Pages

Tuesday, January 5, 2016

ধর্ম কেন ভাইরাসের সমতুল্য? (প্রেক্ষিত : পেশোয়ার এবং শার্লি এবদো)

আমি একটা বই লিখেছিলাম ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামে[1]। তেমন বিরাট কোন কাজ বা মৌলিক কিছু নয়, মূলত আধুনিক মেমেটিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল এ বইয়ে। সেই বিগত সত্তরের দশকে রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন বাজারে আসার পর থেকেই মিম এবং মেমেটিক্স তৈরি করেছে চলমান গবেষণার ক্ষেত্রে এক সজীব প্রেক্ষাপট। পশ্চিমা বিশ্বের একাডেমিয়ায় অজস্র গবেষণাপত্র তো বটেই, বিগত কয়েক বছরে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু জনপ্রিয় ধারার ভাল বিজ্ঞানের বইও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাভাষায় এ নিয়ে কোন বই ছিল না। আমার একটা প্রচেষ্টা ছিল এ বইয়ের মাধ্যমে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেবার। বইটা লিখার প্রেরণা ছিল মূলত সেটাই। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না, তবে মাসখানেকের মধ্যেই বইটির একাধিক সংস্করণ প্রকাশ এবং পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়ার নিরিখে বলা যায় বইটি নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল ছিল, হয়তো এখনো আছে। কৌতূহল এবং প্রশংসার পাশাপাশি বইটির কারণে কিছু লোকের বিরাগভাজনও হয়েছি বোধ করি। বিরাগভাজন হওয়া লোকজনের মধ্যে কিছু মুখচেনা অসুস্থ মৌলবাদী যেমন আছে, তেমনি আবার দু একজন বামপন্থি প্রগতিশীল ব্যক্তিও আছেন। প্রথম দলভুক্তরা রকমারির মত অনলাইন বই-বিপণন প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দিয়ে আমার বই নিষিদ্ধ করার মিছিলে সামিল হয়েছিলেন, আর দ্বিতীয় দলভুক্তরা সরাসরি জিহাদে না নামলেও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে ‘সালাফি সেক্যুলার’ বলে ট্যাগ করেছেন।
প্রথমোক্ত দলভুক্তদের নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। কারণ তারা যুক্তি মানেন না, জবাব দিতে চান অস্ত্রে কিংবা সহি উপায়ে কল্লা ফেলে দিয়ে। তারা মনেই করেন ধর্ম এবং ধর্মপ্রচারকদের বিন্দুমাত্র সমালোচনা কেউ করলে তাকে মেরে ফেলার স্বর্গীয় অধিকার তাদের আছে। তারা যদিও বাস করছেন আধুনিক একবিংশ শতকে, কিন্তু দেখে মনে হয় নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি এবং মনন জিম্মি রেখে এসেছেন সেই সপ্তম শতকে। এদের নিয়ে কিছু লেখার কোন অর্থ হয় না। কারণ জিহাদ এবং কতলের বাইরে তারা চিন্তা করতেই অক্ষম। দ্বিতীয় দলভুক্তরা অবশ্য সেরকম নন। তারা নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পক্ষেই কথা বলেন। সমাজ রাজনীতি এবং মানুষ নিয়ে তারা সংবেদনশীল। ব্লগে পত্র-পত্রিকায় মননশীল লেখা লেখেন। কাজেই তাদের বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব আছে আমার কাছে। পারভেজ আলম এমনি একজন মননশীল লেখক। ব্লগে লেখা ছাড়াও ‘মুসলিম জ্ঞানতত্ত্ব’ নিয়ে এবং ‘শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প’ বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ দুটো বই আছে তার। আমি উদ্যোগী হয়ে বইদুটো সংগ্রহ করেছি, পড়েছি, অন্যদেরও উৎসাহিত করেছি একসময়। ভদ্রলোক আরজ আলী মাতুব্বর পাঠাগার আন্দোলনের সাথেও যুক্ত। এমন একজনের লেখা নিঃসন্দেহে বাড়তি মনোযোগ দাবী করে। ঘটনার শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। সে সময় আমি ইংরেজিতে একটি লেখা লিখেছিলাম, মূলত: আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিখ্যাত মুক্তচিন্তার পত্রিকার অনুরোধে। সে সময় আইসিস কর্তৃক আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাংবাদিকদের শিরোচ্ছেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে মিডিয়া ছিল তোলপাড়। আমার সে সে লেখায় স্বভাবতই আইসিসের সে সব বর্বর কর্মকাণ্ডের কিছু সমালোচনা ছিল, এবং এটিকে দেখেছিলাম আমি ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ মহামারী হিসেবে। এ লেখার বিপরীতে পারভেজ একটি লেখা লিখেন ইস্টিশন ব্লগে আমাকে ‘সালাফি সেক্যুলার’ হিসেবে ট্যাগ করে। তিনি তার লেখাটির শিরোনাম পর্যন্ত দিয়েছিলেন ‘অভিজিৎ রায় কেন সালাফি সেক্যুলার হইলেন?’। কিন্তু মজার বিষয় হল, এ ধরণের উদ্দেশ্যমূলক ট্যাগে সামিল হলেও আমার বইটি পড়ে দেখার সৌজন্য তিনি দেখাননি। কিন্তু বইটি না পড়লেও আমার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। তা না হয় ঠিক আছে, সবাইকে সব কিছু পড়তে হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। অনেক সময় পক্ষে –বিপক্ষের চলমান বিতর্ক থেকেও আমরা শিখি, নিজেদের আপডেট করি। সে সময় এই বিতর্কের কারণেই মুক্তমনায় মুহম্মদ গোলাম সারোয়ার এবং নাস্তিকের ধর্মকথার দু’ দুটি সুলিখিত লেখা পেয়েছিলাম আমরা। বিশেষতঃ নাস্তিকের ধর্মকথা্র কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। তিনি আমার এবং পারভেজের লেখার উপর দুইপক্ষেরই কিছু দোষত্রুটি দেখিয়ে একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন মুক্তমনায় (যদিও দূর্ভাগ্যক্রমে তিনিও আমার বইটি পড়ে দেখেননি)। মিম এবং মেমেটিক্স নিয়ে তার আগ্রহ না থাকলেও (যেটা তিনি লেখাতে স্বীকারও করেছেন) সেই লেখায় ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ এই ধারনাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিছু আপাতঃ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। আমি সে সময় প্রবন্ধটির নীচে একটি প্রতিমন্তব্য করলেও (আমি ছাড়াও অভিষেক রহমান কিছু চমৎকার পয়েন্টের অবতারণা করেছিলেন) বিস্তৃত পরিসরে উত্তর দেবার সময় এবং সুযোগ পাইনি। পারভেজ অবশ্য বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন, শেষ লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের স্বার্থে অভিজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে লিখেছি’। আমি এ লেখায় সেরকম কোন শিরোনাম দিচ্ছি না। আমি ঠিক করেছি ব্যক্তিগত মান অভিমান ক্যাচাকেচি বাদ দিয়ে নির্মোহভাবে আরেকটিবার সবকিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। আর এ লেখার লক্ষ্য কেবল পারভেজ নয়, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পর প্রাসঙ্গিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং আলোচনা দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। এদের নিয়েও আমার কিছু অভিমত রয়েছে। আশা করব এ নিয়ে এটাই হয়তো আমার শেষ লেখা হবে।
