে কথা বলি, এইসব খবরই গোপনে ঢাকা পাচার হয়।
পাচার হলে অসুবিধা কী?
অসুবিধা হলো সেইসব খবর যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঢাকা থেকে আক্রমণ আসে!
কে আক্রমণ করে?
নানা গোপন ভঙ্গিতে তাকিতুকি করছেন। কিছু বলবেন, তখনই তন্ময় এসে তাড়া দিলো, সবাই রেডি। দ্রুত বের হওয়া দরকার। ওয়েদার রিপোর্ট ভালো না। বৃষ্টি হতে পারে।
কাকুদের গাড়ি দুইটা। চাচির পাজারো এবং তন্ময়ের Holden কমোডর। লাইসেন্স সাসপেন্ডেড থাকায় তন্ময় গাড়ি চালাতে পারছে না। পাজেরো গাড়িতে পাঁচ জনের বেশি ওঠা যাবে না। এখানে আইন কঠোর। গাড়ি আরেকটা লাগবে।
কাকু জানালেন সেই ব্যবস্থা হয়েছে। এক গাড়িতে এত লোক যাওয়া যাবে না। কিন্তু কোনো সমস্যাও নেই। আমাদের সফরসঙ্গী হচ্ছেন রকিব আঙ্কেল এবং নার্গিস আন্টি। কাকুর বাসার পাশেই উনাদের বাড়ি। রকিব আঙ্কেল কাকুর কলেজ জীবনের বন্ধু। ভালো বন্ধু।
সী বীচে ভ্রমণ উপলক্ষে সকালে উলওর্থস-এ (Woolworths) যাওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং চেইন মল এটি। কাকু এবং তন্ময়ের সাথে আমিও ছিলাম। ব্যাপক কেনাকাটা হয়েছে। ফল-চিপস-সফ্ট ড্রিংকস কেনা হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বিরাট এক বাক্স বরফের টুকরাও কেনা হয়েছে। সফট ড্রিংকস এবং পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার গরম বড় তেজস্বী।
বাইরে এলাম।
সাবৃনা শ্যারনকে নিয়ে গাড়ির কাছে ছবি তুলছে। চাচি বললেন, তোমরা দুজন একসাথে দাঁড়াও। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।
বাইরে ঝলমলা রোদ। চিরল বাতাস। গ্যারাজের কাছে কাকু গাড়িতে বরফ তুলতে তুলতে বললেন, আজ বৃষ্টি হবে। ওয়েদার ফোরকাস্টিং ব্যাড।
ট্রিপল ডাব্লু (www) অর্থাৎ ওয়েদার, উইমেন অ্যান্ড ওয়ার্ক কোনো কালেই নিশ্চিত কোনো বিষয় না। সুতরাং দুঃশ্চিন্তা করে লাভ নেই।
চাচি আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছেন। সাবৃনার সাথে একটার বেশি ছবি তোলা হলো না। আমার মোশন এবং পোজ নাকি ছবির বিউটি নষ্ট করে ফেলছে। এমনিতে আমার ভুরি নেই। কিন্তু ক্যামেরা ধরলে পেট ফোলা দেখা যায়। বিখ্যাত ফটোগ্রাফাররা বলেন, দুজনের চোখে কিছুই ফাঁকি দেয়া যায় না। ঈশ্বরের চোখ এবং ক্যামেরার চোখ।
কথাটি যে ভুয়া আমি নিজেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ক্যামেরা এবং ছবি যে সবসময় ঠিক কথা বলে না, এটি তার জীবন্ত প্রমাণ।
সাবৃনা নিজের রূপ সৌন্দর্য নিয়ে মহা ব্যস্ত। শ্যারন তার বোনের কর্মকাণ্ডে খুবই মজা পাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণেই হাসছে। আমার সাথে দৃষ্টিবিনিময় হওয়া মাত্রই সেই হাসি দমকা দিয়ে বেরুচ্ছে।
রকিব আঙ্কেল এবং আন্টি গাড়ি বের করে দাঁড়ালেন।
