-এক-
সহজাত প্রকৃতি ও জ্ঞান
মানুষের জীবন যাত্রার শুরু থেকেই সে বিজ্ঞানী। তার জীবনের মানকে উন্নত করতে, বেঁচে থাকার তাগিদে, সে তার চিন্তা ও কর্মের যে উৎকর্ষ সাধন করেছে তা’ই বিজ্ঞানের অংশ হয়ে আছে। সে আবার কখনো ভুল করেছে, পরে বুঝতে পেরেছে, তারপর শুধরিয়ে নিয়েছে।
যন্ত্রের ব্যবহার তার প্রথম থেকেই। সে অনুসন্ধিৎসু প্রাণী। সে চর্মচক্ষে আকাশ-রাজ্য দেখেছে এবং এক প্রকার জ্ঞান লাভ করেছে; তারপর যন্ত্র ব্যবহার করেছে এবং যান্ত্রিক দেখার জ্ঞান লাভ করেছে। এভাবে চর্মচক্ষে পদার্থের মৌলিক জ্ঞান লাভ করেছে, তারপর যান্ত্রিকভাবে পদার্থের ক্ষুদ্রাংশের জ্ঞান লাভ করেছে। তার বিভিন্ন নতুন যন্ত্র তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত এবং প্রকৃতির ভিন্ন প্রেক্ষিত বুঝার সুযোগ দিয়েছে। এই ধারাতেই তার জ্ঞানের অগ্রগতি ছুটে চলেছে। কিন্তু তার জীবনের সমস্যা ও সমাধান কখনো একান্ত এই বস্তুকেন্দ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিবদ্ধ নয়। অধিকন্তু বস্তুকেন্দ্রিকতা তাকে বার বার বস্তুর জিঞ্জিরেই আবদ্ধ করেছে আর সে বার বার মুক্ত হতে চেয়েছে –এই হচ্ছে তার অনন্তর সংগ্রামের মৌলিক ইতিহাস।
সে বুঝতে সক্ষম হয়েছে, তার চিন্তা চরিত্রে যেমন ভাল দিক আছে তেমনি আছে স্বার্থকেন্দ্রিকতা, হিংস্রতা ও লোভপ্রবণতা, তারপর বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, বিত্তের প্রতি মত্ততা। এগুলোর মধ্যেই সে কালে কালে নিজেই বন্দী হয়েছে এবং এগুলোর সূত্র ধরেই তার এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করেছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা শুধু ভূ-সম্পত্তি দখল করেনি বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কব্জা করেছে। এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব দখল করে নিজেরদের জন্য ‘শিক্ষার’ মাধ্যমে অপর শ্রেণীকে প্রশিক্ষিত দাস-শ্রেণী হিসেবে গড়েছে, যেমন জন্তু জানোয়ারকে নিজেদের স্বার্থে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে সে এক সময় এইসব চক্রান্ত বুঝতে পেরেছে কিন্তু বুঝ-সমঝই যে সবকিছু নয় –এটাও বুঝেছে। প্রভু-শ্রেণীও বুঝেছে ওরা বুঝলেও কাজ হবে না –জিঞ্জির ছিন্ন করতে পারবে না।
মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরেক স্বরূপ লক্ষ্য করেছে। আর তা হল এটাকে যেমন ভাল, তেমনি মন্দ কাজের সাথে জড়িয়ে ব্যবহার করা যায়। সে লক্ষ্য করেছে যে, যে শ্রেণী প্রভু হয়ে বসে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিজেদের উন্নয়ন, ক্ষমতা বৃদ্ধি, নিজ শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই কাজে আমলা-বাহিনী (bureaucrats/staff) গড়ে, অবস্থান সুদৃঢ় করে। মন্দ লোকের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান মন্দের চরম বিস্তৃতি ঘটায়।