এর মধ্যে বেশ কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। আইসিসের বিধর্মী-কাফেরদের ধরে ধরে শিরোচ্ছেদের যজ্ঞ তো চলছেই, পাশাপাশি খবরে দেখলাম, তারা আবার ১৫০ জন সগোত্রীয় নারীকেও হত্যা করেছে, কারণ এই নারীরা ইসলামের তাগুদি জিহাদীদের বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল[2]। পাশাপাশি চলছে নাইজেরিয়াতে বোকো হারামের ম্যাসাকার। প্রায় ২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ইসলামের নামে[3]। আরেকটা খবরে দেখলাম, রেইহানা নামে এক ইরানী মেয়েকে ধর্ষণ করা হল, আবার উল্টে শরিয়া আইনে বিচার করে তাকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল। এদিকে সৌদি আরবে এক মুয়াজ্জিন আজান দিতে দেরী করায় গুলি করে দিয়েছে ধর্মের এক দ্বীন এক ‘পাগলা’ সেবক। ক’দিন পরেই অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে এক ক্যাফে দখল করে মানুষজনকে জিম্মি করে রাখল আইসিসের পতাকাবাহী এক মধ্য বয়সী যুবক। এর মধ্যে আরেকটি দুঃখজনক ঘটনায় পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাকিস্তানী তালিবানেরা স্কুলে এসে গুলি করে প্রায় ১৪০ জন ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর পাক তালিবান প্রধান সহি বুখারির রেফারেন্স দিয়ে বলেছে, তাদের পেশোয়ারে গনহত্যা মুহম্মদের জীবনী এবং হাদিস শরিফ দিয়ে সমর্থিত। পেশোয়ারে যা তারা করেছে, তা ইসলামী ‘সুন্নত’[4]। পেশোয়ারের বর্বরতার রক্ত শুকোতে না শুকাতেই ঘটলো ফ্রান্সে শার্লি এবদোর দুঃখজনক ঘটনা। সাম্প্রতিক এ ঘটনাটি নিয়ে আবারো মিডিয়া তোলপাড়। নবী মুহম্মদকে নিয়ে ‘ব্যঙ্গাত্মক’ কার্টুন আঁকার কারণে ‘ধর্মানুভূতি’তে আঘাতপ্রাপ্ত জিহাদিরা ফ্রান্সের শার্লি এবদো পত্রিকা অফিসে হামলা চালায়। ১২ জন কার্টুনিস্টকে হত্যা করে “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিয়ে। হত্যা-মিশন সম্পন্ন করার সময় সন্ত্রাসীর মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল – ‘The prophet has been avenged’। পেশোয়ারের এবং শার্লি এবদোর বিয়োগান্তক ঘটনার পর আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, এ ধরণের বর্বরোচিত হামলার পর যদি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নিয়ে কারো সংশয় থাকে তা ঝেড়ে ফেলা উচিৎ। স্কুলের ১৪০ জন নিষ্পাপ শিশুদের গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিতে যাদের হাত এতোটুকু কাঁপে না, সামান্য কার্টুনের জবাব যারা বন্দুক এবং বোমার মাধ্যমে দিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তাদের মস্তিষ্ক ভাইরাসাক্রান্ত নয়তো আর কি! সেই চির পুরাতন ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ !
আসলে আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, ধর্মের বিস্তার আর টিকে থাকার ব্যাপারগুলো ভাইরাসের মত করেই কাজ করে অনেকটা। ধর্মের তাগুদি বান্দারাই তা বারে বারে প্রমাণ করে দেন। একটি ভাইরাসের যেমন ‘হোস্ট’ দরকার হয় বংশবৃদ্ধির জন্য, নিজেকে ছড়িয়ে দেবার জন্য, ধর্মেরও টিকে থাকার জন্য দরকার হয় এক গাদা অনুগত বান্দা এবং সেবকের, যাদের বুকে আশ্রয় করে ধর্ম টিকে থাকে। শুধু তাই নয়, জীবাণু যেমন নিজেকে রক্ষার জন্য অন্য জীবাণুর সাথে প্রতিযোগিতা করে, ঠিক তেমনি এক বিশ্বাসও প্রতিযোগিতা করে অন্য বিশ্বাসের সাথে। নিজেকে অন্য বিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। বিশ্বাসী বান্দাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয় – ‘অবিশ্বাসীদের কিংবা বিধর্মীদের কথা বেশি শুনতে যেয়ো না, ঈমান আমান নষ্ট হয়ে যাবে।’ ভাইরাস যেমন চোখ বন্ধ করে নিজেকে কপি করে করে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়, প্রতিটি ধর্মীয় বিশ্বাস অন্য বিশ্বাসগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে কেবল নিজের বিশ্বাসের কপি করে যেতে থাকে ঠিক একইভাবে। এভাবেই বিস্তার ঘটাতে থাকে বিশ্বাস নির্ভর সাম্রাজ্যের। কেন ধর্ম ভাইরাসের মতো সঙ্ক্রামক তা পেশায় চিকিৎসক এবং সুলেখক মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার তাঁর একটি সুলিখিত প্রবন্ধে খুব চমৎকার ভাবে দেখিয়েছিলেন[5]। তিনি ভাইরাসের শারীরিক গড়ন, ভাইরাসের কর্মক্ষমতা এবং এর কাজের ধরণ, ভাইরাসের ক্ষতিকর দিক এবং এমনকি ভাইরাসের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ধর্মের সাথে ভাইরাসের প্রবল সাযুজ্যের উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। সেখান থেকে কিছু পয়েন্ট আমাকে উল্লেখ করতেই হবে –
১ -ভাইরাসের শারীরিক গড়ন
ভাইরাস হচ্ছে এক ধরনের জীবাণু যা নিজে নিজের খাদ্য তৈরি করতে পারেনা, এটা বংশ বৃদ্ধি করতে পারেনা যদিনা এরা ভিন্ন কোনও প্রাণী দেহের ভেতরে অবস্থান না করে, অর্থাৎ, কোনও হোস্ট বা প্রাণী দেহের বাইরে ভাইরাস একটি নিরেট জড় পদার্থ। মাইক্রোবায়োলজির কোনও কোনও পুস্তক হোস্ট দেহের বাইরের ভাইরাস কে স্রেফ একটি জড় পাথরের সাথে তুলনা করেছে, ইংরাজিতে যাকে বলা যায় Inert substance। অর্থাৎ অন্যের দেহে না ঢুকে, ভাইরাসের পক্ষে কোনও কাজই করা সম্ভব নয়। নিজ অস্তিত্ব ও বৃদ্ধির প্রয়োজনে তাকে একটি হোস্ট খুঁজতেই হয়।
এবারে আসুন, পারভেজ আলমের লেখায় হজরত আলীর জবানিতে তিনি কি লিখেছেন পড়ে দেখুন –
সিফফিনের যুদ্ধের সময় খারেজিরা যখন ‘আল্লাহ ছাড়া কোন শাসক নাই’ এবং ‘কুরান ছাড়া কোন বিচারক নাই’ এই জাতীয় স্লোগান দিয়ে আলীর বিরোধিতা শুরু করেছিল তখন তাদের সাথে আলীর একটি বিতর্কের কাহিনী পাওয়া যায়। আলী একটি কুরান শরিফকে জনসমাজের সামনে রেখে সেই কুরানকে বলেছিলেন আল্লাহর আইন জনগণকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে। কুরান তো কথা বলতে পারে না, সে আলীর প্রশ্নের জবাব কিভাবে দেবে? জনগণ এই প্রশ্ন তোলার পর আলী সায় দিয়ে বলেছিলেন, কুরান হলো কাগজ আর কালি, কুরান নিজে থেকে কিছু বলতে পারে না। কুরান থেকে আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে খালি মানুষ, তার নিজের বুঝ বুদ্ধির আওতা অনুযায়ী।“