সিডনিতে সমুদ্র সৈকতের অভাব নেই। অসংখ্য বীচ। কোন বীচে যাবো সেটা দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ালো। পাম বীচ, কলারয় বীচ এগুলো ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযোগী–এরকম কথা শোনা যাচ্ছে।
মুরব্বিদের মধ্যে ঘুসুর-ফুসুর চলছে। কাকু, রকিব আঙ্কেল এবং নার্গিস আন্টির মধ্যে সিদ্ধান্তমূলক মিটিং চলছে রাস্তায় দাঁড়িয়েই।
ওয়েদার রিপোর্টে বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় অনেক বীচেই আজ লোক যাবে না। এই তথ্য দিলেন চাচি।
নিরিবিলি পার্ক ভালো লাগে। সমুদ্রে ভালো লাগে জনসমাগম। প্রথমবার ইউরোপ ভ্রমণে স্পেনের বিলবাও এবং স্যান সিবাস্তিয়ান গিয়ে বিরাট উত্তেজনার মধ্যে পড়লাম। আটলান্টিক মহা সাগরের পানি ছুঁবো। টিভিতে যে প্রাণোচ্ছল রঙ্গিন সমুদ্র সৈকত দেখি, বাস্তবে সেটা উপভোগ করবো। মাহমুদ আঙ্কেলের নেতৃত্বে যথারীতি বিরাট দলসহ হাজির হলাম সৈকতে। গিয়ে মহা হতাশ। শীতের কারণে বীচগুলোতে লোক নেই। প্রায় নির্জন। কুকুর-বিড়াল নিয়ে কিছু নর-নারী ঘোরাফেরা করছে। মানুষ নেই। পশুরাই তাদের সঙ্গী। বন্ধু। মনটাই দমে গেলো।
আমি বললাম, সিডনির যেই বীচে লোক সবচেয়ে বেশি সেই বীচে যাবো।
তন্ময় তার থামা থামা বাংলায় বললো, বনদাই বীচে গেলেই ভালো হয়। বনদাই চলো।
বনদাইয়ের নাম শুনে রকিব অঙ্কেল এবং আন্টি চমকে উঠলেন। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
আন্টি বললেন, ফ্যামিলি নিয়ে কি ওই বীচে যাওয়া যাবে?
সমস্যা কী?
উত্তর দিলেন নানা। উনি এর আগে বনদাই বীচে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়াতে এটি তার দ্বিতীয় ভ্রমণ। বললেন, বনদাই বীচ থেকে একবার চার বাঙালীকে একটি গাছের ওপর থেকে ঝাঁকি জালি দিয়ে ধরা হয়েছিলো।
জাল দিয়ে মাছ ধরে, মানুষ ধরবে কেন?
কারণ ঐ মানুষরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বনদাই বীচের নগ্ন নর নারীর নানা কর্মকাণ্ড উপভোগ করতো। গোপনে ছবি তুলতো।
রকিব আঙ্কেল আন্টি কেন অস্বস্তি বোধ করছিলেন এখন বুঝলাম।
কাকু আবার বললেন, ওয়েদার খারাপ হবে। জোরে বৃষ্টি নামবে। চলো আমরা দ্রুত রওয়ানা হই।
সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত–আমরা বনদাই বীচেই যাচ্ছি।
Lets go to Queen Elizabeth Drive Bondi Beach.
বনদাই(BONDI) বীচ
সাবৃনা, শ্যারন, চাচি এবং কাকু আর নানা বড় গাড়িতে উঠলেন। আমি আর তন্ময় উঠলাম রকিব আঙ্কেলদের কার-এ।
সিডনিতে প্রায় যে কোনো গন্তব্যে যেতেই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের ড্রাইভ।
গাড়ি চলছে। রকিব আঙ্কেল শান্ত প্রকৃতির মানুষ। চুপচাপ ড্রাইভ করছেন। আন্টি বাংলা ফোক গান শুনছেন। গাড়ি মটর ওয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছে। আমি তন্ময়ের সাথে গল্প করছি। ওর কথা বলার গতি ধীর। নিচু কণ্ঠ। শান্ত ভঙ্গি। জিজ্ঞাসা করলাম, বনদাই (BONDI) মনে কী? এটা কি ইংরেজী শব্দ?
