আগে গোসলের সময় সাবান শ্যাম্পু অবশ্য ব্যবহার করতাম কিন্তু মরক্কো আসার
পর, যেদিন প্রথম মরক্কোর হাম্মামে গোসল করতে আসি। আমার শরীর থেকে রুটি
খামিরের মত দলা দলা করে, সেদিন যখন ময়লা বের হয়ে আসতে থাকে, তখন বুঝতে
পারি আসলে এতদিন আমি গোসল করতে জানতাম না।
ভাল করে গোসল করতে জানতামনা বলেই ছোটবেলা আম্মা প্রায় শরীর ঘষে মেজে গোসল করিয়ে দিতেন। যখন ঢাকায় ছিলাম এই কাজ নুরুল ইসলাম নামক গার্ড ছিলো সে করে দিতো। এই নুরুল ইসলাম আমার পায়ে সরিষার তেল মালিশের বদ অভ্যাস করে। একদিন সে বলল, স্যার আপনার মাথা সব সময় গরম থাকে। রাতে ভাল করে ঘুমাতে পারেননা, বরিশালের টানে বলেছিলো, স্যার পায়ে তেল দেলে – মস্তক ঠাণ্ডা হইয়া যায়!!
১৯৯১ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর, শারজাহতে আসার পর পর গোসল আর কাপড় ধোয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এখানে কাপড় ধোয়ার লোক কোথায় ? গা ঘষিয়ে দেবার লোক কোথায়? এখানে যেভাবে ভোরে উঠে দৌড়ের উপর গোসল করতে হয়; তাতে শরীর ডলা ডলির তেমন সময় পাওয়া যায়না। আমার জীবনে আমি কখনো নিজের কাপড় ধোবার কাজও করিনি। প্রবাস জীবনে কাপড় ধোয়া নিয়েই বড় সমস্যায় পড়ে গেলাম।
একদিন আল্লাহ ভরসা করে অভিনব উপায়ে কাপড় ধোয়া শুরু করি। শ্রীলংকান মেয়েরা যে রুমগুলোতে থাকে, সেই রুমের পাশে, তাদের চলাচলের পথের পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসে গেলাম। ভিখারি যেভাবে ভিক্ষার আশায় রাস্তার পাশে গাছের তলায় ছালা বিছিয়ে বসে থাকে! আগেই বালতির মধ্যে পানি আর সার্ফ ডিটারজেন্ট পাউডার ঢেলে নিয়ে ছিলাম। এবার এক এক করে আমার সার্ট আর প্যান্ট সাবানের পানিতে চুবিয়ে দিলাম। চেয়ার থেকে বসে বালতির তলা পর্যন্ত হাত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা বুঝতে পেরে ; একখণ্ড বাঁশের সাহায্য নিলাম। বাঁশ দিয়ে যেভাবে যাতার পাথর দিয়ে গম ভেঙ্গে আটা বানানো হয়, আমিও বাঁশ দিয়ে পানির মধ্যে কাপড় গুলো ঘোরা শুরু করি!
চণ্ডিদাস যেমন শুকনা পুকুরে বড়শি ফেলেছিলেন, আমিও সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি! কিন্তু কোন মাছ আর গিলতে আসছেনা। শ্রীলংকান মেয়েরা প্রথমে না বুঝতে না পারলেও শেষে বুঝতে পেরেছে! আমাকে পাশ কেটে যাবার সময় মিটমিট করে হেসে চলে যাচ্ছে। শুধু শ্রীয়ান্তি নামের শুকনাটি মেয়ে কাছে এসে জিজ্ঞাস করে- মুনিম স্যার তোমাদের দেশে কি এই ভাবে কাপড় ধুইয়ে থাকে?
