ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যে আগাগোড়া এক অভিশাপ মানবতার জন্য একথা তুরষ্কের
বিগত প্রজন্ম যেভাবে উপলব্ধি করেছে, এ প্রজন্মের কাছে তা অনেকটা নতুন ঠেকতে
পারে। কেননা, ইতিহাস বিকৃতিকরণে তাদের জুড়ি নেই। শুধুমাত্র ইতিহাস কেন,
তারা তো একটি জাতির সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তারা ভাষার অক্ষর
পরিবর্তনের মত কাজটিও করেছে কেবলমাত্র ইসলামী চেতনাবোধ থেকে মানুষকে দূরে
রাখার জন্য। হত্যাযজ্ঞ, যুলুম, নির্যাতনের ইতাহাস তো যেন রূপকথা- সে
তুরষ্কবাসীর পিতা(!) কামালপাশার সংঘটিত ঘটনাবলী সত্যিই রূপকথার মত ঠেকে।
আযানের অপরাধে মুয়াজ্জিনের জিহ্বা কেটে দেয়া হয়েছে, সকল মাদ্রাসা বন্ধ করে
দেয়া হয়েছে, ইসলামী শিক্ষার সবগুলো পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, আজো সেখানে
ছোট্ট একটুকরো কাপড়-যা মেয়েরা মাথার চুলগুলো ঢাকার জন্য পরে থাকে-সেটুকু
অধিকার সে দেশের মেয়েরা অর্জন করার জন্য আদালতের পর আদালতে বিচার-বিবেচনা
হয়, এমনকি এই ছোট্ট একটুকরো কাপড় সরকারে সিংহাসন পর্যন্ত নড়িয়ে দিচ্ছে।
তাহলে ইসলামের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কতদূর? সে
প্রশ্নের পূর্বে এ প্রশ্ন অনিবার্য যে, তুরষ্কবাসীর পিতা(!) কি পেরেছিল শত
যুলুম-নির্যাতন-হত্যার পরও তুরষ্কবাসীর অন্তর থেকে ইসলামকে মুছে দিতে?
পেরেছিল কি নিরঙ্কুশ ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বপন করতে? না, পারেনি। বিগত কয়েক
দশকের ইসলামী দলগুলোর উত্থান আমাদেরকে সে জবাবই দিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশকে নিয়ে এই ষড়যন্ত্র দানাবাঁধে স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে। আমাদের প্রতিবেশী কথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশটির যে ধর্মনিরপেক্ষ রূপ আমরা দেখে যাচ্ছি যাতে প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকায় সরকারী মদদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সংখ্যালঘু মুসলিম ও খৃষ্টানদের যে হত্যা করা হয়, যুলুম নির্যাতন চালানো হয়; তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। ভারত আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে সত্য, সাথে সাথে এটাও সত্য যে, স্বাধীনতার পর পরই ভারত সে সহযোগিতার বিনিময় সুদে আসলে আদায় করে নিয়েছে লুটপাটের মাধ্যমে এবং আজো নিচ্ছে ফারাক্কার মত মরণ ফাঁদ ও সীমান্তে পাখির ছানার মত শত শত বাংলাদেশীকে হত্যার মাধ্যমে। ফারাক্কা আমাদের নদীগুলোকে হত্যা করেছে, যার দায়ভার ভারত সরকারের। পৃথিবীতে যদি কখনো নদী হত্যার বিচার শুরু হয়, তবে সে বিচারে ভারতের ফাঁসী অনিবার্য করলেই সুবিচার করা হবে। এছাড়াও নানা কুটনৈতিক ও ব্যবসায়িক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত ক্রমাগত যে অবিচার করে যাচ্ছে তাতে এদেশবাসী এতদিনে প্রায় ভুলতে বসেছে যে, একদিন আমরা যখন ঘোরতর বিপদে ছিলাম, তখন এই দেশটি আমাদেরকে সাহায্য করেছিল।
প্রসঙ্গান্তর ঘটে যাচ্ছিল, তবে প্রয়োজনও ছিল এ মর্মে যে, ভারত একটি আলাদা দেশ এবং বাংলাদেশও একটি আলাদা দেশ। সুতরাং দু’দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত; ভারতীয় দাদারা তা ভুলে যান কখনো কখনো। অবশ্য এটা যে তাদের দাদাগিরীর বদভ্যাস থেকে আসা, সেকথা আমরা জানি, কিন্তু এসব দাদাগিরী সিকীমের মানুষেরা সহ্য করেছিল, বাংলাদেশের বীর জনগণ সহ্য করেনি।