না। এটা অ্যাবরিজিনাল। আদিবাসীদের শব্দ। বনদাই মানে হচ্ছে ঢেউয়ের আওয়াজ!
’ঢেউয়ের আওয়াজ’–কী সুন্দর নাম!
যেই বীচের নাম এত সুন্দর–সেখানে অসুন্দর কিছু থাকতে পারে না।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তার দুই পাশে ঝকঝকা শহর। খুবই উপভোগ্য দৃশ্য।
তন্ময় যোগ করলো, গরমের সময় বনদাই বীচে লক্ষের ওপর পর্যটক হয়। আজ বৃষ্টির কারণে কম হতে পারে। তবু ইয়াংরা এখানে সবসময়ই আসে।
তুমি যাও নাই?
অনেকবার। আমার কাছে এটা এখন পুরানো জায়গা।
বনদাই বীচে পৌঁছলাম দুইটায়।
অস্ট্রেলিয়ায় জমি অফুরন্ত। গাড়ি শস্তা। কিন্তু পার্কিং দুর্লভ। বাংলাদেশের মতো যত্রতত্র গাড়ি রাখার অশ্লীল চর্চা সভ্য দুনিয়ায় সম্ভব না। বৃটিশদের মতো অস্ট্রেলিয়ানরাও ফাইন করে দেয়। রকিব আঙ্কেল গাড়ি পার্ক করলেন পাঞ্চ মেশিনে। অর্থাৎ কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট করে গাড়ি পার্ক করতে হলো। সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তিনটা ২০ মিনিট পর্যন্ত এই চার্জ-এ গাড়ি রাখা যাবে। দেরি হলে ফাইন।
ঢাকাতেও গাড়ি পার্কিং-এর জন্য চার্জ বসানো শুধু উচিত না, জরুরি। চার্জ না থাকায় যত্রতত্র গাড়ি রাখায় রাস্তায় তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে। ফি এবং ফাইন সিস্টেম চালু হলে জমিদারি স্টাইলে রাস্তা দখল করে গাড়ি পার্ক করে রাখার প্রবণতা কমবে। ফাইন কঠিন জিনিস।
বনদাই এলাকাটা জমজমাট। প্রচুর লোকের ভিড়। অসংখ্য দেশি-বিদেশী পর্যটক। কাকুর গাড়ি বীচের কাছে চলে এসেছে। তাদের খুঁজতে তন্ময়-আমি নিচে নেমে এলাম। বনদাই প্যাভিলিয়নে লিপটন-এর গ্রীন আইস টি বিতরণ করা হচ্ছে। ফ্রি। তন্ময় এক গ্লাস হাতে নিয়ে বললো, খেয়ে দেখেন ভায়া। মজা। (তন্ময় ‘ভাইয়া’ বলতে পারে না। বলে ‘ভায়া’)
আমিও আইস টি নিলাম।
দুজন আইস টি খেতে খেতে শাওয়ার জোনে চলে এলাম। পিচ্ছাবের উৎকট গন্ধ আসছে। নানাকে দেখি দুই পাশে দুলতে দুলতে একই পথে এগুচ্ছেন। তার পরনে হাফ প্যান্ট এবং নীল শার্ট। পায়ে কেডস। টয়লেটে যাবেন।
পশ্চিমাদের কিছু টয়লেট ম্যানেজমেন্ট বড় অস্বস্তিকর। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এদের মধ্যে পাক-নাপাকের বিষয়টি দুর্বল। ইহুদিদের অবস্থা আবার ভিন্ন। তারা খাদ্যে হালাল-হারাম এবং পাক-নাপাকে বড় সচেতন। প্যারিস থেকে আমস্টারডামগামী টিজিভি ট্রেনে আমার একই বগিতে কিছু ইহুদি যাত্রী ছিলো। ১২০০ কেলোমিটারের পথ। চার ঘণ্টার যাত্রা। এই সময়ে তারা টয়লেটে গিয়ে পাক হতে যেয়ে টিসু পেপারে দরজা ভরে ফেলেছিলো।
তন্ময় একটি আশ্চর্যকর তথ্য দিলো। জাতি হিসাবে অস্ট্রেলীয়রা প্রতি দশ জনের মধ্যে নয়জনই এখনো টয়লেট শেষ করে সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। এটি স্ট্যাটিস্টিকাল রিপোর্ট। সোর্সটা ওর মনে নেই।