বললাম- আমাদের দেশে নয় আমি এইভাবে ধুইয়ে থাকি! সে মুখে হাত চাপা দিয়ে তার পথে চলে গেল! এক এক করে মেয়েরা আসে আর মেয়েরা চলে যায় কিন্তু কেউ আমার টোপ গিলছেনা। কুমারী, দায়ানী, চামেলি, আইরাংগিনী, প্রিয়ান্তি, মনরী, একনায়িকা, কান্তি, আনুলা, চান্দ্রানী,কল্যানী, ইরোমা, মনিকা, শিলা, ইয়ামুনা সব মেয়েরা তাদের ঘরে চলে গেল। কেউ আর কাছে এসে বললোনা, ইশ! মুনিম স্যার, বুঝতে পারছি আপনি কাপড় ধুতে জানেন না। তাই কাপড় ধুইতে পারছেন না, দিন আমাকে আমিই ধুইয়ে দিচ্ছি!!
মনে মনে গালি দিলাম, শ্রীলংকান মাইয়াগুলো পাথরের জান! আমাদের দেশের মেয়েরা এমন পাথর জান হতোনা। মনে মনে গালি দিলেই কি? কোন লাভ নেই! নিজে নিজকে বলি, মুনিম তোমার মিশন ফেল, এ কি বাংলাদেশ যে, দুলারী আর আমেনার মত মেয়েরা এসে তোমার ঘর গুছায়ে দিবে, কাপড় ধুইয়ে দিবে? এবার নিজের কাজ নিজে করে নাও সেলফ হেল্প! নতুবা আগামী কাল ময়লা কাপড় পরে তোমাকে অফিস করতে হবে।
যাকে বলে, নসিবের বাটা আর কপালের ফাটা!! দেখি ছেলেদের কাউকে কি পটানো যায়! চরম নিরাশ হয়ে ছেলেদের বাথরুমের দিকে যাবার উদ্দেশ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই, দ্রুত পায়ে দুটি শ্রীলংকান মেয়ে আমার কাছে এলো ! বিদ্যুৎ গতিতে ইংরেজিতে বলে । মুনিম স্যার, সব শ্রীলংকান মেয়ে বুঝতে পারছে, আপনি কি চাচ্ছেন! আপনার কাপড় ধুইয়ে দিতে কোন আপত্তি নাই কিন্তু আমাদের শ্রীলংকান ছেলেরা তা দেখলে মেনে নেবেনা। তারা আমাদেরকে গালাগালি করবে। তারপরও আমাদের ছেলেরা ঘুমি গেলে আমরা আপনার কাপড় ধুইয়ে দেব। স্যার আপনার বালতি আমাদের গেটের পাশে রেখে যান । হিপ! হিপ হুররে!
কেউ ভিক্ষা দিবে কি দিবেনা সেটি পরে ভাবলে চলবে; আগে দরজার নক করে দেখতে কি ক্ষতি? এরপর থেকে আমি বাংলাদেশের মত আমার কাপড় কাপড় ওয়াশ জনিত সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলাম!
যখন শারজাহ আসি তার দিন তিনেক আগে ঢাকা থেকে ১০/১২ জন ছেলে এসেছিলো। তাদের সকলের সাথে ঢাকার বনানীর আরব আমিরাত মৈত্রী কমপ্লেক্সের এফ সি আই লিঃ এর অফিসে একাধিক বার আলাপ পরিচয় হয়েছিলো। তারা সুইং অপারেটর পদে চাকুরী নিয়ে শারজাহ ফ্যাক্টরিতে আসে। তাদের মধ্যে মোশাররফ নামের একটি ছেলে ।