শিক্ষা-লাভ, জ্ঞান-লাভ –এসব কথা মূল্যবোধ (value led) তাড়িত। কার শিক্ষা, কার স্বার্থে? ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ কাউকে এমনিতেই ভাল হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ‘ভাল’ শব্দটিও মূল্যবোধ তাড়িত। কার দৃষ্টিতে, কোন সমঝের আলোকে ভাল? মানুষ তো জেনে-বুঝেও তার নিজ স্বার্থে মন্দ কাজ করতে পারে। যে ডাকাতি করে সে জানে ডাকাতি অন্যায়। যে ঠকিয়ে ব্যবসা করে সেও জানে কাজটি মন্দ। কিন্তু স্বার্থাগ্রহ তাকে মন্দের দিকে আগ্রহান্বিত করে। আবার, মন্দ কাজ করার পরও মানুষ মন্দের পক্ষে নানান যুক্তি খোঁজে পায়, তার ভাষিক ও সৃষ্টিশৈলী শক্তি তাকে একাজে সহায়তা করে। সুতরাং একান্ত ‘জানার’ কারণে, বা জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করলেই ‘ভাল মানুষ’ হওয়ার ধারণা ভুল। হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা চিন্তা করুন। এই বোমাগুলো কে তৈরি করেছিল? কারা এগুলোর ‘জ্ঞান’ দিয়েছিল, কারা এই বিধ্বংসী কাজের নির্দেশ দিয়েছিল, কারা এগুলো বাহন-ভর্তি করেছিল, কারা এগুলো নিক্ষেপ করেছিল –এই বিষয়গুলো চিন্তা করুন। যুদ্ধগুলোর শুরু, শুরুপূর্ব রাজনীতি, দুর্নীতি, সমাজের আভ্যন্তরীণ শ্রেণীবিন্যাস, আত্মকলহ, আধিপত্যবাদের আদর্শগত অমানবিকতা, এবং অপর সমাজ ও মানবতাকে পাশবিকতায় দেখার যুগান্তরব্যাপী স্তূপীকৃত ধারণা –এসব কথা খেয়ালে রাখুন।
মন্দ ধারার শিক্ষা
আজকের, এবং অতীতের, জল, স্থল ও বায়ু দূষণের কথা চিন্তা করুন; অতীতের যুদ্ধে ব্যবহৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় ও উপকরণের কথা চিন্তা করুন; মানব চরিত্রের সার্বিক দিকগুলোর কথা চিন্তা করুন। জ্ঞান-বিজ্ঞান সবদিনই ছিল। ক্রমান্বয়েই আমরা আজকের এই স্থানে এসেছি। আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানব চরিত্রের মন্দের পরিব্যাপ্তি, প্রসারণ ও পরিণতি কতটুকু হয়েছে এবং এখন তা কোন গতিতে এবং কোন ধারায় ছুটে চলেছে -এই বিষয়টির উপরও মনোনিবেশ করা হোক। আজকের অস্ত্র ইন্ডাস্ট্রির ৮৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার কথাও মনে রাখা যাক -ক্ষমতার রাজনীতির পরিমণ্ডলকেও। ‘শিক্ষা’ মানুষকে যদি মানুষ করে ফেলত তবে বন্দুকের (দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলছি) নলগুলো কেন এক ‘শিক্ষিত’ জাতি অপর ‘শিক্ষিত’ জাতির প্রতি নিশানা করে রাখছে? কেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমাগুলো সাজিয়ে রেখেছে? “অশিক্ষিত” লোকগুলো কী কারো হুমকি হওয়ার কারণে এসব হচ্ছে? আজ পর্যন্ত এই শিক্ষা ব্যবস্থা কার স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে –কোন শ্রেণী এগুলো করায়ত্ত করে কোন শ্রেণীকে বিভ্রান্ত করছে? আপনার পোষা ময়নাটি যখন গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সভ্যতা ইত্যাদি শব্দ আওড়াবে, তখন কী বুঝতে হবে? বুঝতে হবে ময়নাটির উপর প্রশিক্ষণ কার্যকর হয়েছে।
