মনে পরে সেই ১৯/২০ বছরের ছেলেটির কথা। ছেলেটির কথা মনে হলে এখনও আমার দুই চোখ অশ্রু সজল হয়ে যায়। কিন্তু আমি পারিনি ওর জন্য কিছু করতে এমনকি পারিনি তাকে একদিনের জন্যও আশ্রয় দিতে।
যে ছেলেটির কথা বলছি: আমার শ্বশুর খুবই অসুস্থ, তাকে নিয়ে আমরা সবাই হাসপাতালে ছুটাছুটি করছিলাম। তারপর বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে শেষ পর্যন্ত এক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এ্যাম্বুল্যান্স্ থেকে আমার শশুরকে নামানোর পর এক যুবক হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ, সে আমাদের পাশে পাশে ছুটছে। মনে হয়েছিল সে আমাদের কেউ একজন। সবাই তো আব্বাকে নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না কে এই ছেলে । আমি দেখতে পেলাম সেই ছেলেটি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে; পাশে রাখা সেই কাপড়ের ব্যাগটি। অন্যরা দেখলে মনে করবে সে আমাদের সাথে এসেছে। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না । আমি বাসায় চলে এলাম। তার পরদিন যখন আমি আবার হাসপাতালে গেলাম; রাতের বেলা কেবিন থেকে বের হয়ে দেখলাম যে, সেই ছেলেটি আজও ওখানে ঘুমুচ্ছে । আমার শব্দ শুনে সে জেগে গেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি কাছে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার কি কেউ এখানে ভর্তি হয়েছে? ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘না’। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে আপনি এখানে কি করছেন প্রতিদিন ?’ সে বলল, ‘আমার কথা কি আপনার বিশ্বাস হবে ? আমার কথা শুনার মত সময় কি আপনাদের আছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ বলুন আমি আপনার সব কথা শুনব।’
সে বলতে লাগল, ‘আমার বাবা নেই। আমি বাবা মা’র বড় সন্তান। তিন বোন আর মা। আমার মা খুব অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা চলছে না । আমি অনেক কষ্ট করে এইচ.এস.সি পাশ করেছি । টাকার অভাবে আর লেখা পড়া হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও কোন কাজ পাচ্ছিলামনা । মায়ের চিকিৎসার টাকা দিতে বোনদেরকে দু-বেলা দুমুঠো ভাত আমি দিতে পারিনি। এসব কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চলে এলাম এই ঢাকা শহরে! এখানে এসে বুঝতে পারলাম আমি কতটা অসহায়, পৃথিবী কত কঠিন! মানুষ কত নির্মম! এখানে সবাই খুব ব্যস্ত নিজেদেরও প্রয়োজনে। এক মূহুর্তের জন্যও কেউ কাউকে সময় দিতে চায়না।’ আমি বললাম, আসলেই সবাই খুব ব্যস্ত, তাই সময় দিতে পারছেনা।
ছেলেটি আবার বলতে লাগল, ‘একদিকে মায়ের সে অসুস্থ মুখ অন্যদিকে বোনদের ক্ষুর্ধাত মুখ আমার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে। আমি ভাই হয়ে ওদের জন্য কিছুই করতে পারিনি । তাই উপায় না পেয়ে অনেক বলে কয়ে এক গ্যারেজ থেকে একটা রিক্সা নিয়েছিলাম। প্রতিদিন যা পেতাম তাতে ওদের টাকা জমা দিয়ে আমার থাকত ৭০/৮০ টাকা। এই টাকা দিয়ে আমি নিজে চলব নাকি বাড়িতে মা, বোনদের জন্য পাঠাব? ওরা তো আমার আশায় বসে আছে, তাই আমি সারাদিন এক বেলা খাই, অনেক দিন না খেয়েও থাকি । কিন্তু রাতে তো কোথাও থাকতে হবে তাই সন্ধ্যার পর রিক্সা গ্যারেজে জমা দিয়ে আমি ছুটতে থাকি বিভিন্ন হাসপাতালে।’
ছেলেটি আবার বলতে লাগল, ‘একদিকে মায়ের সে অসুস্থ মুখ অন্যদিকে বোনদের ক্ষুর্ধাত মুখ আমার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে। আমি ভাই হয়ে ওদের জন্য কিছুই করতে পারিনি । তাই উপায় না পেয়ে অনেক বলে কয়ে এক গ্যারেজ থেকে একটা রিক্সা নিয়েছিলাম। প্রতিদিন যা পেতাম তাতে ওদের টাকা জমা দিয়ে আমার থাকত ৭০/৮০ টাকা। এই টাকা দিয়ে আমি নিজে চলব নাকি বাড়িতে মা, বোনদের জন্য পাঠাব? ওরা তো আমার আশায় বসে আছে, তাই আমি সারাদিন এক বেলা খাই, অনেক দিন না খেয়েও থাকি । কিন্তু রাতে তো কোথাও থাকতে হবে তাই সন্ধ্যার পর রিক্সা গ্যারেজে জমা দিয়ে আমি ছুটতে থাকি বিভিন্ন হাসপাতালে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাসপাতালে কেন ?’ উত্তরে সে বলল, ‘বুঝতে পারছেন না, হাসপাতালে কেন ?’ আমি মাথা নেরে বলাম, ‘না।’ ছেলেটি বলল, ‘অবশ্য আপনাদের মত লোকরা আমাদের মত এই গরীবদের দুঃখের কথাগুলো না বুঝার-ই কথা। আমি কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে আছি। সে আবার বলতে লাগল, একেক দিন একেক হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, যখন দেখি কোন একটা এ্যাম্বুল্যান্স তখনি পাশে পাশে থাকি এবং রোগীর সাথে যে মানুষ আসে তাদের সাথে ঢুকে যাই। হাসপাতালের লোক জন মনে করে আমি সে রোগীর কেউ হই। তারপর যতদিন সে রোগী থাকে আমিও ততদিন থাকি। সারারাত এই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকি, সকালের অপেক্ষায়। যখনি রাত শেষে ভোর হয় তখনি রিক্সার জন্য গ্যারেজের দিকে ছুটতে থাকি। এভাবে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে আমার রাত চলে যায় আর দিন চলে রিক্সায়। এভাবে মাসের পর যে টাকা জমে সেগুলো দেশের বাড়িতে আমার মা, আর বোনদের জন্য পাঠিয়ে দেই। ওরা ভাল থাকলেই আমি ভাল থাকব। ওরা জানে আমি ঢাকা শহরে খুব ভাল চাকরি করি।’
আমি বললাম, ‘তাহলে আপনার খাওয়া, গোসল এগুলো? ’ সে আমাকে বলল, ‘যদি কখনও সম্ভব হয় তাহলে হাসপাতালেই গোসল করি।’ সে আরও বলল, ‘আমি এখানে মাঝে মাঝে ডিউটিও করি। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম সে একটু হেসে বলল ডিউটি বুঝতে পারছেন না তো? অনেক রোগী আসে যাদের সাথে কেউ থাকে না, যদি কখনও এরকম দেখি তখন ওদের জন্য আমার খুব মায়া হয়, সে রোগীর জন্য আমি কিছু করার চেষ্টা করি। আমি যদি বলি যে আমি এভাবে এখানে থাকি তখন হয়ত কেউ আমাকে সন্দেহ করবে, বা রোগীটিও আমাকে ভুল বুঝতে পারে । তাই বলি যে আমার ও এখানে রোগী আছে, সে কথা বলে সেবা যত্ন করি ।’
আমি ছেলেটির সব কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম, মনে মনে ভাবলাম যার সময় শেষ আমরা তাকে জোর করে আটকাতে চাই। আর যার বেঁচে থাকা খুব দরকার, বাঁচার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছে তাকে আমরা একটু সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসি না। আমি কিন্তু ছেলেটির জন্য কিছুই করতে পারিনি! আমি পারতাম অন্তত একটু আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু আমি তা করিনি। কারণ আমার সংসার, আমার সমাজ; পাছে লোকে কিছু বলে, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ,ভয় এসব ভেবে আমি আর কিছু করতে পারিনি সেই ছেলেটির জন্য। আমি তাকে তার মায়ের জন্য কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে নেয়নি। সে বলেছিল, ‘আমার মাকে আল্লাহ্ দেখবে কোন মানুষের সাহায্য আমি চাই না।’
আমি তাকে আর কিছুই বলতে পারিনি। সেই ছেলেটির কথা আমার প্রতি মূহুর্তে মনে পরে। মনে হয় গ্রামের এই সহজ সরল ছেলেটি নিজের সাথে সংগ্রাম করতে করতে হয়ত একদিন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে পারবে। আবার এমনও হতে পারে যে টাকার জন্য সে নিজের আত্ম বিশ্বাস হারিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে পারে। হয়তবা হয়ে যাবে বখাটে মাস্তান। এর জন্য তো আমরা সবাই দায়ী। আমাদের সমাজের এই বৈষম্য থেকেই তো সমাজে সর্বপ্রকার অরাজকতা এবং বিশৃংখলার সৃষ্টি।
আমিতো আর কিছু করতে পারিনি। দোয়া করি, এই রকম সব ছেলেরা যেন, জীবনের সাথে সংগ্রাম করে একদিন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে পারে। আমি একজনকে জেনেছি, কিন্তু এরকম আরও কতশত ছেলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। আমরা কি কেউ তাদের খবর রাখি?
No comments:
Post a Comment