চরমপন্থা বা গোঁড়ামী বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলী থেকে উৎপন্ন হয়নি। এর অবশ্যই কারণ ও
উদ্দেশ্য আছে। সকল প্রণীর মতো ঘটনা ও কার্যাবলী ও শূন্য থেকেউদ্ভব হয় না-
বীজ ছাড়া যেমন চারা হয় না। প্রতিটি ঘটনার পেছনে থাকে কার্যকারণ। এটা
আল্লাহর সৃষ্টিরও রীতি (সুনাম)। কোনো রোগের প্রতিকার করতে হলে প্রথমে দরকার
রোগ নির্ণয় (ডায়াগনোসিস)। আবার এর জন্যে অত্যাবশ্যক হচ্ছে রোগের কার গুলো
জানা আর কারণ জানা না গেলে রোগের ডায়াগনোসিস অসম্বম- অন্তত খুব কষ্টকর। এ
কথা স্মরণ রেখেই আমরা চরমপন্থর (গোড়ামীর) কারণ ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ে প্রয়াসী
হবো। এখানে চরমপন্থা শব্দটি গুলু অর্থাৎ ধর্মীয় বাড়াবড়ির সমার্থবোধক।
প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, কোনো একটা মাত্র কারণ গোঁড়ামী বিস্তারের জন্যে সামগ্রিকভাবে দায়ী নয়। এটা একটা জটিল অদ্ভুত বিষয়। এর পেছনে নানা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি প্রত্যক্ষ, কোনোটি পরোক্ষ, কোনোটির গোড়া সূদুর অতীতে আবার কোনোটির উৎপত্তি বর্তমানে। সুতরাং একটি বিশেষ কারণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অনান্য কারণগুলো উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কোনো কোনো মতের প্রবক্তারা এরূপ একপেশে দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণে অভ্যস্ত। উদাহরণস্বরূপ মনোবিজ্ঞানী, বিশেষত মনস্তত্ত্ববিদরা অবচেতন মন থেকে উদ্ভূত কারণগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানীরা সামজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের মুখে মানুষের অসহায়ত্বের দিকে ইঙ্গিত দেন। তাদের দৃষ্টিতে মানুষ হচ্ছে সমাজের হাতে বন্দী প্রাণহীন পুতুল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রবক্তারা যুক্তি দেখান, অর্থনৈতিক শক্তিই ঘটনাবলীর স্রষ্টা এবং এটাই ইতিহাসের গতডি পরিবর্তন করে।
পক্ষান্তরে আরেক দল অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও ভারসাম্যময় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তাদের মতে কারণসমূহ অত্যাধিক জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এগুলো নানবিধ ক্রিয়া উৎপন্ন করে এবং একটা থেকে আরেকটার রূপ ভিন্ন। কিন্তু শেষ বিশ্লষণে এগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। গোঁড়ামির কারণসমূহ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা সবগুলোর সমন্বয়ও হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অথবা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সমাজে অথাৎ সেই সমাজের বিশ্বাস ও আচরণ,কল্পনা ও বাস্তব, ধর্ম ও রাজনৈতিক, কথা ও কাজ, আকাঙ্ক্ষা ও সাফল্য অথবা দ্বীন ও দুনিয়ার অসংগতির মধ্যে এর কারণসমূহ বিদ্যমান থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এসব পরস্পর বিরোধিতা বৃদ্ধরা মেনে নিলেও তা সাময়িকমাত্র।
ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতির দরুনও চরমপন্থা বিস্তার লাভ করতে পারে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থপরতা, তোষামোদপ্রিয়তা, মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের প্রতি সেবাদাসবৃত্তি, স্বদেশের জনগণের অধিকার হরণ ইত্যাদি মানুষের মাঝে চরমপন্হী মনোভাবের জন্ম দেয়। মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ শেষ পযর্ন্ত ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
গোঁড়ামির আরেকটি প্রধান কারন হচ্ছে, দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অথাৎ এর উদ্দেশ্যে ও মূল চোতনার গভীর তাৎপর্য উপলদ্ধিতে ব্যর্থতা। এই উপলদ্ধির অর্থ সার্বিক অজ্ঞাতাকে বোঝায় না। সার্বিক অজ্ঞতা বাড়াবাড়ি বা গোঁড়ামির জন্ম দেয়। আসলে অল্পবিদ্যা হচ্ছে ভয়ঙ্করী। এসব লোক মনে করে সেসব কিছু জানে এবং নিজেই যেন ফকীহ। আসলে সে নানা অজীর্ণ জ্ঞানের জগাখিচুড়ি। সে বিভিন্ন খন্ডের রূপ এবং তার সাথে অখন্ডের সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যার্থ। ফলে তার সামগ্রিক দৃষ্টভঙ্গি কখনো পরিচ্ছন্ন হতে পারে না। অতএব তার পক্ষে কনো সুনির্দৃষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব। এমন ব্যক্তি যদি নিজেকে ফকীহ বলে দাবী করে তাহলে দীনের অবস্থা কী হবে! ইমাম আবু ইসহাক আশ-শাতিবী তার আল-ইতিশাম গ্রন্থে অল্পবিদ্যার বিপদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। বিদআত এবং মুসলিম উম্মাহর অনৈক্যের মূল কারণ হলো আত্মজ্ঞানের অহঙ্কার, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে মনে করে কেউ যখন ইচ্ছা মাফিক ইজতিহাদ শুরু করে রায় দিতে থাকে তখন তাকে অবশ্যই মুবতাদী ( নতুন কিছু উদ্ভাবনকারী) বলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) এ ধরনের লোক সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন: “আল্লাহ জ্ঞান কেড়ে নেন না জনগনের (হৃদয়) থেকে। কিন্তু যখন কোনো আলিম থাকে না তখন তিনি তা কেড়ে নেন এবং জনগণ অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের নেতা বানাবে যারা জ্ঞান ছাড়াই রায় দেবে, সুতরাং তারাও বিপথগামী হবে, জনগণকেও বিপথগামী করবে।” (বুখারী)
এ থেকে বিজ্ঞাজনেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, খাঁটি আলিমরা জনগণকে বিভ্রান্ত করেন না। কিন্তু তাদের অভাবে আলিমের বিশ্বাসভাজন কখনোই বিশ্বাস ভঙ্গ করে না, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক তা পারে। এর সাথে যোগ দিয়ে বলা যায় খাঁটি আলিম কখনোই বিদআতের জন্ম দেয়। আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, রাবিয়া একদিন খুব কাঁদছিলেন। তার ওপর কোনো মুসিবত এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “না, এ জন্যে কাঁদছি যে, মানুষ তাদের কাছ থেকে ফতোয়া তালাশ করেছে যাদের কোনো জ্ঞান নেই।”
বস্তুত সার্বিক অজ্ঞতার চেয়ে অহংকারযুক্ত অল্পবিদ্যার পন্ডিত কখনোই তার সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে না। এদের একটি লক্ষণ হলো এরা আক্ষরিক অর্থের প্রতি বেশী জোর দেয়, তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য উপলব্ধির চেষ্টা করে না। আলজাহিরিয়া মতাবরম্বীরা এ ধরনের পণ্ডিতী করতো। তারা আত-তালিল ও কিয়াস অগ্রাহ্য করতো।
“সমকালীন জাহিরিয়া” মতালম্বীরা পূর্বসূরীদের পথ ধরে যুক্তি প্রদর্শন করে যে, বাধ্যতামূলক কাজকর্মের কোনো গভীর অর্থ খোঁজা উচিৎ নয়। অবশ্য নব্যজাহিরিয়ারা পূর্বসূরীদের মতো তালিল পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে না। আমার ও অন্যান্য আলিমের মতে ইবাদত হচ্ছে এমন বাধ্যতামূলক কর্তব্য যার কারণ ও উদ্দেশ্য কখনোই বিশ্লেষণযোগ্য নয়। তবে যেসব শিক্ষা আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রন করতে চায় সেগুলো অবশ্যই বিশ্লেষণ করতে হবে।
সুতরাং কোনো মুসলমান দান-খয়রাত করে বলে তার হজ্জ করা উচিত কিংবা হজ্জের সময় কুরবানীর অর্থ সদকা করে দেয়া উচিত-এই দাবী করা ভুল হবে। তেমনিভাবে এটাও অচিন্তনীয় যে, আধুনিক কর যাকাতের স্থান দখল করবে, রমযানের পরিবর্তে অন্য যে কোনো মাসে রোযা কিংবা শুক্রবারের স্থলে অন্য যে কোনো দিন জুমআ’র নামায আদায় করা যাবে। এসব বাদ দেওয়া যাবে না। এগুলো সবই মুসলমানের জন্যে অবশ্য পালনীয়। কিন্তু এ ধরনের আনুষ্ঠানিক ইবাদত প্রক্রিয়া ব্যতীত অন্য যে কোনো বিষয়ের কারণ ও উদ্দেশ্য আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সঠিক উপলব্ধির পর ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
এখন আমরা কতিপয় প্রামাণিক বিষয় পর্যালোচনা করতে পারি:
ক. একটি বিশ্বস্ত হাদীসে বলা হয়েছে, কাফিরের দেশে কুরআন শরীফ নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, কাফিররা কুরআনের ক্ষতি বা অবমাননা করতে পারে এই আশংকায় রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ আদেশ দিয়েছেন। এরূপ আশংকা না থাকলে যেখানে ইচ্ছে কুরআন শরীফ নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া দাওয়াতী কাজের জন্যে এটা তো অপরিহার্য।
খ. আরেকটি হাদীসে মাহরাম (অথাৎ বিষয় অযোগ্য পুরুষ আত্মীয়) সঙ্গী ছাড়া মুসলিম নারীকে সফর করতে নিষেধ করা হয়েছে। নারীর নারাপত্তা ও সফরের কষ্ট লাঘবই এর উদ্দেশ্য। আধুনিক যুগে যেহেতু সফরের এতো ঝুঁকি নেই তাই কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে গাড়িতে তুলে দিতে পারেন। গন্তব্য স্থানে কোনো মাহরাম ব্যক্তি তাকে স্বাগত জানালে দোষের কিছু নেই। বস্তুত রাসূলুল্লাহ (সা) যোগাযোগ ব্যবস্থার এরূপ উন্নতির আভাস দিয়ে বলেছিলেন, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করেই ইরাক থেকে মক্কা ভ্রমন করতে পারবে।
গ. রাসূলুল্লাহ (সা) দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর রাতে বাড়ি ফেরা নাষিদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেও সক্লে বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। এর দু’টো কারণ। প্রথম, আকস্মিকভাবে স্বামীর রাতে বাড়ি ফেরার মধ্যে স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস ইসলাম সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত, স্ত্রী যেন নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে পারে সে জন্যে স্বামীর আগমনের সময় জানার অধিকার তার আছে। কিন্তু এখন এসব আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ খুব কম। মানুষের যাতায়াতের সময়সূচী মেনে চলতে হয়। কে কখন কোথায় যাবে তা আগেভাগেই নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বাড়ি যাওয়া আগে টেলিফোন বা চিঠিতে জানানো উচিত। সুতরাং আমাদেরকে স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে উক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণ ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করতে হবে।
যাকাতকে ইবাদত মনে না করে অনেকে এটাকে কেবল অর্থ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গণ্য করতে চান। যাকাত ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ধর্মীয় কর্তব্য। এটা ইসলামী শরীয়ত ব্যবস্থার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও স্থায়ী আয়ের সূত্র, সেই হিসেবে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থারও স্তম্ভ। তাই এটার বাধ্যবাধকতাকে খর্ব করার কোনো উপায় নেই। যাকাতের সামাজিক সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য করে সকল মাযহাব-এর আহকামের ব্যপারে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ফসলের (ফল ও শস্য) দ অথবা পাঁচ ভাগ গরীবদের দান করা বাধ্যতামূলক- সে ফসল শুকনোই হোক আর তাজা হোক। সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে - এর মূল লক্ষ্য। ধনীর সম্পদে গরীবের সুনির্দিষ্ট হিস্যা আছে। আর এর লক্ষ্য হচ্ছে পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা: “তাদের সম্পদ থেকে তুমি সাদকা গ্রহন করো। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবে।”
একজন আধ্রনিক পন্ডিত “খাদ্যশস্যের ওপর সাদকা নেই” এই হাদীস উদ্ধৃত করে উপরোল্লিখিত যুক্তি অস্বীকার করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে খাদ্যশস্যের ওপর যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল না বলেও তিনি দাবী করেন। কিন্তু হাদীসটি দুর্বল বিধায় তার যুক্তি মিথ্যা এবং বলেছেন এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো প্রামাণিক হাদীস নেই। দ্বিতীয় যুক্তিটিও দু’টি কারণে মিথ্যা। প্রথম কারণ, ইমাম ইবনুল আরবীর ভাষায় এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে বর্ণিত সুস্পষ্ট বিধানের মুকাবিলার অন্য কোনো প্রমাণ অগ্রাহ। কুরআন বলছে : “মৌসুমের ফলমূল থেকে খাও ; কিন্তু ফসল সংগ্রহের দিনে ন্যায্য হিস্যা দান করে দাও।” (৬ : ১৪১)
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় এ ব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে, তিনি হয়তো বিষয়টি তাঁর উম্মতের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। কেননা সে যুগে ফলমূল ও খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা কষ্টকর ছিলো।
অবশ্য উক্ত পন্ডিত স্বীকার করেছেন যে, একটি হাদীসে কেবল খেজুর, গম, কিসমিস ও বার্লির ওপর যাকাত সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ হাদীসটিও দুর্বল এবং কোনো কোন হাদিস বিশারত এর প্রামাণিকতা স্বীকার করেননি বিধায় কোনো মাযহাব একে প্রমাণিক বলে গ্রহণ করেনি। সুতরাং সকল ফলসের ওপর যাকাতের বাধ্যতামুলক বিধানকে কিভাবে অস্বীকার করা যায় যখন কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে : “তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট খাদ্য শস্য, জলপাই ও ডালিম র্সষ্টি করেছেন। এগুলো একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও। যখন এটা ফলবান হয় তখন ফল খাবে আর ফসল তুলবার দিনে এর দেয় প্রদান করবে। ” (৬:১৪১)
আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে: “হে ইমানদারগন, তোমরা যা কিছু উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদান করে দিই তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো।” (২:২৬৭)
একটি প্রমানিক হাদীসেও যাকাত প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “নদী অথবা বৃষ্টির পানি বিধৌত জমি থেকে এক-দশমাংশ; (সেচের) পানি সিঞ্চিহত জমি থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ ।” (ইমাম আবু হানিফা: আহকামুল কুরআন) এই হাদীসে কোনো বিশেষ ফসলের মধ্যে যাকাতকে সীমিত করা হয়নি। এখানে বাধ্যতামূলক হার পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে উমর ইবনে আবদুল আজিজ ও ইমাম আবু হানিফা (রহ) এ ব্যাপারে কুরআনী আয়াতের (৬:১৪১)
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ)-র মতগুলোকে অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ় বলে উল্লেখ করেছেন। অনান্য মাযহাবের প্রমাণগুলোকে দুর্বল আখ্যায়িত করে ইবনুল আরবী (রহ) বলেছেন, “ আবু হানিফা (রহ) (পূর্বোউল্লিখিত) মূল সূত্রগুলোকে আয়নার মত ব্যবহার করেসত্যকে অবলকন করেছেন।” শরাহ আত-তিরিমিযীতে আরবী (রহ) বলেন, “(যাকাতের ব্যাপারে) আবু হানিফা (রহ)-এর মাযহাব সূদৃঢ় প্রমাণ পেশ করেছে।” আহকাম ও তাদের কারনগুলোর মধ্যেকার সঙ্গতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে মারাত্মক স্ববিরোধিতার আশংকা থাকে। তখন আমরা একই বিষয়কে ভাগ ভাগ করে দেখি। আবার বিভিন্ন বিষয়কে এক করে ফেলি। এটা হচ্ছে সুবিচারের পরিপন্থী যার ওপরে আশ-শারীরাহ প্রতিষ্ঠিত পাণ্ডিত্যভিমানীরা কোনো জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি ছাড়াই আহকামের কারন খুঁজতে গিয়ে বিষয়গুলোকে জটিল করে তোলেন। এ জন্যে জনগণের কছে সত্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে অথবা বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যে ইজতিহাদের দ্বার খুলে দিতে হবে। সেই অনধিকার চর্চাকারী পরজীবীদের বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকা দরকার।
এটা দুঃখজনক যে, যারা এ ধরনের বিতর্ক ও সংঘাতের সূত্রপাত করেন তারাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধি পালনে উদাসীন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাতা-পিতার প্রতি কতব্য, স্ত্রী ও সন্তান প্রতিপালন, প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব, সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন, বৈধ ও অবৈধ বিচারে সতর্কতা ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু তারা নিজেদের মান উন্নত করার পরিবর্তে বিতর্ক সৃষ্টি করে খুব মজা পান। শেয় পর্যন্ত তাদেরকে এর দরুন বৈরিতা অথবা মুনাফিকীর ন্যায় আচরণ করতে হয়। একটি হাদীসে এরূপ বাক-বিতন্ডার কথা উণ্ণখ করা হয়েছে : “যারা (সঠিক) পথ পেয়েছে তারা কখনো বিভ্রান্ত হবে না যতক্ষন না তারা বাক-বিতন্ডায় নিমজ্জিত হয়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) এ রকমও দেখা যায়, কেউ কেউ আহলে কিতাবদের জবাই করা পশুর গোশত মুসলমানদেরকে খেতে নিষেধ করেন যদিও বর্তমান ও অতীতে এর বৈধ হওয়া সম্পর্কে ফতোয়া আছে। অথধচ এ রকম লোকদেরই দেখা যাবে এর চেয়ে বড় বড় নিষিদ্ধ কাজ করতে তারা সিদ্ধহস্ত। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের একটা ঘটনার কথা আমি শুনেছি। এক ব্যক্তি খুব বড় গলায় বলছিল ইহুদী ও খৃষ্টানদের জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। কিন্তু সে নির্লজ্জের মতো অন্যদের সাথে একই টেবিলে বসে মদ সহযোগে ঐ গোশত ভক্ষণ করছিলো। অথচ সে নির্দ্বিধায় একিট অনিশ্চত ও বিতর্কিত বিষয়ে গোঁড়া বক্তব্য রাখছিলো। ঠিক এ রকম পরস্পর বিরোধী আচরণ দেখে একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। হযরত হুসাইনের (রা) শাহাদাতের পর ইরাক থেকে এক ব্যক্তি এসে তাকে মশা মারা হালাল কি হারাম জিজ্ঞেস করলো। ইমাম আহমদ তাঁর মসনদে বর্ণনা করছেন:
আমি ইবনে উমরের সাথে বসেছিলাম । একিট লোক এসে তাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞস করলো। ইবনে উমর (রা) তাকে বললেন, “তুমি কোত্থেকে এসেছ?” সে জবাব দিল, “ইরাক থেকে।” তখন ইবনে উমর বললেন, “দেখ লোকটির দিকে! সে আমাকে মশার রক্ত সম্পর্কে প্রশ্ন করছে, অথচ তারা (ইরাকিরা) রাসূলুল্লাহ (সা)- এর পৌত্রকে [আল-হুসাইন ইবনে আলী (রা)] হত্যা করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) - কে বলতে শুনেছি : “তারা (হাসান ও হুসাইন) এই জগতে আমার দু’টি মিষ্টি মধুর সুরবিত ফুল।” (আহমাদ)
“তোমাদের মুখ থেকে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটি হালাল এবং ওটি হারাম।” (১৬: ১১৬)
রাসূলুল্লাহ (সা) - এর সাহাবী এবং প্রাথমিক যুগোর বুজর্গানে দ্বীন নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত কনো জিনিসকে নিষিদ্ধ বা হারাম বলে ফতোয়া দিতেন না। কিন্তু চরমপন্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে হারাম ফতোয়া দিতে যেন এক পায়ে খাড়া থাকে। ইসলামী আইনশাস্ত্রে কোন বিষয়ে যদি দুটো মত থাকে যদি এক পক্ষ বলে মুবাহ, আন্য পক্ষ বলে মাকরূহ; চরমপন্থীরা এক্ষেত্রে মাকরূহকে সমর্থন করে পরহেযগারী যাহির করে। এক পক্ষ যদি একটি বিষয়কে মাকরূহ এবং অন্য পক্ষ হারাম বলে ঘোষণা করে সে ক্ষেত্রে গোঁড়া ব্যক্তিরা হারামের পক্ষ নিয়ে সাধুতার প্রমাণ রাখতে চায় অর্থাৎ সহজ ও কঠিনের মধ্যে তারা শেষোক্তটাকে বেছে নেয়াই অধিকতর তাকওয়ার লক্ষণ বলে মনে করে। তারা ইবনে আব্বাসের (রা) কঠোর মত গ্রহণে বেশি আগ্রহী। বস্তুত এই প্রবণতা মধ্যমপন্থার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই ফসল। বিষয়টি বোঝায় সুবিধার্থে আমি একটি প্রত্যক্ষ ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
একদিন এক গোঁড়া লোক অপর এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে দেখে তার পাক সাফ হওয়ার জন্যে তৎক্ষণাৎ বমি করতে বলল। আমি তখন গোঁড়া লোকটিকে নম্রবাবে বললাম, “এজন্য এতো কঠোর ব্যবস্থার দরকার পড়ে না। এটা একটা চোট ব্যাপার।” সে বলল, হাদীসে এটা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি ভুলক্রমে করে বসে তবে সহীহ হাদীসে বমির বিধান আছে।” আমি জবাব দিলাম, “কিন্তু দাঁড়িয়ে পানি খাওয়ার পক্ষে যে হাদীস আছে তা অধিক প্রমাণিত এবং বুখারীর একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম হলো, “দাড়িয়ে পানি পান করা।” ঐ ব্যক্তি নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোনো হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে পারলো না । অথচ এটা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের সময় দাঁড়িয়ে পানি পান করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম)
এছাড়া একবার হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে করতে বলেছিলেন, “এটা অনেকেই পছন্দ করে না, কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এরূপ করতে দেখেছি যেমন তোমরা আমাকে দেখছ।” (বুখারী, মুসলিম)
ইবনে উমরের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে ইমাম তিরমিযী বলছেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে আমরা চলন্ত অবস্থায় খাবার খেতাম এবং দাঁড়িয়ে পানি পান করতাম।” কাবশাহ (রা) বলেন, “আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সা) -কে ঝুলন্ত মশক থেকে পানি পান করতে দেখেছি।”
মোটকথা নির্ভরযোগ্য হাদীস বিশারদদের ব্যাখ্যা থেকে আমরা দেখতে পাই বসে পানি পান করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ নেই। আর দু’টো ব্যাপারই প্রমাণিত। অতএব, কেউ দাঁড়িয়ে পান করলেও নিষেধ নেই। কেউ দাঁড়িয়ে পানি পান করলেই বমির বিধান জারি করাটা সম্পুর্ণ ভুল।
একইভাবে, আজকাল অনেক তরুণ ইসলামী পোশাক নিয়ে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত। হাদীসে এর দৃঢ় ভিত্তি আছে: “(পোশাকের) যে অংশ গোঁড়ালির নিচে (ঝুলে থাকে) তা আগুনে (পুড়বে)।” (বুখারী)
এ জন্য অনেক তরুণকে গোঁড়ালির উপরে পোশাক পরতে দেখা যায় এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের উপরেও এটা চাপাতে চায়। কিন্তু এরূপ চাপাচাপির ফলটা এই হবে যে, একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই গোঁড়ামির অভিযোগ আনবে। এটা সত্য যে, কিছু হাদীসে গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আবার অন্য হাদীসে এই নিষেধাজ্ঞার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। একদা এভাবে কাপড় পরাকে অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও অপচয়ের লক্ষণ মনে করা হতো। দৃষ্টান্তস্বরুপ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সেই ব্যক্তির দিকে থাকবেন না যে অহঙ্কারবশত তার কাপড়কে (পেছনে) টেনে নিয়ে যায়।” (মুসলিম)
হযরত আবু বকর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, “আমার ইজার অসাবধানতাবশত নিচে নেমে যায়।” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন “যারা গর্বোদ্ধত হয়ে এরূপ করে তুমি তাদের মধ্যে নও।” (বুখারী) এ কারনে আন-নববী ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীরা তম প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ কাপড় পরা মাকরূহ। কিন্তু মাকরূহ অনিবার্য কারণে মুবাহ হতে পারে।
কুরআনে এই ঈমান সম্পর্কে বলা হয়েছে :
“মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি করে দেয়।”(৮:২)
“ সেসব ঈমানদারই সফলকাম হয়েছে যারা বিনয়াবনত চিত্তে নামায আদায় করে।” “তারাই ঈমানদার যারা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তারপর কখনোই সন্দেহ পোষন করেনি এবং আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে লড়াই করেছে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (৪৯: ১৫) নিম্মোক্ত হাদীসেও ঈমানের এই রূপ তুলে ধরা হয়েছে:
“যারাই আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর ঈমান এনেছে তাদের উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ... যা ভাল তাই তাদের বলা উচিত নতুবা চুপ থাকা (উত্তম)।” (বুখারী)
আরেকটি হিদীসে ঈমানের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে : “সেই ব্যক্তি ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না সে তার (মুসলমান) ভাইয়ের জন্যে তাই ভাল মনে করবে যা সে তার নিজের জন্য ভাল মনে করেব।” (বুখারী)
এখানে লক্ষণীয়, শোষোক্ত হাদীসে দু’টিতে ঈমানের নেতিবাচক রূপ তুলে ধরে প্রকুতপক্ষে ঈমানের পূর্ণ রূপ তুলে ধরা হয়েছে।; সেরূপ ঈমান নয় যেমন বলা হয়: “যে তার জ্ঞান কাজে লাগায় না সে বিদ্বান নয়।” এখানে সীমিত জ্ঞান নয়, বরং পূর্ণ জ্ঞানের নেতিবাচক দিকটির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই হাদীসেও পূর্ণ ঈমানের পরিচয় বিধৃত হয়েছে: ঈমানের সত্তরটি শাখা আছে, তার মধ্যে একটি শাখা হচ্ছে লজ্জা বা হায়া। ইমাম আবু বকর আল-বয়হাকী তাঁর ‘আল -জামি’লী শুয়াব আল- ঈমান’ কিতাবে ঈমনকে একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছেন। গাছের কান্ড হচ্ছে ঈমানের মৌলিক অঙ্গের প্রতীক। যেহেতু গাছ এর কিছু শাকা-প্রশাখা নিয়ে ইসলামের আওতায় তাকতে পারে। ফেরেশ্তা ও তকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।”
আল-হাফিজ আল-বায়হাকী ফতহুল বারীতে লিখেছেন: “আমাদের বুজর্গ পূর্বপুরুষরা বলেছেন : ঈমান হলো হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপন, মুখে উচ্চারণ ও কর্মে রূপায়ণ। এর অর্থ বাস্তব জীবনে রূপায়ণ ছাড়া ঈমান পূর্ণ হতে পরে না। এ জন্যে তারা মনে করতেন ঈমান বাড়াতে ও কমাতে পারে। আল-মাজিয়াহ মনে করেন, ঈমান শুধু মনে ও উচ্চারণে; আল-করামিয়াহ বিশ্বাস করেন , উচ্চারণই যথেষ্ট; আল-মুতাযিলাহর ধারণা, ঈমান হলো বিশ্বাস, উচ্চারন ও বাস্তাবায়নের সমন্বত রূপ।... এ ব্যাপারে তাঁদের ও পূর্ববতী বুজর্গদের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে, পূর্বোক্তরা আমলকে ঈমানের প্রমাণ হিসেবে মনে করেন। আর শেষোক্তরা আমলকে পূর্ণতার শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পূর্ণ সত্তা কেবল আল্লাহ তায়ালাই। আমাদের কাছে ঈমানের মৌলিক ঘোষণাই যথেষ্ট। কেননা পরিপূর্ণ পরম সত্তা কেবল আল্লাহ জাল্লা জালালুহু। একবার যে মুখে ঈমানের ঘোষনা দেয় তখন থেকেই আল্লাহ শানুহুর দৃষ্টিতে তাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করা হয। যতোক্ষণ না সে এমন আচরন করে যাতে মনে হয় সে বেঈমান, যেমন মূর্তির কাছে মাথা নত করা। কেউ যখন পাপ কাজ করে তখন তাকে আমরা ঈমন সংক্রান্ত স্ব স্ব ধারণার আলোকে ঈমানদার ভাবতে আবার নাও ভাবতে পারি। পূর্ণ ঈমানদার। কারো বিরুদ্ধে যদি কাফির হওয়ার অভিযোগ ওঠে তবে এ কারণেই যে সে কুফরীর আচরণ করে।’