সাবৃনা এবং শ্যারন শাওয়ার হল থেকে ফিরেই বললো, আইস টি খাবো।
ফ্রি আইস টি সবাই খাচ্ছে। খেতে খেতে ছবিও তোলা হচ্ছে।
প্রচুর পর্যটক আসছেন। তরুণ-তরুণীরাই সংখ্যায় অধিক। অনেকে সমুদ্র স্নান সেরে ফিরবেন। ফেরার আগে শাওয়ার হল থেকে গোসল সারছেন। পোশাক বদল করছেন। ওয়েদারের ব্যাড রিপোর্টের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
চাচি বললেন, বেলা কিন্তু অনেক হয়েছে। চলো নিচে নামি।
…….. বীচ প্যাভিলিয়নে ফ্রি আইস টি খাওয়ার পরে তন্ময়, সাবৃনা ও শ্যারন
………
আমরা বীচের দিকে নামছি। রোদ ঝলমল করছে। সমুদ্রপ্রেমী মানুষের ভিড়। অধিকাংশই যুগল। পরিবার কম। বালির ওপর অনেকেই জোড়া বেঁধে শুয়ে আছে। প্রকৃতি আর প্রেমের স্পর্শ-আনন্দে তারা মাতোয়ারা। প্রশান্ত মহা সাগরের শান্ত ঢেউয়ে জলকেলি করছে অনেকেই। প্রায় সকলের পরনেই ন্যূনতম সংক্ষিপ্ত পোশাক। বহু রঙের। নানা বর্ণের। প্রাণবন্ত। সুন্দর। ‘উপলব্ধি’ করার মতো। মানুষের কাছে বিদেশের সমুদ্র নিয়ে অনেক রকম কথা শুনেছি। যার বড় অংশই শ্লীল না। যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, সৈকতের এই দৃশ্যাবলী একবারেই অশ্লীল মনে হচ্ছে না। আসলে ‘অশুদ্ধ’ অন্তর অশ্লীল চিন্তা করে। ‘বিশুদ্ধ’ হৃদয় শুভ কামনা করে। আর ‘পরিশুদ্ধ’ অন্তর উপলব্ধি করে।
বালিতে হাঁটার সময় কাকু বললেন, কেউ খালি পায়ে হেঁটো না।
কেন? সমুদ্র সৈকতে তো খালি পায়েই হাঁটতে হয়।
তন্ময় বললো, এডিকটেড লোকজন অনেক সময় তাদের ব্যবহৃত সিরিঞ্জ বা সুঁই বালিতে ফেলে রাখে। একবার একজনের পায়ে সেই সুঁই বিঁধেছিলো। সেটা নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড। কারণ এই ধরনের ব্যবহৃত সুঁই থেকে এইডসের জীবানু ছড়িয়ে যেতে পারে।
রকিব আঙ্কেল এবং আন্টি গাড়ির পার্কিং বদল করতে গেছেন।
চাচি নানাকে নিয়ে বালিতে চেয়ার পেতে বসেছেন।
তন্ময় জানালো, সে পানিতে নামবে না। এর মধ্যে শ্যারন এবং কাকু সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝাপাঝাপি শুরু করে দিয়েছে।
আমি হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছি। সাবৃনা ডুবেছে কোমর পর্যন্ত। সে আমার হাত ধরে আছে। সাগরের ঢেউ তীরে ছুটে আসছে। যখন বড় ঢেউ আসে, সেই ঢেউয়ের সাথে খরগোশের মতো সে লাফ দেয়ার চেষ্টা করছে। পর মুহূর্তেই তন্ময়কে বলছে, ছবি তোলো। ছবি তোলো।
তন্ময় তীরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব পালন করছে।
আমাদের সামনে এক যুগল এলো। তরুণ-তরুণী। ছেলেটি অসম্ভব লম্বা। দুজনেরই পরনে সাতার পোশাক। একটা ঢেউ আসছে। ছেলেটি তার গার্ল ফ্রেন্ডকে পাজা কোলে তুলে ঢেউয়ের মধ্যে জাম্প করলো। একটু পরে উঠে চুমু খেলো। তারপর আবার অপেক্ষা করতে লাগলো আরেকটা ঢেউয়ের জন্য। খুবই মজার খেলা।
…….. পুতুলের মতো দুই বাচ্চা নিয়ে সমুদ্রে এসেছেন এক বাবা।
……..
