রাঙা মাটির পথটি লোকালয় ছাড়িয়ে বনপথে আছড়ে পড়েছে। সেই পথে বাঘের ভয়, তাই
চলতে মানা। মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় বাবার সাথে গরুর গাড়িতে চড়ে একবার সেই
পথের সাওয়ারি হয়েছিলাম। তারপর আর কখনো নয়। খুব জানতে ইচ্ছে হয়, কি আছে এই
গ্রামের ওপারে, কোন সেই সম্পদ, কেন ওই পথে যেতে মানা। প্রায়ই ডোরাকাটা একটা
বাঘের স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠি আমি। তবে কি সত্যি আমাকে বাঘে পেল?
গ্রামের লোকেরা আমাকে বিন্নি বলে ডাকে। কিন্তু আমি আমাকে ফাতিমা নামে ডাকি। সবার প্রত্যাশা আমি প্রকৌশলী হব। কিন্তু আমি চাই লেখিকা হতে। পুরোটা পৃথিবীর সাথে লড়বার ক্ষমতা আমার হয়তো নেই, তাই রোজ রোজ প্রকৌশলী হবার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করে আমি বেড়ে উঠছি, বেড়ে উঠছি অন্যের প্রত্যাশার সমস্ত ভার আপন কাঁধে বয়ে বেড়াবার চিরাচরিত এক ধারায় গা ভাসিয়ে। অসহায়ের মতন প্রতিদিন বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছি আমার ফাতিমা হয়ে ওঠার স্বপ্নটুকু। বনের বাঘের হাত থেকে রেহাই পেলেও, বাধা পড়লাম মনের বাঘের থাবায়। কি যে অসহ্য যন্ত্রণা, কি ব্যথাতুর সে অনুভূতি, হৃদয়ের সে কি যে রক্তক্ষরণ তা কিকরে কাউকে দেখাব?
মনে মনে ভাবি, জীবন তো আল্লাহ্র দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তবে কেন তাকে অন্যের ইচ্ছায় বাঁচতে হয়? এসব অনর্থক প্রশ্নের একটা সহজ জবাব নেই কারও কাছে। নিয়ম-কানুনের বিষাদের ছোবলে সৃজনশীলতাও দুর্বল হয়ে পড়েছে আজকাল। লিখতেও পারি না আর। কার জন্য লিখব, সবাই তো ব্যস্ত নিজেদের দৌড়ে প্রথম হবার জন্য। ব্যক্তির চাওয়ার কোন মূল্যই তো আর নাই। আমার লেখিকা হবার লক্ষ্যটি কি খুবই ছোট? ইচ্ছাটির ব্যপারে শোনা মাত্রই প্রত্যেকে নিজের একান্ত কর্তব্যবোধ থেকে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আমি কখনই দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ হতে পারবনা। কিন্তু আমাকে তো পৌঁছতেই হবে আমার গন্তব্ব্যে।
সুতরাং লড়তে হবে আমাকে। ক্ষমতা নয় সত্য, অন্তত সাহসটুকু দিয়ে। আজকাল তাই আমার ভেতরেও একটুকু প্রতিরোধের আভাস পাই। মানুষের গড়ে তোলা সামাজ, সংসার, জাত-রীতির সহস্র বছরের যে ধারা বিন্নির ভেতরের ফাতিমাকে তার আত্মপ্রকাশে বাধা দেয়; সেই নিষেধাজ্ঞার মহাপ্রাচীরের পদতলে অবিরত বয়ে চলছে কি যেন এক স্বাধীন মোহের স্রোতধারা, যার গতি ক্ষুরধার, দুর্বার। সে স্রোত পরাধীনতার সকল বাঁধ ভেঙে আমার সবুজ মনটিকে প্লাবিত করতে চায়। একটিমাত্র বিশ্বাসের ওপরই এখন নিয়তির সকল বিধান ন্যস্ত;- একদিন আমি আমার আমি হব।
আজ বনপথে রাঙা মাটির ওই পথটি আর নাই। সে পথ এখন পিচঢালা। রোজ বিকেলে যখন স্কুল থেকে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরি, ভাবি, বনের বাঘে আমায় আর পেলনা। স্কুলে যাবার পথে দেখি সোনায় মোড়া দিবসের প্রথম প্রহর, দেখি চারিপাশে চিকচিকে রোদের লহর। দেখি বৃক্ষ, দেখি আনাজ; দেখি প্রকৃতির অঙ্গে নববধুর সাজ। নদীর ধারে দেখি ফুটে থাকা কাশফুল, শুনি জলের কলতান; দেখি বালকের হাতে ঘুড়ির নাটাই, শুনি শৈশবের জয়গান। নিজেকে বড় অসহায় লাগে তখন। ভাবি বন্দিত্বের এই পিঞ্জর ভেঙ্গে আমিও একদিন উড়াল দিব। চলন্ত বাসটি থেকে নদীর চিকচিকে জলে লাফিয়ে পড়ব। পতনের পর কতটা আঘাত লাগবে শরীরে তা আর ভাবতে চাই না। শুধু শূন্যে হাতদুটি প্রসারিত করে ডানা মেলে ঘুড়ির মতন বাধা পড়ে নয়, পাখির মতন উড়তে চাই কিছুক্ষণ। শিকারির নিশানা আমি হতেই পারি, কিন্তু হার মানতে চাই না, সকল ঝুঁকি বুক পেতে নিয়েও উড়তে চাই আপন মনে। উড়ালের ওই সময়টুকুই তো কেবল বেঁচে থাকা, বাকিটা বন্দিত্ব।
জানি কখনো আমি দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ হতে পারবনা। কিন্তু আমিতো দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ হতেই চাইনা। আমি হতে চাই আমার আমি, প্রথম ফাতিমা।
গ্রামের লোকেরা আমাকে বিন্নি বলে ডাকে। কিন্তু আমি আমাকে ফাতিমা নামে ডাকি। সবার প্রত্যাশা আমি প্রকৌশলী হব। কিন্তু আমি চাই লেখিকা হতে। পুরোটা পৃথিবীর সাথে লড়বার ক্ষমতা আমার হয়তো নেই, তাই রোজ রোজ প্রকৌশলী হবার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করে আমি বেড়ে উঠছি, বেড়ে উঠছি অন্যের প্রত্যাশার সমস্ত ভার আপন কাঁধে বয়ে বেড়াবার চিরাচরিত এক ধারায় গা ভাসিয়ে। অসহায়ের মতন প্রতিদিন বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছি আমার ফাতিমা হয়ে ওঠার স্বপ্নটুকু। বনের বাঘের হাত থেকে রেহাই পেলেও, বাধা পড়লাম মনের বাঘের থাবায়। কি যে অসহ্য যন্ত্রণা, কি ব্যথাতুর সে অনুভূতি, হৃদয়ের সে কি যে রক্তক্ষরণ তা কিকরে কাউকে দেখাব?