একজন কাফির যখন এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল, তখুনি সে মুসলমান হয়ে যায। তৎখণাত সে নামায আদায় করলো কিনা সেটা বড় কথা নয়। যাকাত ইত্যাদি এগুলো সে মেনে নিলো সেটাই বড় কথা। আমল কতটুকু করলো সেটা পরে লক্ষণীয়। কালেমার মৌখিক উচ্চারণের সাথে সাথেই সে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যারা কালেমা (শাহাদাত) উচ্চারণ করলো, তারা আমার কাছ থেকে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেলো... তাদেরকে আল্লাহর কাছেই জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী)
ইসলাম শব্দটিও ইবনে উমর (রা) বর্নিত পাঁটি স্তম্ভেকেই বোঝায়: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত - এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল; নামায আদায় করা যাকাত দেয়া, রোজা রাখা এবং হজ্জ আদায় করা।” হাদীস শাস্ত্রেও জিবরাঈল (আ)-এর মুখে ইসলামের সংঙা দেয়া হয়েছৈ। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন তাঁকে বলেন, “ইসলাম কী?” তখন তিনি বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা, নামায আদায় করা যাকাত দেয়া এবং রমযান মাসে রোজা রাখা।” (বুখারী)
জিবরাঈল (আ) এর কথা থেকে আমরা ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য বুঝতে পারি। এটাও পিরষ্কার যে, দু’টি শব্দকে এক অর্থেও ব্যবহার করা যায়। দু’টির একত্র সমাহারে দেখা যাবে একটির মধ্যে আরেকটির অর্থ লুক্কায়িত আছে, অথাৎ ঈমান ছাড়া ইসলাম নেই। ইসলাম ছাড়া ঈমান নেই। ঈমনের স্থান হৃদয় কন্দরে আর ইসলামের রূপায়ণ হচ্ছে আবেগ ও আচরণের সংমিশ্রণে। নিম্মোক্ত হাদীস থেকে আমরা এটাই উপলব্ধি করতে পারি: “ইসলাম হচ্ছে প্রকাশ্য আর ঈমান হচ্ছে অন্তরে (বিশ্বাসের বিষর)।”(আহমদ, আলবাজ্জাজ)
ঈমানের এই সংজ্ঞা আমরা কুরআনেও দেখতে পাই : “বেদুঈনরা বলে, ‘আমরা ঈমান আনলাম; বল, তোমরা ঈমান আননি বরং, তোমরা বল, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি, কেননা তোমাদের হৃদয়ে এখনও ঈমান প্রবেশ করেনি।” (৪৯:১৪)
আর ইসলামের পূর্ণ পরিচয় দিয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: “ইসলাম হলো (সেই অবস্থা) যখন তোমার হৃদয় (সম্পূর্ণরূপে) আল্লাহ্ র কাছে সমর্পিত হয় এবং যখন তুমি মুসলমানদেরকে তোমার যবান ও হাত দিয়ে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকো।” অন্য দু’টি হাদীসেও বলা হয়েছে: “সেই হচ্ছে মুসলমান যার যবান ও হাত দিয়ে অন্য মুসলমানের ক্ষতি হয় না” এবং তুমি নিজের জন্য যা ইচ্ছে করো অপরের জন্যে তাই করলেই তুমি মুসলমান।”
ফিকাহর ভাষায় কুফরের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর কালামের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও অস্বীকৃতি। আল-কুরআনে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়: “কেউ আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং কিয়ামত দিবমকে অস্বীকার করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (৪:১৩৬)
কুফর রিদ্দাকেও বোঝায় ফলশ্রুতিতে ঈমান সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়: “কেউ ঈমান ত্যাগ করলে তার আমল নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত হবে।” (৫:৫)
“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন দ্বীন থকে ফিরে যায় এবং বেঈমান হয়ে মরে যায়, ইহকালে ও পরকালে তাদের আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারাই দোযখী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” (২:২১৭) কুফরের অর্থ সীমালংঘনও হয় যা পুরোপুরি ইসলামকে প্রত্যেখানের শামিল নয়, কিংবা আল্লাহ্-রাসূলের অস্বীকৃতিও বোঝায় না।
মনষী ইবনুল কাইয়েম কুফরকে ছোট ও বড় এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। বড় কুফরের শাস্তি স্থায়ী জাহান্নাম আর ছোট কুফরের শাস্তি জাহান্নমের অস্থায়ী বাস। একটি হাদীস লক্ষণীয় : “আমার উম্মাহর মধ্যে কুফরীর দু’টি (লক্ষণ) প্রচলিত আছে: “বংশ পরিচয় কলংকিত করা এবং মৃত্যে জন্য বিলাপ” এবং কেউ যদি গণকের খৌঁজ করে এবং তাকে বিশ্বাস করে তবে সে মুহাম্মদ (সা)-এর অবতীর্ণ ওহীর সাথে কুফরী করে।” হাদীসে আরো বলা হয়েছে: “(আমার পরে) পরস্পরকে হত্যা করে কুফরীর দিকে ফিরে যেয়ো না।” কুরআনের একটি আয়াতের এটা হচ্ছে ইবনে উমর (রা) ও অনান্য বিশিষ্ট সাহাবীর ব্যাখ্যা, আয়াতটি হচ্ছে: “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অবিশ্বাসী।” (৫:৪৪) আয়তটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “এটা সেই কুফরী নয় যা একজনকে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত করে, বরং এটি হচ্ছে কুফরীর একটি উপাদান; কারণ যে ব্যক্তি এরূপ করে সে আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে অবিশ্বাস করে না।” তাউস একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। আতা বলেন, এটা হচ্ছে কুফর অথবা অন্যায় অথবা ফিস্ ক যা অপরটির চেয়ে ছোট অথবা বড় হতে পারে। ইকরামার মতো অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন: আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার করে না তারা কুফরী করে। কিন্তু এই যুক্তিটা দুর্বল। কারণ এক ব্যক্তি শরীয়াহর আলোকে বিচার করুক আর নাই করুক, নিরেট অস্বীকৃতিই কুফর। এ প্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়েম বলেন: আল্লাহ্র বিধানের পরিপন্থী বিচার বিবেচনার মধ্যে ছোট ও বড় দুই ধরনের কুফরী হয়ে থাকে। আর এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যদি সে বিশ্বাস করে যে, বিচার আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ীই হতে হবে এবং শাস্তির সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তা করা থেকে বিরত খাকলো তাহলে সে ছোট কুফরী করে। কিন্তু যদি কোন বিশ্বাসী মনে করে যে, এটা বাধ্যতামূলক নয় এবং ঈমানের পরিপন্থী যা খুশী তাই করতে পারে তাহলে সে বড় পাপ করে। কিন্তু যদি সে অজ্ঞতা ও অনিচ্ছাবশত ভুল করে বসে তবে তাকে কেবল “ভুল করেছে” এতটুকু বলা যাবে।
যা হোক বিষয়টির সারাংশ হচ্ছে, সকল সীমালংঘন ছোট কুফরের লক্ষণ, এই অর্থে অকৃতজ্ঞতা; কারণ মান্য করা বা আনুগত্যের মধ্যেই কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। অতএব মানবীয় প্রচেষ্টা কৃতজ্ঞতা অথবা কুফর কিংবা এ দুয়ের মাঝখানে কোনো কিছু দিয়ে প্রকাশ পায়-প্রকৃত সত্য আল্লাহ্ পাকই জানেন।
শিরকও দু’ভাগে বিভক্ত: ছোট ও বড়। বড় শিরক হলো আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা অথবা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শিরক করা। আল-কুরআনের একটি আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক করলে তিনি মাফ করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ যাকে ইচ্ছা করেন।” (৪:৪৮)
ছোট শিরক হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা অথবা দুর্ভাগ্য সৌভাগ্য পরিণত করার জন্যে তাবিজ-তুমারের ক্ষমতায় বিশ্বাস করা। এই শিরক সম্পর্কে এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো নামে শপথ করে সে শীরক করে এবং যে তাবিজ পরে সে শিরক করে।” (আহমাদ, আলহাকিম) এছাড়া “যাদু, তাবিজ ও ম্যাসকট (কোনো কিছু কে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মানা) বিশ্বাস হচ্ছে শিরক।” (ইবনে হাবান, আলহাকিম)
নিফাকও (মুনাফিকী) ছোট ও বড়-দু’ভাগে বিভক্ত। বড় মুনাফিকী হলো হৃদয়ে কুফরী পোষণ আর বাইরে প্রতারণার উদ্দেশ্যে ঈমানের ভাব করা। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে: “মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করি, কিন্তু তারা বিশ্বসী নয়।আল্লাহ্ ও ঈমানদারদের তারা ভাঁওতা দিতে চায়। তারা নিজেদের ছাড়া কাউকে প্রতারিত করে না এটা তারা বুঝতে পারে না।”(২:১৪)
এ ধরনের নিফাকের কথা সূরা আল-মুনাফিকুনে এবং কুরআনের অনান্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিফাকের জন্যে আল্লাহ জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করেছেন।
“মুনাফিকরা তো দোযখের নিকৃষ্টতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্যে তুমি কখনো কোনো সহায় পাবে না।” (৪:১৪৫)
ছোট নিফাকের লক্ষণ হচ্ছে আল্লাহ্ ও পরকালের প্রকৃতই বিশ্বাস আছে কিন্তু মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যও আছে। ও ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হাদীস হচ্ছে:
“মুনাফিকীর তিনটি লক্ষণ: সে যখন কথা বলে, (সর্বদা) মিথ্যা বলে; যখন সে প্রতিজ্ঞা করে (সর্বদা) ভঙ্গ করে; যদি তাকে বিশ্বাস করা হয় তবে (সর্বদা) সে অসাধু বলে প্রমাণিত হবে।” (অনুমোদিত হাদীস)
“যার মধ্যে (৪টি বৈশিষ্ট্য) আছে যে নির্ভেজাল মুনাফিক, যার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে নিকাফের একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে এটা পরিত্যাগ করে: যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে; বিশ্বাস করা হলে বিশ্বাসঘাতকতা করে; চুক্তি করা হলে খেলাফ করে এবং যদি সে ঝগড়া করে তবে খুব হঠকারী, অশালীন ও অপমানজনক আচরণ করে।”( অনুমোদিত হাদীস)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবাগণ ও বুজুর্গানে দ্বীন এ ধরনের নিফাককে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন। তাঁরা বলতেন, এ ধরনের নিফাক নিফাক নিয়ে কেবল মুনাফিক ছাড়া আর কেউ নিশ্চিত বোধ করবে না, প্রকৃত ঈমানদারই কেবল যার ভয় করে।
প্রচীন বিদাতী ও গোঁড়া লোকেরা এই রূপক আয়াতগুলোকে চূরান্ত প্রমাণ বলে মনে করেছে। তারা স্পষ্ট মৌলিক বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করেছে। বর্তমান চরমপন্থীরাও তাই করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা এর আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাল-মন্দ, শত্রু-মিত্র ও কাফির-ঈমানদার নির্ধারণ করেছে। ফলে এক মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সতর্ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা- নিরীক্ষা ছাড়া কেবল রূপক আয়াতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া জ্ঞানে অগভীরতা ছাড়া আর কিছু নয়। আল-খাওয়ারিজ এভাবে আত-তাকফিরের ফাঁদে পড়েছিলো। তারা তো সকাল মুসলমানকে কাফির বলে মনে করতো কেবল নিজেরা ছাড়া। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, অথচ তারা তাঁরই সহচর ও সৈনিক ছিলো। তাদের মত পাথর্ক্যের মূল কারণ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার সাথে হযরত আলীর (রা) আপোস রফা। হযরত আলী (রা) সৈন্যদের সঙহতি ও মুসলমানদের জীবন রক্ষার জন্যে এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু আল-খাওয়ারিজ কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েআপোস অগ্রাহ করে। আয়াতটি হচ্ছে... “আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা নেই।” (১২:৪০০)
আলী (রা) তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে জবাব দিলেন, “একটি সত্য বাণী বাতিলের জন্যে ব্যবহৃত।” বস্তুত সকল আদেশ ও কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহ্ র জন্যে- এর অর্থ এই নয়- মানুষ ছোটখাট ব্যপারে শরীয়াহর কাঠামোয় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) আল-খাওয়ারিজের যুক্তি খন্ডন করেছেন। আপোস - সমঝোতা ইত্যাদি অনুমোদন করে কুরআনে যেসব আয়াত রয়েছে তিনি সেগুলোর উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতা সংক্রান্ত আয়াতে বলা হয়েছে: “তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা তার পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিয়োগ করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।” (৪:৩৫)
কোনো হজ্জযাত্রী হজ্জের পোশাকে শিকার করলে সালিশরা তার ব্যাপারেও মীমাংসা করে দিতে পারে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। কুরআন বলছে:
“হে মানদারগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা শিকার জন্তু বধ করো না; তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা বধ করলে তার বিনিময় হলো অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়বান লোক-বিনিময়ের জন্তুটি কা’বায় পাঠাতে হবে কুরবানীরূপে অথবা তার কাফফারা হবে দরিদ্রকে খাওয়ানো কিংবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে পারে।” (৫:৯৫)
অতএব কুরআন ও সুন্নাহকে গভীরভাবে ও সতর্কতার সাথে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশংকাই সমধিক। বাড়াবাড়ি ও অগভীর জ্ঞানের ফাঁদে পড়ে আজকাল এক শ্রেণীর লোক খারিজীদের মতে শরীয়াহর তাৎপর্য সঠিকভাবে বোধগম্য না হওয়ার দুণই এরূপ গোঁড়ামির উদ্ভব হয়ে থাকে। অন্যদিকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী লোক কখনোই হঠকরী আচরণ করতে পারে না। কুরআন-হাদীস সঠিক প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করলে এর সুসংলগ্ন ও সুমহান অর্থ অনুবাধন করা অসম্ভব নয়। আর এর বিপরীত পন্থায় কুরআন পাঠের অর্থ হবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় তাদের মতো “যারা কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু অর্থ তাদের হৃদয়ে স্পর্শ করে না।”
সম্ভবত এর মানে এই দাঁড়ায়- আল্লাহ ভাল জানেন- তাদের মৌখিক তিলাওয়াত শারীরিক কসরতের মতো যা কখনো হৃদয়কে প্রভাবিত করে না। এই কথাটি পূর্বে উদ্ধৃত “জ্ঞান ছিনিয়ে নেয়া” সংক্রন্ত হাদীসটির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার সাথে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর ব্যক্তব্যের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। আবু উবায়েদের ফাযায়েলে কুরআন ও ইবরাহীম আত-তায়িমীর বর্ণনার ভিত্তিতে সাঈদ আবনে মনসুরের ব্যাখ্যায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন: “একদা একাকী বসে থাকার সময় উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যারা এক রাসূলের অনুসরণ করে এবং কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে তারা কেন মতভেদে লিপ্ত হয়। উমর (রা) তখন ইবনে আব্বাস (রা)-কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এই উম্মাহ কেন মতভেদে লিপ্ত হয় যখন তারা এক রাসূল (সা) ও এক কিবলাহ্র অনুসারী?” (সাঈদ-এর সাথে “এবং একই কিতাব” কথাটি যোগ করেছেন)। ইবনে আব্বাস (রা) জবাব দিলেন: “আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা পাঠ করে ঐশী বাণীর মর্ম উপলব্ধি করেছি। কিন্তু এমন লোক আসবে যারা কুরাআন তিলাওয়াত করবে অথচ এর শানে নুযূল ও বক্তব্য বিষয় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তারা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেবে এবং মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়বে।”
ইবনে আব্বাসের (রা)-এর জবানীতে সাঈদ আরো বলেন, “প্রতিটি গ্রুপের একটি মত থাকবে, তারপর মতবেদ থেকে সংঘাত সৃষ্টি হবে।” কিন্তু সেখানে উপস্থিত উমর ও আলী (রা) তাঁর এই অশুভ ব্যাখ্যা পছন্দ করলেন না এবং তাকে ভৎসনা করলেন। কিন্তু ইবনে আব্বাস (রা) চলে যাওয়া মাত্র তার মনে হলো যে, তার কথায় কিছু সত্য থাকতে পারে। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার কথার পুনরাবৃত্তি করতে বললেন, সতর্ক বিবেচনার পর উমর (রা) ইবনে আব্বাস (রা)-এর সাথে একমত হলেন।
আশ-শাতিবী লিখেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) সঠিক ছিলেন। যখন এক ব্যক্তি একটি সূরা নাযিলের কারণ জানে তখন সে এটাও বুঝতে পারে যে, এর ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য কী। কিন্তু এ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মতভেদে লিপ্ত হয় এবং তাদের মতামতের পেছনে শারীয়াহর কোনো সমর্থন না থাকায় তারা বিভ্রান্ত হয়। এর একটি নযীর পাওয়া যায় ইবনে ওয়াহাবের বর্ণনায়: বাকির জিজ্ঞেস করলেন নাফিকে, “ইবনে উমর (রা) আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে কি চিন্তা করেন? (আল-খাওয়ারিজিকে আল-হারুরিয়াও বলা হয়। কারণ তারা হারাওয়া নামক একটি স্থানে দেখতে পান)। জবাব দিলেন, “ তিনি তাদেরকে খুব খারাপ লোক বলে মনে করেন। কুফফার সংক্রান্ত আয়াত তারা ঈমানদারদের ওপর প্রযোজ্য করে।” সাঈদ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, আল-খাওয়ারিজ যেসব রূপক আয়াতের অপব্যাখ্যা দেয় তাদের মধ্যে রয়েছে: “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।” (৫:৪৪) এর সাথে তারা জুড়ে দেয় এই আয়াতটি, তথাপি কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সংগে অন্যকে সমতুল্য করে। (৬:১)
সুতরাং তারা এই উপসংহার টানে যে, কোনো শাসক যদি ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন না করে সে কুফরী করে। আর যে কুফরী করলো সে অন্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করলো। অতএব সে শিরক করলো। আর এই ভুল বিচারের ভিত্তিতে তারা অন্যকে মুশরিকুন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং হত্যা করে। আবনে আব্বাস (রা) এই ধরনের অপব্যাখ্যা ও ভ্রান্ত ধারণার বারুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। আর এর উৎপত্তি হয় ওহীর অর্থ বুঝতে অক্ষমতার দারুন।
নাফি বলেন, যখনি ইবনে উমর (রা)-কে আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো তিনি বলতেন: “তারা মুসলমানদেরকে কুফফার ঘোষণা করে, তাদের রক্তপাত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির অনুমোদন কের; তারা নারীর ইদ্দাহর সময় তাকে বিয়ে করে এবং স্বামীর বর্তমানে বিবাহিত মেয়েদের বিয়ে করে। আমি জানি না তাদের চেয়ে আর কে আছে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়।” (শাতিবী, আলইতিসাম)
এক শ্রেণীর এই তরুণদের বিভ্রান্তির জন্যে পেশাদার আলিম ও পন্ডিতরা বহুলাংশে দায়ী। তারা মনে করে এই আলিমরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছে। তাই তারা শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধীতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে, বরং তারা মুনাফিকের মতো শাসকদের গর্হিত কাজের প্রশংসা ও সমর্থন করে। অথচ বাতিলকে সমর্থন না করে অন্তত তাদের নিশ্চুপ থাকাই নিরাপদ ছিল। সুতরাং তরুণরা বর্তমান এরূপ আলিমদের পরিবর্তে অতীতের আলিমদের অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করলে অবাক হবার কিছু নেই। একাবর আমি তাদেরকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে তারা পরিষ্কার বলেছে, “নির্ভরযোগ্য আলিম আমরা পাব কোথায়? যারা আছে তারা তো শাসকদের ক্রীড়নক। তাদের মর্জি-মাফিক ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত। শাসক যখন সমাজতন্ত্রী হয়, আলিমদের দৃষ্টিতে তাই ইসলামী; শাসক যদি হয় পুঁজিবাদী, পুঁজিবাদও তখন হয় ইসলামী! তাঁরা ফতোয়া দেন শত্রুর সাথে সন্ধি হারাম; কিন্তু শাসক যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন তাদের জন্যে দোয়া করেন। “তারা আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা হালাল করতে পারে।” (৯:৩৭)
এসব আলিম মসজিদ ও গীর্জা এবং মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু ভারতকে সমান চোখে দেখে। আমি এর জবাব দিয়েছি এভাবে: “ব্যপারটি সাধারণ সত্যে পরিণত করা উচিত নয়। নিশ্চয় এমন আলিমও আছেন যারা বাতিলের নিন্দা করেন, নির্যাতন রুখে দাঁড়ান, একনায়কদের সাথে আপোস করেন না ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও। এসব আলিমদের অনেককে কারাবরণ করতে হয়েছে। তারা নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি ইসলামের জন্যে শাহাদত বরণ করেছেন।”
সেই তরুণটি এটা স্বীকার করলেও বলল, “নেতৃত্ব ও ফতোয়া দেয়ার ক্ষমতা এখনো ঐ শাসকদের হাতে, আলিমদের নয়-এরাই হচ্ছে তথাকখিত পথবিচ্যুত আলিম।”
অবশ্য এটা কেউ স্বীকার করতে পারেন না যে, ঐ যুবকটি যা বলেছে তা অনেকাংশে সত্য। নেতৃত্ব-অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব “প্রখ্যাত” “আলিম” সরকারের বন্ধকী পণ্যে পরিণত হয়েছেন এবং ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হচ্ছেন। এ ধরনের আলিমদের জানা উচিত সত্য সম্পর্কে নীরব থাকা বাতিল সমর্থনের শামিল। দুটোই শয়তানী কাজ। একবার মিসরীয় টেলিভিশনে “পরিবার পরিকল্পনা” ও “জন্মনিয়ন্ত্রন” অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারী একজন সুপরিচিত মুসলিম বুদ্ধিজীবী তো প্রশ্নই করে বসলেন, এই বিতর্কের উদ্দেশ্য কী, বিরোধীতা না সমর্থন-যাতে তিনি নিজের গা বাঁচিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। বিতর্কের চেয়ারম্যান ঐ পণ্ডিতের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। অথচ এর আগের আলিমরা মত প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন, কারো পরোয়া করতেন না। আল্লাহ্ এদের ওপর রহম করুন! এদেরই একজন মিসর সরকারের একজন প্রভাবশালী সদস্যকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি কাজের খোঁজে পা বাড়ায় তার ভিক্ষের হাত বাড়াবার দরকার পড়ে না।” সমসাময়িক আলিম বা পণ্ডিতরা এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে নিঃসন্দেহে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করতে পারেন।
এখন আলিমদের জ্ঞানগরিমা এতোই সঙ্কীর্ণ যে, তরুণ মুসলমানরা তাদের সংস্পর্শে এসে হতাশ হয়ে পড়ে। এ ধরনের একজন আলিম একবার একটি পত্রিকায় লিখলেন, পিতা ও পুত্রের লেনদেনে যেহেতু কোনো সুদের ব্যাপার থাকতে পারে না। কিন্তু পিতা ও পুত্রের তুলনা দিয়ে তিনি যে যুক্তি খাড়া করেছেন তা বিতর্কিত। মোটকথা এসব আলিম বিভিন্ন বিষয়ে সর্বসম্মত প্রামাণিক সূত্র বাদ দিয়ে দুর্বল সনদের হাদীস দিয়ে নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এগুলো সাধুতা সত্যতার খেলাফ। মুসলিম তরুণরা স্বভাবতই এসব কাণ্ড কারখানা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে। কোনো কোনো আলিম অনেক সময় সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জিত হতে পারে এমন কাজও করে বসেন। এগুলো সচেতন তরুণদের নযর এড়াতে পারে না। আরেকটি ঘটনা।একবার মিশর সরকার বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাদের অনেক সদস্যকে বন্দী করেন। একজন সুখ্যাত আলিম প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ইসলামী গ্রুপকে আল্লাহ্ পরিত্যাগ করেছেন। তার যুক্তি ছিল, তাঁরা যদি সঠিক পথের অনুসারী হতেন তবে আল্লাহ্র রহমতে তাদেরকে পুলিশ বা সৈন্য কেউই পরাজিত করতে পারতো না। হক ও বাতিলের এরূপ অদ্ভুত বিচার সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধী। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্যের সংগ্রামীদের বিজয় লাভে কতকগুলো শর্ত আছে। সেই শর্ত পূরণ না হলে তাদের পরাজিত হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। অন্যদিকে পরিস্থিতির আনুকূল্যে বাতিলের বিজয় অর্জিত হলেও তা চিরস্থায়ী হতে পারে না, কিছুদিন টিকে থাকতে পারে মাত্র। সমকালীন ইতিহাসে এর অনেক জাজ্জল্যমান নযীর আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন সত্য ও মিথ্যা বা হক বাতিলের দ্বারা জয়-পারজয় নির্ধারিত হয় না। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় বৃহৎ শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ। আরবদের উপরে ইসরাঈলের ‘বিজয়’-এর একটি অত্যুজ্জ্বল নযীর।
আমরা কি জানি না, আতাতুর্ক ও তার দুষ্টচক্র মুসলমান জনগণ ও আলিমদের কী নির্মমভাবে দমন করেছে? খিলাফতের পাদপীঠ থেকে কিভাবে ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতা জবরদস্তি তুর্কী জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে! এখন বলুন, এ দু’পক্ষের মধ্যে কারা হক আর কারা বাতিল? সম্পতি একটি মুসলিম দেশে “পরিবার আইন” প্রবর্তনের বিরোধী বহু শ্রদ্ধাভাজন আলিমের উপর নির্যাতন চালানো এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অথচ ঐ পরিবার আইন সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাচারী সরকার সন্ত্রাসী কায়দায় ঐ আইনের বিরোধী জনসাধারণ ও আলিমকে স্তব্ধ করে দেয়। এর অর্থ কি এই যে, সরকারের পদক্ষেপ সঠিক ছিল, আর শাস্তিপ্রপ্ত আলিমরা ভ্রান্ত? আরেকটি মুসলিম দেশে অমুসলিম সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের উপর শাসন চালায়। সেখানে সরকার বিরোধী তৎপরতা দমনের জন্যে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলমান নর-নারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং নিপীড়ন চালানো হয়। তদুপরি যেসব দৃঢ়চেতা মুসলমান যুলুম সহ্য করে টিকে থাকে তাদের উপর হালাকু ও চেঙ্গিস খানের মতো হিংস্র কায়দায় নির্যাতন চালানো হয় আর তাদের সামনে তাদের কন্যা, বোন বা স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়।
বস্তুত ইতিহাসে তথা ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর এমন নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার বহু নযীর আছে। হুসাইন ইবনে আলী (রা) পরাজিত হয়েছেন এবং ইয়াজিদ ইবনে আমীর মুয়াবিয়া তাঁর পবিত্র দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। পরিণামে বনু উমাইয়া বহুকাল শাসন করেছে; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশধাররা তাদের হাত থেকে নিষ্কৃত পাননি, এমনকি আব্বাসীয়দের শাসনামলেও নয়। এ থেকে কি এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজিদের কার্যকলাপ সঠিক ছিল আর হযরত হুসাইন (রা)-এর অনুসৃত পন্থা বাতিল? হে আল্লাহ, আপনি এদের যুলুমের সাক্ষী, এদের হাত থেকে উম্মাহকে রক্ষা করুন!