এক বাবা পুতুলের মতো তার দুই বাচ্চা নিয়ে পানিতে নেমেছে। ঢেউয়ের ধাক্কা খেয়ে সেই বাচ্চা কান্না শুরু করলো। বাবা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কোনো লাভ হচ্ছে না। আরেকটা ঢেউ আসার আগেই সেই বাচ্চা দৌড়ে তীরে উঠে এলো।
খনিক দুরেই লাইফ গার্ডের স্পিড বোট চাক্কর দিচ্ছে। তীরেও লাইফ গার্ডের লোকজন প্রস্তুতিসহ নানা জায়গায় অবস্থান করছে। তন্ময় বললো, এখানে শার্ক বা হিংস্র হাঙরও আছে। কিন্তু এই বীচ ওয়েল নেটিং করে সিকিউরড করা।
আমার সামনে দুই তরুণী এসে দাড়ালো। পরণে স্নানের পোশাক। বৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি। তবু দুজনের হাতেই ছাতা। অগ্রিম সতর্কতা। কিন্তু খালি পা। চেহারা এশীয়। সম্ভবত তারা জাপানিজ। মেয়ে দুজনকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে।
…….. ঢেউয়ের ভয়ে ভীত বাচ্চা সমুদ্রে থাকতে চাচ্ছে না। বাবা তাকে বোঝাচ্ছেন।
……..
নতুন ঢেউ আসায় সাবৃনা আবার লাফ দিলো। পুরো পানিতে না নামলেও হাইটের কারণে সে অনেকখানি ভিজে গেছে।
দুরে সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের সাথে শ্যারন ডিগবাজি খাচ্ছে। তার সাহস এবং কসরৎ দেখবার মতো।
রকিব আঙ্কেল এবং আন্টি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন পোশাক বদল করে।
আমরা বীচে উঠে ছবি তুলছি। তারা তখন পানিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখছি। মানুষের এই ভিড়ের মধ্যে এক সী-গাল পাখি নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে গভীর আগ্রহে মানুষের কাজ কারবার পর্যবেক্ষণ করছে।
…….. লেখককে ধরে সমুদ্রে নিয়ে চলেছেন সাবৃনা
……..