মনে মনে ভাবি, জীবন তো আল্লাহ্র দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তবে কেন তাকে অন্যের ইচ্ছায় বাঁচতে হয়? এসব অনর্থক প্রশ্নের একটা সহজ জবাব নেই কারও কাছে। নিয়ম-কানুনের বিষাদের ছোবলে সৃজনশীলতাও দুর্বল হয়ে পড়েছে আজকাল। লিখতেও পারি না আর। কার জন্য লিখব, সবাই তো ব্যস্ত নিজেদের দৌড়ে প্রথম হবার জন্য। ব্যক্তির চাওয়ার কোন মূল্যই তো আর নাই। আমার লেখিকা হবার লক্ষ্যটি কি খুবই ছোট? ইচ্ছাটির ব্যপারে শোনা মাত্রই প্রত্যেকে নিজের একান্ত কর্তব্যবোধ থেকে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আমি কখনই দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ হতে পারবনা। কিন্তু আমাকে তো পৌঁছতেই হবে আমার গন্তব্ব্যে।
সুতরাং লড়তে হবে আমাকে। ক্ষমতা নয় সত্য, অন্তত সাহসটুকু দিয়ে। আজকাল তাই আমার ভেতরেও একটুকু প্রতিরোধের আভাস পাই। মানুষের গড়ে তোলা সামাজ, সংসার, জাত-রীতির সহস্র বছরের যে ধারা বিন্নির ভেতরের ফাতিমাকে তার আত্মপ্রকাশে বাধা দেয়; সেই নিষেধাজ্ঞার মহাপ্রাচীরের পদতলে অবিরত বয়ে চলছে কি যেন এক স্বাধীন মোহের স্রোতধারা, যার গতি ক্ষুরধার, দুর্বার। সে স্রোত পরাধীনতার সকল বাঁধ ভেঙে আমার সবুজ মনটিকে প্লাবিত করতে চায়। একটিমাত্র বিশ্বাসের ওপরই এখন নিয়তির সকল বিধান ন্যস্ত;- একদিন আমি আমার আমি হব।
আজ বনপথে রাঙা মাটির ওই পথটি আর নাই। সে পথ এখন পিচঢালা। রোজ বিকেলে যখন স্কুল থেকে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরি, ভাবি, বনের বাঘে আমায় আর পেলনা। স্কুলে যাবার পথে দেখি সোনায় মোড়া দিবসের প্রথম প্রহর, দেখি চারিপাশে চিকচিকে রোদের লহর। দেখি বৃক্ষ, দেখি আনাজ; দেখি প্রকৃতির অঙ্গে নববধুর সাজ। নদীর ধারে দেখি ফুটে থাকা কাশফুল, শুনি জলের কলতান; দেখি বালকের হাতে ঘুড়ির নাটাই, শুনি শৈশবের জয়গান। নিজেকে বড় অসহায় লাগে তখন। ভাবি বন্দিত্বের এই পিঞ্জর ভেঙ্গে আমিও একদিন উড়াল দিব। চলন্ত বাসটি থেকে নদীর চিকচিকে জলে লাফিয়ে পড়ব। পতনের পর কতটা আঘাত লাগবে শরীরে তা আর ভাবতে চাই না। শুধু শূন্যে হাতদুটি প্রসারিত করে ডানা মেলে ঘুড়ির মতন বাধা পড়ে নয়, পাখির মতন উড়তে চাই কিছুক্ষণ। শিকারির নিশানা আমি হতেই পারি, কিন্তু হার মানতে চাই না, সকল ঝুঁকি বুক পেতে নিয়েও উড়তে চাই আপন মনে। উড়ালের ওই সময়টুকুই তো কেবল বেঁচে থাকা, বাকিটা বন্দিত্ব।
জানি কখনো আমি দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ হতে পারবনা। কিন্তু আমিতো দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ হতেই চাইনা। আমি হতে চাই আমার আমি, প্রথম ফাতিমা।
No comments:
Post a Comment