আরো ঘটনা আছে। কয়েক বছর পর বিজ্ঞ ও সাহসী সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ অনারবী হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের হাতে পরা জিত হয়েছিলেন; পরে হাজ্জাজ আরেকজন মহান মুসলিম সেনাপতি আবদুর রহমান ইবনে আল-আসাস এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের, আশশাবী, মুতরিয়াসহ একদল বিশিষ্ট আলিমকে হত্যা করে। এগুলো ছিল উম্মাহর জন্যে বিরাট ক্ষতি, বিশেষ করে সাঈদ ইবনে জুবায়ের সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র) বলেন, তিনি এমন এক সময় নিহত হলেন যখন তাঁর খুব প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়: “আল্লাহর কসম! হিংস্র নেকড়ে যদি আমাদের ছিন্নভিন্ন করে তবুও আমরা আমাদের সত্য বিশ্বাস ও তোমাদের মিথ্যাবাদিতা সম্পর্কে সংশয়ী হবো না।” ইবনে জুবায়ের ও তার সঙ্গী-সাথীরা মক্কায় অবরুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন: “আল্লাহর শপথ! সৎ মুত্তাকীদের কেউ অবনত করতে পারবে না যদি গোটা পৃথিবীও তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আর বিপথগামীরা কখনোই যথার্থ সম্মান পাবে না যদি তাদের কপালে চন্দ্রও উদিত হয়। এসব উক্তি কুরআনে বর্ণিত নবীদের ঘটনাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ। কুরআন বলছে: “তবে কি যখনি কোনো রাসূল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনই তোমরা অহংকার করেছে আর কতককে অস্বীকার করেছে এবং কতককে হত্যা করেছ!” (২:৮৭) এমন একজন নবীদের মধ্যে ছিলেন হযরত যাকারিয়া (আ) ও তাঁর পুত্র ইয়ারিয়া (আ)। এই নবীদের হত্যা এবং তাদের শত্রুদের সাফল্যকে কী পূর্বোক্তদের ভূমিকাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে? আমরা কুরআনুল করীমে আসহাবুল উখদুদের ঘটনাও জানি। তারা ঈমানদারদের জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে সেই বীভৎস্য দৃশ্য উপভোগ করতো: “এবং অন্য কোনো কারণে নয়, কেবল তারা সর্বশক্তিমান ও সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহ্ কে বিশ্বাস করতো বলেই (কাফিররা) তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।” (৮৫:৮)
কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ঈমানদারদের কখনো কখনো বিপদাপদের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং বেঈমানদেরকে সাময়িক সাফল্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা করা হয়। আল্লাহ বলেন: “মানুষ কি মনে করে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়া হবে? তাদের পূর্ববর্তীদেরও আমি পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।” (২৯:২-৩)
ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর নিম্মোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়: “যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে তবে অনুরূপ আঘাত তাদেরও তো লেগেছে। মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর আমি পর্যায়ক্রমে আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।” (৩:১৪০)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “...আমি তাদেরকে এমনভাবে ক্রমে ক্রমে ধরব, তারা তা বুঝতেও পারবে না।” (৬৮:৪৪)
বস্তুত এই মুসলমানরা যদি মুহুর্তের জন্যেও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতো তাহলে নিশ্চিতভাবে সঠিক পথ-নিদের্শ লাভ করতো। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ১৩ বছরের মক্কী জীবন। তিনি শুধু দাওয়াত দিয়ে ক্ষান্ত হননি, ৩৬০টি মূর্তি থাকা সত্ত্বেও কা’বায় নামায ও তাওয়াফ করতে বলেছেন। কেন এরূপ করলেন? তিনি কাফিরদের তুলনায় তাঁর অনুল্লেখযোগ্য শক্তি ও অবস্থানের কথা ভেবে অতি বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি কখনোই কমান্ডো হামলা চালিয়ে পাথরের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার চিন্তা করেননি। তাহলে তো আসর উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যেতো। ঐ পদক্ষেপে কাফিরদের মন থেকে তো বহু-ইশ্বরবাদের ভুত মুছে ফেলা যেতো না। তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তাঁর স্বজাতির মনকে মুক্ত করতে-কা’বাকে মূর্তিমুক্ত করতে নয়। এ জন্যে তওহীদেরশিক্ষা দিয়ে প্রথম মুশরিকদের মন পবিত্র করার লক্ষ্যে এমন একদল ঈমানদার তৈরি করেন যারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন এবং কঠোর অধ্যবসা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা বাতিলৈর বিরুদ্ধে হকের লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম। এসব বিশ্বাসীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা নিরলস নির্বিকার চিত্তে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করে যায়, বিজয়ের উল্লাসে তারা মাদকতায় বিভোর হয়ে যায় না, আবার পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে না। অবশ্য কখনো কখনো তারা কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু তিনি এখনো সময় আসেনি বলে তা অগ্রাহ্য করেছিলেন এবং আল্লাহ্ র নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারনের উপদেশ দিয়েছিলেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আম্মার বিন ইয়াসির (রা) ও তাঁর পিতাকে নিগৃহীত হতে দেখলেন। তিনি তাঁদেরকে সহ্য করার জন্যে উৎসাহিত করলেন এবং তাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। স্বাধীনতা ও ধর্মরক্ষার জন্যে আল্লাহ্ র আদেশ না পাওয়া অবধি ঘটনা এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে আদেশ এলো। কুরআনের ঘোষণা: “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। নিশ্চই আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে: আমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ্ ।” (২২:৩৯-৪০)
কিন্তু এই অনুমতি দেয়া হয়েছে কেবল তখনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা নিজেস্ব আবাসভূমি স্থাপন করে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারপরই তাঁদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছৈ। তাঁরা এরপর একর পর এক বিজয় অর্জন করেছেন যতক্ষণ না তাঁরা আল্লাহ্ র হুকুমের মক্কা বিজয় করেছেন। এই মক্কা থেকেই তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কাফিরদের অত্যাচারে।শৈষ পর্যন্ত তিনি মক্কার মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং তিলাওয়াত করলেন এই আয়াত, “ বলো সত্র সমাগত এবং মিথ্যা বালুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত বাধ্য।” (১৭:৮১)
বিস্ময়ের ব্যাপার, জামায়াত আত-তাকফির আল-হিজরা ইতিহাসের এই ধারাকে অস্বীকার করে। এই অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবশ্য গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ শুকরী ও আবদুর রহমান আবু আল-খায়েরের মধ্যে মতপার্থক্যও হয়েছিলো। আবু আল-খায়ের তাঁর “স্মৃতিকথায়” লিখেছেন যে, ইসলামের ইতিহিসের প্রতি শেখ শুকরীর অবস্থা ছিল না। তিনি এটাকে “অপ্রমাণিক ঘটনাবলী” বলে মনে করতেন। এটা ছিলো সাথে মতভেদের চতুর্থ বিষয়। তিনি কেবল কুরআন শরীফে বর্ণীত ঘটনাবলীকেই ইতহাসের উপাদান বলে মনে করতেন। তাই তানি ইসলামী খিলাফতের অধ্যায় পাঠ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
ধর্মীয় অজুহাতে ইতিহাস সম্পর্কে ও ধরনের সংকীর্ণ ও অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তারা ইসলামের ইতিহাসকেও হারাম ঘোষণা করেছিলেন। ইতিবাচক ও নেতিবাচক, জয় ও পরাজয় তথা সকল বিষয় সমন্বিত একটি জাতির ইতিহাস হচ্ছে সমৃদ্ধ খনির মতো যা থেকে সম্পদ আহরণ করে একটি জাতি তার বর্তমান গড়ে তোলে। যে জাতি ইতিহাসকে উপেক্ষা করে তার অবস্থা স্মৃতিভ্রংশ মানুষের সাথে তুলনীয়, যার কোনো মূল বা দিক-দর্শন নেই। কোনো গ্রুপ বা জনগোষ্ঠী কিভাবে এরূপ একটি অস্বাভাবিক শর্তকে টিকে থাকার ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করতে পারে? তাছাড়া ইতাহাস হচ্ছে এমন একটি আয়না যাতে আল্লাহ্র বিধান প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এজন্যে আর কুরআনে গোটা সৃষ্টিলোক সাধারণ ভাবে এবং মানব জীবনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ কারণেই আল কুরআন ইতিহাসের প্রেক্ষিত অনুধাবন এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বর্ণনা: “তোমাদের পূর্বে বহু জীবন প্রণালী গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা দুনিয়া ভ্রমণ করো এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের কি পরিণাম হয়েছে।” (৩:১৩৭)
আল্লাহ্ রীতির বৈশিষ্ট্য হলো স্থায়িত্ব, তার কখনো পরিবর্তন হয় না। আল কুরআন বলছে: “তারা আল্লাহ্ র নামে দৃঢ় অঙ্গীকার করে বলতে যে, তাদের কাছে কোনো সতর্ক বাণী এলে তারা অন্য সকল সম্প্রদায় অপেক্ষা সৎপথের অধিকতর অনুসারী হবে। কিন্তু যখন তাদের কাছে সতর্ক বাণী এলো তখন তা কেবল এদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করলো, যমীনের বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট-ষড়যন্ত্রের কারণে। কূট-ষড়যন্ত্র এর উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তবে কি তারা প্রত্যক্ষ করেছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? কিন্তু তুমি আল্লাহ্ র বিধানে কখনো কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না এবং আল্লাহর রীতিতে কোন ব্যাতিক্রম দেখবে না। (৩৫: ৪২-৪৩)
আল।রাহ্ র রীতি যেহেতু অপরিবতর্নীয় ও স্থায়ী তাই যারা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় স্থান-কাল ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আচরণে তিনি একই রীতি প্রয়োগ করেন। এই নীতির একটি শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেথেছি ওহুদের যুদ্ধে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপদেশ উপেক্ষা করার দরুন তাদেরকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিলো। কুরআনুল করীমে একথা উল্লিখিত হয়েছৈ: “কী ব্যাপার! যখন তোমাদের ওপর মুসীবত এল তখন তোমরা বললে এটা কোথা থেকে এলো! অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলো এটা তোমাদের নিজেদেরই নিকট থকে। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিশালী। (৩:১৬৫)
আরেকটি আয়াতে যে কারণে মুসলমানদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তার পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে: “আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহ্ র অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বদ্ধে মতভেদ করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকর দেখবার পর তোমরা অবাধ্য হলে।” (৩:১৫২)
কিছু বিছিন্ন ঘটনার দরুণ ইতিহাসে অনেক সন্দেহজনক ঘটনা সংযোজিত হয় সত্য, কিন্তু মূল গটনা প্রবাহ সুরক্ষিত থাকে এবং একাধিক প্রামাণিক সূত্রে তা সমর্থিত হয়। আর সন্দেহপূর্ণ ঘটনাগুলো বিজ্ঞ ব্যাক্তি বিশ্লেষণ করতে পারেন। যাতে সত্য নিরূপণ করা যায়।
পক্ষান্তরে আমরা শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, সৃষ্টির পর থেকে মানব ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে চাই। শুধু ঈমানদারদের ইতিহাস নয়, বরং নাস্তিকদের ইতিহাস থেকেও জ্ঞান আহরণ করা যায়। কেননা আল্লাহ্ র রীতিতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।তা তো তাওহীদ পন্থী ও পৌত্তলিক উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। বস্তুত জাহিলিয়ার ভ্রান্ত প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে আমরা কুরআনুল কারীমকে এবং ইসলামের বদৌলতে আমরা কী কল্যাণ লাভ করেছি তাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো না। কুরআনে বলা হয়েছে: “...যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রন্তিতে নিমজ্জিত ছিলো।” (৩:১৬৪) এবং “তোমরা অগ্নি গহবরের কিনারে দাঁড়িয়েছিলে, আল্লাহ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (৩:১০৩)
উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর একটি উক্তিতেও এই মর্ম প্রতিফলিত হয়েছে: “জাহিলিয়ার প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যর্থতা শুরু হলে একে একে ইসলামের বন্ধনী বিছিন্ন হতে থাকবে।”
সত্য প্রকাশ যদি পুণ্য হয় তাহলে আমি বলবো ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ইতিহাস সঠিকভাবে অধ্যায়ন ও অনুধাবন করেননি। ইতিহাস পাঠের অর্থ শুধু বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনাকে জানা নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এর মর্ম উপলব্ধি করা, শিক্ষা নেয়া এবং আল্লাহ্ র রীতিগুলো উদ্ভাসিত করা। নিছক পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসাবশেষ অবলোকন করলে কোনো ফায়দা হবে না। শুধূ দেখা আর শোনার মাধ্যমে ইতিহাসের মর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “তারা কি দেশে ভ্রমন করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারতো। আসলে চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।” (২২:৪৬)
ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং একটির সাথে অপরটির সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ এগুলো একই অপরিবর্তনীয় নিয়মে প্রবাহিত হয়। তাই পাম্চাত্য শিখিয়েছে: “ইতিহাসের চাকা ঘোরা” আর আরবারা বলে, “আজবকের রাত কালকের রাতের মতোই।”
আল কুরআনুল করীমে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণে সাদৃশ্যের কারণ হিসেবে অভিন্ন চিন্তা ও দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে:
“যাদের জ্ঞান নেই তরা বলে, ‘আল্লাহ কেন আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে আসে না কেন? এর আগের লোকেরাও এ ধরনের কথা বলতো। তাদের হৃদয় একই রকম। আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।” (২:১১৮)
কুরায়েশ পৌত্তলিকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন: “এভাবে এদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনি কোনো রাসূল (সা) এসেছেন তারা তাঁকে বলেছে, ‘তুমি তো এক যাদুকর, না হয় এক উম্মাদ!’ তারা কি একে অপরকে এই মন্ত্রাণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুত তারা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।” (৫১:৫২-৫৩)
তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্ র নবীর প্রতি আগের ও পরের জাতিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্নতা তাদের মধ্যে সমঝোতার ফলশ্রুতি নয়, বরং সাদৃশ্য হলো অন্যায় ও স্বচ্ছাচারী আচরণে। সুতরাং তাদের দৃষ্টভঙ্গি অভিন্ন কারণ হলো স্বেচ্ছাচারিতা।
যারা ইতিহাসের গুরুত্ব এবং আল্লাহর রীতির মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম কেবল তারাই অতীত জাতিসমূহের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তারাই প্রকৃত সুখী। তারাই যারা এসব ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেরা সতর্ক হয় বটে, কিন্তু অন্যের ভাল দিকগুলোকেও উপেক্ষা করে না। জ্ঞানই ঈমানদারের লক্ষ্য তা সে যেখান থেকেই অর্জন করুক না কেনো। কেননা অন্য যে কোন ব্যাক্তির চেয়ে এটা তারই প্রাপ্য।
তিনি তাঁর (হিসেবে) ছয় দিনে এগুলো সৃষ্টি করেছেন অথাৎ পর্যায়ক্রমে যা কেবল তিনিই জানেন। কেননা “দিন” সংক্রন্ত আমাদের ধারনা থেকে তা ভিন্ন। সকল প্রাণীর বিকাশের ক্ষেত্রেও পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। ধীরে ধীরে এগুলো পূর্ণতা লাভ করে। দাওয়াতী কাজেও এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার থেকে মনকে মুক্ত করার জন্যে প্রথমে সেখানে তওহীদের বীজ প্রোথিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে ঈমানের ভিত্তি মজবুত হলে ওয়াজিবাত ও মুহাররামাতের প্রক্রিয়া চালু করা হয়। এরপর সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদি প্রবর্তন করা হয়। এজন্যে আমরা মক্কী ও মাদানী আয়াতের মধ্যে পার্থ্ক্য লক্ষ্য করি।
আয়েশা (রা) শারীয়ার প্রবর্তন এবং কুরআন নাযীলের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন: প্রথমে কুরআনের যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে তাতে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (পরে) যখন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলো তখন হালাল ও হারামের বিধান নাযীল হলৌ। যদি প্রথমেই “মদ পান করো না” এবং “ব্যভিচার করো না” নাযিল হতো লোকেরা বলতো, ‘আমরা মদপান ও ব্যভিচার কখনোই ছাড়তে পারব না।’ (বুখারী) সুতরাং যারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতাষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদেরকে পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রতিবন্ধকতা, উপায়-উপকরণ ও সামর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পর্যায়ক্রমে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। এক্ষেত্রে খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজের দৃষ্টান্ত স্মর্তব্য। তিনি খেলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ জীবন পুনর্গঠন করেছিলেন। কিন্তু পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সহজ ছিলো না। তার পুত্র আবদুল মালিক অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে একবার বললেন, “হে পিতা, আপনি কেন হত্যা করেন না? আল্লাহ্ শপথ, সত্যের জন্যে আমরা বা আপনার প্রাণ গেলেও আমি পরোয়া করি না।” কিন্তু উমর জবাব দিলেন, “তাড়াহুড়া করো না আমার পুত্র। আল্লাহ্ পাক কুরআনুল কারীমে দু’বার মদ্যপানেরনিন্দা করেছেন এবং তৃতীয়বারে নিষিদ্ধ করেছেন। আমার ভয় হয়, একবারেই সব চাপিয়ে দিলে এক সাথেই তা প্রত্যাখ্যাত হয় কিনা। এতে ফিতনার সৃষ্টি হতে পারে।” (আল মুয়াফাকাত)
দ্বিতীয়: দ্বিতীয় রীতিটি হচ্ছে প্রথমটির পরিপূরক। প্রতিটি জিনিসের পূর্ণতা বা পরিণতি লাভের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই এই রীতি প্রযোজ্য। ফসল পাকার আগেই কাটা যায় না। অপরিপক্ক ফলমূল ও শাকসবজি উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে। ঠিক তেমনি মহৎ কাজের সুফল অনেক বছর পরেই পরিদৃশ্যমান হয়। পরিণত হতে যতো সময় লাগবে ততোই তা ফলপ্রদ হবে। এক পুরুষের চেষ্টা-সাধনা অন্য পুরুষে ফল দিতে পারে। মক্কা মুকাররমায় প্রথমদিকে কাফিররা আল্লাহর শাস্তির হুশিয়ারীকে অবিবেচকের মতো উপহাস করতো এবং দ্রুত শাস্তি আনার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি আহবান জানাতো। কিন্তু তারা এটা জানতো না যে, নির্দিষ্ট সময়েই তা আসবে। বিলম্বও নয়, দ্রুতও নয়।
“তারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে। যদি নির্ধরিত সময় না থাকতো তবে শাস্তি তাদের ওপর আসবে আকস্মিকভাবে, অজ্হতসারে।” (২৯:৫৩)
“তরা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, অথচ আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনো ভঙ্গ করেন না, তোমাদের গণনার হাজার বছরের সামন।” (২২:৪৭)
এই পর্যায়ে আল্লাহ্ তায়ালা মহানবীর (সা)-এর প্রতি বিগত নবীদের মতো অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দিলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।”(৪৬:৩৫) বিগত নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের কঠোর সঙগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন:
“তোমরা কি মনে করো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি! অর্থ কষ্ট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিলো এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিলো। এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার অনুসারীরা বলে উঠেছিলো, আল্লাহ্র সাহায্য কখন আসবে; নিশ্চয় আল্লাহ্র সাহায্য নিকটবর্তী। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময় কেবল আল্লাহ্রই জানা আছে। এ জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের ধৈর্য ধারণ করতে বলতেন এবং নিদির্ষ্ট সময়ের পূর্বে বিজয় প্রত্যাশা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। একটি ঘটনা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার খারায ইবনে আল-আর্ত ইসলামের জন্যে তাঁর দুঃখকষ্ট বরণের কথা বলে আর্লাহ্ র সাহায্য প্রার্থনার আবেদন জানালে রাসূলুল্লাহ (সা) এতোই ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখ লাল হয়ে যায়। তিনি বললেন: “তোমাদের আগে একজন বিশ্বাসীকে লোহা দিয়ে এমনভাবে পিষ্ট করা হয়েছে যে, হাড় ছাড়া তার শরীরের গোশ্ত ও শিরা-উপশিরা অবশিষ্ট ছিলো না। আর একজনকে করাত দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় দু’ভাগে চিরে ফেলা হয়েছিলো। কিন্তু তাঁরা কেউই ধর্মত্যাগ করেননি। আল্লাহ্র শপথ, তিনি এমনভাবে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন যে, একজন ভ্রমনকারী সানা থেকে হাদ্রামাউত পর্যন্ত সফরের সময় এক আল্লাহ্ এবং তার ভেড়ার জন্যে নেকড়ে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা অধৈর্য।” ( বুখারী)
এছাড়া মুসলিম দেশগুলোতে এমন সব বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে যা শরীয়তে নিষিদ্ধ অথচ ভাব দেখানো হয় উম্মার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ উজ্জীবিত করাই এর লক্ষ্য। কিন্তু মূলত এসব আইনের উৎস শরীয়ত নয়,বরং ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন। সুতরাং এতে বিস্ময়ের কিছু নেই- এসব আইন আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে সিদ্ধ করে আর আল্লাহ্ যা সিদ্ধ করেছেন তাকে অসিদ্ধ ঘোষণা করে। আর এসব তথাকথিত আধুনিক আইন সব রকম দুর্নীতি ও অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়। অন্যদিকে শাষকদের কার্যকলাপও হতাশাব্যঞ্জক। তারা ইসরামের শত্রুদের সাথে সন্ধি করে আর ইসলামের কথা শোনা যায় নিছক ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়া তাও আবার সাধারণ মানুষকে ধোঁধা দেয়ার জন্যে।
মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা আরো করুণ। তরুণরা তাদের চোখের সামেন সামেন দেখেত পাচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের কী অহসনীয় বৈষম্য! কেউ কোনোভাবে জীবন ধারণ করছে, এমনকি ওষুধপথ্যও সংগ্রহ করতে পারছে না কিংবা মাথা গোঁজারও ঠাঁই নেই। অন্যদিকে বিত্তবানরা লাখ লাখ টাকা মদ ও নারীর পেছনে ঢালছে, বড় বড় প্রাসাদে বাস করছে কিৎবা অনেক সময় খালিই পড়ে থাকে। বিদেশী ব্যাংকে তারা কোটি কোটি ডলার গোপনে সঞ্চয় করছে। তারা তেলের টাকা অপহরণ, পাশ্চাত্যের সাথে সহযোগিতা এবং আর্ন্তজাতিক কোম্পানীগুলোর সাথে লেনদেন করে বিত্তের পাহাড় গড়েছে। আর এই অর্থ তারা জুয়া এ নরীর পেছনে অকাতরে ব্যয় করছে। এর একটি অংশও যদি তারা দরিদ্র মানুষের জন্যে দান করতো তাহলে হাজার হাজার মানুষের অন্ন ও আশ্রয়ের সংস্থান হতো। অথচ এই সুবিধাভোগী শ্রেণী দিনে দুপুরে ডাকাতির মতো জনগণেরন সম্পত্তি অপহরণ করে চলছে। সুদ, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি তো আছেই কিন্তু এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার কেউ নেই। আইনের হাত থেকে বাঁচার রাস্তাও তাদের জন্য সহজ। সুতরাং এই নিদারুণ পরিস্থিতি সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে, এতে আর সন্দেহ কী! আর এই সুযোগের জন্যে ওৎ পেতে বেস থাকে সর্বনাশা মার্ক্সবাদীরা। তখন তারা বিকল্প হিসেবে শ্রেণী সংগ্রামের কাজ জারি করে দেয়।
এক্ষণে এই মর্মান্তিক অবস্থায় মূল কারণ সর্ম্পকে কোনো হেঁয়লির অবকাশ নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যময় ও সুবিচারপূর্ণ বিধান হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম আজ স্বদেশেই নির্বসিত। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্র পরিচালনা, মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক তথা সর্বক্ষেত্রে আজ ইসলাম অপসারিত। খ্রীষ্টানদের অবক্ষয়ের সময় যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো এখন মুসলমানদের অবস্থা তাই। ইসলামকে শরীয়ত ছাড়া দ্বীন, রাষ্ট্র ছাড়া ধর্ম এবং কর্তৃত্ব ছাড়া আইনের কিতাবে পর্যবসিত করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে এমন পরিনামের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে যার সাথে তার নিজস্ব ইতিহাসের কোনো সাদৃশ্য নেই। ক্যাথলিক গীর্জা সব রকম অনাচারে নিমজ্জিত হয়েছিলো। তারা স্বৈরাচারী শাসকদের পৃষ্টপোষকতা করে সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিলো। সামান্য বিরোধিতা তারা সহ্যকরতে পারতো না। স্বাধীনভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিলো নিষিদ্ধ। এ জন্যে তারা নিষ্ঠুর নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল। তারা বই পুড়িয়েছে, মানুষকেও পুড়িয়ে মেরেছে। সুতরাং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ খুব স্বাভাবিক এবং ইউরোপে তাই হয়েছে। তারা গীর্জার জোয়াল থেকে এমনভাবেই নিজেদের মুক্ত করেছে যে, এখন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলেছে আরেক ধ্বংসের দাকে। যা হোক, মুসলমানদেরকে কেন এই কালো ইতিহাসের পরিণাম ভোগ করতে হবে? ইসলাম কেন নির্বসিত হবে স্রেফ মসজিদে কিংবা মানুষের বিবকের সীমিত পরিসরে? কিন্তু মসজিদও আজ নিরাপদ নয়। সেখানেও জিহ্বাকে আংটাবদ্ধ রাখতে হয়। কেননা গুপ্ত পুলিশের কড়া নযর থাকে এগুলোর ওপর। মোটকথা মসজিদেও আজকাল ইসলামের বিপ্লবী ব্যাখ্যা দেয়ার অনুমতি নেই।
এই সমস্যার মৌলিক কারণ, মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মকে রাষ্ট্র, আইন প্রণয়ন ও ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার শিক্ষা দেয়। মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক ইতিহাসে এরূপ অদ্ভুত শিক্ষার কোন নযীর নেই। কোননা আশ-শারীয়াহ শুধু ইবাদত-বন্দেগীর ভিত্তি নয়, বরং আইন, লেনদেন, ঐতিহ্য ও রীতি-নীতিরও উৎস। একথা সত্যি, কোনো কোনো মুসলমান শাসক সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন; কিন্তু অন্তত বিচার-আচারের ক্ষেত্রে শরীয়তকে উপেক্ষা করার তেমন নযীর নেই। এমনকি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো স্বেচ্ছাচারী শাসকও কুরআনুল কারীম ও সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়কে অগ্রাহ্য করার ধৃষ্টতা দেখাতেন না। এই পার্থক্যটা অনুধাবনযোগ্য। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি বা অবহেলার কারণে শরীয়ত থেকে বিচ্যুত হওয়া এক কথা আর আল্লাহর বিধান হিসেবে অন্যান্য মতবাদের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠতা অস্বীকার করা ভিন্ন কথা। এদিকেই ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ্ বলছেন: “নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহ্ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর?” (৫:৫০)