বনদাই বীচে বিপুল জনসমাগম। লাইফ এখানে অনেক কালারফুল, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বীচ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো দীর্ঘ না। স্লবিও (ঢালু) না। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, অস্ট্রেলিয়ার সম্মিলিত সমুদ্র সৈকতেও তা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালুতে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর ১৫ ভাগ ব্লাক গোল্ড। এই ব্লাক গোল্ড মহা মূল্যবান। কক্সবাজার সৈকতের বালুকাবেলায় প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের মধ্যে আছে জিরকন, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটসহ প্রায় আট ধরনের উপাদান, যা রত্নের চেয়ে মূল্যবান। অথচ অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সৈকতে এই ধরনের ব্লাক গোল্ডের পরিমাণ শতকরা ৫ ভাগ। তাই নিয়ে অস্ট্রেলিয়া খনিজ শিল্পে ব্লাক গোল্ড রপ্তানি করে বিদেশের চাহিদার ৯০ ভাগ পূরণ করছে। অথচ ১৫ ভাগ ব্লাক গোল্ড নিয়ে আমরা চুপচাপ বসে আছি। আমাদের সম্পদ রয়েছে। কিন্তু আমরা ব্যবহার করি না। করতে জানি না। সম্ভবত সদ্ব্যবহার করতেও চাই না।
১৮৫ কিমি-এর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত থাকা সত্ত্বেও বনদাই বীচের মতো টুরিস্টরা আমাদের কক্সবাজার বীচ-এ চাইলেও আসতে পারেন না। সেই সুবিধা আমরা তৈরি করিনি। আমি ভাবছি এবং আফসোস করছি।
…….. পানিতে ঝাপাঝাপি শেষে ওঠার পরে সাবৃনা, কাকু ও শ্যারন
………
পানিতে ঝাপাঝাপি করে সবারই খিদে লেগেছে। ড্রেস বদল করতে শাওয়ার রুমে রওয়ানা হলাম। সামনেই একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে ভিড় করে সিরিয়ালে সবাই ছবি তুলছে। ছবি তোলার আগে পোজ দিচ্ছে।
চাচি আমাদের বললেন, তোমরাও যাও, ছবি তোলো। সামনে একটা ফ্রেম। ফ্রেমের মধ্যে গলা বসানের জায়গা। আমি, সাবৃনা গলার পোজ দিলাম। তন্ময় একটা ছবি তুলে পজিশন বদল করতে বললো। এবার আমি ডান দিকে, সাবৃনা বাম দিকে গেলো।
তন্ময় ছবি তুলে স্ক্রীনে দেখছে। বললো, বিউটিফুল।
সাবৃনা ছুটে গেলো। আমিও গেলাম। একজন উন্নত বক্ষা রমণীর কার্টুন ছবির গলায় আমার মাথা বসানো। (ছবি-২১) দুলাভাইয়ের সাথে শ্যালক হিসাবে তন্ময় যে এই জটিল রসিকতাটা করতে পারে ধারণা ছিলো না। গহনার মধ্যে বালা, আর কুটুমের মধ্যে শালা…। নো প্রবলেম। মজা পেয়েছি।
……… লেখকের শ্যালকের রসিকতা–নারী-কার্টুনের মুখটি লেখকের, আর পুরুষ-কার্টুনের গলায় সাবৃনার মুখ
………
পরমুহূর্তে দেখি নানা একই জায়গায় উঠে ছবি তুললেন শ্যারনকে নিয়ে। কাকু আর চাচির পোঁজ দেয়া ছিলো সবচেয়ে সুন্দর।
সবাই ক্ষুধার্ত। এখানে বারবিকিউ করার প্রচুর জায়গা আছে। ইলেকট্রিক গ্রীল আছে। যে কেউ চাইলে জিনিসপত্র নিয়ে এসে কাবাব বানিয়ে খেতে পারে। অনেকেই খাচ্ছে। সমুদ্রকে যতভাবে উপভোগ করা যায়, তার সব আয়োজনই বনদাই বীচে আছে ।
বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের বসিয়ে রেখে আমরা পুরুষরা গেলাম লাঞ্চের জোগারে, পিৎজা আনতে। কাছে-ধারে পিৎজা হাট নেই। যেসব দোকান আছে–গলাকাটা দাম। অগ্নিমূল্য। আরেকটু এগিয়ে সামনে এক দোকানে এসে অর্ডার দেয়া হলো। পিৎজা তৈরিতে সময় লাগে।
আমরা অপেক্ষা করছি।
রেস্টুরেন্টে লোক কম। পার্সেল অর্ডার বেশি। ফলে দেরি হচ্ছে।
তন্ময়ের ফোনে বার বার মেসেজ আসছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কী?
