আমার নাম নিলা সুলতানা, বয়স ২২ বছরের মত। আমার বাবা খুলনার একটি পাট কলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত এবং ১৯৮৪ সালের দিকে আমি সেখানে জন্মগ্রহন করি। তিনি সাপ্তাহিক ভিত্তিতে কাজ করত। আমার দাদার বাড়ি হচ্ছে ফরিদপুর জেলায়। আমার দাদার বাড়ি এবং নানার বাড়ি কাছাকাছি কিন্তু সেখানে সামান্য বাড়ী ভিটা ছাড়া কোন সম্পতি নেই । ছোট সময় দাদার বাড়ী, নানার বাড়ীতে বছরে দু’একবার সাধারনত ঈদের ছুটিতে যাওয়া হতো। আমার মা শুধু গৃহিণী হিসেবেই কাজ করত। আমি খুলনার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক বছর লেখাপড়া করেছি। আর্থিক অস্বচ্ছলতা,অজ্ঞতা ইত্যাদি কারনে লেখপড়াকরা হয়নি। কিন্তু এখন ঝুঝতে পাড়ি লেখাপড়ার মূল্য কত কিন্তু আফসোস ছাড়া কিছুই করার নেই। আমরা তিন ভাই, দুই বোন। দুই ভাই এক বোন বড় তারা ইতিমধ্যে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। বড় দুই ভাইই ঢাকায় রিক্সা চালায়। তাদের আর্থিক অবস্থা এত ভাল নয় যে বাবা-মা কে সাহায্য করবে।
সম্ভবত ১৯৯৩ সালে খুলনার জুটমিলটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাবা আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বেকার হয়ে পড়ে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার উপায়ও নেই। তাই নিরূপায় হয়ে তখন বাবা সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে। ঢাকায় আসার পর বাবা প্রথম দিকে নির্মান শ্রমিক হিসেবে কাজ করিলেও পরে একটি বাসার দারোয়ান হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় আসার পর মাও বাবাকে আর্থিক ভাবে সাহায্যে করার জন্য একটি গার্মেন্টসে চাকুরী করেন। প্রায় এক বছর চাকুরী করার পর আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে বাবা কাজ করিতে পারে না এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
সম্ভবত ১৯৯৩ সালে খুলনার জুটমিলটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাবা আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বেকার হয়ে পড়ে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার উপায়ও নেই। তাই নিরূপায় হয়ে তখন বাবা সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে। ঢাকায় আসার পর বাবা প্রথম দিকে নির্মান শ্রমিক হিসেবে কাজ করিলেও পরে একটি বাসার দারোয়ান হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় আসার পর মাও বাবাকে আর্থিক ভাবে সাহায্যে করার জন্য একটি গার্মেন্টসে চাকুরী করেন। প্রায় এক বছর চাকুরী করার পর আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে বাবা কাজ করিতে পারে না এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
এখন আমি বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে থাকি। ছোট ভাই আয় করিতে পারে না, বর্তমানে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে । আমি আমার বাচ্ছাসহ অনেক দিন ধরেই তাদের সাথে থাকছি।