প্রসঙ্গে আসি, খবরটি বিগত ১৬ অক্টোবরের দৈনিকে নজরে পড়লো: “ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চালু ও স্কার্ফ খুলে ফেলতে পরামর্শ দিলেন ইউনেস্কোর ভারতীয় দূত”। খবরে বলা হয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর ষষ্ঠ স্কাউটস ফ্রেন্ডশিপ জাম্বুরিতে আসা বিভিন্ন দেশের প্রধান এবং জাতীয় চিফ স্কাউট কমিশনারের সম্মানে বাংলাদেশ স্কাউটসের জাতীয় কমিশনার গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আয়োজিত এক নৈশভোজে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দূত ভারতীয় নাগরিক মদনজিৎ সিং বাংলাদেশের স্কাউট নেতাদের সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে বক্তব্য রাখেন। যেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং তার মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন এবং তারাও বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে মদনজিৎ সিংয়ের বক্তব্যকে সমর্থন করেন।
ভোজসভা চলাকালে তার কাছাকাছি টেবিলে বসেছিলেন স্কাউটসের জাতীয় কমিশনার অধ্যাপিকা নাজমা শামস। মদনজিৎ সিং এক পর্যায়ে অধ্যাপিকা নাজমা শামসকে তার মাথা থেকে স্কার্ফও খুলে ফেলতে বলেন। অধ্যাপিকা নাজমা শামসকে স্কার্ফ পড়ার জন্য ননসেন্স বলেও ভর্ৎসনা করেন মদনজিৎ সিং। এমনকি মদনজিৎ সিং তার সাথে করর্মদন করার জন্যও পীড়াপীড়ি করলে নাজমা শামস বিব্রতবোধও করেন। এতে নাজমা শামসের পাশাপাশি অন্যান্য বিদেশী অতিথিরাও বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। এ সময় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, পাশ্চাত্যে কোনো নারী হাত না বাড়ানো পর্যন্ত কোনো পুরুষ তার সাথে করর্মদন করার অভিপ্রায় পোষণ করে না। আগত অন্যান্য অতিথিরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা একজন বিদেশী অতিথির ঔদ্ধ্যতপূর্ণ আচরণ ছাড়া কিছুই নয়। [সংবাদটি দৈনিক নয়াদিগন্তের সৌজন্যে]
আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার কথায়, কি হবে সেখানে? মোটের উপর শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনটি দিক থেকে চিন্তা করা যেতে পারে- ১) ধর্ম সংক্রান্ত কোন শিক্ষার সুযোগ থাকবে না, ২) সকল ধর্মের শিক্ষাই বর্তমান থাকবে এবং শিক্ষার্থীদের সব শিখতে হবে আর ৩) যার ইচ্ছা ধর্ম নিয়ে পড়বে আর যার ইচ্ছা ধর্ম ছাড়া পড়বে।
এ তিনটি দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, প্রথম অংশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের নাস্তিক্য অংশ কঠোর অবস্থানে আছে। তাদের ভাষ্যমতে ধর্মশিক্ষার কোনই প্রয়োজন নেই, ধর্ম মানুষ হত্যা করা শিখায়। আর যারা সুবিধাবাদী অংশ তারা আবার এ প্রস্তাবে দারুন পিচ্ছিল। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে না এটা স্বীকার করলে তো ধর্মপ্রতিষ্ঠাকারী দলগুলোর অপবাদ(?)কে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়ে যাবে যে, “ধর্মনিরপেক্ষতাই ধর্মহীনতা”। কেননা, শিক্ষা ব্যবস্থাতেই যদি ধর্ম না থাকে তবে তো ধর্ম নিরপেক্ষাতার মানে ধর্মহীনতাই প্রমাণিত হয়, যেখানে ধর্মকে শিখতে বাধা প্রদান করা হয়। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধদের ভেবে দেখা উচিত যে, উপরে বর্ণিত পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা কি আদৌ আপনারা চান?