আরেকটি ব্যতিক্রমী বিষয় মুসলিম তরুণদের পীড়া দেয়। অমুসলিম দেশগুলো তাদেরই আদর্শ ও দর্শন মোতাবেক জীবন ধারা গড়ে তুলছে, অথচ কেবল মুসলমানরাই তাদের বিশ্বাস ও বাস্তবতা, তাদের দ্বীন ও সমাজের মধ্যে সৎঘাত জারি রেখেছে। আমার একটি বইয়ে লিখেছি: “ধর্মনিরপেক্ষতা খৃষ্টানরা গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তা মুসলমান সমাজে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।” খৃষ্টধর্ম জীবনের জন্যে পূর্ণাঙ্গ ঐশি বিধান পেশ করতে পারে না যার প্রতি তার অনুসারীরা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে পারে। খোদ বাইবেলে জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: একটি ঈশ্বর অথাৎ ধর্ম অন্যটি সীজার অথাৎ রাষ্ট্র। এতে বলা হয়েছে: “সীজারের জন্যে নির্ধারিত বিষয় সীজারকেই চালাতে দাও আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও।” (ম্যাথিউ-২২:২১)
সুতরাং একজন খ্রীষ্টান বিবেকের কোনরূপ দংশন ছাড়াই ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া তাদের পক্ষে ধর্মীয় শাসনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন গ্রহণ করার যুক্তি আছে। তাদের ধর্মীয় শাসনের অভিজ্ঞতা বড় নির্মম। অতীতে যাজকদের স্বেছ্ছাচারী শাসনের স্মৃতি তাদের মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন। মুসলিম সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নেয়া মানে আবাদত, বান্দেগী, আইন-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুকে সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করার শামিল। তাছাড়া বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণে শারীয়াহ সক্ষম নয়- এই মিথ্যা দাবীর কাছে নতি স্বীকার করা। বস্তুত মানুষের রচিত আইন মেনে নেয়া মানে ঐশী বিধানের পরিবর্তে মানুষের সীমিত জ্ঞানকে শ্রেয় মনে করা, অথচ আল-কুরআন বলছে: “বল! তোমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ্ ?” (২:১৪০)
এ কারণে মুসরমানদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার দাওয়াত নাস্তিকতা ও ইসলাম পরিহারের দাওয়াতের সমতুল্য। শারীয়াহর পরিবর্তে একে শাসনের ভিত্তি বলে গ্রহণ করলে তা হবে সরাসরি রিদ্দাহ। এই বিচ্যুতি সম্পর্কে জনগণ নীরব থাকরে তা বড় ধরনের সীমালংঘন ও পরিষ্কার অব্াধ্যতার নযীর বলে গণ্য হবে। এর ফলে মুসলিম সমাজে অপরাধবোধ, দীনতা, হিংসা, ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হতে বাধ্য। বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের নিজেস্ব ধ্যান-ধারণাই ফসল। এই মতবাদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন বটে, কিন্তু এর দেখাশোনার দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন অথাৎ জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কে ঘড়ির সাথে ঘড়ি-নির্মাতার সম্পর্কের মতো। ঘড়ি-নির্মাতা ঘড়ি তৈরি করে দেয়ার পর নির্মাতার সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে, তেমনি আল্লাহ পৃথিবী নির্মাণের পর তা আপন গতিতেই চলছে। এই ধারণা এসেছে গ্রীক দর্শন থেকে। এরিস্টলের মতে আল্লাহ পৃথিবী নিয়ন্ত্রন করেন না এবং এ সম্পর্কে কিছুই খবর রাখেন না। উইল ডুরান্ট এক ধাপ এগিয়ে তাকে বলেছেন অসহায় ঈশ্বর। সুতরাং এতে আর আশ্চর্যের কী আছে, যে ঈশ্বর তার সৃষ্ট জীবের খবরই রাখেন না তিনি কী করে তাদের জীবন যাত্রার বিধান তৈরি করবেন? এ দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া ছাড়া তো তার গত্যন্তর নেই! ইসলামের ধারনা থেকে এই ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত । আমরা মুসলমানরা বিশ্বাস করি আল্লাহ্ একই সাথে জগতের সৃষ্টিকর্তা, বিধানদাতা ও পালনকর্তা : “... তিনি সবকিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন।” (৭২:২৮)
তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বদর্শী; তাঁর দয়া ও বদান্যতা সকলের জন্য যথেষ।ট। এই ক্ষমতা বলেই তিনি মানুষের ঐশী পথ রচনা করছেন, হালাল-হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং বান্দাদেরকে তাঁরই বিধান মেনে চলতে এবং সেই অনুযায়ী ফায়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তারা না করে তবে তা হবে কুফরী ও সীমালংঘন।
নিষ্ঠাবান মুসলিম তরুণরা এ ধরনের অনাচার তাদের চোখের সামনেই দেখেছে কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা শক্তি প্রয়োগ কিংবা গলাবাজি করে এ সবের পরিবর্তন করতে পারছে না। তাদের একমাত্র উপায় মনের মণিকোঠায় গভীর অনুভূতি পোষণ যা ঈমানের দুর্বলতম অঙ্গ। অবশ্য, এই হৃদয়াবেগ চিরদিন চাপা থাকবে না। একদিন না একদিন তার বিস্ফোরণ ঘটবেই।
এছাড়া ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের পবিত্র স্থানসমূহ সর্বগ্রাসী হামলার শিকার। ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ, পৌত্তলিক, মার্ক্সবাদী তথা সকল ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের মত পার্থক্য ভুলে একযোগে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ইসলামী পুনরুজ্জীবন, ইসলামী আন্দোলন অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হীন তৎপরতা চালিয়ে যাছ্ছে। এ কারণে সকল অনৈসলামী ইস্যু প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, বিশেষত আমেরিকা ও রাশিয়ার নৈতিক ও বৈষয়িক মদদ পায়, কিন্তু ইসলামী ইস্যুতে তারা নির্বিকার। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজীদ বলছেন: “বেঈমনারা একে অন্যের সমর্থক।” (৮:৭৩)
কিন্তু ভাষা-বর্ণ-গোত্র-স্থান-কাল-নির্বিশেষে মুসলমানরা অন্য মুসলমানের বিপদাপদে, নিগ্রহ নিষ্পোষণ ও হত্যাযজ্ঞে নীরব থাকতে পারে না। কারণ তারা সেই সবূত্তোম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত যারা একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। কেননা যে মুসলমানের মনে অন্য মুসলমানের সম্পর্কে কোনো অনুভূতি নেই, সে মুসলমান নয়।
প্রতিদিন খবর আসছে ফিলিস্তিন, লেবানন, আফগানিস্থান, ফিলিপাইন, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, সাইপ্রাস ও ভারতে মুসলমানরা কিভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। অথচ আমরা দেখি আজকাল অন্য কোনো মুসলিম দেশ এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করে না, বরং সম্পূর্ণ উদাসীন। আরো মর্মান্তিক, কোনো কোনো শাসক ইসলামের শত্রুদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। তারা স্রেফ গোত্রীয়, আঞ্চলিক বা জাতিগত স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।
আল্লাহ, তাঁর রাসূল, দ্বীন, উম্মাহ ও এর স্বার্থের প্রতি তাদের কোনো আনুগত্য বা অনুভূতি নেই। তরুণরা আরো লক্ষ্য করছে, ইসলামের প্রতি শাসকদের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নেপথ্যে কাজ করছে ইহুদী, খ্রীষ্টান ও কম্যুনিজমের চক্রান্ত। কিন্তু শাসকদের মনে ভীতি সৃষ্টিকরে এবং তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনদমনে প্ররোচিত করে।
বহুবিধ বিষয়ের মধ্যে আরেকটি বিষয় বিগত কয়েক বছরে মুসলিম তরুণদের মদ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এটি হচ্ছে ১৯৬৭ সালের ৬ দিনব্যাপী মিসর-ইসরাঈল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া রোধের লক্ষ্যে যুদ্ধের জন্য দায়ি ব্যক্তিরা এই আশ্বাস বাণী শোনালেন যে, এটা “পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন”- তেমন ক্ষতিকর কিছু নয়। অথচ আরব দেশগুলোর তরুণরা শৈশব থেকে এই অঞ্চলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এই এলাকাকে মুক্ত করা মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় দায়িত্ব। ফিলিস্তিনের গ্রান্ড মুফতী মরহুম আমীন আল-হুসয়নী (র) -এ ব্যাপারে বলেছিলেন, “ফিলিস্তিন জনবসতিহীন জনপদ নয় যে, এখানে জনপদহীন লোকদের আশ্রয় দিতে হবে।” যা হোক ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পরিস্থিত নতুন মোড় নিলো অথাৎ আগ্রাসনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার নামে ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন কর হলো। এর অর্থ দাঁড়ায়, সাম্প্রতিক ইসরাঈলী আগ্রাসনে পুরানো আগ্রাসনকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে ১৯৪৯, ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের কী কারণ ছিল? গোড়াতেই ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দিলে মুসলিম উম্মাহ মারাত্মক পরিণতির হাত থেকে রেহাই পেতো। বস্তুত তথাকথিত “শান্তিপূর্ণ সমাধান” ও শান্তিচুক্তির অজুহাতে এসব অবমাননাকর উদ্যোগ নেয়া হয়। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ সামরিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তাদের নীতির পক্ষে সাফাই দেন। কিন্তু এসবই মুসলমানদের আশা-আকাংখায় তীব্র আঘাত হানে, বিশেষ কর ইসরাঈলের প্রতি সকর বৃহৎ শক্তির স্বীকৃতি ও সমর্থন এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা মুসলমানেদের আঘাত তীব্রতর করে। এসব ঘটনা থেকে এই উপসংহার টানা যায় যে, ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্রুসেড শুরু করা হচ্ছে। এসরামী বিশ্ব ও ইসরামী আন্দোলনের প্রতি পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক নেতাদের মনোভাবে এটা পরিস্ফুটিত। মুসলমানদের সাথে শতাব্দী প্রাচীন লজ্জাকর লড়াইয়ের স্মৃতি তাদের মনে এখন তরতাজা রয়েছে। তাই তাদের অন্তরে এখনো মুসরিম বুদ্ধিজীবি অবশ্য এই ধারণা বাতিল করে যুক্তি দেখাতে চান যে, পাশ্চাত্যে ক্রুসেড চেতনা নয়, তাদের জাতীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্তিতি তাদের এই দাবীকে ভুল প্রমাণিত করেছে, বরং পাশ্চাত্যে ক্রুসেড চেতনা পূর্ণমাত্রায় জীবন্ত। আমি আমি এলেনবী অথবা জেনারেল গুরান্ডের কথা বলতে চাই না। আমাদের সমসাময়িকদের মনেই প্রশ্ন জেগেছে : কেন পাশ্চাত্য মুসলিম ভূখন্ডে ইসরাঈলের অস্তিত্ব বহাল রাখতে আগ্রহী? কেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাঈলের নিন্দা সম্বলিত প্রতিটি জাতিসংঘ প্রস্তাবে ভেটো দেয়? কেন তারা ইরিত্রিয়ার বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী ইথিওপিয়াকে সমর্থন যোগায়? কেন সংবাদপত্রে মুসলিম দেশের ঘটনাবলী গুরুত্ব সহকারে স্থান পায় না? অথচ বিশ্বের কোথাও একটি বিমান হাইজ্যাক হলে যেন তুলকালাম কান্ড শুরু হয়? কেন তারা অন্যদের চেয়ে আরবদের সস্তা মনে করে? আসলে এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ ও কম্যুনিজমের শয়তানী আঁতাত গড়ে উঠেছে।
বস্তুত মুসলিম তরুণদের মতে মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা বিদেশী শক্তির দাবার গুটিমাত্র। তাদেরকে সামরিক অভ্যুথ্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনে মুসলমানদের চৌখে ‘হীরো’ সাজানো হয়। এই ধারণার মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহের আলোকে একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। এসব ঘটনা চোখে আয়্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যেই এই শাসকরা শয়তানী চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছে। এই নেতারা দৃশ্যত মুসলমান ও ইসলামের জন্যে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে, আসলে তারা মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের পোষা এজেন্ট।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রত্যেক সাহাবী ছিলেন ইসলাম প্রচারক (দাইয়া)। কুরআন আরো বলছে: “বল, এটাই আমার পথ: আল্লfহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি সজ্ঞানে। আমি ও আমার অনুসারীগণ।” (১২:১০৮)
অতএবসংস্কার কর্মীদের লক্ষ্য হচ্ছে: “নিজে সৎ হও অপরকে সৎ করো।” আলকুরআনের ভাষায়: “কে উত্তম আল্লাহ্র (সাহায্যের) হাত জামা’তের সাথেই থাকে।” তিনি আরো বলেন: “একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারের কাছে সেই ইমারতের মতো যার বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত।” (বুখারী)
নিজেদের মধ্যে সহৃদয় সহযোগিতা এবং সৎ কাজের আদেশ কেবল একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। অতএব দাওয়াতী ক।ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক- এছাড়া দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে। বাস্তব কথা হচ্ছে ইসলাম বিরোধী শক্তি বিভিন্নভাবে সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছে, অতএব মুসলমানদেরকেও সংঘবদ্ধ হয়েই ঐ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। আন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়তে থাকব যখন অন্যরা এগুতে থাকবে। অতএব যেসব মুসলিম দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত দাওয়াতী কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, সরকারীভাবে এমনকি সেন্সরশীপের মাধ্যমে তারা মস্ত বড় গুনাহ করে। দাওয়াতী কাজে ভীতি প্রদান ও বাধা সৃষ্টিও চরমপন্থী মনোভাব সৃষ্টির প্রধান কারণ, বিশেষ করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও মার্ক্সবাদ প্রচারে কোনো বাধা দেয়া হয় না; বরং সকর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয় তখন এটাকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এ কারণে যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বিপ্লবের কাজে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই, কোনো সরকারেরও থাকতে পারে না।
বস্তুত মুসলিম দেশগুলোতেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা করতে গিয়ে সেন্সরশীপ ও নানা রকম দলনের শিকার হতে হচ্ছে। সেখানে ইসলামের চেহারা হচ্ছে পশ্চাদপদতা ও অবজ্ঞায় এবং আচার-অনুষ্ঠান, বিদাতী কাজ কাম, শাসক-তোষণ এবং শাসকদের গদী বহাল রাখার দেয়ার মধ্যে সীমিত। আর দুর্নীতিপয়ারণ শাসকরাও এ ধরনের ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় অতি উৎসাহী। এভাবে অন্যায়-অবিচার শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদকে তারা স্যাবোটাজ করার অপচেষ্টা চালায়। মার্কস সম্ভবত এই অর্থে দাবী করেছিলেন, “ধর্ম জনগণের জন্যে আফিম।”
কিন্তু কুরআনুল করীম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন যে ইসলাম রেখে গেছেন তা হচ্ছে সত্য, শক্তি, সম্মানান-মর্যাদা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জিহাদের প্রতিভূ। আর শাসকরা এই ইসলামকে ভয় পায়; কারণ তাদের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কি জানি কখন বিদ্রোহ দেখা দেয়! পক্ষান্তরে এই ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বলে: “তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করতো এবং তাঁকে ভয় করতো, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করতো না।” (৩৩:৩৯)
এই পরিছন্ন বিশ্বাসের আলোকে ঈমানদাররা মনে করে যেহেতু জীবন মেয়াদ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত, অতএব কাউকে ভয় করার দরকার নেই, আর তিনি ছাড়া কারো কাছে পার্থনারও দরকার নেই। সমসাময়িক তুরস্কের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার একজন উপপ্রধান মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি একটি দলের নেতা। তাদের বিরুদ্ধে শরীয়ত প্রবর্তন করার দাবী জানানোর অভিযোগ আনা হয়। অথচ তুরস্কের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান! উক্ত নেতা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ খাড়া করা হয়। অভিযোগগুলোর মূল বিষয় ছিলো তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে এসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। ধর্মনিরপেক্ষ আতাতুর্কের অনুসারী তুরস্কের তদানীন্তন সামরিক সরকার শরীয়ত তথা আসলামী জীবন বিধান পুনঃপ্রবর্তনের যে কোন প্রচেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ উক্ত গ্রুপ সর্বসম্মত আইনানুগ পন্থায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা শক্তি প্রয়োগ করে সহিংস পন্থায় সরকার উৎখাত করতে চাননি। সামরিক কৌশুলী তাদের বিরুদ্ধে নানা আপত্তিকর শ্লোগান তোলার অভিযোগও উথ্থাপন করে। শ্লোগানগুলো ‘আশাশারীয়াহ এবং ইসলাম এক ও অভিন্ন’ এবং আল-কুরআনই হচ্ছে সংবিধান।’
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মুসলমানই যিনি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দ্বীন ও হযরত মুহাম্মদ (সা) কে রাসূল হিসেবে স্বীকার করেন তার পক্ষে কী এগুলো অস্বীকার করা সম্ভব? যখন ঈমানের পরিবর্তে কুফর এবং হারামকে হালাল করা হয় তখন মুসলমানদের কীকরা উচিত? এসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কী বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থার মূল কারণ নয়? একটি আফ্রো-আবর দেশে কম্যুনিস্ট তৎপরতার জন্যে সাংবিধানিক সুযোগ ও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামী ভাবধারা জাগ্রত করার সকল প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ঐ দেশটি নিজেকে তথাকথিত “স্বাধীন বিশ্বের অঙশ” বলে বিবেচনা করে। আরো মারাত্মক হচ্ছে ঐ দেশটির মুসলিম নেতা-কর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও একমাত্র অভিযোগ, তারা আল্লাহ্ কে প্রভু, সত্যকে লক্ষ্য, ইসলামকে একমাত্র পথ, কথাকে অস্ত্র এবং জ্ঞানকে তাদের একমাত্র খোরাক বলে ঘোষণা করেছিলো।
অতএব, হেকমত ও সুন্দর ভাষণের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তরুণরা যদি শক্তিকে ও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়ে মোকাবিলা করতে চায় তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়? এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ইন্ শাআল্লাহ ইসলাম যেভাবে হোক সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে। তাদেরকে সুস্থ ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করতে দেয়া উচিত। অন্যথায় ঘটনাবলী অবাঞ্ছিত বিপরীত খাতে প্রবাহিত হতে পারে। খোলাখুলি কাজ করতে না দিলে দাওয়াতী কাজ বিভ্রান্তিকর গোপন সহিংসতা কিংবা চরমপন্থার রূপ নিতে পারে। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের মারাত্মক ভুল হচ্ছে তারা ইসলামী আন্দোলন দমনে বন্দী শিবির সহিংস মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। বন্দীশিবিরগুলোতে মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এ প্রনঙ্গে ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের মিসরের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। সামরিক কারাগারে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদেরকে লোমহর্ষক ও অবিশ্বাস্য পন্থায় শাস্তি দেয়া হয়। এখনো এসব কথা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তাদের দেহে আগুন ও সিগারেটের ছ্যাঁক দেয়া হয়, নারী ও পুরুষ বন্দীকে জবাই করা পশুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়, কারারক্ষীরা পালাক্রমে রক্ত ও পুঁজ জমে না ওঠা পর্যন্ত বন্দীদেরকে আগুনে ঝলসাতে থাকে। এই পাশাবিক আচরণে অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু শাস্তিদাতাদের দিল আল্লাহর ভয়ে এতোটুকু কেঁপে ওঠেনি। নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদের উদ।ভাবিত সকর নির্যাতন কৌশল তারা নির্বাচারে আল্লাহ্র পথের মুজিহিদদের ওপর প্রয়োগ করে।
এই বন্দীশালায় চরমপন্থা ও তাকফীরের প্রবণতা জন্ম নেয়। বন্দীদের মনে প্রশ্ন জাগে : আমরা কি অপরাধে হচ্ছি? আমরা আল্লাহর কালামের কথা ছাড়া আর কিছুতো বলিনি? আল্লাহর পথে জিহাদে আমরা কেবল আল্লাহ্ রই সাহায্য চেয়েছি, অন্য কারো কাছে তো পুরস্কার বা প্রসঙসা চাইনি? এই প্রশ্ন আরো প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই পশুরা কে যারা আমাদের নির্যাতন করে, আমাদের মানব সত্তাকে অপমানিত করে, আমাদের ধর্মকে অভিশাপ দেয়, আমাদের প্রভুরও অমর্যদা করার মতো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে! একজন পদস্হ কর্মকর্তা একদিন বলে: ‘তোমাদের প্রভুকে আমার কাছে হাযির করো, তাকে আমি জেলে পুরব।” এই পশুগুলোকে কি মুসলমান বলা চলে? এরা যদি মুসলমান হয় তাহলে কুফরী কী? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এরাই হচ্ছে কাফির, এদেরকে ইসলামের
আওতা থেকে বিতাড়িত করতেই হবে। এরপর আরো প্রশ্নের উদয় হয়: এদের সম্পর্কে এই যদি হয় আমাদের বিচার, তাহলে এদের মনিব সম্পর্কে আমরা কি সিদ্ধান্ত নেবো? ক্ষমতার আসনে বসে যেসব নেতা ও শাসক ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকেই বা কিভাবে বিচার করা উচিত? তুলনামূলক বিচারে তাদের অপরাধ অধিকতর মারাত্মক এবং তাদের রিদ্দাহ আরো স্পষ্ট- যে সম্পর্কে কুরআনুল করীমে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা সত্যত্যাগী।” (৫:৪৭)
এই সিদ্ধান্তে আসার পর ঐ নির্যাতিত মুসলমানরা তাদের সহবন্দীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: যেসব শাসক আল্লাহ্র বিধান মোতাবেক বিচার করে না এবং যারা শরীয়তের বাস্তয়নে সংগ্রামরত তাদের সাথে একমত হলো তাদেরকে শত্রু গণ্য করলো। এমনকি কাফিরও মনে করলো, কেনা কাফিরের কুফরী সম্পর্কে যে সন্দেহ পোষণ করে সে নিজেই কাফির। কিন্তু একানে শেষ নয়। যেসব লোক ঐরূপ শাসকের আনুগত্য করে তাদের সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠলো। জবাব তৈরি ছিলো: তাদের শাসকের আনুগত্য করে সে নিজেও কাফির।
এভাবে ব্যক্তি গ্রুপ বিশেষকে কুফরী ফতোয়া দেয়ার্ প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সহিংসতা শুধু সহিংসতার জন্ম দেয় না, সুস্থ চিন্তাকেও দূষিত করে এবং ঐ দলন-দমন অর্নিবার্য বিদ্রোহের জন্ম দেয়।Faru
প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, কোনো একটা মাত্র কারণ গোঁড়ামী বিস্তারের জন্যে সামগ্রিকভাবে দায়ী নয়। এটা একটা জটিল অদ্ভুত বিষয়। এর পেছনে নানা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি প্রত্যক্ষ, কোনোটি পরোক্ষ, কোনোটির গোড়া সূদুর অতীতে আবার কোনোটির উৎপত্তি বর্তমানে। সুতরাং একটি বিশেষ কারণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অনান্য কারণগুলো উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কোনো কোনো মতের প্রবক্তারা এরূপ একপেশে দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণে অভ্যস্ত। উদাহরণস্বরূপ মনোবিজ্ঞানী, বিশেষত মনস্তত্ত্ববিদরা অবচেতন মন থেকে উদ্ভূত কারণগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানীরা সামজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের মুখে মানুষের অসহায়ত্বের দিকে ইঙ্গিত দেন। তাদের দৃষ্টিতে মানুষ হচ্ছে সমাজের হাতে বন্দী প্রাণহীন পুতুল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রবক্তারা যুক্তি দেখান, অর্থনৈতিক শক্তিই ঘটনাবলীর স্রষ্টা এবং এটাই ইতিহাসের গতডি পরিবর্তন করে।
পক্ষান্তরে আরেক দল অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও ভারসাম্যময় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তাদের মতে কারণসমূহ অত্যাধিক জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এগুলো নানবিধ ক্রিয়া উৎপন্ন করে এবং একটা থেকে আরেকটার রূপ ভিন্ন। কিন্তু শেষ বিশ্লষণে এগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। গোঁড়ামির কারণসমূহ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা সবগুলোর সমন্বয়ও হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অথবা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সমাজে অথাৎ সেই সমাজের বিশ্বাস ও আচরণ,কল্পনা ও বাস্তব, ধর্ম ও রাজনৈতিক, কথা ও কাজ, আকাঙ্ক্ষা ও সাফল্য অথবা দ্বীন ও দুনিয়ার অসংগতির মধ্যে এর কারণসমূহ বিদ্যমান থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এসব পরস্পর বিরোধিতা বৃদ্ধরা মেনে নিলেও তা সাময়িকমাত্র।
ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতির দরুনও চরমপন্থা বিস্তার লাভ করতে পারে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থপরতা, তোষামোদপ্রিয়তা, মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের প্রতি সেবাদাসবৃত্তি, স্বদেশের জনগণের অধিকার হরণ ইত্যাদি মানুষের মাঝে চরমপন্হী মনোভাবের জন্ম দেয়। মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ শেষ পযর্ন্ত ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
গোঁড়ামির আরেকটি প্রধান কারন হচ্ছে, দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অথাৎ এর উদ্দেশ্যে ও মূল চোতনার গভীর তাৎপর্য উপলদ্ধিতে ব্যর্থতা। এই উপলদ্ধির অর্থ সার্বিক অজ্ঞাতাকে বোঝায় না। সার্বিক অজ্ঞতা বাড়াবাড়ি বা গোঁড়ামির জন্ম দেয়। আসলে অল্পবিদ্যা হচ্ছে ভয়ঙ্করী। এসব লোক মনে করে সেসব কিছু জানে এবং নিজেই যেন ফকীহ। আসলে সে নানা অজীর্ণ জ্ঞানের জগাখিচুড়ি। সে বিভিন্ন খন্ডের রূপ এবং তার সাথে অখন্ডের সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যার্থ। ফলে তার সামগ্রিক দৃষ্টভঙ্গি কখনো পরিচ্ছন্ন হতে পারে না। অতএব তার পক্ষে কনো সুনির্দৃষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব। এমন ব্যক্তি যদি নিজেকে ফকীহ বলে দাবী করে তাহলে দীনের অবস্থা কী হবে! ইমাম আবু ইসহাক আশ-শাতিবী তার আল-ইতিশাম গ্রন্থে অল্পবিদ্যার বিপদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। বিদআত এবং মুসলিম উম্মাহর অনৈক্যের মূল কারণ হলো আত্মজ্ঞানের অহঙ্কার, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে মনে করে কেউ যখন ইচ্ছা মাফিক ইজতিহাদ শুরু করে রায় দিতে থাকে তখন তাকে অবশ্যই মুবতাদী ( নতুন কিছু উদ্ভাবনকারী) বলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) এ ধরনের লোক সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন: “আল্লাহ জ্ঞান কেড়ে নেন না জনগনের (হৃদয়) থেকে। কিন্তু যখন কোনো আলিম থাকে না তখন তিনি তা কেড়ে নেন এবং জনগণ অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের নেতা বানাবে যারা জ্ঞান ছাড়াই রায় দেবে, সুতরাং তারাও বিপথগামী হবে, জনগণকেও বিপথগামী করবে।” (বুখারী)