কাপড় ধোয়া জনিত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবার পর আমি ছেলেদের গোসলখানায় দেখতে এলাম ছেলেরা কি করছে? অনেকগুলো ছেলে গোসল করছে, মোশাররফকে দেখতে পেলাম, একপাশে বসে সে তার কাপড় ধুচ্ছে। তার দিকে খেয়াল করে দেখি তাকে কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জিজ্ঞাস করি, মোশাররফ তুমি কি অসুস্থ? সে জানায়, তার শরীর কেমন কেমন লাগছে। বললাম – অসুস্থ বোধ করলে আতিক ভাইয়ের কাছ থেকে ঔষধ নিয়ে খাবার জন্য।
আমাদের কাজ শুরু হয় ভোর সাড়ে সাতটায়, আমি যত রাত্রি জেগে কাজ করিনা কেন, আমাকে প্রতিদিন কাজ শুরুর আগে, সবার আগে গিয়ে ফ্যাক্টরির দরজায় খাঁড়া থাকতে হয়। কারণ আমি যদি সেখানে দাঁড়িয়ে না থাকি তাহলে অন্যরাও দেরি করে কাজে আসবে।
কোম্পানির জন্য কোম্পানীর প্রাথমিক সময় আমাদের একজনকে একসাথে বহুজনের কাজ একাই করতে হতো! সাড়ে সাতটার পর বাংলাদেশী ছেলেদের সুইং লাইনে চোখ পড়তে; দেখতে পাই মোশররফের মেশিন খালি পড়ে আছে! সুপারভাইজার রয়কে জিজ্ঞাস করি, মোশাররফ কোথায়? সে আমাকে জানায় মোশাররফ নাকি অসুস্থ। রাতে ঘুমাতে যাবার পূর্বে রয়কে জানিয়েছে যে, সে একটু দেরি করে কাজে আসবে।
গতকালের কথা মনে হলো, সে যে অসুস্থ তা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো শারজাহ ফ্যাক্টরিতে বাংলাদেশের মত অতিরিক্ত লোকবল নেই, যাতে কেউ অনুপস্থিত হলেই তার বদলি লোক বসিয়ে দেয়া যাবে। একজন লোক নাই মানে লাইনের প্রোডাকশনে ধ্বস নামা। আমাদের একটি লাইনে মাত্র বিশ/ বাইশজন অপারেটর, মাত্র দুইজন হেলপার, একজন সুপার ভাইজর ,একজন ইনপুট-ম্যান। ব্যাস এদের দিয়ে যেমন লাইনে কাপড় সেলাই করাতে হতো আবার লুজ সুতাও তাদের দিয়ে কেটে সাফ করতে হতো। কাজেই আমাদের কাজ খুব সহজ ছিলোনা!
আমাদের ফ্যাক্টরির ক্লিনর, সে বার দুয়েক মোশাররফের কথা এসে জিজ্ঞাস করে গেছে, জানতে চাইছে কেন মোশাররফ কাজে আসছেনা? তাকে জানাই সে অসুস্থ ন’টার পর নাস্তা করে আসবে।
নয়টার সময় নাস্তার টাইম চলে যাবার পর আবার যখন দেখি এখনো মোশাররফ কাজে আসেনি, তখন ছেলেটিকে ডেকে আনতে তার রুমে যাই! দোতলা খাটের উপরে ঘুমিয়ে ছিলো। খাটে বাইরে তার হাতের কুনোই বের হয়ে আছে। আমি রুমে আসার সাথে সাথে ক্লিনর সেও আমার সাথে রুমে আসে। যখন বার দুয়েক মোশাররফের নাম ধরে ডাকার পর তার তরফ থেকে কোন সাড়া পাইনি ; তখন তার কুনিতে ধরতেই কেমন যেন হিম শীতল অনুভূতি হলো!!