দ্বিতীয় দিকটি যদি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হয়, তবে তো প্রতিজন মুসলিমকে মহাভারত, গীতা, বাইবেল, ত্রিপটক, জিন্দাবেস্তা ইত্যাদি পাঠ করতে হবে, আবার অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। যেহেতু সিলেবাসে আছে সেহেতু পরীক্ষা পাসের জন্য হলেও পাসমার্ক উঠানো পর্যন্ত পড়তে হবে। আর তাতে বোধ হয় ইসলামের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ হবার কথা নয়; সুতরাং এদেশের মুসলমানগণ তাতে এক কথায় রাজী হয়ে যেতে পারেন। কেননা, পৃথিবীর বর্তমান ইতিহাসেও শোনা যায় না যে, মহাভারত, গীতা, বাইবেল, ত্রিপটক, জিন্দাবেস্তা পড়ে কোন মুসলমান আকৃষ্ট হয়ে সেসব ধর্ম গ্রহণ করেছে; বরং অহরহই শোনা যাচ্ছে যে, কুরআন পড়ে কুরআনের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অগুণতি অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। সুতরাং একটি শিশু যদি ছোটবেলা থেকেই কুরআনের সাথে সাথে অন্যান্য গ্রন্থাদিও পড়ে, তবে আমি মনে করি ইসলামের সৌন্দর্য্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে সে আধা পথ এগিয়ে থাকবে যৌবনে পা রাখার আগেই। এবং সেসব শিশুরা যখন ইসলাম গ্রহণ করবে তখন তারা হবে প্রকৃত অর্থে বুঝেশুনে ইসলাম গ্রহণ করা মুসলিম।
তৃতীয় দিকটিই যদি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের টার্গেট হয়ে থাকে, তবে বলবো যে, বর্তমানে যেভাবে আছে সেটাই তো ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা। কেন? ছেলে বেলায় অন্য সব বিষয়ে সারা বছর পড়ে পড়ে এমনকি প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষা দিয়ে বহু কষ্টে শিষ্টে পাস করতে হতো। আর ধর্ম শিক্ষা? সে তো পরীক্ষার আগের রাতে পড়লেই ষাট/সত্তর মার্ক উঠানো যেত। অন্যরা কি করতেন জানি না, তবে আমি তাই করতাম। হুজুরের ক্লাসে, অর্থাৎ ধর্মের ক্লাসে চলতো সব বিচার আচার। কি পরিবর্তন হয়েছে সে অবস্থা থেকে?
এছাড়া মাদ্রাসাগুলোতে তো ঘোষণা দিয়েই ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় এবং সেগুলোতে কোন অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীরা যায় না, যাবার দরকারও নেই। ঠিক মাদ্রাসার মত করে যদি হিন্দুরা হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে, তবে ইসলামের কোন বাধা তাতে আছে বলে আমার জানা নাই। কিন্তু সেসব ধর্ম কি আদৌ তেমন কোন শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর জন্য যথেষ্ট বিষয়াদি ধারণ করে? একই ব্যাপার খৃষ্ট ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের বেলায়ও।
তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে বাকী থাকছে কি? “ধর্ম শিক্ষা” নামে ক্লাসে ক্লাসে যে বইগুলো আছে সেগুলো? হায়রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী! এই ছোট্ট একটা বই-যার পরীক্ষা দিয়ে পাস করার জন্য বছরে একটি রাত মাত্র ব্যয় করাই যথেষ্ট-সেই বইটিকে বাদ দেয়াই যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, তবে নিশ্চিত থাকুন যে, এই আদর্শে পৃথিবীর জন্য কোন কল্যাণ অবশিষ্ট নেই।
অথবা যদি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এমন হয় যে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে কামাল পাশা থেকে নিয়ে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের গুণগাঁথা শিখানো, তবে সেসবও কি বর্তমান নেই? তাহলে কি চাই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার মোড়কে? কি এমন মহা মূল্যবান রত্ন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের হাতছাড়া হয়ে গেছে যা তারা অর্জন করবে এই শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে?