পারভেজ, আপনার এই গল্পটি হচ্ছে একটি আদর্শ উদাহরণ যে কুরআন বা যেকোনো গ্রন্থ হচ্ছে এক রকমের নিরেট নির্জীব পদার্থ, যার নিজের কোনও স্বাধীন কার্যক্ষমতা নেই, যার সক্রিয় হবার জন্যে অন্যের কাঁধে সওয়ার হতে হয়, অর্থাৎ যার সক্রিয় হবার জন্যে অবশ্যই একজন হোস্ট দরকার হয়, ঠিক যেমনটা দরকার হয় ভাইরাসের। অর্থাৎ কুরআনের বা যেকোনো ধর্মগ্রন্থের একটি হোস্ট দরকার, তার নিজেকে বৃদ্ধির জন্যে, নিজের বিস্তারের জন্যে। হোস্ট বিহীন কুরআন বা বাইবেল বুক শেলফ এর আরও তিন হাজার পুস্তকের মতই একটি নিরুপদ্রব পুস্তক। কিন্তু যখন ধর্ম গ্রন্থ একটি হোসট লাভ করে, তখন? তখন সে তার হোস্ট এর উপরে নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে হোস্ট তার নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে দাস হয়ে পড়েন ধর্মের, যাকে “ধর্মীয় অনুশাসন” নামে চালানো হয়ে থাকে। এই অনুশাসন মানুষ কে মুসলমান বানায়, হিন্দু বানায়, শিখ বানায় তারপর একজনকে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক চিন্তার জায়গাটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ধর্ম। আসুন, ভাইরাস এই কাজটি কিভাবে করে দেখা যাক –
২ – ভাইরাসের কর্মক্ষমতা এবং এর কাজের ধরণ
ভাইরাস যখন কোনও হোস্ট সেল এর ভেতরে ঢুকে যায়, তখন ভাইরাস সেই হোসট সেল এর প্রজনন ও অন্যান্য মেটাবলিক বা বিপাকীয় কাজের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। ভাইরাস কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম কে বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ এটি একটি স্বাভাবিক কোষের সাধারণ কাজ কে বন্ধ করে দিয়ে তাঁর মতো করে কাজ শুরু করে দেয়। তখন কোষ আর নিজের কাজের রুটিন বা নিয়ম মানতে পারেনা, যে ভাইরাস টি দ্বারা আক্রান্ত ঠিক তার শাসন অনুযায়ী কাজ করে। এক পর্যায়ে ভাইরাস মানব বা প্রাণী কোষের ভিতরে প্রজনন শুরু করে, লক্ষ লক্ষ নতুন ভাইরাস আরও লক্ষ লক্ষ কোষ কে আক্রমণ করে এবং এক সময় মানুষের দেহের কোনও নির্দিষ্ট তন্ত্রের স্বাভাবিক কাজ কে বন্ধ করে দেয়। সব শেষে হোস্ট কোষের বা এমনকি হোস্ট প্রাণীরও মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন টা ধর্ম একজন মানুষের স্বাভাবিক সামাজিক বোধ বুদ্ধি কে বন্দী করে ধর্মের অনুশাসন চাপিয়ে দেয়।মানুষ তখন হয়ে যায় ধর্মের ডিক্টেশনে চালিত, বিজ্ঞান বা মানবিক বোধ দ্বারা চালিত নয়।
৩ -ভাইরাসের ক্ষতিকর দিক এবং আক্রমণের ধরণ
ভাইরাস আক্রান্ত প্রাণী বা মানুষ বা হোস্ট দুই ধরনের হতে পারে। প্রথমত – ভাইরাস সঙ্ক্রমিত এবং যার মধ্যে সক্রিয় রোগ দেখা দিয়েছে (Virus infected with disease menifestation)। দ্বিতীয়ত – ভাইরাস আক্রান্ত কিন্তু রোগাক্রান্ত নয় (Carrier without active infection or disease), কিছু হোস্ট বা মানুষ কোনও রকমের রোগের প্রকাশ বিহীন ভাবেও থাকতে পারেন তার সারা জীবন। অথচ এরা ভাইরাস এর বাহক, এদেরকে বলা হয় ক্যারিয়ার।
– প্রথম গোত্রের মানুষ হচ্ছে সংক্রমিত এবং যাঁদের রোগের লক্ষণ প্রকাশিত ইনফেক্টেড উইথ এক্টিভ ডিজিস! বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত মানুষের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা ভোগান্তি হয়ে থাকে, মৃত্যুও হয়ে থাকে। এই ভোগান্তি সামান্য সর্দি – কাশী – ফ্লু থেকে শুরু করে মরনঘাতি এইডস ও হতে পারে।