আমার জীবনে এর আগে নিকট থেকে কাউকে মরতে দেখিনি! কাজেই বুঝতে পারছিলামনা আসলে কি হয়েছে! আমার সাথে সাথে ক্লিনর লোকটি মোশাররফের গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠে, স্যার! মরে ডাট্টা (শক্ত) হয়ে গেছে! আমার বিশ্বাস হচ্ছিলোনা! আমি জিজ্ঞাস করি, তুমি কি করে বুঝলে যে সে মরে গেছে? সে এবার মোশাররফের বুকে হাত দিয়ে জানায়, স্যার সে আগ রাতেই (রাত বারোটার আগে) মরে গেছে তাইতো তার সারা শরীর শক্ত হয়ে গেছে! বুঝতে পারি ক্লিনর আগেই জানতে পেরেছিলো কিন্তু পুলিশি ঝামেলা পড়ার ভয়ে সে জানাতে সাহস করেনি।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস করতে পারিনি, দৌড়ে আমাদের রুমে চলে আসি, চিৎকার করে মৌলভী হান্নান ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, হান্নান ভাই জলদি আসুন, মনে হয় আমাদের একটি ছেলে মারা গেছে! শুনেই হান্নান ভাই বলে উঠেন, বলেন কি? ইন্নালিল্লাহ পড়তে পড়তে পাশের রুমে চলে আসেন। ছেলেটির বুকে হাত দিয়ে তিনি আবার ইন্নালিল্লাহ পাঠ করলেন এবং কলেমা শাহাদত পাঠ করতে করতে বললেন- হ্যাঁ ভাই ছেলেটি মারা গেছে।
আমি এবার দৌড়ে অফিসে চলে আসি, আতিকভাইকে খবর পৌঁছে দেই। ফ্লোরে রয়কেও জানাই এই মর্মান্তিক খবর। আতিকভাই সাথে সাথে বসের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেন। আতিকভাই আমাদের ফ্যাক্টরির কফিলের ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করেন। কফিলের ম্যানেজার পুলিশকে জানায়। কিছুক্ষণের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পুলিশ এসে পড়ে।
পুরো ফ্যাক্টরির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই ফ্লোর ত্যাগ করে বাইরের খালি জায়গাটুকুতে জমায়েত হয়ে আছে! আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নয় শ্রীলংকান মেয়েরা, তাছাড়া মাত্র সপ্তাহ পনরো দিন হয় এখানে এসেছি, তাদের সাথে আমাদের এখনো ভালো করে জানা পরিচয় ঘটেনি। তারপরও শ্রীলংকান সকল মেয়েরা এই বাংলাদেশী ছেলেটির জন্য যে ভাবে কেঁদেছিল তা দেখে আমার লজ্জা লাগছে, আমরা বাংলাদেশীরা তার মৃত্যুতে শক পেলেও কেউ কান্না করিনি! ছেলেটির মৃত্যুতে এইদিন ফ্যাক্টরি ছুটি দেয়া হয়। পরে শুনেছি ছেলেটির একটি ছোট্ট মেয়ে আছে, সে তার স্ত্রীর কাবিনের জায়গা বিক্রি করে বিদেশ এসেছিলো সুখি ভবিষ্যত গড়ে তুলতে। আমরা আমাদের একদিনের বেতন এবং বস নিজের পক্ষ থেকে টাকা দিয়ে মোশাররফের মেয়ের নামে টাকাগুলো ব্যাংকে রাখা হয়েছিলো। চলবে-
ভাল করে গোসল করতে জানতামনা বলেই ছোটবেলা আম্মা প্রায় শরীর ঘষে মেজে গোসল করিয়ে দিতেন। যখন ঢাকায় ছিলাম এই কাজ নুরুল ইসলাম নামক গার্ড ছিলো সে করে দিতো। এই নুরুল ইসলাম আমার পায়ে সরিষার তেল মালিশের বদ অভ্যাস করে। একদিন সে বলল, স্যার আপনার মাথা সব সময় গরম থাকে। রাতে ভাল করে ঘুমাতে পারেননা, বরিশালের টানে বলেছিলো, স্যার পায়ে তেল দেলে – মস্তক ঠাণ্ডা হইয়া যায়!!
১৯৯১ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর, শারজাহতে আসার পর পর গোসল আর কাপড় ধোয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এখানে কাপড় ধোয়ার লোক কোথায় ? গা ঘষিয়ে দেবার লোক কোথায়? এখানে যেভাবে ভোরে উঠে দৌড়ের উপর গোসল করতে হয়; তাতে শরীর ডলা ডলির তেমন সময় পাওয়া যায়না। আমার জীবনে আমি কখনো নিজের কাপড় ধোবার কাজও করিনি। প্রবাস জীবনে কাপড় ধোয়া নিয়েই বড় সমস্যায় পড়ে গেলাম।
একদিন আল্লাহ ভরসা করে অভিনব উপায়ে কাপড় ধোয়া শুরু করি। শ্রীলংকান মেয়েরা যে রুমগুলোতে থাকে, সেই রুমের পাশে, তাদের চলাচলের পথের পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসে গেলাম। ভিখারি যেভাবে ভিক্ষার আশায় রাস্তার পাশে গাছের তলায় ছালা বিছিয়ে বসে থাকে! আগেই বালতির মধ্যে পানি আর সার্ফ ডিটারজেন্ট পাউডার ঢেলে নিয়ে ছিলাম। এবার এক এক করে আমার সার্ট আর প্যান্ট সাবানের পানিতে চুবিয়ে দিলাম। চেয়ার থেকে বসে বালতির তলা পর্যন্ত হাত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা বুঝতে পেরে ; একখণ্ড বাঁশের সাহায্য নিলাম। বাঁশ দিয়ে যেভাবে যাতার পাথর দিয়ে গম ভেঙ্গে আটা বানানো হয়, আমিও বাঁশ দিয়ে পানির মধ্যে কাপড় গুলো ঘোরা শুরু করি!