একজন আলেম বলেছিলেন: “তারা মনে করে মোল্লারা কিছু বুঝে না, কিন্তু মোল্লারা যে বুঝে সেটা আবার তারা বুঝে না।” সুতরাং এদেশের আলেম সমাজকে নাস্তিকদের লিখিত নাটকে দেখানো “আলেম” মনে করলে তা দিয়ে হয়ত জনগণকে কিছুদিনের জন্য বিভ্রান্ত করা যাবে, কিন্তু নিজেরাও যদি নাটকে চিত্রিত “কাল্পনিক আলেম”-এর মত সবাইকে জ্ঞান করে, তবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের পতনের জন্য হয়ত এই একটি কারণই যথেষ্ট হয়ে যাবে। বিগত দুই/তিন সংসদ নির্বাচন ও সেসবের ফলাফল নিয়ে হামলা-মামলাগুলোর ফলাফল সে প্রমাণ পেশ করেছে এদেশবাসীর নিকট।
ফিরে যাই খবরের শেষাংশে, ড. কামাল হোসেনদেরকে এদেশের ভাবতে সত্যি ইতস্ত হয়, কেননা যারা নিজের মেয়েকে পাশে বসিয়ে মেয়ে কিংবা মা তুল্য ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী কর্তৃক আরেক বঙ্গনারীর অপমান শুধু সহ্যই নয়; বরং অপমানে উৎসাহ দিয়ে যায়, সমর্থন দিয়ে যায়; তারা কি করে বাংলাদেশের কল্যাণকামী হতে পারে। একজন মুসলিম নারী অন্য পুরুষের সাথে করমর্দন করতে পারেন না, যারা করছেন তারা নিঃসন্দেহে পাপাচারে লিপ্ত রয়েছেন। তদুপরি ভারতীয় মদনজিৎ সিং এর স্কার্ফ খুলে ফেলতে এবং না খোলার কারণে ভর্ৎসনা করাটা কত বড় অপরাধ তা বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং তার মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের ভালোভাবে জানা থাকার কথা। কিন্তু তারা ছিলেন নিরব। তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ এখনো আসেনি। আসেনি কোন নিন্দাও; পরন্তু এই অনুষ্ঠানে মদনজিৎ সিং এর ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু নিয়ে দেয়া বক্তব্যের সাথে সাথে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকেও যেন কামাল হোসেন সকন্যা সমর্থন করলেন।
প্রশ্ন একটাই, কবে এদেশ মুক্ত হবে ড. কামাল হোসেন আর সারা হোসেনদের সাথে সাথে মদনজিৎ সিংদের থাবা থেকে?