এ থেকে বিজ্ঞাজনেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, খাঁটি আলিমরা জনগণকে বিভ্রান্ত করেন না। কিন্তু তাদের অভাবে আলিমের বিশ্বাসভাজন কখনোই বিশ্বাস ভঙ্গ করে না, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক তা পারে। এর সাথে যোগ দিয়ে বলা যায় খাঁটি আলিম কখনোই বিদআতের জন্ম দেয়। আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, রাবিয়া একদিন খুব কাঁদছিলেন। তার ওপর কোনো মুসিবত এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “না, এ জন্যে কাঁদছি যে, মানুষ তাদের কাছ থেকে ফতোয়া তালাশ করেছে যাদের কোনো জ্ঞান নেই।”
বস্তুত সার্বিক অজ্ঞতার চেয়ে অহংকারযুক্ত অল্পবিদ্যার পন্ডিত কখনোই তার সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে না। এদের একটি লক্ষণ হলো এরা আক্ষরিক অর্থের প্রতি বেশী জোর দেয়, তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য উপলব্ধির চেষ্টা করে না। আলজাহিরিয়া মতাবরম্বীরা এ ধরনের পণ্ডিতী করতো। তারা আত-তালিল ও কিয়াস অগ্রাহ্য করতো।
“সমকালীন জাহিরিয়া” মতালম্বীরা পূর্বসূরীদের পথ ধরে যুক্তি প্রদর্শন করে যে, বাধ্যতামূলক কাজকর্মের কোনো গভীর অর্থ খোঁজা উচিৎ নয়। অবশ্য নব্যজাহিরিয়ারা পূর্বসূরীদের মতো তালিল পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে না। আমার ও অন্যান্য আলিমের মতে ইবাদত হচ্ছে এমন বাধ্যতামূলক কর্তব্য যার কারণ ও উদ্দেশ্য কখনোই বিশ্লেষণযোগ্য নয়। তবে যেসব শিক্ষা আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রন করতে চায় সেগুলো অবশ্যই বিশ্লেষণ করতে হবে।
সুতরাং কোনো মুসলমান দান-খয়রাত করে বলে তার হজ্জ করা উচিত কিংবা হজ্জের সময় কুরবানীর অর্থ সদকা করে দেয়া উচিত-এই দাবী করা ভুল হবে। তেমনিভাবে এটাও অচিন্তনীয় যে, আধুনিক কর যাকাতের স্থান দখল করবে, রমযানের পরিবর্তে অন্য যে কোনো মাসে রোযা কিংবা শুক্রবারের স্থলে অন্য যে কোনো দিন জুমআ’র নামায আদায় করা যাবে। এসব বাদ দেওয়া যাবে না। এগুলো সবই মুসলমানের জন্যে অবশ্য পালনীয়। কিন্তু এ ধরনের আনুষ্ঠানিক ইবাদত প্রক্রিয়া ব্যতীত অন্য যে কোনো বিষয়ের কারণ ও উদ্দেশ্য আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সঠিক উপলব্ধির পর ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
এখন আমরা কতিপয় প্রামাণিক বিষয় পর্যালোচনা করতে পারি:
ক. একটি বিশ্বস্ত হাদীসে বলা হয়েছে, কাফিরের দেশে কুরআন শরীফ নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, কাফিররা কুরআনের ক্ষতি বা অবমাননা করতে পারে এই আশংকায় রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ আদেশ দিয়েছেন। এরূপ আশংকা না থাকলে যেখানে ইচ্ছে কুরআন শরীফ নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া দাওয়াতী কাজের জন্যে এটা তো অপরিহার্য।
খ. আরেকটি হাদীসে মাহরাম (অথাৎ বিষয় অযোগ্য পুরুষ আত্মীয়) সঙ্গী ছাড়া মুসলিম নারীকে সফর করতে নিষেধ করা হয়েছে। নারীর নারাপত্তা ও সফরের কষ্ট লাঘবই এর উদ্দেশ্য। আধুনিক যুগে যেহেতু সফরের এতো ঝুঁকি নেই তাই কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে গাড়িতে তুলে দিতে পারেন। গন্তব্য স্থানে কোনো মাহরাম ব্যক্তি তাকে স্বাগত জানালে দোষের কিছু নেই। বস্তুত রাসূলুল্লাহ (সা) যোগাযোগ ব্যবস্থার এরূপ উন্নতির আভাস দিয়ে বলেছিলেন, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করেই ইরাক থেকে মক্কা ভ্রমন করতে পারবে।
গ. রাসূলুল্লাহ (সা) দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর রাতে বাড়ি ফেরা নাষিদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেও সক্লে বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। এর দু’টো কারণ। প্রথম, আকস্মিকভাবে স্বামীর রাতে বাড়ি ফেরার মধ্যে স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস ইসলাম সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত, স্ত্রী যেন নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে পারে সে জন্যে স্বামীর আগমনের সময় জানার অধিকার তার আছে। কিন্তু এখন এসব আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ খুব কম। মানুষের যাতায়াতের সময়সূচী মেনে চলতে হয়। কে কখন কোথায় যাবে তা আগেভাগেই নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বাড়ি যাওয়া আগে টেলিফোন বা চিঠিতে জানানো উচিত। সুতরাং আমাদেরকে স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে উক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণ ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করতে হবে।
যাকাতকে ইবাদত মনে না করে অনেকে এটাকে কেবল অর্থ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গণ্য করতে চান। যাকাত ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ধর্মীয় কর্তব্য। এটা ইসলামী শরীয়ত ব্যবস্থার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও স্থায়ী আয়ের সূত্র, সেই হিসেবে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থারও স্তম্ভ। তাই এটার বাধ্যবাধকতাকে খর্ব করার কোনো উপায় নেই। যাকাতের সামাজিক সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য করে সকল মাযহাব-এর আহকামের ব্যপারে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ফসলের (ফল ও শস্য) দ অথবা পাঁচ ভাগ গরীবদের দান করা বাধ্যতামূলক- সে ফসল শুকনোই হোক আর তাজা হোক। সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে - এর মূল লক্ষ্য। ধনীর সম্পদে গরীবের সুনির্দিষ্ট হিস্যা আছে। আর এর লক্ষ্য হচ্ছে পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা: “তাদের সম্পদ থেকে তুমি সাদকা গ্রহন করো। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবে।”
একজন আধ্রনিক পন্ডিত “খাদ্যশস্যের ওপর সাদকা নেই” এই হাদীস উদ্ধৃত করে উপরোল্লিখিত যুক্তি অস্বীকার করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে খাদ্যশস্যের ওপর যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল না বলেও তিনি দাবী করেন। কিন্তু হাদীসটি দুর্বল বিধায় তার যুক্তি মিথ্যা এবং বলেছেন এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো প্রামাণিক হাদীস নেই। দ্বিতীয় যুক্তিটিও দু’টি কারণে মিথ্যা। প্রথম কারণ, ইমাম ইবনুল আরবীর ভাষায় এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে বর্ণিত সুস্পষ্ট বিধানের মুকাবিলার অন্য কোনো প্রমাণ অগ্রাহ। কুরআন বলছে : “মৌসুমের ফলমূল থেকে খাও ; কিন্তু ফসল সংগ্রহের দিনে ন্যায্য হিস্যা দান করে দাও।” (৬ : ১৪১)
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় এ ব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে, তিনি হয়তো বিষয়টি তাঁর উম্মতের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। কেননা সে যুগে ফলমূল ও খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা কষ্টকর ছিলো।
অবশ্য উক্ত পন্ডিত স্বীকার করেছেন যে, একটি হাদীসে কেবল খেজুর, গম, কিসমিস ও বার্লির ওপর যাকাত সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ হাদীসটিও দুর্বল এবং কোনো কোন হাদিস বিশারত এর প্রামাণিকতা স্বীকার করেননি বিধায় কোনো মাযহাব একে প্রমাণিক বলে গ্রহণ করেনি। সুতরাং সকল ফলসের ওপর যাকাতের বাধ্যতামুলক বিধানকে কিভাবে অস্বীকার করা যায় যখন কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে : “তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট খাদ্য শস্য, জলপাই ও ডালিম র্সষ্টি করেছেন। এগুলো একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও। যখন এটা ফলবান হয় তখন ফল খাবে আর ফসল তুলবার দিনে এর দেয় প্রদান করবে। ” (৬:১৪১)
আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে: “হে ইমানদারগন, তোমরা যা কিছু উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদান করে দিই তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো।” (২:২৬৭)
একটি প্রমানিক হাদীসেও যাকাত প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “নদী অথবা বৃষ্টির পানি বিধৌত জমি থেকে এক-দশমাংশ; (সেচের) পানি সিঞ্চিহত জমি থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ ।” (ইমাম আবু হানিফা: আহকামুল কুরআন) এই হাদীসে কোনো বিশেষ ফসলের মধ্যে যাকাতকে সীমিত করা হয়নি। এখানে বাধ্যতামূলক হার পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে উমর ইবনে আবদুল আজিজ ও ইমাম আবু হানিফা (রহ) এ ব্যাপারে কুরআনী আয়াতের (৬:১৪১)
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ)-র মতগুলোকে অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ় বলে উল্লেখ করেছেন। অনান্য মাযহাবের প্রমাণগুলোকে দুর্বল আখ্যায়িত করে ইবনুল আরবী (রহ) বলেছেন, “ আবু হানিফা (রহ) (পূর্বোউল্লিখিত) মূল সূত্রগুলোকে আয়নার মত ব্যবহার করেসত্যকে অবলকন করেছেন।” শরাহ আত-তিরিমিযীতে আরবী (রহ) বলেন, “(যাকাতের ব্যাপারে) আবু হানিফা (রহ)-এর মাযহাব সূদৃঢ় প্রমাণ পেশ করেছে।” আহকাম ও তাদের কারনগুলোর মধ্যেকার সঙ্গতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে মারাত্মক স্ববিরোধিতার আশংকা থাকে। তখন আমরা একই বিষয়কে ভাগ ভাগ করে দেখি। আবার বিভিন্ন বিষয়কে এক করে ফেলি। এটা হচ্ছে সুবিচারের পরিপন্থী যার ওপরে আশ-শারীরাহ প্রতিষ্ঠিত পাণ্ডিত্যভিমানীরা কোনো জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি ছাড়াই আহকামের কারন খুঁজতে গিয়ে বিষয়গুলোকে জটিল করে তোলেন। এ জন্যে জনগণের কছে সত্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে অথবা বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যে ইজতিহাদের দ্বার খুলে দিতে হবে। সেই অনধিকার চর্চাকারী পরজীবীদের বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকা দরকার।
১. ছোট খাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা
বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধাত্বের একটি লক্ষন হচ্ছে বড় বড় বিষয় উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেত থাকা। অথচ বৃহৎ বিষয়গুলৌ এতো গুরুত্বপূর্ন যে, এগুলোর প্রতি উদিসীন উম্মাহর অস্তিত্ব, আশা-আকাক্ষা, পরিবেশ তথা সামগ্রিক সত্তাকে বিপন্ন করতে পারেঅ দাড়ি রাখা, গোড়ালীর নিচে পযর্ন্ত কাপড় পরা, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নাড়ানো, আলৌকচিত্র রাখার মতো ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে অবিরাম বাড়াবাড়ি চলছে।এমন এক সময় এসব নিয়ে হৈ চৈ করা হচ্ছে যখন মুসলিম উম্মাহ ধর্ম নিরপেক্ষবাদ , ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের নিরবচ্ছিন্ন বৈরিতা ও অনুপ্রবেশের সম্মুখীন । ক্রীশ্চান মিশনরীরা মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ইসলামী চরিত্র ক্ষুণ্ণ করার জন্যে নতুন ক্রুসেড শুরু করেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন আংশে মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম ধর্ম প্রচারকরা চরম ভীতি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমি দেখছি, যারা শিক্ষাদীক্ষা আথবা জীবিকা অর্জনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপে এসেছেন, তাঁরাও ছোটখাট বিতর্কিত বিষয়গুলো সাথে নিয়ে এসেছেন এবং এ নিয়ে মাথা ঘামান। এটা এক কথায় র্মমান্তিক! আমি নিজে দেখেছি এবং শুনেছি এসব বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্য অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিষয়গুলো ইজতিহাদ সাপেক্ষ। এগুলো এমন বিষয় যা নিয়ে ফকীহদের মত সর্বস্মত হয় না। আমি নিজেও এগুলের ওপর বক্তব্য রেখেছি। যা হোক এসব নিরর্থক মাসলা-মাসাকয়েল নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ না করে প্রবাসীদের উচিত ইসলামের মূল সত্যকে আঁকড়ে ধরা। বিশেষ করে মুসলিম তরুণদের এদিকে আকৃষ্ট করা, তাদেরকে অবশ্য পালনীয় কাজগুলো করতে এবং কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা । এই দায়িত্ব পালনে সফল হলে ইসলাম প্রচারে এক নতুন আশার সঞ্চার হেব।এটা দুঃখজনক যে, যারা এ ধরনের বিতর্ক ও সংঘাতের সূত্রপাত করেন তারাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধি পালনে উদাসীন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাতা-পিতার প্রতি কতব্য, স্ত্রী ও সন্তান প্রতিপালন, প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব, সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন, বৈধ ও অবৈধ বিচারে সতর্কতা ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু তারা নিজেদের মান উন্নত করার পরিবর্তে বিতর্ক সৃষ্টি করে খুব মজা পান। শেয় পর্যন্ত তাদেরকে এর দরুন বৈরিতা অথবা মুনাফিকীর ন্যায় আচরণ করতে হয়। একটি হাদীসে এরূপ বাক-বিতন্ডার কথা উণ্ণখ করা হয়েছে : “যারা (সঠিক) পথ পেয়েছে তারা কখনো বিভ্রান্ত হবে না যতক্ষন না তারা বাক-বিতন্ডায় নিমজ্জিত হয়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) এ রকমও দেখা যায়, কেউ কেউ আহলে কিতাবদের জবাই করা পশুর গোশত মুসলমানদেরকে খেতে নিষেধ করেন যদিও বর্তমান ও অতীতে এর বৈধ হওয়া সম্পর্কে ফতোয়া আছে। অথধচ এ রকম লোকদেরই দেখা যাবে এর চেয়ে বড় বড় নিষিদ্ধ কাজ করতে তারা সিদ্ধহস্ত। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের একটা ঘটনার কথা আমি শুনেছি। এক ব্যক্তি খুব বড় গলায় বলছিল ইহুদী ও খৃষ্টানদের জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। কিন্তু সে নির্লজ্জের মতো অন্যদের সাথে একই টেবিলে বসে মদ সহযোগে ঐ গোশত ভক্ষণ করছিলো। অথচ সে নির্দ্বিধায় একিট অনিশ্চত ও বিতর্কিত বিষয়ে গোঁড়া বক্তব্য রাখছিলো। ঠিক এ রকম পরস্পর বিরোধী আচরণ দেখে একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। হযরত হুসাইনের (রা) শাহাদাতের পর ইরাক থেকে এক ব্যক্তি এসে তাকে মশা মারা হালাল কি হারাম জিজ্ঞেস করলো। ইমাম আহমদ তাঁর মসনদে বর্ণনা করছেন:
আমি ইবনে উমরের সাথে বসেছিলাম । একিট লোক এসে তাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞস করলো। ইবনে উমর (রা) তাকে বললেন, “তুমি কোত্থেকে এসেছ?” সে জবাব দিল, “ইরাক থেকে।” তখন ইবনে উমর বললেন, “দেখ লোকটির দিকে! সে আমাকে মশার রক্ত সম্পর্কে প্রশ্ন করছে, অথচ তারা (ইরাকিরা) রাসূলুল্লাহ (সা)- এর পৌত্রকে [আল-হুসাইন ইবনে আলী (রা)] হত্যা করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) - কে বলতে শুনেছি : “তারা (হাসান ও হুসাইন) এই জগতে আমার দু’টি মিষ্টি মধুর সুরবিত ফুল।” (আহমাদ)
২.নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাড়াবাড়ি
ইসলামী আইনশাস্র ও শরীয়াহর জ্ঞানের অবাবে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি দেখা যায়। কুরআন ও সুন্নায় এর বিরুদ্ধে পরিস্কার সতর্ক বাণী রয়েছে। কুরআন বলছে :“তোমাদের মুখ থেকে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটি হালাল এবং ওটি হারাম।” (১৬: ১১৬)
রাসূলুল্লাহ (সা) - এর সাহাবী এবং প্রাথমিক যুগোর বুজর্গানে দ্বীন নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত কনো জিনিসকে নিষিদ্ধ বা হারাম বলে ফতোয়া দিতেন না। কিন্তু চরমপন্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে হারাম ফতোয়া দিতে যেন এক পায়ে খাড়া থাকে। ইসলামী আইনশাস্ত্রে কোন বিষয়ে যদি দুটো মত থাকে যদি এক পক্ষ বলে মুবাহ, আন্য পক্ষ বলে মাকরূহ; চরমপন্থীরা এক্ষেত্রে মাকরূহকে সমর্থন করে পরহেযগারী যাহির করে। এক পক্ষ যদি একটি বিষয়কে মাকরূহ এবং অন্য পক্ষ হারাম বলে ঘোষণা করে সে ক্ষেত্রে গোঁড়া ব্যক্তিরা হারামের পক্ষ নিয়ে সাধুতার প্রমাণ রাখতে চায় অর্থাৎ সহজ ও কঠিনের মধ্যে তারা শেষোক্তটাকে বেছে নেয়াই অধিকতর তাকওয়ার লক্ষণ বলে মনে করে। তারা ইবনে আব্বাসের (রা) কঠোর মত গ্রহণে বেশি আগ্রহী। বস্তুত এই প্রবণতা মধ্যমপন্থার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই ফসল। বিষয়টি বোঝায় সুবিধার্থে আমি একটি প্রত্যক্ষ ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
একদিন এক গোঁড়া লোক অপর এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে দেখে তার পাক সাফ হওয়ার জন্যে তৎক্ষণাৎ বমি করতে বলল। আমি তখন গোঁড়া লোকটিকে নম্রবাবে বললাম, “এজন্য এতো কঠোর ব্যবস্থার দরকার পড়ে না। এটা একটা চোট ব্যাপার।” সে বলল, হাদীসে এটা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি ভুলক্রমে করে বসে তবে সহীহ হাদীসে বমির বিধান আছে।” আমি জবাব দিলাম, “কিন্তু দাঁড়িয়ে পানি খাওয়ার পক্ষে যে হাদীস আছে তা অধিক প্রমাণিত এবং বুখারীর একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম হলো, “দাড়িয়ে পানি পান করা।” ঐ ব্যক্তি নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোনো হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে পারলো না । অথচ এটা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের সময় দাঁড়িয়ে পানি পান করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম)
এছাড়া একবার হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে করতে বলেছিলেন, “এটা অনেকেই পছন্দ করে না, কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এরূপ করতে দেখেছি যেমন তোমরা আমাকে দেখছ।” (বুখারী, মুসলিম)
ইবনে উমরের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে ইমাম তিরমিযী বলছেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে আমরা চলন্ত অবস্থায় খাবার খেতাম এবং দাঁড়িয়ে পানি পান করতাম।” কাবশাহ (রা) বলেন, “আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সা) -কে ঝুলন্ত মশক থেকে পানি পান করতে দেখেছি।”
মোটকথা নির্ভরযোগ্য হাদীস বিশারদদের ব্যাখ্যা থেকে আমরা দেখতে পাই বসে পানি পান করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ নেই। আর দু’টো ব্যাপারই প্রমাণিত। অতএব, কেউ দাঁড়িয়ে পান করলেও নিষেধ নেই। কেউ দাঁড়িয়ে পানি পান করলেই বমির বিধান জারি করাটা সম্পুর্ণ ভুল।
একইভাবে, আজকাল অনেক তরুণ ইসলামী পোশাক নিয়ে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত। হাদীসে এর দৃঢ় ভিত্তি আছে: “(পোশাকের) যে অংশ গোঁড়ালির নিচে (ঝুলে থাকে) তা আগুনে (পুড়বে)।” (বুখারী)
এ জন্য অনেক তরুণকে গোঁড়ালির উপরে পোশাক পরতে দেখা যায় এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের উপরেও এটা চাপাতে চায়। কিন্তু এরূপ চাপাচাপির ফলটা এই হবে যে, একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই গোঁড়ামির অভিযোগ আনবে। এটা সত্য যে, কিছু হাদীসে গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আবার অন্য হাদীসে এই নিষেধাজ্ঞার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। একদা এভাবে কাপড় পরাকে অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও অপচয়ের লক্ষণ মনে করা হতো। দৃষ্টান্তস্বরুপ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সেই ব্যক্তির দিকে থাকবেন না যে অহঙ্কারবশত তার কাপড়কে (পেছনে) টেনে নিয়ে যায়।” (মুসলিম)
হযরত আবু বকর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, “আমার ইজার অসাবধানতাবশত নিচে নেমে যায়।” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন “যারা গর্বোদ্ধত হয়ে এরূপ করে তুমি তাদের মধ্যে নও।” (বুখারী) এ কারনে আন-নববী ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীরা তম প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ কাপড় পরা মাকরূহ। কিন্তু মাকরূহ অনিবার্য কারণে মুবাহ হতে পারে।
৩. ভ্রান্ত ধারণা
ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান থেকেই মূলত বিতর্কের সূত্রপাত। এ জন্যে ইসলাম, ঈমান, কুফর, নিফাক ও জাহিলিয়াত ইত্যাদির সঠিক সংজ্ঞা ও পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ভাষাগত জটিলতা, বিশেষত আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তির অভাব বহুলাংশে বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণার জন্যে দায়ী। ফলত অনেকেই রূপক ও প্রকৃত অর্থের মধ্যে তারতম্য উপলদ্ধি করতে পারেন না। ঈমান ও পূর্ণ ইমান, ইসলাম ও প্রকৃত ইসলাম, বিশ্বাসে মুনাফেকী ও কর্মে মুনাফিকী, ছোট ছোট শিরক ও বড় বড় শিরকের মধ্যে তারা পার্থক্য করতে অক্ষম । এখন আমি এসব বিষয়ের একিট সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। এতে এ সম্পর্কে আমারা সতর্ক হতে পারব। বস্তুত অনুভূতি, কথা ও কাজের সমন্বয়ে ঈমান পূণৃ রূপ লাভ করে।কুরআনে এই ঈমান সম্পর্কে বলা হয়েছে :
“মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি করে দেয়।”(৮:২)
“ সেসব ঈমানদারই সফলকাম হয়েছে যারা বিনয়াবনত চিত্তে নামায আদায় করে।” “তারাই ঈমানদার যারা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তারপর কখনোই সন্দেহ পোষন করেনি এবং আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে লড়াই করেছে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (৪৯: ১৫) নিম্মোক্ত হাদীসেও ঈমানের এই রূপ তুলে ধরা হয়েছে:
“যারাই আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর ঈমান এনেছে তাদের উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ... যা ভাল তাই তাদের বলা উচিত নতুবা চুপ থাকা (উত্তম)।” (বুখারী)
আরেকটি হিদীসে ঈমানের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে : “সেই ব্যক্তি ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না সে তার (মুসলমান) ভাইয়ের জন্যে তাই ভাল মনে করবে যা সে তার নিজের জন্য ভাল মনে করেব।” (বুখারী)
এখানে লক্ষণীয়, শোষোক্ত হাদীসে দু’টিতে ঈমানের নেতিবাচক রূপ তুলে ধরে প্রকুতপক্ষে ঈমানের পূর্ণ রূপ তুলে ধরা হয়েছে।; সেরূপ ঈমান নয় যেমন বলা হয়: “যে তার জ্ঞান কাজে লাগায় না সে বিদ্বান নয়।” এখানে সীমিত জ্ঞান নয়, বরং পূর্ণ জ্ঞানের নেতিবাচক দিকটির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই হাদীসেও পূর্ণ ঈমানের পরিচয় বিধৃত হয়েছে: ঈমানের সত্তরটি শাখা আছে, তার মধ্যে একটি শাখা হচ্ছে লজ্জা বা হায়া। ইমাম আবু বকর আল-বয়হাকী তাঁর ‘আল -জামি’লী শুয়াব আল- ঈমান’ কিতাবে ঈমনকে একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছেন। গাছের কান্ড হচ্ছে ঈমানের মৌলিক অঙ্গের প্রতীক। যেহেতু গাছ এর কিছু শাকা-প্রশাখা নিয়ে ইসলামের আওতায় তাকতে পারে। ফেরেশ্তা ও তকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।”
আল-হাফিজ আল-বায়হাকী ফতহুল বারীতে লিখেছেন: “আমাদের বুজর্গ পূর্বপুরুষরা বলেছেন : ঈমান হলো হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপন, মুখে উচ্চারণ ও কর্মে রূপায়ণ। এর অর্থ বাস্তব জীবনে রূপায়ণ ছাড়া ঈমান পূর্ণ হতে পরে না। এ জন্যে তারা মনে করতেন ঈমান বাড়াতে ও কমাতে পারে। আল-মাজিয়াহ মনে করেন, ঈমান শুধু মনে ও উচ্চারণে; আল-করামিয়াহ বিশ্বাস করেন , উচ্চারণই যথেষ্ট; আল-মুতাযিলাহর ধারণা, ঈমান হলো বিশ্বাস, উচ্চারন ও বাস্তাবায়নের সমন্বত রূপ।... এ ব্যাপারে তাঁদের ও পূর্ববতী বুজর্গদের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে, পূর্বোক্তরা আমলকে ঈমানের প্রমাণ হিসেবে মনে করেন। আর শেষোক্তরা আমলকে পূর্ণতার শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পূর্ণ সত্তা কেবল আল্লাহ তায়ালাই। আমাদের কাছে ঈমানের মৌলিক ঘোষণাই যথেষ্ট। কেননা পরিপূর্ণ পরম সত্তা কেবল আল্লাহ জাল্লা জালালুহু। একবার যে মুখে ঈমানের ঘোষনা দেয় তখন থেকেই আল্লাহ শানুহুর দৃষ্টিতে তাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করা হয। যতোক্ষণ না সে এমন আচরন করে যাতে মনে হয় সে বেঈমান, যেমন মূর্তির কাছে মাথা নত করা। কেউ যখন পাপ কাজ করে তখন তাকে আমরা ঈমন সংক্রান্ত স্ব স্ব ধারণার আলোকে ঈমানদার ভাবতে আবার নাও ভাবতে পারি। পূর্ণ ঈমানদার। কারো বিরুদ্ধে যদি কাফির হওয়ার অভিযোগ ওঠে তবে এ কারণেই যে সে কুফরীর আচরণ করে।’
একজন কাফির যখন এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল, তখুনি সে মুসলমান হয়ে যায। তৎখণাত সে নামায আদায় করলো কিনা সেটা বড় কথা নয়। যাকাত ইত্যাদি এগুলো সে মেনে নিলো সেটাই বড় কথা। আমল কতটুকু করলো সেটা পরে লক্ষণীয়। কালেমার মৌখিক উচ্চারণের সাথে সাথেই সে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যারা কালেমা (শাহাদাত) উচ্চারণ করলো, তারা আমার কাছ থেকে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেলো... তাদেরকে আল্লাহর কাছেই জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী)
ইসলাম শব্দটিও ইবনে উমর (রা) বর্নিত পাঁটি স্তম্ভেকেই বোঝায়: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত - এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল; নামায আদায় করা যাকাত দেয়া, রোজা রাখা এবং হজ্জ আদায় করা।” হাদীস শাস্ত্রেও জিবরাঈল (আ)-এর মুখে ইসলামের সংঙা দেয়া হয়েছৈ। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন তাঁকে বলেন, “ইসলাম কী?” তখন তিনি বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা, নামায আদায় করা যাকাত দেয়া এবং রমযান মাসে রোজা রাখা।” (বুখারী)
জিবরাঈল (আ) এর কথা থেকে আমরা ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য বুঝতে পারি। এটাও পিরষ্কার যে, দু’টি শব্দকে এক অর্থেও ব্যবহার করা যায়। দু’টির একত্র সমাহারে দেখা যাবে একটির মধ্যে আরেকটির অর্থ লুক্কায়িত আছে, অথাৎ ঈমান ছাড়া ইসলাম নেই। ইসলাম ছাড়া ঈমান নেই। ঈমনের স্থান হৃদয় কন্দরে আর ইসলামের রূপায়ণ হচ্ছে আবেগ ও আচরণের সংমিশ্রণে। নিম্মোক্ত হাদীস থেকে আমরা এটাই উপলব্ধি করতে পারি: “ইসলাম হচ্ছে প্রকাশ্য আর ঈমান হচ্ছে অন্তরে (বিশ্বাসের বিষর)।”(আহমদ, আলবাজ্জাজ)