চণ্ডিদাস যেমন শুকনা পুকুরে বড়শি ফেলেছিলেন, আমিও সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি! কিন্তু কোন মাছ আর গিলতে আসছেনা। শ্রীলংকান মেয়েরা প্রথমে না বুঝতে না পারলেও শেষে বুঝতে পেরেছে! আমাকে পাশ কেটে যাবার সময় মিটমিট করে হেসে চলে যাচ্ছে। শুধু শ্রীয়ান্তি নামের শুকনাটি মেয়ে কাছে এসে জিজ্ঞাস করে- মুনিম স্যার তোমাদের দেশে কি এই ভাবে কাপড় ধুইয়ে থাকে?
বললাম- আমাদের দেশে নয় আমি এইভাবে ধুইয়ে থাকি! সে মুখে হাত চাপা দিয়ে তার পথে চলে গেল! এক এক করে মেয়েরা আসে আর মেয়েরা চলে যায় কিন্তু কেউ আমার টোপ গিলছেনা। কুমারী, দায়ানী, চামেলি, আইরাংগিনী, প্রিয়ান্তি, মনরী, একনায়িকা, কান্তি, আনুলা, চান্দ্রানী,কল্যানী, ইরোমা, মনিকা, শিলা, ইয়ামুনা সব মেয়েরা তাদের ঘরে চলে গেল। কেউ আর কাছে এসে বললোনা, ইশ! মুনিম স্যার, বুঝতে পারছি আপনি কাপড় ধুতে জানেন না। তাই কাপড় ধুইতে পারছেন না, দিন আমাকে আমিই ধুইয়ে দিচ্ছি!!
মনে মনে গালি দিলাম, শ্রীলংকান মাইয়াগুলো পাথরের জান! আমাদের দেশের মেয়েরা এমন পাথর জান হতোনা। মনে মনে গালি দিলেই কি? কোন লাভ নেই! নিজে নিজকে বলি, মুনিম তোমার মিশন ফেল, এ কি বাংলাদেশ যে, দুলারী আর আমেনার মত মেয়েরা এসে তোমার ঘর গুছায়ে দিবে, কাপড় ধুইয়ে দিবে? এবার নিজের কাজ নিজে করে নাও সেলফ হেল্প! নতুবা আগামী কাল ময়লা কাপড় পরে তোমাকে অফিস করতে হবে।
যাকে বলে, নসিবের বাটা আর কপালের ফাটা!! দেখি ছেলেদের কাউকে কি পটানো যায়! চরম নিরাশ হয়ে ছেলেদের বাথরুমের দিকে যাবার উদ্দেশ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই, দ্রুত পায়ে দুটি শ্রীলংকান মেয়ে আমার কাছে এলো ! বিদ্যুৎ গতিতে ইংরেজিতে বলে । মুনিম স্যার, সব শ্রীলংকান মেয়ে বুঝতে পারছে, আপনি কি চাচ্ছেন! আপনার কাপড় ধুইয়ে দিতে কোন আপত্তি নাই কিন্তু আমাদের শ্রীলংকান ছেলেরা তা দেখলে মেনে নেবেনা। তারা আমাদেরকে গালাগালি করবে। তারপরও আমাদের ছেলেরা ঘুমি গেলে আমরা আপনার কাপড় ধুইয়ে দেব। স্যার আপনার বালতি আমাদের গেটের পাশে রেখে যান । হিপ! হিপ হুররে!