শ্যারন মেসেজ দিচ্ছে। খিধার যন্ত্রনায় নানা পাগলামি করছে।
ফিরে এসে দেখি আশপাশে বারবিকিউ হচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে এরকম কাবাবের ঘ্রাণ সহ্য করা কঠিন। সাধারণ ক্ষিদাও এখানে পাগলা ক্ষিধা হতে বাধ্য।
…….. নানা পোজ দেয়ার সময় জানালেন বিমানের এয়ারহোস্টেজ তাকে বেবি এলিফ্যান্ট বলে ডেকেছিলো–লেখক
………
নানা বললেন, আমাদের দেরি দেখে তিনি তার NO JOB, NO MONEY, NO HOPE, NO HOME ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। বারবিকিউঅলাদের কাছে যাওয়ার এরাদা করেছিলেন। এই কার্ড দেখালে যে কেউ ভিক্ষা হিসাবেও কাবাব না দিয়ে পারতো না।
নানার আইডিয়াটা ভালো। তবে আমি তার চেয়েও অগ্রবর্তী।
প্রথমবার প্যারিস সফরেই সেখানকার বাঙালীরা আমাকে অনুরোধ করেছিলো প্যারিসে থেকে যেতে । আমি থাকলে না-কি প্রচুর ইনকাম করতে পারবে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী কারণে?
তারা জবাবে বললো, প্যারিসে বিশেষ চেহারার লোক ছাড়া ভিক্ষা করে সফল হওয়া কঠিন। আমার চেহারায় না-কি ভিক্ষুকের সেই বিশেষ লুক আছে। প্যারিসের মেট্রো নেটওয়ার্ক ইউরোপের মধ্যে সর্ববৃহৎ। যে কোনো স্টেশনে সর্বোচ্চ কামাই এই বিশেষ চেহারার লোকদের জোটে।
তাদের এই মন্তব্যের যথার্থতা কী, জানি না। তবে প্যারিস থেকে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম যাওয়ার পথে ট্রেনে এক ডাচ কাম ফরাসি নারীর সাথে পরিচয় হলো। বয়স্ক। ফরাসিরা ইংরেজি বলতে অপছন্দ করে। ইনি সেই দলের না। ভদ্রমহিলা যাবেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি রটারড্যাম-এ। ট্রেন থেকে নামার আগে আমার হাতে এক গিল্ডার (ডাচ মুদ্রা) দিয়ে বললেন, আমস্টারডাম নেমে কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করো।
টাকাটা হাতে নিয়েই আমার ভিক্ষুকের বিষয়টা মনে হলো।
ভদ্র মহিলাকে বললাম, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি–কসম করেন, সত্যি উত্তর দিবেন।
উনি বললেন, কসম।
তোমার সাথে মিথ্যা কেন বলবো?
আপনি আমাকে যে ডাচ মুদ্রা দিলেন, এটা কি ভিক্ষা হিসাবে দিয়েছেন? আপনার সাথে তো আমার আর দেখা হবে না; এই টাকা ফেরত দিবো কীভাবে?
তিনি কিড়া কসম করেই উত্তর দিলেন, তোমাকে ভিক্ষা দেইনি। যেহেতু তোমার কাছে ডাচ মুদ্রা নেই, আমস্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে সমস্যা হতে পারে। ফোন করতে হতে পারে–তখন এই গিল্ডারটা তোমার উপকারে লাগবে। তোমার সাথে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। সেই ভালোবাসা থেকেই তোমার জন্য এটি আমার শুভেচ্ছা। এটা ভিক্ষা না। ভালোবাসা।
এই লেখার মাধ্যমে আমি ভদ্রমহিলার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি।
আমাদের সামনে তিন ধরনের বিশাল পিৎজা। চিকেন, বিফ এবং সীফুড মিক্সড। সবাই মজা করে খাচ্ছে। বরফের কোল্ড বক্স থেকে কোক বের করলো তন্ময়। সাবৃনা কাকুকে বললো, খাবারের ছবি তুলে দিতে। বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু হয়েছে।
চাচি বললেন, তাড়াতাড়ি ওঠো।
আমরা এখন কোথায় যাবো?
লাইট হাউস, ওয়াটসন বে… তবে সবার আগে দেখবো মাল্টি মিলিওনিয়ারদের হাউস।
সরল বাংলায় অস্ট্রেলিয়ার কোটিপতিদের বাড়ি।
আমরা বনদাই ছেড়ে গাড়িতে উঠলাম আরেক গন্তব্যেও উদ্দেশ্যে।
No comments:
Post a Comment