– দ্বিতীয় গোত্রের হোস্ট হচ্ছে ক্যারিয়ার অর্থাৎ এরা জীবাণু টি বহন করেন কোনও রকমের লক্ষণ ছাড়াই। এই গোত্রের হোস্ট দের দুইটি সমস্যা আছে –
প্রথমত, যেহেতু এরা ক্যারিয়ার কিন্তু সাফারার নন, তাই এরা মনে করেন যে এরা সুস্থ এবং বাস্তবের এদের ইনফেকশন এর কথা ধরাও পড়ে কদাচিৎ বা অনেক দেরীতে, যেহেতু এদের কোনও লক্ষণ বা অভিযোগ থাকেনা। এদের কারো কারো সারা জীবনেও লক্ষণ প্রকাশিত হয়না।
দ্বিতীয়ত, রোগের আক্রমণ থেকে এরা বেঁচে গেলেও সবার অলক্ষ্যে এরা এই ভাইরাস কে সমাজের অন্যান্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন। অর্থাৎ ক্যারিয়ার হোস্ট বা মানুষেরা আপাত দৃষ্টিতে ঝুকিহীন হলেও এরা সবার অলক্ষ্যে ভাইরাস টিকে ছড়িয়ে দেন সমাজের সবার মাঝে।যারা ক্যারিয়ার বা বাহক, তারা যে সব সময় রোগের ঝুকিমুক্ত থাকবেন, তাও কিন্তু নয়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে এলে, এই ক্যারিয়ার বা বাহকরাও আক্রান্ত হতে পারেন সক্রিয় রোগে। সুতরাং ভাইরাস এর বাহক আপাত লক্ষনবিহিন হলেও এরাই ভাইরাসটিকে ছড়িয়ে দিয়ে আরও হাজার হোস্ট কে আক্রান্ত করে এবং নিজেও কোনও দিন আক্রান্ত হতে পারে।
আশ্চর্য জনক ভাবে একথা সত্যি যে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন রকমের ভাইরাস বহন করছেন কোনও রকমের রোগের লক্ষণ ছাড়াই। এমন কি মারাত্মক এইচ আই ভি ভাইরাসও বহন করছেন অনেকেই কোনও রকমের রোগের লক্ষণ ছাড়া। তার মানে হচ্ছে রোগের লক্ষণ প্রকাশিত না হলেই ভাইরাসের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করেনা। ধর্মের ভাইরাস বহন করছেন কিন্তু কোনও রকমের সন্ত্রাসী কাজ কর্মের সাথে জড়িত নন, এই গোত্রের মানুষদের পারভেজ বলছেন “শান্তিপ্রিয়” অর্থাৎ যারা ধর্ম বিশ্বাসী বা ধর্মের বিশ্বাস কে বহন করেন কিন্তু কোনও রকমের সন্ত্রাসবাদী কাজের সাথে জড়িত নন। তাই পারভেজ প্রশ্ন রাখছেন –
“কিন্তু দুনিয়ার সকল মুসলমানই কেনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে না অথবা আক্রান্ত হলেও কার্যক্ষেত্রে তার কোন প্রকাশ ঘটাচ্ছে না সেই প্রশ্নটি আসে।“
পারভেজ এর প্রশ্ন টি কি ভাইরাস এর “ক্যারিয়ার” ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
লক্ষণ প্রকাশিত না হওয়াকে পারভেজ বলেন “শান্তিপ্রিয়” কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় কি আমরা দেখিনি, ধর্মের বিশ্বাস বহন করা এই “শান্তিপ্রিয়” মানুষেরাও কখনও কখনও হয়ে ওঠেন ভয়ংকর? ধর্ম এদের কে কখনও সক্রিয় করে তোলে আবার নির্লিপ্ত – ভুমিকাহীন ও করে তোলে। এজন্যেই গুজরাটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা বাঁচাতে পারেনা মুসলিম শিশুর খুন হওয়াকে, এ জন্যেই বাংলাদেশের একটি গ্রামে যেখানে লক্ষ ঘর মুসলিম “শান্তিপ্রিয়” মানুষ থাকতেও ৫ – ১০ টি হিন্দু পরিবার কে বাচাতে পারেনা। এ জন্যেই দেখা যায় মাত্র ৩০ জন মুসলমান সন্ত্রাসী হয়ত ৩০০ হিন্দু পরিবার কে ভারতে পাঠিয়ে দিলো অথচ গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখলো। কারণ এই হাজার হাজার মানুষ গুলোর মস্তিষ্কের ভাইটাল মেকানিজম ধর্ম নামের ভাইরাসের দখলে। মানুষ এখানে ডিক্টেটেড বা পরিচালিত হয় “ধর্মের” অনুশাসন দ্বারা।

No comments:

Post a Comment