এই বিশ্বে যে লুটপাট হচ্ছে সেটার দিকে একটু মনোনিবেশ করুন। এই লুট, ঠকবাজি, এই আধিপত্যের কথা ব্যক্তি থেকে একটু আলাদা করে সামষ্টিক ও আদর্শিকভাবে দেখুন। ব্যক্তির কুযুক্তি কীভাবে সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহ করে, এর পক্ষে কীভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারা যায়, সেই বিষয়টি অনুধাবন করুন। অতঃপর ভাষাকে কীভাবে সৃষ্টিশৈলী রূপ দিয়ে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, মন্দকে ভাল দেখানো যায় –সেটাও দেখুন। এর সবই শিক্ষার অংশ হয়ে আছে। এসবের অনেক কিছু শিক্ষার থিওরিতেও রূপায়িত হয়েছে। যারা শিক্ষা-দর্শনের সাথে পরিচিত তাদের অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন যে এই শিক্ষাব্যবস্থা বস্তুমোহী আধিপত্যচক্রের বৈশ্বিক বিস্তারবাহী মানসিকতা সৃষ্টি করছে। গোলামীকে স্বাধীনতা ভাবার হেয়ালী মানসিকতা তৈরি করছে। স্বার্থ ও লোভের ‘গুণ’ কীর্তনের (celebration) সয়লাব বৃদ্ধি করছে। আজ এই শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হয়েছে যে এক ব্যক্তি কেবল একজন চাকর হওয়ার জন্য ২০/২৫ বছর পড়াশুনা করতে হয়। অতঃপর আরও ২০ বছর চাকুরী করার যখন ‘প্যাচ’ সমঝে আসে, তখন আর ফিরার পথ নেই। ফিরার চিন্তাই বেকারত্বের চরম ভীতি! এই হচ্ছে শিক্ষা। হায় আক্ষেপ। আমরা এখানে।
-দুই-
Privileged শিক্ষা ও হারানো শিক্ষা
এক কালে শিক্ষার ধারণাটি দুটি ধারায় বহমান ছিল। একটি ছিল বাদশাহের হিসেব রক্ষক হওয়া। তার সোনা-দানার অংক কষা। তার কোন্ গোলাম কত পেল আর কত বাকী থাকল –সেই হিসেব লেখা, আর তার চৌদ্দগোষ্ঠীর ইতিহাস রচনা করা, (History মানি His-story, রাজকীয় কাহিনী)। মন্দকেও গৌরবের রঙ চড়িয়ে কীর্তন (glorify) করা, মিথ্যার স্তম্ভ গড়ে অথবা দেয়াল নির্মাণ করে তার রক্তে রাঙানো বাহাদুরির (!) দুটি কথা এঁকে দেয়া। কিন্তু বাদশাহের সংস্পর্শে এসে এই লেখকও, এই হিসেবকারীও তার নিজ সমাজে মর্যাদাবান হয়েছে; সে বাদশাহের চাকর হয়েও আপন সমাজে ক্ষমতা ও দাপটের স্থান পেয়েছে। সে যখন বাড়ি ফিরেছে, তখন তার মা, বাকি ছেলেদেরকে একপাশে রেখে, (যারা তাকে মাছ ধরে খাওয়াত, জমি চষে সংসার চালাত –এই জগতের ‘জ্ঞান’ ছিল বলেই), মুরগী জবাই করে খাইয়েছে, কেননা, “শিক্ষিত” ছেলে ঘরে এসেছে। এভাবে সমাজ নূতনত্বের (of novelty) মোহে এক “শিক্ষাকে” (যেমন আবাস-জ্ঞান (knowledge of the habitat, চাষবাস ইত্যাদি) অপর “শিক্ষার” উপর অগ্রাধিকার দিয়ে বসেছে। একটিকে “শিক্ষা” বলেছে আর হেয়ালীভাবে অপরটিকে “অশিক্ষা” বলে মেনে নিয়েছে!
