Pages

Tuesday, December 29, 2015

মাকে মনে পরে

এসএসসি পাস করে যখন কলেজে ভর্তি হই তখনই আমার মা মারা যায়আমরা ৫ ভাই বোন, আমি সবার ছোটখুব আদর-যত্নে বড় হয়েছিতখন কোন দুঃখ, কষ্ট, এবং বাস্তবতা সর্ম্পকে কোন ধারণাই ছিলনাদুচোখ ভরা ছিল স্বপ্ন কিন্তু হঠাৎ একদিন এক ঝড় এসে আমার জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিল
সে দিন ছিল ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৯ তারিখ, সোমবারমা আমার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেলকরে গেল আমায় একাসে দিনটির কথা মনে হলে আমি আর কিছু ভাবতে পারিনামনে হয় আমি এখনও বেঁচে আছি কিভাবে? সে রাতের ঝড়ে আমার জীবনটা হয়ে গেল এলোমেলো, আমি হয়ে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগ্য মানুষের একজনআমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল সব আনন্দ, সব সুঃখ, ভেঙে গেল সব স্বপ্নআমি হয়ে গেলাম একাআমি বুঝতে পারতাম না বাস্তবতা কত কঠিন,পৃথিবী কত নির্মম, নিষ্ঠুরশুধু একজনকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেলামসব কিছু আছে চারদিকে তবু আমার মনে হয় আমার কিছুই নেইসারাক্ষণ আমার মনের মধ্যে শুধু শূণ্যতা আর হাহাকার! আসলে আমি যে অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি সে অমূল্য সম্পদ কি আর কোনদিন ফেরত পাব?
সেদিন মনে হচ্ছিল অমি আর বাঁচবনাআমিও চলে যাব মায়ের সাথেযার জন্য এই সুন্দর ধরণীতে আসা, তাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব? আমি কিন্তু এখনও বেঁচে আছিকারণ কঠিন বাস্তবতা তো আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে
আমি বেঁচে আছি, জীবন চলছে জীবনের গতিতেকিন্তু আমি তো পারিনি এক মুহুর্তের জন্য আমার মাকে ভুলে থাকতেআমার মা আমার শিরা, উপশিরা, প্রতিটি রক্তকণিকায় মিশে আছেআমি প্রতিটি মুর্হুতে আমার মায়ের শূণ্যতা অনুভব করিকারও কাছ থেকে কোন আদর পেতে আমার ভালো লাগে না, কেবলি মনে হয় ওদের আদর পেয়ে আমি যদি আমার মাকে ভুলে যাইআমি অনাদর অবহেলার মাঝে আমার মাকে মনে রাখতে চাইআমার মা আমার সবআমি আমার মাকে মনে রেখেই বেঁচে থাকতে চাই! সারা দিন কেটে যায় ব্যস্ততার মাঝেদিন গিয়ে রাত আসে, সবাই যখন ঘুমে বিভোর কিন্তু আমি কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারিনামনে পরে মায়ের সেই হাসি ভরা মুখ, মনে পরে মায়ের সব স্মৃতিমনে পরে আমি যে এত বড় হয়েছি তখনও মায়ের গলা জরিয়ে না ধরলে ঘুম আসতনা আমারএক দিনের জন্য কোন আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাইনিকারণ মাকে ছাড়া আমি ঘুমুতে পারব না তাই
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৯ তারিখ, সোমবার আমার মায়ের মৃত্য হয়রমজান ঈদের তিন দিন পরআমার বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকাতে ছিলবোনেরা শ্বশুর বাড়িতে, আর আমার একমাত্র ভাই দেশের বাহিরে থাকেন, ভাবী তাঁর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলবাড়িতে আমি আর আমার মা ছাড়া আর কোন মানুষ ছিল নামা অসুস্থ ছিলেন তবে এমন কোন অসুস্থ ছিলেন না যে এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেআমরা তা কোন দিন ভাবতেও পারিনিরাত তখন ১১ টারাতে খাওয়ার পর আমি আর মা দুজনে শুয়ে আছিসে রাতে কেন যেন আমার ভয় ভয় লাগছিল! মা আর আমি দুজনেই ঘুমিয়ে আছিরাত যখন ১টা বাজে তখন হঠাৎ কি এক দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়আমি জেগে দেখি আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছিকিন্তু মা কেমন যেন করছেআলো জ্বালানো ছিল, আমি উঠে বসে মায়ের মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে মা? এমন করছো কেন? তোমার কেমন লাগছে?’ আমার মা আমাকে কখনও নাম ধরে ডাকতেন না, সব সময় মাবলে ডাকতেনমা আমাকে তখনও সানা দিয়ে বলে যে, আমার কিছু হয়নি মা তুমি ভয় পেওনাআমি কিছু ঝুঝে উঠার আগেই আমার মা চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে চলে গেলআর কোন কথা বলতে পারিনিআমি শুধু কয়েক বার মা মা বলে ডেকেছিলামতারপর আর কিছুই বলতে পারলামনা
পরে দরজা খুলে লোকজন ঘরে ঢুকে দেখে আমি মাকে জরিয়ে ধরে মায়ের বুকের উপর অজ্ঞান হয়ে আছিআমার যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি সকাল হয়ে গেছে সব আত্নীয়-স্বজন এসে গেছে আমাদের বাড়িতে মাকে শেষ বিদায় জানাতেমার চির বিদায়ের আয়োজন করছে সবাইবাবার জন্যও লোক পাঠিয়েছেএত কিছুর পরও আমি মাকে শেষবারের মত গোসল করিয়েছি অন্যদের সাথে থেকেআমার মনে হচ্ছিল মাকে তো আর কোনদিন দেখতে পারবো নাআজ যতকিছু করতে হয় আমি সাথে থেকে করব, যাতে আমার মার কোন অযত্ন না হয়সেদিন আমি আমার মাকে নিজ হাতে সাজিয়েছিলামসে দিনের সেই কথা আমি কোনদিন ভুলে থাকতে পারবো নাআমি আজও ভাবী আমি এত কিছু কি করে পারলামবড় হলাম, বিয়ে হলো, আমি নিজেই মা হয়েছিতারপরও আমি আমার মাকে ভুলতে পারবোনাপ্রায় রাতেই মাকে স্বপ্নে দেখে জেগে উঠিআর তখনি খুব ইচ্ছে করে সেই আগের মত মাকে জড়িয়ে ধরে যদি একটু ঘুমুতে পারতামশান্তির সেই ঘুম !

No comments:

Post a Comment