ঈমানের এই সংজ্ঞা আমরা কুরআনেও দেখতে পাই : “বেদুঈনরা বলে, ‘আমরা ঈমান আনলাম; বল, তোমরা ঈমান আননি বরং, তোমরা বল, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি, কেননা তোমাদের হৃদয়ে এখনও ঈমান প্রবেশ করেনি।” (৪৯:১৪)
আর ইসলামের পূর্ণ পরিচয় দিয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: “ইসলাম হলো (সেই অবস্থা) যখন তোমার হৃদয় (সম্পূর্ণরূপে) আল্লাহ্ র কাছে সমর্পিত হয় এবং যখন তুমি মুসলমানদেরকে তোমার যবান ও হাত দিয়ে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকো।” অন্য দু’টি হাদীসেও বলা হয়েছে: “সেই হচ্ছে মুসলমান যার যবান ও হাত দিয়ে অন্য মুসলমানের ক্ষতি হয় না” এবং তুমি নিজের জন্য যা ইচ্ছে করো অপরের জন্যে তাই করলেই তুমি মুসলমান।”
ফিকাহর ভাষায় কুফরের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর কালামের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও অস্বীকৃতি। আল-কুরআনে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়: “কেউ আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং কিয়ামত দিবমকে অস্বীকার করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (৪:১৩৬)
কুফর রিদ্দাকেও বোঝায় ফলশ্রুতিতে ঈমান সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়: “কেউ ঈমান ত্যাগ করলে তার আমল নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত হবে।” (৫:৫)
“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন দ্বীন থকে ফিরে যায় এবং বেঈমান হয়ে মরে যায়, ইহকালে ও পরকালে তাদের আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারাই দোযখী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” (২:২১৭) কুফরের অর্থ সীমালংঘনও হয় যা পুরোপুরি ইসলামকে প্রত্যেখানের শামিল নয়, কিংবা আল্লাহ্-রাসূলের অস্বীকৃতিও বোঝায় না।
মনষী ইবনুল কাইয়েম কুফরকে ছোট ও বড় এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। বড় কুফরের শাস্তি স্থায়ী জাহান্নাম আর ছোট কুফরের শাস্তি জাহান্নমের অস্থায়ী বাস। একটি হাদীস লক্ষণীয় : “আমার উম্মাহর মধ্যে কুফরীর দু’টি (লক্ষণ) প্রচলিত আছে: “বংশ পরিচয় কলংকিত করা এবং মৃত্যে জন্য বিলাপ” এবং কেউ যদি গণকের খৌঁজ করে এবং তাকে বিশ্বাস করে তবে সে মুহাম্মদ (সা)-এর অবতীর্ণ ওহীর সাথে কুফরী করে।” হাদীসে আরো বলা হয়েছে: “(আমার পরে) পরস্পরকে হত্যা করে কুফরীর দিকে ফিরে যেয়ো না।” কুরআনের একটি আয়াতের এটা হচ্ছে ইবনে উমর (রা) ও অনান্য বিশিষ্ট সাহাবীর ব্যাখ্যা, আয়াতটি হচ্ছে: “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অবিশ্বাসী।” (৫:৪৪) আয়তটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “এটা সেই কুফরী নয় যা একজনকে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত করে, বরং এটি হচ্ছে কুফরীর একটি উপাদান; কারণ যে ব্যক্তি এরূপ করে সে আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে অবিশ্বাস করে না।” তাউস একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। আতা বলেন, এটা হচ্ছে কুফর অথবা অন্যায় অথবা ফিস্ ক যা অপরটির চেয়ে ছোট অথবা বড় হতে পারে। ইকরামার মতো অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন: আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার করে না তারা কুফরী করে। কিন্তু এই যুক্তিটা দুর্বল। কারণ এক ব্যক্তি শরীয়াহর আলোকে বিচার করুক আর নাই করুক, নিরেট অস্বীকৃতিই কুফর। এ প্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়েম বলেন: আল্লাহ্র বিধানের পরিপন্থী বিচার বিবেচনার মধ্যে ছোট ও বড় দুই ধরনের কুফরী হয়ে থাকে। আর এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যদি সে বিশ্বাস করে যে, বিচার আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ীই হতে হবে এবং শাস্তির সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তা করা থেকে বিরত খাকলো তাহলে সে ছোট কুফরী করে। কিন্তু যদি কোন বিশ্বাসী মনে করে যে, এটা বাধ্যতামূলক নয় এবং ঈমানের পরিপন্থী যা খুশী তাই করতে পারে তাহলে সে বড় পাপ করে। কিন্তু যদি সে অজ্ঞতা ও অনিচ্ছাবশত ভুল করে বসে তবে তাকে কেবল “ভুল করেছে” এতটুকু বলা যাবে।
যা হোক বিষয়টির সারাংশ হচ্ছে, সকল সীমালংঘন ছোট কুফরের লক্ষণ, এই অর্থে অকৃতজ্ঞতা; কারণ মান্য করা বা আনুগত্যের মধ্যেই কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। অতএব মানবীয় প্রচেষ্টা কৃতজ্ঞতা অথবা কুফর কিংবা এ দুয়ের মাঝখানে কোনো কিছু দিয়ে প্রকাশ পায়-প্রকৃত সত্য আল্লাহ্ পাকই জানেন।
শিরকও দু’ভাগে বিভক্ত: ছোট ও বড়। বড় শিরক হলো আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা অথবা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শিরক করা। আল-কুরআনের একটি আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক করলে তিনি মাফ করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ যাকে ইচ্ছা করেন।” (৪:৪৮)
ছোট শিরক হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা অথবা দুর্ভাগ্য সৌভাগ্য পরিণত করার জন্যে তাবিজ-তুমারের ক্ষমতায় বিশ্বাস করা। এই শিরক সম্পর্কে এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো নামে শপথ করে সে শীরক করে এবং যে তাবিজ পরে সে শিরক করে।” (আহমাদ, আলহাকিম) এছাড়া “যাদু, তাবিজ ও ম্যাসকট (কোনো কিছু কে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মানা) বিশ্বাস হচ্ছে শিরক।” (ইবনে হাবান, আলহাকিম)
নিফাকও (মুনাফিকী) ছোট ও বড়-দু’ভাগে বিভক্ত। বড় মুনাফিকী হলো হৃদয়ে কুফরী পোষণ আর বাইরে প্রতারণার উদ্দেশ্যে ঈমানের ভাব করা। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে: “মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করি, কিন্তু তারা বিশ্বসী নয়।আল্লাহ্ ও ঈমানদারদের তারা ভাঁওতা দিতে চায়। তারা নিজেদের ছাড়া কাউকে প্রতারিত করে না এটা তারা বুঝতে পারে না।”(২:১৪)
এ ধরনের নিফাকের কথা সূরা আল-মুনাফিকুনে এবং কুরআনের অনান্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিফাকের জন্যে আল্লাহ জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করেছেন।
“মুনাফিকরা তো দোযখের নিকৃষ্টতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্যে তুমি কখনো কোনো সহায় পাবে না।” (৪:১৪৫)
ছোট নিফাকের লক্ষণ হচ্ছে আল্লাহ্ ও পরকালের প্রকৃতই বিশ্বাস আছে কিন্তু মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যও আছে। ও ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হাদীস হচ্ছে:
“মুনাফিকীর তিনটি লক্ষণ: সে যখন কথা বলে, (সর্বদা) মিথ্যা বলে; যখন সে প্রতিজ্ঞা করে (সর্বদা) ভঙ্গ করে; যদি তাকে বিশ্বাস করা হয় তবে (সর্বদা) সে অসাধু বলে প্রমাণিত হবে।” (অনুমোদিত হাদীস)
“যার মধ্যে (৪টি বৈশিষ্ট্য) আছে যে নির্ভেজাল মুনাফিক, যার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে নিকাফের একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে এটা পরিত্যাগ করে: যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে; বিশ্বাস করা হলে বিশ্বাসঘাতকতা করে; চুক্তি করা হলে খেলাফ করে এবং যদি সে ঝগড়া করে তবে খুব হঠকারী, অশালীন ও অপমানজনক আচরণ করে।”( অনুমোদিত হাদীস)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবাগণ ও বুজুর্গানে দ্বীন এ ধরনের নিফাককে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন। তাঁরা বলতেন, এ ধরনের নিফাক নিফাক নিয়ে কেবল মুনাফিক ছাড়া আর কেউ নিশ্চিত বোধ করবে না, প্রকৃত ঈমানদারই কেবল যার ভয় করে।
৪. রূপকের ওপর গুরুত্ব প্রদান
বর্তমান ও অতীতে অনেক গোঁড়ামি ও ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ হলো স্পষ্ট ভাষণের প্রতি উপেক্ষা করে রূপক অর্থের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া। রূপক আয়াত হচ্ছে যেগুলোর গূঢ় অর্থ আছে। আক্ষরিক অর্থই শেষ কথা নয়। আর সুস্পষ্ট আয়াত হচ্ছে পরিষ্কার স্বচ্ছ দ্ব্যর্থহীন যার অর্থ বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কুরআনুল করীম বলছে: “তিনিই তোমার কাছে এই কিতাব পাঠিয়েছেন, যার কতক আয়াত সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন; এগুলো কিতাবের মূল অংশ আর অন্যগুলো রূপক। যাদের অন্তরে সত্য লংঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিত্ না এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানেন না।” (৩:৭)প্রচীন বিদাতী ও গোঁড়া লোকেরা এই রূপক আয়াতগুলোকে চূরান্ত প্রমাণ বলে মনে করেছে। তারা স্পষ্ট মৌলিক বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করেছে। বর্তমান চরমপন্থীরাও তাই করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা এর আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাল-মন্দ, শত্রু-মিত্র ও কাফির-ঈমানদার নির্ধারণ করেছে। ফলে এক মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সতর্ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা- নিরীক্ষা ছাড়া কেবল রূপক আয়াতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া জ্ঞানে অগভীরতা ছাড়া আর কিছু নয়। আল-খাওয়ারিজ এভাবে আত-তাকফিরের ফাঁদে পড়েছিলো। তারা তো সকাল মুসলমানকে কাফির বলে মনে করতো কেবল নিজেরা ছাড়া। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, অথচ তারা তাঁরই সহচর ও সৈনিক ছিলো। তাদের মত পাথর্ক্যের মূল কারণ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার সাথে হযরত আলীর (রা) আপোস রফা। হযরত আলী (রা) সৈন্যদের সঙহতি ও মুসলমানদের জীবন রক্ষার জন্যে এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু আল-খাওয়ারিজ কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েআপোস অগ্রাহ করে। আয়াতটি হচ্ছে... “আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা নেই।” (১২:৪০০)
আলী (রা) তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে জবাব দিলেন, “একটি সত্য বাণী বাতিলের জন্যে ব্যবহৃত।” বস্তুত সকল আদেশ ও কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহ্ র জন্যে- এর অর্থ এই নয়- মানুষ ছোটখাট ব্যপারে শরীয়াহর কাঠামোয় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) আল-খাওয়ারিজের যুক্তি খন্ডন করেছেন। আপোস - সমঝোতা ইত্যাদি অনুমোদন করে কুরআনে যেসব আয়াত রয়েছে তিনি সেগুলোর উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতা সংক্রান্ত আয়াতে বলা হয়েছে: “তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা তার পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিয়োগ করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।” (৪:৩৫)
কোনো হজ্জযাত্রী হজ্জের পোশাকে শিকার করলে সালিশরা তার ব্যাপারেও মীমাংসা করে দিতে পারে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। কুরআন বলছে:
“হে মানদারগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা শিকার জন্তু বধ করো না; তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা বধ করলে তার বিনিময় হলো অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়বান লোক-বিনিময়ের জন্তুটি কা’বায় পাঠাতে হবে কুরবানীরূপে অথবা তার কাফফারা হবে দরিদ্রকে খাওয়ানো কিংবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে পারে।” (৫:৯৫)
অতএব কুরআন ও সুন্নাহকে গভীরভাবে ও সতর্কতার সাথে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশংকাই সমধিক। বাড়াবাড়ি ও অগভীর জ্ঞানের ফাঁদে পড়ে আজকাল এক শ্রেণীর লোক খারিজীদের মতে শরীয়াহর তাৎপর্য সঠিকভাবে বোধগম্য না হওয়ার দুণই এরূপ গোঁড়ামির উদ্ভব হয়ে থাকে। অন্যদিকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী লোক কখনোই হঠকরী আচরণ করতে পারে না। কুরআন-হাদীস সঠিক প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করলে এর সুসংলগ্ন ও সুমহান অর্থ অনুবাধন করা অসম্ভব নয়। আর এর বিপরীত পন্থায় কুরআন পাঠের অর্থ হবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় তাদের মতো “যারা কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু অর্থ তাদের হৃদয়ে স্পর্শ করে না।”
সম্ভবত এর মানে এই দাঁড়ায়- আল্লাহ ভাল জানেন- তাদের মৌখিক তিলাওয়াত শারীরিক কসরতের মতো যা কখনো হৃদয়কে প্রভাবিত করে না। এই কথাটি পূর্বে উদ্ধৃত “জ্ঞান ছিনিয়ে নেয়া” সংক্রন্ত হাদীসটির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার সাথে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর ব্যক্তব্যের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। আবু উবায়েদের ফাযায়েলে কুরআন ও ইবরাহীম আত-তায়িমীর বর্ণনার ভিত্তিতে সাঈদ আবনে মনসুরের ব্যাখ্যায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন: “একদা একাকী বসে থাকার সময় উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যারা এক রাসূলের অনুসরণ করে এবং কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে তারা কেন মতভেদে লিপ্ত হয়। উমর (রা) তখন ইবনে আব্বাস (রা)-কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এই উম্মাহ কেন মতভেদে লিপ্ত হয় যখন তারা এক রাসূল (সা) ও এক কিবলাহ্র অনুসারী?” (সাঈদ-এর সাথে “এবং একই কিতাব” কথাটি যোগ করেছেন)। ইবনে আব্বাস (রা) জবাব দিলেন: “আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা পাঠ করে ঐশী বাণীর মর্ম উপলব্ধি করেছি। কিন্তু এমন লোক আসবে যারা কুরাআন তিলাওয়াত করবে অথচ এর শানে নুযূল ও বক্তব্য বিষয় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তারা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেবে এবং মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়বে।”
ইবনে আব্বাসের (রা)-এর জবানীতে সাঈদ আরো বলেন, “প্রতিটি গ্রুপের একটি মত থাকবে, তারপর মতবেদ থেকে সংঘাত সৃষ্টি হবে।” কিন্তু সেখানে উপস্থিত উমর ও আলী (রা) তাঁর এই অশুভ ব্যাখ্যা পছন্দ করলেন না এবং তাকে ভৎসনা করলেন। কিন্তু ইবনে আব্বাস (রা) চলে যাওয়া মাত্র তার মনে হলো যে, তার কথায় কিছু সত্য থাকতে পারে। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার কথার পুনরাবৃত্তি করতে বললেন, সতর্ক বিবেচনার পর উমর (রা) ইবনে আব্বাস (রা)-এর সাথে একমত হলেন।
আশ-শাতিবী লিখেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) সঠিক ছিলেন। যখন এক ব্যক্তি একটি সূরা নাযিলের কারণ জানে তখন সে এটাও বুঝতে পারে যে, এর ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য কী। কিন্তু এ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মতভেদে লিপ্ত হয় এবং তাদের মতামতের পেছনে শারীয়াহর কোনো সমর্থন না থাকায় তারা বিভ্রান্ত হয়। এর একটি নযীর পাওয়া যায় ইবনে ওয়াহাবের বর্ণনায়: বাকির জিজ্ঞেস করলেন নাফিকে, “ইবনে উমর (রা) আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে কি চিন্তা করেন? (আল-খাওয়ারিজিকে আল-হারুরিয়াও বলা হয়। কারণ তারা হারাওয়া নামক একটি স্থানে দেখতে পান)। জবাব দিলেন, “ তিনি তাদেরকে খুব খারাপ লোক বলে মনে করেন। কুফফার সংক্রান্ত আয়াত তারা ঈমানদারদের ওপর প্রযোজ্য করে।” সাঈদ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, আল-খাওয়ারিজ যেসব রূপক আয়াতের অপব্যাখ্যা দেয় তাদের মধ্যে রয়েছে: “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।” (৫:৪৪) এর সাথে তারা জুড়ে দেয় এই আয়াতটি, তথাপি কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সংগে অন্যকে সমতুল্য করে। (৬:১)
সুতরাং তারা এই উপসংহার টানে যে, কোনো শাসক যদি ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন না করে সে কুফরী করে। আর যে কুফরী করলো সে অন্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করলো। অতএব সে শিরক করলো। আর এই ভুল বিচারের ভিত্তিতে তারা অন্যকে মুশরিকুন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং হত্যা করে। আবনে আব্বাস (রা) এই ধরনের অপব্যাখ্যা ও ভ্রান্ত ধারণার বারুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। আর এর উৎপত্তি হয় ওহীর অর্থ বুঝতে অক্ষমতার দারুন।
নাফি বলেন, যখনি ইবনে উমর (রা)-কে আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো তিনি বলতেন: “তারা মুসলমানদেরকে কুফফার ঘোষণা করে, তাদের রক্তপাত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির অনুমোদন কের; তারা নারীর ইদ্দাহর সময় তাকে বিয়ে করে এবং স্বামীর বর্তমানে বিবাহিত মেয়েদের বিয়ে করে। আমি জানি না তাদের চেয়ে আর কে আছে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়।” (শাতিবী, আলইতিসাম)
৫. বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা
চরমপন্থীদের জ্ঞানের অগভীরতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীর কথা শুনতে মোটেও রাজী থাকে না কিংবা কোনোরকম আলোচনায় বসতে চায় না। তাদের অর্থাৎ গোঁড়াদের মত যে অন্যের মতের আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে তাও তারা স্বীকার করে না। তারা বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষা পায়নি। বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ইত্যাদি হচ্ছে তাদের স্বল্প জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এগুলো আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগও পায় না। ফলে তারা যা পড়ে তা থেকে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে। সুতরাং তাদের পড়া ও সিদ্ধান্তে যে ভুল হবে তাতে আর সন্দেহ কী! কেউ কোথাও কখনো তাদের মতো যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করলেও এগুলোর প্রতি কেউ তাদে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আশ-শারূয়াহ বুঝতে হলে যে নির্ভরযোগ্য আলিমদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত সে প্রয়োজনীয়তাও তারা স্বীকার করে না।কোনো মুসলিম তরুণ যদি একা একা এরূপ প্রচেষ্টা চালায় তবে তা হবে আনাড়ি সাঁতারুর মতো গভীর পানিতে ঝাঁপ দেয়া।বিশেষজ্ঞদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছাড়া শারীয়াহর জ্ঞান পূর্ণ হতে পারে না, বিশেষ করে সেসব ক্ষেত্রে যেগুলো নিয়ে মতভেদ আছে। এ কারণে আমাদের অভিজ্ঞ আলিমরা তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন যারা বিষয়বস্তু উপলব্ধি ছাড়াই কেবল কুরআনের হাফিজ হয়েছেন কিংবা কিছু বইপত্র পাঠ করে যাদের অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর হয়েছে।এক শ্রেণীর এই তরুণদের বিভ্রান্তির জন্যে পেশাদার আলিম ও পন্ডিতরা বহুলাংশে দায়ী। তারা মনে করে এই আলিমরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছে। তাই তারা শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধীতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে, বরং তারা মুনাফিকের মতো শাসকদের গর্হিত কাজের প্রশংসা ও সমর্থন করে। অথচ বাতিলকে সমর্থন না করে অন্তত তাদের নিশ্চুপ থাকাই নিরাপদ ছিল। সুতরাং তরুণরা বর্তমান এরূপ আলিমদের পরিবর্তে অতীতের আলিমদের অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করলে অবাক হবার কিছু নেই। একাবর আমি তাদেরকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে তারা পরিষ্কার বলেছে, “নির্ভরযোগ্য আলিম আমরা পাব কোথায়? যারা আছে তারা তো শাসকদের ক্রীড়নক। তাদের মর্জি-মাফিক ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত। শাসক যখন সমাজতন্ত্রী হয়, আলিমদের দৃষ্টিতে তাই ইসলামী; শাসক যদি হয় পুঁজিবাদী, পুঁজিবাদও তখন হয় ইসলামী! তাঁরা ফতোয়া দেন শত্রুর সাথে সন্ধি হারাম; কিন্তু শাসক যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন তাদের জন্যে দোয়া করেন। “তারা আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা হালাল করতে পারে।” (৯:৩৭)
এসব আলিম মসজিদ ও গীর্জা এবং মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু ভারতকে সমান চোখে দেখে। আমি এর জবাব দিয়েছি এভাবে: “ব্যপারটি সাধারণ সত্যে পরিণত করা উচিত নয়। নিশ্চয় এমন আলিমও আছেন যারা বাতিলের নিন্দা করেন, নির্যাতন রুখে দাঁড়ান, একনায়কদের সাথে আপোস করেন না ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও। এসব আলিমদের অনেককে কারাবরণ করতে হয়েছে। তারা নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি ইসলামের জন্যে শাহাদত বরণ করেছেন।”
সেই তরুণটি এটা স্বীকার করলেও বলল, “নেতৃত্ব ও ফতোয়া দেয়ার ক্ষমতা এখনো ঐ শাসকদের হাতে, আলিমদের নয়-এরাই হচ্ছে তথাকখিত পথবিচ্যুত আলিম।”
অবশ্য এটা কেউ স্বীকার করতে পারেন না যে, ঐ যুবকটি যা বলেছে তা অনেকাংশে সত্য। নেতৃত্ব-অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব “প্রখ্যাত” “আলিম” সরকারের বন্ধকী পণ্যে পরিণত হয়েছেন এবং ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হচ্ছেন। এ ধরনের আলিমদের জানা উচিত সত্য সম্পর্কে নীরব থাকা বাতিল সমর্থনের শামিল। দুটোই শয়তানী কাজ। একবার মিসরীয় টেলিভিশনে “পরিবার পরিকল্পনা” ও “জন্মনিয়ন্ত্রন” অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারী একজন সুপরিচিত মুসলিম বুদ্ধিজীবী তো প্রশ্নই করে বসলেন, এই বিতর্কের উদ্দেশ্য কী, বিরোধীতা না সমর্থন-যাতে তিনি নিজের গা বাঁচিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। বিতর্কের চেয়ারম্যান ঐ পণ্ডিতের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। অথচ এর আগের আলিমরা মত প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন, কারো পরোয়া করতেন না। আল্লাহ্ এদের ওপর রহম করুন! এদেরই একজন মিসর সরকারের একজন প্রভাবশালী সদস্যকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি কাজের খোঁজে পা বাড়ায় তার ভিক্ষের হাত বাড়াবার দরকার পড়ে না।” সমসাময়িক আলিম বা পণ্ডিতরা এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে নিঃসন্দেহে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করতে পারেন।
এখন আলিমদের জ্ঞানগরিমা এতোই সঙ্কীর্ণ যে, তরুণ মুসলমানরা তাদের সংস্পর্শে এসে হতাশ হয়ে পড়ে। এ ধরনের একজন আলিম একবার একটি পত্রিকায় লিখলেন, পিতা ও পুত্রের লেনদেনে যেহেতু কোনো সুদের ব্যাপার থাকতে পারে না। কিন্তু পিতা ও পুত্রের তুলনা দিয়ে তিনি যে যুক্তি খাড়া করেছেন তা বিতর্কিত। মোটকথা এসব আলিম বিভিন্ন বিষয়ে সর্বসম্মত প্রামাণিক সূত্র বাদ দিয়ে দুর্বল সনদের হাদীস দিয়ে নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এগুলো সাধুতা সত্যতার খেলাফ। মুসলিম তরুণরা স্বভাবতই এসব কাণ্ড কারখানা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে। কোনো কোনো আলিম অনেক সময় সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জিত হতে পারে এমন কাজও করে বসেন। এগুলো সচেতন তরুণদের নযর এড়াতে পারে না। আরেকটি ঘটনা।একবার মিশর সরকার বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাদের অনেক সদস্যকে বন্দী করেন। একজন সুখ্যাত আলিম প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ইসলামী গ্রুপকে আল্লাহ্ পরিত্যাগ করেছেন। তার যুক্তি ছিল, তাঁরা যদি সঠিক পথের অনুসারী হতেন তবে আল্লাহ্র রহমতে তাদেরকে পুলিশ বা সৈন্য কেউই পরাজিত করতে পারতো না। হক ও বাতিলের এরূপ অদ্ভুত বিচার সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধী। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্যের সংগ্রামীদের বিজয় লাভে কতকগুলো শর্ত আছে। সেই শর্ত পূরণ না হলে তাদের পরাজিত হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। অন্যদিকে পরিস্থিতির আনুকূল্যে বাতিলের বিজয় অর্জিত হলেও তা চিরস্থায়ী হতে পারে না, কিছুদিন টিকে থাকতে পারে মাত্র। সমকালীন ইতিহাসে এর অনেক জাজ্জল্যমান নযীর আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন সত্য ও মিথ্যা বা হক বাতিলের দ্বারা জয়-পারজয় নির্ধারিত হয় না। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় বৃহৎ শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ। আরবদের উপরে ইসরাঈলের ‘বিজয়’-এর একটি অত্যুজ্জ্বল নযীর।
আমরা কি জানি না, আতাতুর্ক ও তার দুষ্টচক্র মুসলমান জনগণ ও আলিমদের কী নির্মমভাবে দমন করেছে? খিলাফতের পাদপীঠ থেকে কিভাবে ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতা জবরদস্তি তুর্কী জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে! এখন বলুন, এ দু’পক্ষের মধ্যে কারা হক আর কারা বাতিল? সম্পতি একটি মুসলিম দেশে “পরিবার আইন” প্রবর্তনের বিরোধী বহু শ্রদ্ধাভাজন আলিমের উপর নির্যাতন চালানো এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অথচ ঐ পরিবার আইন সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাচারী সরকার সন্ত্রাসী কায়দায় ঐ আইনের বিরোধী জনসাধারণ ও আলিমকে স্তব্ধ করে দেয়। এর অর্থ কি এই যে, সরকারের পদক্ষেপ সঠিক ছিল, আর শাস্তিপ্রপ্ত আলিমরা ভ্রান্ত? আরেকটি মুসলিম দেশে অমুসলিম সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের উপর শাসন চালায়। সেখানে সরকার বিরোধী তৎপরতা দমনের জন্যে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলমান নর-নারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং নিপীড়ন চালানো হয়। তদুপরি যেসব দৃঢ়চেতা মুসলমান যুলুম সহ্য করে টিকে থাকে তাদের উপর হালাকু ও চেঙ্গিস খানের মতো হিংস্র কায়দায় নির্যাতন চালানো হয় আর তাদের সামনে তাদের কন্যা, বোন বা স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়।
বস্তুত ইতিহাসে তথা ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর এমন নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার বহু নযীর আছে। হুসাইন ইবনে আলী (রা) পরাজিত হয়েছেন এবং ইয়াজিদ ইবনে আমীর মুয়াবিয়া তাঁর পবিত্র দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। পরিণামে বনু উমাইয়া বহুকাল শাসন করেছে; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশধাররা তাদের হাত থেকে নিষ্কৃত পাননি, এমনকি আব্বাসীয়দের শাসনামলেও নয়। এ থেকে কি এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজিদের কার্যকলাপ সঠিক ছিল আর হযরত হুসাইন (রা)-এর অনুসৃত পন্থা বাতিল? হে আল্লাহ, আপনি এদের যুলুমের সাক্ষী, এদের হাত থেকে উম্মাহকে রক্ষা করুন!