কেউ ভিক্ষা দিবে কি দিবেনা সেটি পরে ভাবলে চলবে; আগে দরজার নক করে দেখতে কি ক্ষতি? এরপর থেকে আমি বাংলাদেশের মত আমার কাপড় কাপড় ওয়াশ জনিত সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলাম!
যখন শারজাহ আসি তার দিন তিনেক আগে ঢাকা থেকে ১০/১২ জন ছেলে এসেছিলো। তাদের সকলের সাথে ঢাকার বনানীর আরব আমিরাত মৈত্রী কমপ্লেক্সের এফ সি আই লিঃ এর অফিসে একাধিক বার আলাপ পরিচয় হয়েছিলো। তারা সুইং অপারেটর পদে চাকুরী নিয়ে শারজাহ ফ্যাক্টরিতে আসে। তাদের মধ্যে মোশাররফ নামের একটি ছেলে ।
কাপড় ধোয়া জনিত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবার পর আমি ছেলেদের গোসলখানায় দেখতে এলাম ছেলেরা কি করছে? অনেকগুলো ছেলে গোসল করছে, মোশাররফকে দেখতে পেলাম, একপাশে বসে সে তার কাপড় ধুচ্ছে। তার দিকে খেয়াল করে দেখি তাকে কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জিজ্ঞাস করি, মোশাররফ তুমি কি অসুস্থ? সে জানায়, তার শরীর কেমন কেমন লাগছে। বললাম – অসুস্থ বোধ করলে আতিক ভাইয়ের কাছ থেকে ঔষধ নিয়ে খাবার জন্য।
আমাদের কাজ শুরু হয় ভোর সাড়ে সাতটায়, আমি যত রাত্রি জেগে কাজ করিনা কেন, আমাকে প্রতিদিন কাজ শুরুর আগে, সবার আগে গিয়ে ফ্যাক্টরির দরজায় খাঁড়া থাকতে হয়। কারণ আমি যদি সেখানে দাঁড়িয়ে না থাকি তাহলে অন্যরাও দেরি করে কাজে আসবে।
কোম্পানির জন্য কোম্পানীর প্রাথমিক সময় আমাদের একজনকে একসাথে বহুজনের কাজ একাই করতে হতো! সাড়ে সাতটার পর বাংলাদেশী ছেলেদের সুইং লাইনে চোখ পড়তে; দেখতে পাই মোশররফের মেশিন খালি পড়ে আছে! সুপারভাইজার রয়কে জিজ্ঞাস করি, মোশাররফ কোথায়? সে আমাকে জানায় মোশাররফ নাকি অসুস্থ। রাতে ঘুমাতে যাবার পূর্বে রয়কে জানিয়েছে যে, সে একটু দেরি করে কাজে আসবে।
গতকালের কথা মনে হলো, সে যে অসুস্থ তা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো শারজাহ ফ্যাক্টরিতে বাংলাদেশের মত অতিরিক্ত লোকবল নেই, যাতে কেউ অনুপস্থিত হলেই তার বদলি লোক বসিয়ে দেয়া যাবে। একজন লোক নাই মানে লাইনের প্রোডাকশনে ধ্বস নামা। আমাদের একটি লাইনে মাত্র বিশ/ বাইশজন অপারেটর, মাত্র দুইজন হেলপার, একজন সুপার ভাইজর ,একজন ইনপুট-ম্যান। ব্যাস এদের দিয়ে যেমন লাইনে কাপড় সেলাই করাতে হতো আবার লুজ সুতাও তাদের দিয়ে কেটে সাফ করতে হতো। কাজেই আমাদের কাজ খুব সহজ ছিলোনা!