আমার ২০০১ সালের দিকে আলাল নামের একটি ছেলের সাথে বিয়ে হয়। তার বর্তমান বয়স ২৭ বছর তার বাড়ী পাবনা জেলায়, সেখানেই তার পরিবারের সবাই থাকে। সে আমাদের এই এলাকায় থাকত এবং রিক্সা চালাতো। আলাল নবম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে এবং দেখতেও বেশ সুশ্রী ছিল। সে অন্য কোন কাজ পায়নি বলেই রিক্সা চালাত। কিন্তু নিয়মিত রিক্সা চালাতে চাইত না। বিয়ে করার পর সে আমাকে নিয়ে একটি এক রুমের বাসা ভাড়া করে। কিন্তু অলসতা এবং নিয়মিত রিক্সা চালাতনা বলে সে সংসার চালাতে পারত না। মাঝে মাঝে আমার বাবা-মা আর্থিক ভাবে সাহায্য করত। টাকার অভাবে মাঝে মাঝেই দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতো। এরই মধ্যে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়ি। আমাদের আরো খরচ বেড়ে গেলো। এক পর্যায়ে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে আমি তার বাসা থেকে চলে আসি বাবা-মায়ের কাছে। বাবা-মায়ের কাছে থাকা অবস্থায়ই আমার পুত্র সন্তান হয় ২০০৩ সালের শেষের দিকে। এদিকে স্বামী রাগ করে তার গ্রামের বাড়ী চলে যায়। তখন বাবা-মা ই আমাকে এবং সন্তানকে দেখাশুনা করত। বাবা-মার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল ছিল না। ভাইয়েরাও কেউ সাহায্য করিত না। বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাকে নানা রকম কথা শুনতে হতো। টাকা পয়সার অভাবে আমাকে অনেক সমস্যায় ভূগতে হতো। পরিবারের সবার কাছেই অতিরিক্ত হয়ে গেলাম। তখন আমি টাকা পয়সা আয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম যদিও তখনও আমি পুরোপুরি সুস্থ ছিলাম না। তখন আমি কয়েকটি বাসায় খন্ড কালীন বুয়া হিসাবে কাজ করা শুরু করলাম। আমি খুব পরিশ্রম করিতে শুরু করিলাম আয় করার জন্য। গৃহভৃত্য হিসাবে খুব পরিশ্রম করেও খুব বেশী আয় করা যেত না। তিন/চারটি বাসায় ১৩/১৪ ঘন্টা কাজ করে মাত্র ৯০০ টাকা পেতাম। তখন আমি কিছু বেশী আয় করার জন্য কত পরিশ্রম এবং কত সমস্যায় যে পড়েছিলাম তা ভাষায় ব্যাখ্যা করিতে পারিব না। আমাদের একই এলাকার কহিনুর নামে মাঝবয়সী একজন মহিলা থাকতো - সে আমাকে চিনত এবং আমার সমস্যা সম্পর্কেও অবহিত ছিল। তার কাছেই আমি নারী জীবন সম্পর্কে এবং এর চেয়ারম্যানের মহানুভবতা সম্পর্কে জানতে পারলাম। কোহিনুর নারী জীবনের ছাত্রী ছিল। আমি কোহিনুর আপাকে নারী জীবনে নিতে এবং এর চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করানোর জন্য অনুরোধ করলাম। আমি কোহিনুরের সাথেই নারী জীবন সংস্থায় গেলাম এবং এর কার্যক্রম দেখে খুবই আশ্চার্য হলাম। মনে হলো এখনো পৃথিবীতে কিছু সংস্থা এবং মানুষ সত্যি মানুষের জন্যই কাজ করে। নারী
জীবনে গিয়ে বাংলায় লেখাপড়া এবং দর্জির কাজ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হলো কারণ
বাসায় দর্জির কাজ করে আয় করা যায় যা অন্য মানুষের বাসায় কাজ করার চেয়ে অনেক
ভালো এবং সম্মানের। কিন্তু কিভাবে এবং কখন শিখবো টাকা আয় না করিতে পারলে তো আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। অসুস্থ বাবা-মা বাচ্চা সবাইকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়তে হবে। কোহিনুর আপা যেহেতু আমার সব সমস্যার কথা জানে সেই নারী জীবনের চেয়ারম্যানকে আমার সব সমস্যার কথা বললো। সব কিছু শুনার পর তিনি আমাকে এমন সুবিধা দিলেন যে আমি নারী জীবন থেকে সব কিছু শিক্ষার সুযোগ পেলাম। কাজ শেখার পাশাপাশি আমার বেতনের ব্যবস্থা করিলেন যা সারাদিনের বুয়ার কাজের বেতনের চেয়ে অনেক বেশী। এ রকম মহান মানুষ আমার জীবনে আসেনি।