আমাদের দেশকে নিয়ে এই ষড়যন্ত্র দানাবাঁধে স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে। আমাদের প্রতিবেশী কথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশটির যে ধর্মনিরপেক্ষ রূপ আমরা দেখে যাচ্ছি যাতে প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকায় সরকারী মদদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সংখ্যালঘু মুসলিম ও খৃষ্টানদের যে হত্যা করা হয়, যুলুম নির্যাতন চালানো হয়; তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। ভারত আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে সত্য, সাথে সাথে এটাও সত্য যে, স্বাধীনতার পর পরই ভারত সে সহযোগিতার বিনিময় সুদে আসলে আদায় করে নিয়েছে লুটপাটের মাধ্যমে এবং আজো নিচ্ছে ফারাক্কার মত মরণ ফাঁদ ও সীমান্তে পাখির ছানার মত শত শত বাংলাদেশীকে হত্যার মাধ্যমে। ফারাক্কা আমাদের নদীগুলোকে হত্যা করেছে, যার দায়ভার ভারত সরকারের। পৃথিবীতে যদি কখনো নদী হত্যার বিচার শুরু হয়, তবে সে বিচারে ভারতের ফাঁসী অনিবার্য করলেই সুবিচার করা হবে। এছাড়াও নানা কুটনৈতিক ও ব্যবসায়িক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত ক্রমাগত যে অবিচার করে যাচ্ছে তাতে এদেশবাসী এতদিনে প্রায় ভুলতে বসেছে যে, একদিন আমরা যখন ঘোরতর বিপদে ছিলাম, তখন এই দেশটি আমাদেরকে সাহায্য করেছিল।
প্রসঙ্গান্তর ঘটে যাচ্ছিল, তবে প্রয়োজনও ছিল এ মর্মে যে, ভারত একটি আলাদা দেশ এবং বাংলাদেশও একটি আলাদা দেশ। সুতরাং দু’দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত; ভারতীয় দাদারা তা ভুলে যান কখনো কখনো। অবশ্য এটা যে তাদের দাদাগিরীর বদভ্যাস থেকে আসা, সেকথা আমরা জানি, কিন্তু এসব দাদাগিরী সিকীমের মানুষেরা সহ্য করেছিল, বাংলাদেশের বীর জনগণ সহ্য করেনি।
প্রসঙ্গে আসি, খবরটি বিগত ১৬ অক্টোবরের দৈনিকে নজরে পড়লো: “ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চালু ও স্কার্ফ খুলে ফেলতে পরামর্শ দিলেন ইউনেস্কোর ভারতীয় দূত”। খবরে বলা হয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর ষষ্ঠ স্কাউটস ফ্রেন্ডশিপ জাম্বুরিতে আসা বিভিন্ন দেশের প্রধান এবং জাতীয় চিফ স্কাউট কমিশনারের সম্মানে বাংলাদেশ স্কাউটসের জাতীয় কমিশনার গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আয়োজিত এক নৈশভোজে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দূত ভারতীয় নাগরিক মদনজিৎ সিং বাংলাদেশের স্কাউট নেতাদের সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে বক্তব্য রাখেন। যেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং তার মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন এবং তারাও বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে মদনজিৎ সিংয়ের বক্তব্যকে সমর্থন করেন।
ভোজসভা চলাকালে তার কাছাকাছি টেবিলে বসেছিলেন স্কাউটসের জাতীয় কমিশনার অধ্যাপিকা নাজমা শামস। মদনজিৎ সিং এক পর্যায়ে অধ্যাপিকা নাজমা শামসকে তার মাথা থেকে স্কার্ফও খুলে ফেলতে বলেন। অধ্যাপিকা নাজমা শামসকে স্কার্ফ পড়ার জন্য ননসেন্স বলেও ভর্ৎসনা করেন মদনজিৎ সিং। এমনকি মদনজিৎ সিং তার সাথে করর্মদন করার জন্যও পীড়াপীড়ি করলে নাজমা শামস বিব্রতবোধও করেন। এতে নাজমা শামসের পাশাপাশি অন্যান্য বিদেশী অতিথিরাও বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। এ সময় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, পাশ্চাত্যে কোনো নারী হাত না বাড়ানো পর্যন্ত কোনো পুরুষ তার সাথে করর্মদন করার অভিপ্রায় পোষণ করে না। আগত অন্যান্য অতিথিরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা একজন বিদেশী অতিথির ঔদ্ধ্যতপূর্ণ আচরণ ছাড়া কিছুই নয়। [সংবাদটি দৈনিক নয়াদিগন্তের সৌজন্যে]
আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার কথায়, কি হবে সেখানে? মোটের উপর শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনটি দিক থেকে চিন্তা করা যেতে পারে- ১) ধর্ম সংক্রান্ত কোন শিক্ষার সুযোগ থাকবে না, ২) সকল ধর্মের শিক্ষাই বর্তমান থাকবে এবং শিক্ষার্থীদের সব শিখতে হবে আর ৩) যার ইচ্ছা ধর্ম নিয়ে পড়বে আর যার ইচ্ছা ধর্ম ছাড়া পড়বে।
এ তিনটি দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, প্রথম অংশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের নাস্তিক্য অংশ কঠোর অবস্থানে আছে। তাদের ভাষ্যমতে ধর্মশিক্ষার কোনই প্রয়োজন নেই, ধর্ম মানুষ হত্যা করা শিখায়। আর যারা সুবিধাবাদী অংশ তারা আবার এ প্রস্তাবে দারুন পিচ্ছিল। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে না এটা স্বীকার করলে তো ধর্মপ্রতিষ্ঠাকারী দলগুলোর অপবাদ(?)কে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়ে যাবে যে, “ধর্মনিরপেক্ষতাই ধর্মহীনতা”। কেননা, শিক্ষা ব্যবস্থাতেই যদি ধর্ম না থাকে তবে তো ধর্ম নিরপেক্ষাতার মানে ধর্মহীনতাই প্রমাণিত হয়, যেখানে ধর্মকে শিখতে বাধা প্রদান করা হয়। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধদের ভেবে দেখা উচিত যে, উপরে বর্ণিত পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা কি আদৌ আপনারা চান?
দ্বিতীয় দিকটি যদি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হয়, তবে তো প্রতিজন মুসলিমকে মহাভারত, গীতা, বাইবেল, ত্রিপটক, জিন্দাবেস্তা ইত্যাদি পাঠ করতে হবে, আবার অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। যেহেতু সিলেবাসে আছে সেহেতু পরীক্ষা পাসের জন্য হলেও পাসমার্ক উঠানো পর্যন্ত পড়তে হবে। আর তাতে বোধ হয় ইসলামের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ হবার কথা নয়; সুতরাং এদেশের মুসলমানগণ তাতে এক কথায় রাজী হয়ে যেতে পারেন। কেননা, পৃথিবীর বর্তমান ইতিহাসেও শোনা যায় না যে, মহাভারত, গীতা, বাইবেল, ত্রিপটক, জিন্দাবেস্তা পড়ে কোন মুসলমান আকৃষ্ট হয়ে সেসব ধর্ম গ্রহণ করেছে; বরং অহরহই শোনা যাচ্ছে যে, কুরআন পড়ে কুরআনের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অগুণতি অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। সুতরাং একটি শিশু যদি ছোটবেলা থেকেই কুরআনের সাথে সাথে অন্যান্য গ্রন্থাদিও পড়ে, তবে আমি মনে করি ইসলামের সৌন্দর্য্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে সে আধা পথ এগিয়ে থাকবে যৌবনে পা রাখার আগেই। এবং সেসব শিশুরা যখন ইসলাম গ্রহণ করবে তখন তারা হবে প্রকৃত অর্থে বুঝেশুনে ইসলাম গ্রহণ করা মুসলিম।
তৃতীয় দিকটিই যদি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের টার্গেট হয়ে থাকে, তবে বলবো যে, বর্তমানে যেভাবে আছে সেটাই তো ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা। কেন? ছেলে বেলায় অন্য সব বিষয়ে সারা বছর পড়ে পড়ে এমনকি প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষা দিয়ে বহু কষ্টে শিষ্টে পাস করতে হতো। আর ধর্ম শিক্ষা? সে তো পরীক্ষার আগের রাতে পড়লেই ষাট/সত্তর মার্ক উঠানো যেত। অন্যরা কি করতেন জানি না, তবে আমি তাই করতাম। হুজুরের ক্লাসে, অর্থাৎ ধর্মের ক্লাসে চলতো সব বিচার আচার। কি পরিবর্তন হয়েছে সে অবস্থা থেকে?