আমাদের ফ্যাক্টরির ক্লিনর, সে বার দুয়েক মোশাররফের কথা এসে জিজ্ঞাস করে গেছে, জানতে চাইছে কেন মোশাররফ কাজে আসছেনা? তাকে জানাই সে অসুস্থ ন’টার পর নাস্তা করে আসবে।
নয়টার সময় নাস্তার টাইম চলে যাবার পর আবার যখন দেখি এখনো মোশাররফ কাজে আসেনি, তখন ছেলেটিকে ডেকে আনতে তার রুমে যাই! দোতলা খাটের উপরে ঘুমিয়ে ছিলো। খাটে বাইরে তার হাতের কুনোই বের হয়ে আছে। আমি রুমে আসার সাথে সাথে ক্লিনর সেও আমার সাথে রুমে আসে। যখন বার দুয়েক মোশাররফের নাম ধরে ডাকার পর তার তরফ থেকে কোন সাড়া পাইনি ; তখন তার কুনিতে ধরতেই কেমন যেন হিম শীতল অনুভূতি হলো!!
আমার জীবনে এর আগে নিকট থেকে কাউকে মরতে দেখিনি! কাজেই বুঝতে পারছিলামনা আসলে কি হয়েছে! আমার সাথে সাথে ক্লিনর লোকটি মোশাররফের গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠে, স্যার! মরে ডাট্টা (শক্ত) হয়ে গেছে! আমার বিশ্বাস হচ্ছিলোনা! আমি জিজ্ঞাস করি, তুমি কি করে বুঝলে যে সে মরে গেছে? সে এবার মোশাররফের বুকে হাত দিয়ে জানায়, স্যার সে আগ রাতেই (রাত বারোটার আগে) মরে গেছে তাইতো তার সারা শরীর শক্ত হয়ে গেছে! বুঝতে পারি ক্লিনর আগেই জানতে পেরেছিলো কিন্তু পুলিশি ঝামেলা পড়ার ভয়ে সে জানাতে সাহস করেনি।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস করতে পারিনি, দৌড়ে আমাদের রুমে চলে আসি, চিৎকার করে মৌলভী হান্নান ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, হান্নান ভাই জলদি আসুন, মনে হয় আমাদের একটি ছেলে মারা গেছে! শুনেই হান্নান ভাই বলে উঠেন, বলেন কি? ইন্নালিল্লাহ পড়তে পড়তে পাশের রুমে চলে আসেন। ছেলেটির বুকে হাত দিয়ে তিনি আবার ইন্নালিল্লাহ পাঠ করলেন এবং কলেমা শাহাদত পাঠ করতে করতে বললেন- হ্যাঁ ভাই ছেলেটি মারা গেছে।
আমি এবার দৌড়ে অফিসে চলে আসি, আতিকভাইকে খবর পৌঁছে দেই। ফ্লোরে রয়কেও জানাই এই মর্মান্তিক খবর। আতিকভাই সাথে সাথে বসের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেন। আতিকভাই আমাদের ফ্যাক্টরির কফিলের ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করেন। কফিলের ম্যানেজার পুলিশকে জানায়। কিছুক্ষণের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পুলিশ এসে পড়ে।
পুরো ফ্যাক্টরির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই ফ্লোর ত্যাগ করে বাইরের খালি জায়গাটুকুতে জমায়েত হয়ে আছে! আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নয় শ্রীলংকান মেয়েরা, তাছাড়া মাত্র সপ্তাহ পনরো দিন হয় এখানে এসেছি, তাদের সাথে আমাদের এখনো ভালো করে জানা পরিচয় ঘটেনি। তারপরও শ্রীলংকান সকল মেয়েরা এই বাংলাদেশী ছেলেটির জন্য যে ভাবে কেঁদেছিল তা দেখে আমার লজ্জা লাগছে, আমরা বাংলাদেশীরা তার মৃত্যুতে শক পেলেও কেউ কান্না করিনি! ছেলেটির মৃত্যুতে এইদিন ফ্যাক্টরি ছুটি দেয়া হয়। পরে শুনেছি ছেলেটির একটি ছোট্ট মেয়ে আছে, সে তার স্ত্রীর কাবিনের জায়গা বিক্রি করে বিদেশ এসেছিলো সুখি ভবিষ্যত গড়ে তুলতে। আমরা আমাদের একদিনের বেতন এবং বস নিজের পক্ষ থেকে টাকা দিয়ে মোশাররফের মেয়ের নামে টাকাগুলো ব্যাংকে রাখা হয়েছিলো। চলবে-
No comments:
Post a Comment