আমি ১০ই জুলাই ২০০৬ সালে নারী জীবনে এল.পি.সি ( লেখা-পড়া-চাকুরী ) হিসাবে ভর্তি হলাম। আমি বাংলা সেকশনে বাংলা এবং অংক শিখতে শুরু করলাম। যেহেতু আমি বাংলা কিছু কিছু জানতামই তাই শিখতে বেশী দিন লাগলো না। অল্প দিনেই বাংলা-অংক-এবং কিছু ইংরেজী শব্দও শিখে ফেললাম। সুবিধা ছিল এই যে সারাদিন (অফিস সময়) আমার শেখার সুযোগ ছিল। অন্যদিকে চিন্তা মুক্ত ছিলাম পরিবারের ব্যয় নিয়ে। যা পেতাম তা দিয়ে ভালো মতোই চলে যেত। বাংলা সেকশনের কোর্স শেষ করার পর পরই দর্জির কাজ শেখা শুরু করলাম এবং অল্প দিনেই সাফল্যের সাথে সব আইটেম তৈরী করা শিখে ফেললাম। সারাদিন অফিসে থাকতে হতো বলে পর্যাপ্ত অনুশীলন করার সুযোগ পেতাম। নারী জীবন থেকে প্রতি মাসে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি ৩৭০০ টাকা পেতাম। তখন বাবা-মা সহ অন্যরাও আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতো এবং তারা আমার উপর খুশি ছিল। অন্যদিকে আমার স্বামী আবার ঢাকায় এলো। এবং সে মাঝে মাঝেই আমার ছেলেকে দেখতো আসতো নানা রকম জিনিস নিয়ে। কিন্তু আমি তাকে পাত্তা দিতাম না। আমার স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে বিক্রয় কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছে। তাকে আর রিক্সা চালাতে হয়না। দীর্ঘ ছয় মাস আমি নারী জীবনে শেখার সুযোগ পেয়েছি। এই সময়ের মধ্যে বাংলা এবং টেইলরিং কোর্স সমাপ্ত করেছি। তাছাড়াও আমি অফিস ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে প্রশিক্ষন নিয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল গৃহে বসে দর্জির কাজ করা। কিন্তু সেলাই মেশিন ও ব্যবসা শুরু করার জন্য বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন। কিন্তু আমার কাছে তা ছিলনা। তাই আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নারী জীবনের চেয়ারম্যানকে সহযোগীতা করার জন্য অনুরোধ করি। আমার
তৈরী ব্যবসার পরিকল্পনার বাজেট অনুযায়ী তিনি আমাকে একটি নতুন সেলাই মেশিন
এবং আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার জন্য কিছু নগদ টাকা দেন। ইতিমধ্যে আমার স্বামী আমার কাছে ফিরে এসেছে। এখনো আমরা আমার বাবা-মার সাথেই থাকছি। আমার স্বামী চাকুরী করছে এবং আমি ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ করছি। এভাবে যা আয় হয় তা দিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া নিলে আমাদের চলতে অসুবিধা হবে। স্বামীর সাথে আলোচনা করে গত আগষ্ট,২০০৭ সালে আমি একটি গার্মেন্টসে চাকুরী নেই। সেলাই কাজ এবং লেখাপড়া জানি বলে চাকুরী নিতে পেরেছি সহজেই। কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই বলে তিন মাস আমাকে হেলপার হিসাবে চাকুরী করিতে হবে। গার্মেন্টেসের নিয়োগ কর্তা আমাকে কথা দিয়েছেন তিন মাস কাজ করার পরে আমার বেতন বৃদ্ধি করিবেন। বর্তমানে আমার বেতন ধরা হয়েছে ১২৫০ টাকা। গার্মেন্টেস থেকে বাসায় ফিরে আমি সেলাইয়ের কাজ করি। আমি মনে করি নারী জীবন থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমি নারী জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ।
No comments:
Post a Comment