আরো ঘটনা আছে। কয়েক বছর পর বিজ্ঞ ও সাহসী সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ অনারবী হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের হাতে পরা জিত হয়েছিলেন; পরে হাজ্জাজ আরেকজন মহান মুসলিম সেনাপতি আবদুর রহমান ইবনে আল-আসাস এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের, আশশাবী, মুতরিয়াসহ একদল বিশিষ্ট আলিমকে হত্যা করে। এগুলো ছিল উম্মাহর জন্যে বিরাট ক্ষতি, বিশেষ করে সাঈদ ইবনে জুবায়ের সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র) বলেন, তিনি এমন এক সময় নিহত হলেন যখন তাঁর খুব প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়: “আল্লাহর কসম! হিংস্র নেকড়ে যদি আমাদের ছিন্নভিন্ন করে তবুও আমরা আমাদের সত্য বিশ্বাস ও তোমাদের মিথ্যাবাদিতা সম্পর্কে সংশয়ী হবো না।” ইবনে জুবায়ের ও তার সঙ্গী-সাথীরা মক্কায় অবরুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন: “আল্লাহর শপথ! সৎ মুত্তাকীদের কেউ অবনত করতে পারবে না যদি গোটা পৃথিবীও তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আর বিপথগামীরা কখনোই যথার্থ সম্মান পাবে না যদি তাদের কপালে চন্দ্রও উদিত হয়। এসব উক্তি কুরআনে বর্ণিত নবীদের ঘটনাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ। কুরআন বলছে: “তবে কি যখনি কোনো রাসূল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনই তোমরা অহংকার করেছে আর কতককে অস্বীকার করেছে এবং কতককে হত্যা করেছ!” (২:৮৭) এমন একজন নবীদের মধ্যে ছিলেন হযরত যাকারিয়া (আ) ও তাঁর পুত্র ইয়ারিয়া (আ)। এই নবীদের হত্যা এবং তাদের শত্রুদের সাফল্যকে কী পূর্বোক্তদের ভূমিকাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে? আমরা কুরআনুল করীমে আসহাবুল উখদুদের ঘটনাও জানি। তারা ঈমানদারদের জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে সেই বীভৎস্য দৃশ্য উপভোগ করতো: “এবং অন্য কোনো কারণে নয়, কেবল তারা সর্বশক্তিমান ও সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহ্ কে বিশ্বাস করতো বলেই (কাফিররা) তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।” (৮৫:৮)
কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ঈমানদারদের কখনো কখনো বিপদাপদের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং বেঈমানদেরকে সাময়িক সাফল্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা করা হয়। আল্লাহ বলেন: “মানুষ কি মনে করে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়া হবে? তাদের পূর্ববর্তীদেরও আমি পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।” (২৯:২-৩)
ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর নিম্মোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়: “যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে তবে অনুরূপ আঘাত তাদেরও তো লেগেছে। মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর আমি পর্যায়ক্রমে আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।” (৩:১৪০)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “...আমি তাদেরকে এমনভাবে ক্রমে ক্রমে ধরব, তারা তা বুঝতেও পারবে না।” (৬৮:৪৪)
৬. ইতিহাস, বাস্তবতা ও আল্লাহর সুনান সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সচেনতার অভাব ছাড়াও বাস্তবতা, জীবন, ইতিহাস এবং আল্লাহ্ র সৃষ্টির রীতি সম্পর্কেও যথার্থ সচেনতার অভাব রয়েছে। এর অভাবে কিছু লোক অসাধ্য সাধন করতে চায়। যা ঘটতে পারে না তারা তাই কল্পনা করে এবং পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহের ভুল বিচার করে বসে যা আল্লাহ্ র রীতি ও শরীয়তী চেতনার পরিপন্থী। তারা অসমসাহসিক পদক্ষেপ নেয়, এমনকি জীবনেরও ঝুঁকি নেয়। এর পক্ষে বিপক্ষে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তারা তা মোটেও বিবেচনা করে না। কারণ তারা মনে করে তাদের লক্ষ্য তো আল্লাহ্ ও তাঁর কালাম সমুন্নত করা। অতএব এসব লোকের পদক্ষেপকে অন্যরা “আত্মঘাতী” বা উম্মাদনাপূর্ণ বলে অভিহিত করলে আশ্চর্যের কিছু নেই।বস্তুত এই মুসলমানরা যদি মুহুর্তের জন্যেও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতো তাহলে নিশ্চিতভাবে সঠিক পথ-নিদের্শ লাভ করতো। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ১৩ বছরের মক্কী জীবন। তিনি শুধু দাওয়াত দিয়ে ক্ষান্ত হননি, ৩৬০টি মূর্তি থাকা সত্ত্বেও কা’বায় নামায ও তাওয়াফ করতে বলেছেন। কেন এরূপ করলেন? তিনি কাফিরদের তুলনায় তাঁর অনুল্লেখযোগ্য শক্তি ও অবস্থানের কথা ভেবে অতি বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি কখনোই কমান্ডো হামলা চালিয়ে পাথরের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার চিন্তা করেননি। তাহলে তো আসর উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যেতো। ঐ পদক্ষেপে কাফিরদের মন থেকে তো বহু-ইশ্বরবাদের ভুত মুছে ফেলা যেতো না। তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তাঁর স্বজাতির মনকে মুক্ত করতে-কা’বাকে মূর্তিমুক্ত করতে নয়। এ জন্যে তওহীদেরশিক্ষা দিয়ে প্রথম মুশরিকদের মন পবিত্র করার লক্ষ্যে এমন একদল ঈমানদার তৈরি করেন যারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন এবং কঠোর অধ্যবসা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা বাতিলৈর বিরুদ্ধে হকের লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম। এসব বিশ্বাসীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা নিরলস নির্বিকার চিত্তে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করে যায়, বিজয়ের উল্লাসে তারা মাদকতায় বিভোর হয়ে যায় না, আবার পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে না। অবশ্য কখনো কখনো তারা কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু তিনি এখনো সময় আসেনি বলে তা অগ্রাহ্য করেছিলেন এবং আল্লাহ্ র নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারনের উপদেশ দিয়েছিলেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আম্মার বিন ইয়াসির (রা) ও তাঁর পিতাকে নিগৃহীত হতে দেখলেন। তিনি তাঁদেরকে সহ্য করার জন্যে উৎসাহিত করলেন এবং তাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। স্বাধীনতা ও ধর্মরক্ষার জন্যে আল্লাহ্ র আদেশ না পাওয়া অবধি ঘটনা এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে আদেশ এলো। কুরআনের ঘোষণা: “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। নিশ্চই আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে: আমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ্ ।” (২২:৩৯-৪০)
কিন্তু এই অনুমতি দেয়া হয়েছে কেবল তখনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা নিজেস্ব আবাসভূমি স্থাপন করে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারপরই তাঁদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছৈ। তাঁরা এরপর একর পর এক বিজয় অর্জন করেছেন যতক্ষণ না তাঁরা আল্লাহ্ র হুকুমের মক্কা বিজয় করেছেন। এই মক্কা থেকেই তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কাফিরদের অত্যাচারে।শৈষ পর্যন্ত তিনি মক্কার মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং তিলাওয়াত করলেন এই আয়াত, “ বলো সত্র সমাগত এবং মিথ্যা বালুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত বাধ্য।” (১৭:৮১)
বিস্ময়ের ব্যাপার, জামায়াত আত-তাকফির আল-হিজরা ইতিহাসের এই ধারাকে অস্বীকার করে। এই অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবশ্য গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ শুকরী ও আবদুর রহমান আবু আল-খায়েরের মধ্যে মতপার্থক্যও হয়েছিলো। আবু আল-খায়ের তাঁর “স্মৃতিকথায়” লিখেছেন যে, ইসলামের ইতিহিসের প্রতি শেখ শুকরীর অবস্থা ছিল না। তিনি এটাকে “অপ্রমাণিক ঘটনাবলী” বলে মনে করতেন। এটা ছিলো সাথে মতভেদের চতুর্থ বিষয়। তিনি কেবল কুরআন শরীফে বর্ণীত ঘটনাবলীকেই ইতহাসের উপাদান বলে মনে করতেন। তাই তানি ইসলামী খিলাফতের অধ্যায় পাঠ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
ধর্মীয় অজুহাতে ইতিহাস সম্পর্কে ও ধরনের সংকীর্ণ ও অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তারা ইসলামের ইতিহাসকেও হারাম ঘোষণা করেছিলেন। ইতিবাচক ও নেতিবাচক, জয় ও পরাজয় তথা সকল বিষয় সমন্বিত একটি জাতির ইতিহাস হচ্ছে সমৃদ্ধ খনির মতো যা থেকে সম্পদ আহরণ করে একটি জাতি তার বর্তমান গড়ে তোলে। যে জাতি ইতিহাসকে উপেক্ষা করে তার অবস্থা স্মৃতিভ্রংশ মানুষের সাথে তুলনীয়, যার কোনো মূল বা দিক-দর্শন নেই। কোনো গ্রুপ বা জনগোষ্ঠী কিভাবে এরূপ একটি অস্বাভাবিক শর্তকে টিকে থাকার ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করতে পারে? তাছাড়া ইতাহাস হচ্ছে এমন একটি আয়না যাতে আল্লাহ্র বিধান প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এজন্যে আর কুরআনে গোটা সৃষ্টিলোক সাধারণ ভাবে এবং মানব জীবনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ কারণেই আল কুরআন ইতিহাসের প্রেক্ষিত অনুধাবন এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বর্ণনা: “তোমাদের পূর্বে বহু জীবন প্রণালী গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা দুনিয়া ভ্রমণ করো এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের কি পরিণাম হয়েছে।” (৩:১৩৭)
আল্লাহ্ রীতির বৈশিষ্ট্য হলো স্থায়িত্ব, তার কখনো পরিবর্তন হয় না। আল কুরআন বলছে: “তারা আল্লাহ্ র নামে দৃঢ় অঙ্গীকার করে বলতে যে, তাদের কাছে কোনো সতর্ক বাণী এলে তারা অন্য সকল সম্প্রদায় অপেক্ষা সৎপথের অধিকতর অনুসারী হবে। কিন্তু যখন তাদের কাছে সতর্ক বাণী এলো তখন তা কেবল এদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করলো, যমীনের বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট-ষড়যন্ত্রের কারণে। কূট-ষড়যন্ত্র এর উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তবে কি তারা প্রত্যক্ষ করেছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? কিন্তু তুমি আল্লাহ্ র বিধানে কখনো কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না এবং আল্লাহর রীতিতে কোন ব্যাতিক্রম দেখবে না। (৩৫: ৪২-৪৩)
আল।রাহ্ র রীতি যেহেতু অপরিবতর্নীয় ও স্থায়ী তাই যারা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় স্থান-কাল ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আচরণে তিনি একই রীতি প্রয়োগ করেন। এই নীতির একটি শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেথেছি ওহুদের যুদ্ধে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপদেশ উপেক্ষা করার দরুন তাদেরকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিলো। কুরআনুল করীমে একথা উল্লিখিত হয়েছৈ: “কী ব্যাপার! যখন তোমাদের ওপর মুসীবত এল তখন তোমরা বললে এটা কোথা থেকে এলো! অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলো এটা তোমাদের নিজেদেরই নিকট থকে। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিশালী। (৩:১৬৫)
আরেকটি আয়াতে যে কারণে মুসলমানদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তার পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে: “আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহ্ র অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বদ্ধে মতভেদ করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকর দেখবার পর তোমরা অবাধ্য হলে।” (৩:১৫২)
কিছু বিছিন্ন ঘটনার দরুণ ইতিহাসে অনেক সন্দেহজনক ঘটনা সংযোজিত হয় সত্য, কিন্তু মূল গটনা প্রবাহ সুরক্ষিত থাকে এবং একাধিক প্রামাণিক সূত্রে তা সমর্থিত হয়। আর সন্দেহপূর্ণ ঘটনাগুলো বিজ্ঞ ব্যাক্তি বিশ্লেষণ করতে পারেন। যাতে সত্য নিরূপণ করা যায়।
পক্ষান্তরে আমরা শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, সৃষ্টির পর থেকে মানব ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে চাই। শুধু ঈমানদারদের ইতিহাস নয়, বরং নাস্তিকদের ইতিহাস থেকেও জ্ঞান আহরণ করা যায়। কেননা আল্লাহ্ র রীতিতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।তা তো তাওহীদ পন্থী ও পৌত্তলিক উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। বস্তুত জাহিলিয়ার ভ্রান্ত প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে আমরা কুরআনুল কারীমকে এবং ইসলামের বদৌলতে আমরা কী কল্যাণ লাভ করেছি তাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো না। কুরআনে বলা হয়েছে: “...যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রন্তিতে নিমজ্জিত ছিলো।” (৩:১৬৪) এবং “তোমরা অগ্নি গহবরের কিনারে দাঁড়িয়েছিলে, আল্লাহ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (৩:১০৩)
উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর একটি উক্তিতেও এই মর্ম প্রতিফলিত হয়েছে: “জাহিলিয়ার প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যর্থতা শুরু হলে একে একে ইসলামের বন্ধনী বিছিন্ন হতে থাকবে।”
সত্য প্রকাশ যদি পুণ্য হয় তাহলে আমি বলবো ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ইতিহাস সঠিকভাবে অধ্যায়ন ও অনুধাবন করেননি। ইতিহাস পাঠের অর্থ শুধু বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনাকে জানা নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এর মর্ম উপলব্ধি করা, শিক্ষা নেয়া এবং আল্লাহ্ র রীতিগুলো উদ্ভাসিত করা। নিছক পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসাবশেষ অবলোকন করলে কোনো ফায়দা হবে না। শুধূ দেখা আর শোনার মাধ্যমে ইতিহাসের মর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “তারা কি দেশে ভ্রমন করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারতো। আসলে চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।” (২২:৪৬)
ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং একটির সাথে অপরটির সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ এগুলো একই অপরিবর্তনীয় নিয়মে প্রবাহিত হয়। তাই পাম্চাত্য শিখিয়েছে: “ইতিহাসের চাকা ঘোরা” আর আরবারা বলে, “আজবকের রাত কালকের রাতের মতোই।”
আল কুরআনুল করীমে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণে সাদৃশ্যের কারণ হিসেবে অভিন্ন চিন্তা ও দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে:
“যাদের জ্ঞান নেই তরা বলে, ‘আল্লাহ কেন আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে আসে না কেন? এর আগের লোকেরাও এ ধরনের কথা বলতো। তাদের হৃদয় একই রকম। আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।” (২:১১৮)
কুরায়েশ পৌত্তলিকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন: “এভাবে এদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনি কোনো রাসূল (সা) এসেছেন তারা তাঁকে বলেছে, ‘তুমি তো এক যাদুকর, না হয় এক উম্মাদ!’ তারা কি একে অপরকে এই মন্ত্রাণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুত তারা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।” (৫১:৫২-৫৩)
তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্ র নবীর প্রতি আগের ও পরের জাতিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্নতা তাদের মধ্যে সমঝোতার ফলশ্রুতি নয়, বরং সাদৃশ্য হলো অন্যায় ও স্বচ্ছাচারী আচরণে। সুতরাং তাদের দৃষ্টভঙ্গি অভিন্ন কারণ হলো স্বেচ্ছাচারিতা।
যারা ইতিহাসের গুরুত্ব এবং আল্লাহর রীতির মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম কেবল তারাই অতীত জাতিসমূহের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তারাই প্রকৃত সুখী। তারাই যারা এসব ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেরা সতর্ক হয় বটে, কিন্তু অন্যের ভাল দিকগুলোকেও উপেক্ষা করে না। জ্ঞানই ঈমানদারের লক্ষ্য তা সে যেখান থেকেই অর্জন করুক না কেনো। কেননা অন্য যে কোন ব্যাক্তির চেয়ে এটা তারই প্রাপ্য।
৭. দু’টি গুরুত্বপূর্ণ
সাধারণ মুসলমান, বিশেষত ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদেরকে আল্লাহ্র দু’টি রীতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রথম: সৃষ্টি ও বিধানের ক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। অথচ আল্লাহ্ পাক আঁখির পলক পড়ার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে বেহেশত ও সৃষ্টিতে সক্ষম! “হও আর তা হয়ে যায়।” (২:১১৭)তিনি তাঁর (হিসেবে) ছয় দিনে এগুলো সৃষ্টি করেছেন অথাৎ পর্যায়ক্রমে যা কেবল তিনিই জানেন। কেননা “দিন” সংক্রন্ত আমাদের ধারনা থেকে তা ভিন্ন। সকল প্রাণীর বিকাশের ক্ষেত্রেও পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। ধীরে ধীরে এগুলো পূর্ণতা লাভ করে। দাওয়াতী কাজেও এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার থেকে মনকে মুক্ত করার জন্যে প্রথমে সেখানে তওহীদের বীজ প্রোথিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে ঈমানের ভিত্তি মজবুত হলে ওয়াজিবাত ও মুহাররামাতের প্রক্রিয়া চালু করা হয়। এরপর সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদি প্রবর্তন করা হয়। এজন্যে আমরা মক্কী ও মাদানী আয়াতের মধ্যে পার্থ্ক্য লক্ষ্য করি।
আয়েশা (রা) শারীয়ার প্রবর্তন এবং কুরআন নাযীলের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন: প্রথমে কুরআনের যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে তাতে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (পরে) যখন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলো তখন হালাল ও হারামের বিধান নাযীল হলৌ। যদি প্রথমেই “মদ পান করো না” এবং “ব্যভিচার করো না” নাযিল হতো লোকেরা বলতো, ‘আমরা মদপান ও ব্যভিচার কখনোই ছাড়তে পারব না।’ (বুখারী) সুতরাং যারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতাষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদেরকে পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রতিবন্ধকতা, উপায়-উপকরণ ও সামর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পর্যায়ক্রমে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। এক্ষেত্রে খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজের দৃষ্টান্ত স্মর্তব্য। তিনি খেলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ জীবন পুনর্গঠন করেছিলেন। কিন্তু পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সহজ ছিলো না। তার পুত্র আবদুল মালিক অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে একবার বললেন, “হে পিতা, আপনি কেন হত্যা করেন না? আল্লাহ্ শপথ, সত্যের জন্যে আমরা বা আপনার প্রাণ গেলেও আমি পরোয়া করি না।” কিন্তু উমর জবাব দিলেন, “তাড়াহুড়া করো না আমার পুত্র। আল্লাহ্ পাক কুরআনুল কারীমে দু’বার মদ্যপানেরনিন্দা করেছেন এবং তৃতীয়বারে নিষিদ্ধ করেছেন। আমার ভয় হয়, একবারেই সব চাপিয়ে দিলে এক সাথেই তা প্রত্যাখ্যাত হয় কিনা। এতে ফিতনার সৃষ্টি হতে পারে।” (আল মুয়াফাকাত)
দ্বিতীয়: দ্বিতীয় রীতিটি হচ্ছে প্রথমটির পরিপূরক। প্রতিটি জিনিসের পূর্ণতা বা পরিণতি লাভের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই এই রীতি প্রযোজ্য। ফসল পাকার আগেই কাটা যায় না। অপরিপক্ক ফলমূল ও শাকসবজি উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে। ঠিক তেমনি মহৎ কাজের সুফল অনেক বছর পরেই পরিদৃশ্যমান হয়। পরিণত হতে যতো সময় লাগবে ততোই তা ফলপ্রদ হবে। এক পুরুষের চেষ্টা-সাধনা অন্য পুরুষে ফল দিতে পারে। মক্কা মুকাররমায় প্রথমদিকে কাফিররা আল্লাহর শাস্তির হুশিয়ারীকে অবিবেচকের মতো উপহাস করতো এবং দ্রুত শাস্তি আনার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি আহবান জানাতো। কিন্তু তারা এটা জানতো না যে, নির্দিষ্ট সময়েই তা আসবে। বিলম্বও নয়, দ্রুতও নয়।
“তারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে। যদি নির্ধরিত সময় না থাকতো তবে শাস্তি তাদের ওপর আসবে আকস্মিকভাবে, অজ্হতসারে।” (২৯:৫৩)
“তরা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, অথচ আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনো ভঙ্গ করেন না, তোমাদের গণনার হাজার বছরের সামন।” (২২:৪৭)
এই পর্যায়ে আল্লাহ্ তায়ালা মহানবীর (সা)-এর প্রতি বিগত নবীদের মতো অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দিলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।”(৪৬:৩৫) বিগত নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের কঠোর সঙগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন:
“তোমরা কি মনে করো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি! অর্থ কষ্ট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিলো এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিলো। এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার অনুসারীরা বলে উঠেছিলো, আল্লাহ্র সাহায্য কখন আসবে; নিশ্চয় আল্লাহ্র সাহায্য নিকটবর্তী। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময় কেবল আল্লাহ্রই জানা আছে। এ জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের ধৈর্য ধারণ করতে বলতেন এবং নিদির্ষ্ট সময়ের পূর্বে বিজয় প্রত্যাশা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। একটি ঘটনা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার খারায ইবনে আল-আর্ত ইসলামের জন্যে তাঁর দুঃখকষ্ট বরণের কথা বলে আর্লাহ্ র সাহায্য প্রার্থনার আবেদন জানালে রাসূলুল্লাহ (সা) এতোই ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখ লাল হয়ে যায়। তিনি বললেন: “তোমাদের আগে একজন বিশ্বাসীকে লোহা দিয়ে এমনভাবে পিষ্ট করা হয়েছে যে, হাড় ছাড়া তার শরীরের গোশ্ত ও শিরা-উপশিরা অবশিষ্ট ছিলো না। আর একজনকে করাত দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় দু’ভাগে চিরে ফেলা হয়েছিলো। কিন্তু তাঁরা কেউই ধর্মত্যাগ করেননি। আল্লাহ্র শপথ, তিনি এমনভাবে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন যে, একজন ভ্রমনকারী সানা থেকে হাদ্রামাউত পর্যন্ত সফরের সময় এক আল্লাহ্ এবং তার ভেড়ার জন্যে নেকড়ে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা অধৈর্য।” ( বুখারী)
৮. মুসলিম দেশ থেকে ইসলামের নির্বাসন
একজন নিষ্টাবান মুসলমানের কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে এসলামী শিক্ষা অনুসারণের অভাবে বিকৃতি, দুর্নীতি ও মিথ্যা ব্যাপাকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মার্ক্সবাদের ও ধর্মনিরপেক্ষতার ছোবলে মুসলিম সমাজ বিপর্যস্ত। আধুনিক “ক্রুসেডাররা” ক্লাব, থিয়েটার, অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি, ছায়াছবি, নাচ-গান, মদ তথা সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। সংবাদপত্রে তারা অনুপ্রবেশের জাল বিস্তার করেছে। রাস্তাঘাটে অর্ধোলঙ্গ নেশাসক্ত নারীদের অবাধে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে মুসলিম সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দয়ার সুগভীর চক্রান্তের ফল।এছাড়া মুসলিম দেশগুলোতে এমন সব বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে যা শরীয়তে নিষিদ্ধ অথচ ভাব দেখানো হয় উম্মার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ উজ্জীবিত করাই এর লক্ষ্য। কিন্তু মূলত এসব আইনের উৎস শরীয়ত নয়,বরং ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন। সুতরাং এতে বিস্ময়ের কিছু নেই- এসব আইন আল্লাহ্ যা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে সিদ্ধ করে আর আল্লাহ্ যা সিদ্ধ করেছেন তাকে অসিদ্ধ ঘোষণা করে। আর এসব তথাকথিত আধুনিক আইন সব রকম দুর্নীতি ও অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়। অন্যদিকে শাষকদের কার্যকলাপও হতাশাব্যঞ্জক। তারা ইসরামের শত্রুদের সাথে সন্ধি করে আর ইসলামের কথা শোনা যায় নিছক ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়া তাও আবার সাধারণ মানুষকে ধোঁধা দেয়ার জন্যে।
মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা আরো করুণ। তরুণরা তাদের চোখের সামেন সামেন দেখেত পাচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের কী অহসনীয় বৈষম্য! কেউ কোনোভাবে জীবন ধারণ করছে, এমনকি ওষুধপথ্যও সংগ্রহ করতে পারছে না কিংবা মাথা গোঁজারও ঠাঁই নেই। অন্যদিকে বিত্তবানরা লাখ লাখ টাকা মদ ও নারীর পেছনে ঢালছে, বড় বড় প্রাসাদে বাস করছে কিৎবা অনেক সময় খালিই পড়ে থাকে। বিদেশী ব্যাংকে তারা কোটি কোটি ডলার গোপনে সঞ্চয় করছে। তারা তেলের টাকা অপহরণ, পাশ্চাত্যের সাথে সহযোগিতা এবং আর্ন্তজাতিক কোম্পানীগুলোর সাথে লেনদেন করে বিত্তের পাহাড় গড়েছে। আর এই অর্থ তারা জুয়া এ নরীর পেছনে অকাতরে ব্যয় করছে। এর একটি অংশও যদি তারা দরিদ্র মানুষের জন্যে দান করতো তাহলে হাজার হাজার মানুষের অন্ন ও আশ্রয়ের সংস্থান হতো। অথচ এই সুবিধাভোগী শ্রেণী দিনে দুপুরে ডাকাতির মতো জনগণেরন সম্পত্তি অপহরণ করে চলছে। সুদ, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি তো আছেই কিন্তু এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার কেউ নেই। আইনের হাত থেকে বাঁচার রাস্তাও তাদের জন্য সহজ। সুতরাং এই নিদারুণ পরিস্থিতি সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে, এতে আর সন্দেহ কী! আর এই সুযোগের জন্যে ওৎ পেতে বেস থাকে সর্বনাশা মার্ক্সবাদীরা। তখন তারা বিকল্প হিসেবে শ্রেণী সংগ্রামের কাজ জারি করে দেয়।