এছাড়া মাদ্রাসাগুলোতে তো ঘোষণা দিয়েই ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় এবং সেগুলোতে কোন অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীরা যায় না, যাবার দরকারও নেই। ঠিক মাদ্রাসার মত করে যদি হিন্দুরা হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে, তবে ইসলামের কোন বাধা তাতে আছে বলে আমার জানা নাই। কিন্তু সেসব ধর্ম কি আদৌ তেমন কোন শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর জন্য যথেষ্ট বিষয়াদি ধারণ করে? একই ব্যাপার খৃষ্ট ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের বেলায়ও।
তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে বাকী থাকছে কি? “ধর্ম শিক্ষা” নামে ক্লাসে ক্লাসে যে বইগুলো আছে সেগুলো? হায়রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী! এই ছোট্ট একটা বই-যার পরীক্ষা দিয়ে পাস করার জন্য বছরে একটি রাত মাত্র ব্যয় করাই যথেষ্ট-সেই বইটিকে বাদ দেয়াই যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, তবে নিশ্চিত থাকুন যে, এই আদর্শে পৃথিবীর জন্য কোন কল্যাণ অবশিষ্ট নেই।
অথবা যদি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এমন হয় যে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে কামাল পাশা থেকে নিয়ে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের গুণগাঁথা শিখানো, তবে সেসবও কি বর্তমান নেই? তাহলে কি চাই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার মোড়কে? কি এমন মহা মূল্যবান রত্ন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের হাতছাড়া হয়ে গেছে যা তারা অর্জন করবে এই শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে?
একজন আলেম বলেছিলেন: “তারা মনে করে মোল্লারা কিছু বুঝে না, কিন্তু মোল্লারা যে বুঝে সেটা আবার তারা বুঝে না।” সুতরাং এদেশের আলেম সমাজকে নাস্তিকদের লিখিত নাটকে দেখানো “আলেম” মনে করলে তা দিয়ে হয়ত জনগণকে কিছুদিনের জন্য বিভ্রান্ত করা যাবে, কিন্তু নিজেরাও যদি নাটকে চিত্রিত “কাল্পনিক আলেম”-এর মত সবাইকে জ্ঞান করে, তবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের পতনের জন্য হয়ত এই একটি কারণই যথেষ্ট হয়ে যাবে। বিগত দুই/তিন সংসদ নির্বাচন ও সেসবের ফলাফল নিয়ে হামলা-মামলাগুলোর ফলাফল সে প্রমাণ পেশ করেছে এদেশবাসীর নিকট।
ফিরে যাই খবরের শেষাংশে, ড. কামাল হোসেনদেরকে এদেশের ভাবতে সত্যি ইতস্ত হয়, কেননা যারা নিজের মেয়েকে পাশে বসিয়ে মেয়ে কিংবা মা তুল্য ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী কর্তৃক আরেক বঙ্গনারীর অপমান শুধু সহ্যই নয়; বরং অপমানে উৎসাহ দিয়ে যায়, সমর্থন দিয়ে যায়; তারা কি করে বাংলাদেশের কল্যাণকামী হতে পারে। একজন মুসলিম নারী অন্য পুরুষের সাথে করমর্দন করতে পারেন না, যারা করছেন তারা নিঃসন্দেহে পাপাচারে লিপ্ত রয়েছেন। তদুপরি ভারতীয় মদনজিৎ সিং এর স্কার্ফ খুলে ফেলতে এবং না খোলার কারণে ভর্ৎসনা করাটা কত বড় অপরাধ তা বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং তার মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের ভালোভাবে জানা থাকার কথা। কিন্তু তারা ছিলেন নিরব। তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ এখনো আসেনি। আসেনি কোন নিন্দাও; পরন্তু এই অনুষ্ঠানে মদনজিৎ সিং এর ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু নিয়ে দেয়া বক্তব্যের সাথে সাথে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকেও যেন কামাল হোসেন সকন্যা সমর্থন করলেন।
প্রশ্ন একটাই, কবে এদেশ মুক্ত হবে ড. কামাল হোসেন আর সারা হোসেনদের সাথে সাথে মদনজিৎ সিংদের থাবা থেকে?
No comments:
Post a Comment