এক্ষণে এই মর্মান্তিক অবস্থায় মূল কারণ সর্ম্পকে কোনো হেঁয়লির অবকাশ নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যময় ও সুবিচারপূর্ণ বিধান হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম আজ স্বদেশেই নির্বসিত। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্র পরিচালনা, মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক তথা সর্বক্ষেত্রে আজ ইসলাম অপসারিত। খ্রীষ্টানদের অবক্ষয়ের সময় যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো এখন মুসলমানদের অবস্থা তাই। ইসলামকে শরীয়ত ছাড়া দ্বীন, রাষ্ট্র ছাড়া ধর্ম এবং কর্তৃত্ব ছাড়া আইনের কিতাবে পর্যবসিত করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে এমন পরিনামের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে যার সাথে তার নিজস্ব ইতিহাসের কোনো সাদৃশ্য নেই। ক্যাথলিক গীর্জা সব রকম অনাচারে নিমজ্জিত হয়েছিলো। তারা স্বৈরাচারী শাসকদের পৃষ্টপোষকতা করে সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিলো। সামান্য বিরোধিতা তারা সহ্যকরতে পারতো না। স্বাধীনভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিলো নিষিদ্ধ। এ জন্যে তারা নিষ্ঠুর নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল। তারা বই পুড়িয়েছে, মানুষকেও পুড়িয়ে মেরেছে। সুতরাং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ খুব স্বাভাবিক এবং ইউরোপে তাই হয়েছে। তারা গীর্জার জোয়াল থেকে এমনভাবেই নিজেদের মুক্ত করেছে যে, এখন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলেছে আরেক ধ্বংসের দাকে। যা হোক, মুসলমানদেরকে কেন এই কালো ইতিহাসের পরিণাম ভোগ করতে হবে? ইসলাম কেন নির্বসিত হবে স্রেফ মসজিদে কিংবা মানুষের বিবকের সীমিত পরিসরে? কিন্তু মসজিদও আজ নিরাপদ নয়। সেখানেও জিহ্বাকে আংটাবদ্ধ রাখতে হয়। কেননা গুপ্ত পুলিশের কড়া নযর থাকে এগুলোর ওপর। মোটকথা মসজিদেও আজকাল ইসলামের বিপ্লবী ব্যাখ্যা দেয়ার অনুমতি নেই।
এই সমস্যার মৌলিক কারণ, মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মকে রাষ্ট্র, আইন প্রণয়ন ও ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার শিক্ষা দেয়। মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক ইতিহাসে এরূপ অদ্ভুত শিক্ষার কোন নযীর নেই। কোননা আশ-শারীয়াহ শুধু ইবাদত-বন্দেগীর ভিত্তি নয়, বরং আইন, লেনদেন, ঐতিহ্য ও রীতি-নীতিরও উৎস। একথা সত্যি, কোনো কোনো মুসলমান শাসক সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন; কিন্তু অন্তত বিচার-আচারের ক্ষেত্রে শরীয়তকে উপেক্ষা করার তেমন নযীর নেই। এমনকি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো স্বেচ্ছাচারী শাসকও কুরআনুল কারীম ও সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়কে অগ্রাহ্য করার ধৃষ্টতা দেখাতেন না। এই পার্থক্যটা অনুধাবনযোগ্য। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি বা অবহেলার কারণে শরীয়ত থেকে বিচ্যুত হওয়া এক কথা আর আল্লাহর বিধান হিসেবে অন্যান্য মতবাদের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠতা অস্বীকার করা ভিন্ন কথা। এদিকেই ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ্ বলছেন: “নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহ্ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর?” (৫:৫০)
আরেকটি ব্যতিক্রমী বিষয় মুসলিম তরুণদের পীড়া দেয়। অমুসলিম দেশগুলো তাদেরই আদর্শ ও দর্শন মোতাবেক জীবন ধারা গড়ে তুলছে, অথচ কেবল মুসলমানরাই তাদের বিশ্বাস ও বাস্তবতা, তাদের দ্বীন ও সমাজের মধ্যে সৎঘাত জারি রেখেছে। আমার একটি বইয়ে লিখেছি: “ধর্মনিরপেক্ষতা খৃষ্টানরা গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তা মুসলমান সমাজে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।” খৃষ্টধর্ম জীবনের জন্যে পূর্ণাঙ্গ ঐশি বিধান পেশ করতে পারে না যার প্রতি তার অনুসারীরা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে পারে। খোদ বাইবেলে জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: একটি ঈশ্বর অথাৎ ধর্ম অন্যটি সীজার অথাৎ রাষ্ট্র। এতে বলা হয়েছে: “সীজারের জন্যে নির্ধারিত বিষয় সীজারকেই চালাতে দাও আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও।” (ম্যাথিউ-২২:২১)
সুতরাং একজন খ্রীষ্টান বিবেকের কোনরূপ দংশন ছাড়াই ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া তাদের পক্ষে ধর্মীয় শাসনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন গ্রহণ করার যুক্তি আছে। তাদের ধর্মীয় শাসনের অভিজ্ঞতা বড় নির্মম। অতীতে যাজকদের স্বেছ্ছাচারী শাসনের স্মৃতি তাদের মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন। মুসলিম সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নেয়া মানে আবাদত, বান্দেগী, আইন-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুকে সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করার শামিল। তাছাড়া বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণে শারীয়াহ সক্ষম নয়- এই মিথ্যা দাবীর কাছে নতি স্বীকার করা। বস্তুত মানুষের রচিত আইন মেনে নেয়া মানে ঐশী বিধানের পরিবর্তে মানুষের সীমিত জ্ঞানকে শ্রেয় মনে করা, অথচ আল-কুরআন বলছে: “বল! তোমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ্ ?” (২:১৪০)
এ কারণে মুসরমানদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার দাওয়াত নাস্তিকতা ও ইসলাম পরিহারের দাওয়াতের সমতুল্য। শারীয়াহর পরিবর্তে একে শাসনের ভিত্তি বলে গ্রহণ করলে তা হবে সরাসরি রিদ্দাহ। এই বিচ্যুতি সম্পর্কে জনগণ নীরব থাকরে তা বড় ধরনের সীমালংঘন ও পরিষ্কার অব্াধ্যতার নযীর বলে গণ্য হবে। এর ফলে মুসলিম সমাজে অপরাধবোধ, দীনতা, হিংসা, ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হতে বাধ্য। বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের নিজেস্ব ধ্যান-ধারণাই ফসল। এই মতবাদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন বটে, কিন্তু এর দেখাশোনার দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন অথাৎ জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কে ঘড়ির সাথে ঘড়ি-নির্মাতার সম্পর্কের মতো। ঘড়ি-নির্মাতা ঘড়ি তৈরি করে দেয়ার পর নির্মাতার সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে, তেমনি আল্লাহ পৃথিবী নির্মাণের পর তা আপন গতিতেই চলছে। এই ধারণা এসেছে গ্রীক দর্শন থেকে। এরিস্টলের মতে আল্লাহ পৃথিবী নিয়ন্ত্রন করেন না এবং এ সম্পর্কে কিছুই খবর রাখেন না। উইল ডুরান্ট এক ধাপ এগিয়ে তাকে বলেছেন অসহায় ঈশ্বর। সুতরাং এতে আর আশ্চর্যের কী আছে, যে ঈশ্বর তার সৃষ্ট জীবের খবরই রাখেন না তিনি কী করে তাদের জীবন যাত্রার বিধান তৈরি করবেন? এ দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া ছাড়া তো তার গত্যন্তর নেই! ইসলামের ধারনা থেকে এই ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত । আমরা মুসলমানরা বিশ্বাস করি আল্লাহ্ একই সাথে জগতের সৃষ্টিকর্তা, বিধানদাতা ও পালনকর্তা : “... তিনি সবকিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন।” (৭২:২৮)
তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বদর্শী; তাঁর দয়া ও বদান্যতা সকলের জন্য যথেষ।ট। এই ক্ষমতা বলেই তিনি মানুষের ঐশী পথ রচনা করছেন, হালাল-হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং বান্দাদেরকে তাঁরই বিধান মেনে চলতে এবং সেই অনুযায়ী ফায়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তারা না করে তবে তা হবে কুফরী ও সীমালংঘন।
নিষ্ঠাবান মুসলিম তরুণরা এ ধরনের অনাচার তাদের চোখের সামনেই দেখেছে কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা শক্তি প্রয়োগ কিংবা গলাবাজি করে এ সবের পরিবর্তন করতে পারছে না। তাদের একমাত্র উপায় মনের মণিকোঠায় গভীর অনুভূতি পোষণ যা ঈমানের দুর্বলতম অঙ্গ। অবশ্য, এই হৃদয়াবেগ চিরদিন চাপা থাকবে না। একদিন না একদিন তার বিস্ফোরণ ঘটবেই।
এছাড়া ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের পবিত্র স্থানসমূহ সর্বগ্রাসী হামলার শিকার। ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ, পৌত্তলিক, মার্ক্সবাদী তথা সকল ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের মত পার্থক্য ভুলে একযোগে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ইসলামী পুনরুজ্জীবন, ইসলামী আন্দোলন অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হীন তৎপরতা চালিয়ে যাছ্ছে। এ কারণে সকল অনৈসলামী ইস্যু প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, বিশেষত আমেরিকা ও রাশিয়ার নৈতিক ও বৈষয়িক মদদ পায়, কিন্তু ইসলামী ইস্যুতে তারা নির্বিকার। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজীদ বলছেন: “বেঈমনারা একে অন্যের সমর্থক।” (৮:৭৩)
কিন্তু ভাষা-বর্ণ-গোত্র-স্থান-কাল-নির্বিশেষে মুসলমানরা অন্য মুসলমানের বিপদাপদে, নিগ্রহ নিষ্পোষণ ও হত্যাযজ্ঞে নীরব থাকতে পারে না। কারণ তারা সেই সবূত্তোম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত যারা একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। কেননা যে মুসলমানের মনে অন্য মুসলমানের সম্পর্কে কোনো অনুভূতি নেই, সে মুসলমান নয়।
প্রতিদিন খবর আসছে ফিলিস্তিন, লেবানন, আফগানিস্থান, ফিলিপাইন, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, সাইপ্রাস ও ভারতে মুসলমানরা কিভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। অথচ আমরা দেখি আজকাল অন্য কোনো মুসলিম দেশ এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করে না, বরং সম্পূর্ণ উদাসীন। আরো মর্মান্তিক, কোনো কোনো শাসক ইসলামের শত্রুদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। তারা স্রেফ গোত্রীয়, আঞ্চলিক বা জাতিগত স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।
আল্লাহ, তাঁর রাসূল, দ্বীন, উম্মাহ ও এর স্বার্থের প্রতি তাদের কোনো আনুগত্য বা অনুভূতি নেই। তরুণরা আরো লক্ষ্য করছে, ইসলামের প্রতি শাসকদের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নেপথ্যে কাজ করছে ইহুদী, খ্রীষ্টান ও কম্যুনিজমের চক্রান্ত। কিন্তু শাসকদের মনে ভীতি সৃষ্টিকরে এবং তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনদমনে প্ররোচিত করে।
বহুবিধ বিষয়ের মধ্যে আরেকটি বিষয় বিগত কয়েক বছরে মুসলিম তরুণদের মদ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এটি হচ্ছে ১৯৬৭ সালের ৬ দিনব্যাপী মিসর-ইসরাঈল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া রোধের লক্ষ্যে যুদ্ধের জন্য দায়ি ব্যক্তিরা এই আশ্বাস বাণী শোনালেন যে, এটা “পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন”- তেমন ক্ষতিকর কিছু নয়। অথচ আরব দেশগুলোর তরুণরা শৈশব থেকে এই অঞ্চলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এই এলাকাকে মুক্ত করা মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় দায়িত্ব। ফিলিস্তিনের গ্রান্ড মুফতী মরহুম আমীন আল-হুসয়নী (র) -এ ব্যাপারে বলেছিলেন, “ফিলিস্তিন জনবসতিহীন জনপদ নয় যে, এখানে জনপদহীন লোকদের আশ্রয় দিতে হবে।” যা হোক ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পরিস্থিত নতুন মোড় নিলো অথাৎ আগ্রাসনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার নামে ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন কর হলো। এর অর্থ দাঁড়ায়, সাম্প্রতিক ইসরাঈলী আগ্রাসনে পুরানো আগ্রাসনকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে ১৯৪৯, ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের কী কারণ ছিল? গোড়াতেই ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দিলে মুসলিম উম্মাহ মারাত্মক পরিণতির হাত থেকে রেহাই পেতো। বস্তুত তথাকথিত “শান্তিপূর্ণ সমাধান” ও শান্তিচুক্তির অজুহাতে এসব অবমাননাকর উদ্যোগ নেয়া হয়। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ সামরিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তাদের নীতির পক্ষে সাফাই দেন। কিন্তু এসবই মুসলমানদের আশা-আকাংখায় তীব্র আঘাত হানে, বিশেষ কর ইসরাঈলের প্রতি সকর বৃহৎ শক্তির স্বীকৃতি ও সমর্থন এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা মুসলমানেদের আঘাত তীব্রতর করে। এসব ঘটনা থেকে এই উপসংহার টানা যায় যে, ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্রুসেড শুরু করা হচ্ছে। এসরামী বিশ্ব ও ইসরামী আন্দোলনের প্রতি পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক নেতাদের মনোভাবে এটা পরিস্ফুটিত। মুসলমানদের সাথে শতাব্দী প্রাচীন লজ্জাকর লড়াইয়ের স্মৃতি তাদের মনে এখন তরতাজা রয়েছে। তাই তাদের অন্তরে এখনো মুসরিম বুদ্ধিজীবি অবশ্য এই ধারণা বাতিল করে যুক্তি দেখাতে চান যে, পাশ্চাত্যে ক্রুসেড চেতনা নয়, তাদের জাতীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্তিতি তাদের এই দাবীকে ভুল প্রমাণিত করেছে, বরং পাশ্চাত্যে ক্রুসেড চেতনা পূর্ণমাত্রায় জীবন্ত। আমি আমি এলেনবী অথবা জেনারেল গুরান্ডের কথা বলতে চাই না। আমাদের সমসাময়িকদের মনেই প্রশ্ন জেগেছে : কেন পাশ্চাত্য মুসলিম ভূখন্ডে ইসরাঈলের অস্তিত্ব বহাল রাখতে আগ্রহী? কেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাঈলের নিন্দা সম্বলিত প্রতিটি জাতিসংঘ প্রস্তাবে ভেটো দেয়? কেন তারা ইরিত্রিয়ার বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী ইথিওপিয়াকে সমর্থন যোগায়? কেন সংবাদপত্রে মুসলিম দেশের ঘটনাবলী গুরুত্ব সহকারে স্থান পায় না? অথচ বিশ্বের কোথাও একটি বিমান হাইজ্যাক হলে যেন তুলকালাম কান্ড শুরু হয়? কেন তারা অন্যদের চেয়ে আরবদের সস্তা মনে করে? আসলে এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ ও কম্যুনিজমের শয়তানী আঁতাত গড়ে উঠেছে।
বস্তুত মুসলিম তরুণদের মতে মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা বিদেশী শক্তির দাবার গুটিমাত্র। তাদেরকে সামরিক অভ্যুথ্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনে মুসলমানদের চৌখে ‘হীরো’ সাজানো হয়। এই ধারণার মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহের আলোকে একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। এসব ঘটনা চোখে আয়্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যেই এই শাসকরা শয়তানী চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছে। এই নেতারা দৃশ্যত মুসলমান ও ইসলামের জন্যে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে, আসলে তারা মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের পোষা এজেন্ট।
৯. ইসলামী দাওয়াতে প্রতিবন্ধকতা
আরেকটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। বিষয়টি হচ্ছে ইসলাম প্রচারে স্বাধীনতা। ইসলাম শুধু নিজেকে সৎ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয় না, অন্যকেও সংশোধনের তাগিদ দেয়। মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দেয় ও খারাপ কাজ থেকে বিরত প্রচেষ্টাকে এ কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে তার সামর্থ অনুযায়ী ইসলাম প্রচারের কাজে অংশ নিতে হবে। এ জন্যে কুরআনে বলা হয়েছে: “তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান করো।”...(১৬: ১২৫)রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রত্যেক সাহাবী ছিলেন ইসলাম প্রচারক (দাইয়া)। কুরআন আরো বলছে: “বল, এটাই আমার পথ: আল্লfহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি সজ্ঞানে। আমি ও আমার অনুসারীগণ।” (১২:১০৮)
অতএবসংস্কার কর্মীদের লক্ষ্য হচ্ছে: “নিজে সৎ হও অপরকে সৎ করো।” আলকুরআনের ভাষায়: “কে উত্তম আল্লাহ্র (সাহায্যের) হাত জামা’তের সাথেই থাকে।” তিনি আরো বলেন: “একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারের কাছে সেই ইমারতের মতো যার বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত।” (বুখারী)
নিজেদের মধ্যে সহৃদয় সহযোগিতা এবং সৎ কাজের আদেশ কেবল একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। অতএব দাওয়াতী ক।ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক- এছাড়া দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে। বাস্তব কথা হচ্ছে ইসলাম বিরোধী শক্তি বিভিন্নভাবে সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছে, অতএব মুসলমানদেরকেও সংঘবদ্ধ হয়েই ঐ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। আন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়তে থাকব যখন অন্যরা এগুতে থাকবে। অতএব যেসব মুসলিম দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত দাওয়াতী কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, সরকারীভাবে এমনকি সেন্সরশীপের মাধ্যমে তারা মস্ত বড় গুনাহ করে। দাওয়াতী কাজে ভীতি প্রদান ও বাধা সৃষ্টিও চরমপন্থী মনোভাব সৃষ্টির প্রধান কারণ, বিশেষ করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও মার্ক্সবাদ প্রচারে কোনো বাধা দেয়া হয় না; বরং সকর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয় তখন এটাকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এ কারণে যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বিপ্লবের কাজে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই, কোনো সরকারেরও থাকতে পারে না।
বস্তুত মুসলিম দেশগুলোতেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা করতে গিয়ে সেন্সরশীপ ও নানা রকম দলনের শিকার হতে হচ্ছে। সেখানে ইসলামের চেহারা হচ্ছে পশ্চাদপদতা ও অবজ্ঞায় এবং আচার-অনুষ্ঠান, বিদাতী কাজ কাম, শাসক-তোষণ এবং শাসকদের গদী বহাল রাখার দেয়ার মধ্যে সীমিত। আর দুর্নীতিপয়ারণ শাসকরাও এ ধরনের ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় অতি উৎসাহী। এভাবে অন্যায়-অবিচার শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদকে তারা স্যাবোটাজ করার অপচেষ্টা চালায়। মার্কস সম্ভবত এই অর্থে দাবী করেছিলেন, “ধর্ম জনগণের জন্যে আফিম।”
কিন্তু কুরআনুল করীম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন যে ইসলাম রেখে গেছেন তা হচ্ছে সত্য, শক্তি, সম্মানান-মর্যাদা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জিহাদের প্রতিভূ। আর শাসকরা এই ইসলামকে ভয় পায়; কারণ তাদের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কি জানি কখন বিদ্রোহ দেখা দেয়! পক্ষান্তরে এই ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বলে: “তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করতো এবং তাঁকে ভয় করতো, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করতো না।” (৩৩:৩৯)
এই পরিছন্ন বিশ্বাসের আলোকে ঈমানদাররা মনে করে যেহেতু জীবন মেয়াদ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত, অতএব কাউকে ভয় করার দরকার নেই, আর তিনি ছাড়া কারো কাছে পার্থনারও দরকার নেই। সমসাময়িক তুরস্কের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার একজন উপপ্রধান মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি একটি দলের নেতা। তাদের বিরুদ্ধে শরীয়ত প্রবর্তন করার দাবী জানানোর অভিযোগ আনা হয়। অথচ তুরস্কের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান! উক্ত নেতা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ খাড়া করা হয়। অভিযোগগুলোর মূল বিষয় ছিলো তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে এসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। ধর্মনিরপেক্ষ আতাতুর্কের অনুসারী তুরস্কের তদানীন্তন সামরিক সরকার শরীয়ত তথা আসলামী জীবন বিধান পুনঃপ্রবর্তনের যে কোন প্রচেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ উক্ত গ্রুপ সর্বসম্মত আইনানুগ পন্থায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা শক্তি প্রয়োগ করে সহিংস পন্থায় সরকার উৎখাত করতে চাননি। সামরিক কৌশুলী তাদের বিরুদ্ধে নানা আপত্তিকর শ্লোগান তোলার অভিযোগও উথ্থাপন করে। শ্লোগানগুলো ‘আশাশারীয়াহ এবং ইসলাম এক ও অভিন্ন’ এবং আল-কুরআনই হচ্ছে সংবিধান।’
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মুসলমানই যিনি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দ্বীন ও হযরত মুহাম্মদ (সা) কে রাসূল হিসেবে স্বীকার করেন তার পক্ষে কী এগুলো অস্বীকার করা সম্ভব? যখন ঈমানের পরিবর্তে কুফর এবং হারামকে হালাল করা হয় তখন মুসলমানদের কীকরা উচিত? এসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কী বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থার মূল কারণ নয়? একটি আফ্রো-আবর দেশে কম্যুনিস্ট তৎপরতার জন্যে সাংবিধানিক সুযোগ ও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামী ভাবধারা জাগ্রত করার সকল প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ঐ দেশটি নিজেকে তথাকথিত “স্বাধীন বিশ্বের অঙশ” বলে বিবেচনা করে। আরো মারাত্মক হচ্ছে ঐ দেশটির মুসলিম নেতা-কর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও একমাত্র অভিযোগ, তারা আল্লাহ্ কে প্রভু, সত্যকে লক্ষ্য, ইসলামকে একমাত্র পথ, কথাকে অস্ত্র এবং জ্ঞানকে তাদের একমাত্র খোরাক বলে ঘোষণা করেছিলো।
অতএব, হেকমত ও সুন্দর ভাষণের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তরুণরা যদি শক্তিকে ও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়ে মোকাবিলা করতে চায় তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়? এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ইন্ শাআল্লাহ ইসলাম যেভাবে হোক সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে। তাদেরকে সুস্থ ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করতে দেয়া উচিত। অন্যথায় ঘটনাবলী অবাঞ্ছিত বিপরীত খাতে প্রবাহিত হতে পারে। খোলাখুলি কাজ করতে না দিলে দাওয়াতী কাজ বিভ্রান্তিকর গোপন সহিংসতা কিংবা চরমপন্থার রূপ নিতে পারে। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের মারাত্মক ভুল হচ্ছে তারা ইসলামী আন্দোলন দমনে বন্দী শিবির সহিংস মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। বন্দীশিবিরগুলোতে মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এ প্রনঙ্গে ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের মিসরের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। সামরিক কারাগারে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদেরকে লোমহর্ষক ও অবিশ্বাস্য পন্থায় শাস্তি দেয়া হয়। এখনো এসব কথা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তাদের দেহে আগুন ও সিগারেটের ছ্যাঁক দেয়া হয়, নারী ও পুরুষ বন্দীকে জবাই করা পশুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়, কারারক্ষীরা পালাক্রমে রক্ত ও পুঁজ জমে না ওঠা পর্যন্ত বন্দীদেরকে আগুনে ঝলসাতে থাকে। এই পাশাবিক আচরণে অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু শাস্তিদাতাদের দিল আল্লাহর ভয়ে এতোটুকু কেঁপে ওঠেনি। নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদের উদ।ভাবিত সকর নির্যাতন কৌশল তারা নির্বাচারে আল্লাহ্র পথের মুজিহিদদের ওপর প্রয়োগ করে।
এই বন্দীশালায় চরমপন্থা ও তাকফীরের প্রবণতা জন্ম নেয়। বন্দীদের মনে প্রশ্ন জাগে : আমরা কি অপরাধে হচ্ছি? আমরা আল্লাহর কালামের কথা ছাড়া আর কিছুতো বলিনি? আল্লাহর পথে জিহাদে আমরা কেবল আল্লাহ্ রই সাহায্য চেয়েছি, অন্য কারো কাছে তো পুরস্কার বা প্রসঙসা চাইনি? এই প্রশ্ন আরো প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই পশুরা কে যারা আমাদের নির্যাতন করে, আমাদের মানব সত্তাকে অপমানিত করে, আমাদের ধর্মকে অভিশাপ দেয়, আমাদের প্রভুরও অমর্যদা করার মতো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে! একজন পদস্হ কর্মকর্তা একদিন বলে: ‘তোমাদের প্রভুকে আমার কাছে হাযির করো, তাকে আমি জেলে পুরব।” এই পশুগুলোকে কি মুসলমান বলা চলে? এরা যদি মুসলমান হয় তাহলে কুফরী কী? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এরাই হচ্ছে কাফির, এদেরকে ইসলামের
আওতা থেকে বিতাড়িত করতেই হবে। এরপর আরো প্রশ্নের উদয় হয়: এদের সম্পর্কে এই যদি হয় আমাদের বিচার, তাহলে এদের মনিব সম্পর্কে আমরা কি সিদ্ধান্ত নেবো? ক্ষমতার আসনে বসে যেসব নেতা ও শাসক ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকেই বা কিভাবে বিচার করা উচিত? তুলনামূলক বিচারে তাদের অপরাধ অধিকতর মারাত্মক এবং তাদের রিদ্দাহ আরো স্পষ্ট- যে সম্পর্কে কুরআনুল করীমে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা সত্যত্যাগী।” (৫:৪৭)
এই সিদ্ধান্তে আসার পর ঐ নির্যাতিত মুসলমানরা তাদের সহবন্দীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: যেসব শাসক আল্লাহ্র বিধান মোতাবেক বিচার করে না এবং যারা শরীয়তের বাস্তয়নে সংগ্রামরত তাদের সাথে একমত হলো তাদেরকে শত্রু গণ্য করলো। এমনকি কাফিরও মনে করলো, কেনা কাফিরের কুফরী সম্পর্কে যে সন্দেহ পোষণ করে সে নিজেই কাফির। কিন্তু একানে শেষ নয়। যেসব লোক ঐরূপ শাসকের আনুগত্য করে তাদের সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠলো। জবাব তৈরি ছিলো: তাদের শাসকের আনুগত্য করে সে নিজেও কাফির।
এভাবে ব্যক্তি গ্রুপ বিশেষকে কুফরী ফতোয়া দেয়ার্ প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সহিংসতা শুধু সহিংসতার জন্ম দেয় না, সুস্থ চিন্তাকেও দূষিত করে এবং ঐ দলন-দমন অর্নিবার্য বিদ্রোহের জন্ম দেয়।Faru
No comments:
Post a Comment