আজ দুঃখজনকভাবে সত্য যে আবহমানকালের বেঁচে থাকার জ্ঞানকে ধ্বংস করে, যা স্বনির্ভরশীলতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, সবকিছু প্রায় ইন্ডাস্ট্রিয়েলাইজ হয়ে গিয়েছে। ব্যক্তি ও পরিবার শিক্ষিত হয়ে তার বংশ পরম্পরায় অর্জিত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরিচিত (alienate) হচ্ছে এবং সবকিছু আরেক শ্রেণীর হাতে দিয়ে তারা ওদের চাকর-বাকর হচ্ছে।
আক্ষরিক শিক্ষার ধারাকে প্রাধান্য দিয়ে (by orienting it on a privileged position), অনেক প্রাচীন স্বনির্ভরশীল জীবন ধারা ধ্বংস করে, আজ স্বেচ্ছায় পরনির্ভরশীল জীবনকে বরণ করা হয়ে গিয়েছে। তা একদিনে নয় বরং ধনতান্ত্রিকতার কব্জায় ধীরে ধীরে, ড্রাকুলারের কুকুর দাঁত (canine teeth) গজাতে শতাব্দীর ধারাবাহিকতা এসেছে। আজকের অনেক বুদ্ধিজীবী ধনতন্ত্র ও বস্তুবাদের দালাল, অনেক আবার ঘিলুহীনও। দেখতে দেখতে এই বিশ্বটি, হেয়ালীভাবে, আবার ফিরাউনের শিক্ষায়, ফিরাউনের গোলামীতে আত্মাহুতি দিল!
কীভাবে কী হল?
চিন্তা করুন, বাদশাহর চাকর হয়েও যে লোকটি দাপটের স্থান পেয়েছিল, তার মূলে কী ছিল? সেটা ছিল এই আক্ষরিক শিক্ষা। বাদশাহ এই শিক্ষিত গোলামদের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য টিকিয়েছে। সেনানী শিক্ষার কথাও মনে রাখতে হবে। অতঃপর, কালান্তরে, বাদশাহের যাবতীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় গোলামগণ দাখিল হয়ে সেই ব্যবস্থাকেই প্রসার করেছে। বাদশাহের অর্থায়নে এই শিক্ষার দরজা দিয়ে পতঙ্গপাল প্রবেশ করে গোলামীর শিক্ষাকে প্রথাগত রূপ দিয়েছে। তা’ই আজ মহীরূপে বিরাজিত। (কিছু কথা এখানে সাধারণী (generalised) মাত্রায় বলছি, কেননা নানান ব্যতিক্রমের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এখানে সম্ভব নয় –এটি সেই মেজাজের লেখা নয়)। আবার চিন্তা করুন, আজ এক ব্যক্তির ২০ বছরের পড়াশুনার পর, তার শেষ অবস্থানটি কী হয় (what end product does s/he become) -স্বনির্ভরশীল, না পরনির্ভরশীল? বাস্তবতা হচ্ছে এই যে এই শিক্ষা একজনকে আমলা বানায়, অথবা প্রাইভেট সেক্টরে চাকর বানায়, অথবা সুদ-বন্দী ব্যবসায় দাখিল হয়, এবং ভাগ্য ভাল হলে এক সময় প্রভু শ্রেণীতে একাত্ম হয়ে প্রভু শ্রেণীর সাজানো খেলায় অংশ নেয়। আজকের মানবতা এই স্থানে উপনীত হয়েছে।
-তিন-
এক সময় যখন সংঘবদ্ধ (organised) সমাজ ব্যবস্থা ছিল না তখন প্রকৃতিতে মানুষ স্বাধীন ছিল। তখন সে স্বনির্ভরশীল ধারায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা রপ্ত করছিল। কিন্তু কিছু দুষ্ট মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হয়ে জোরপূর্বক অপরের অর্জন ছিনিয়ে নেবার বাস্তবতা দেখিয়েছে, তখন তারা গোত্রপতি, সমাজপতি, এবং পরে, বাদশাহের অধীনে নিজেরাই সংঘবদ্ধ (organised) হতে হয়েছে, নিজেদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে অন্যভাবে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু বাদশাহের কাঠামোগত আমলাতন্ত্রে (structural bureaucracy) যারাই ঢুকেছে তারাই পরবর্তীতে মানুষকে পরাধীন করেছে, মানুষের প্রভু হয়ে বসেছে এবং কালান্তরে এটাকেই “শিক্ষার” রূপ-ধারায় সাজিয়ে নিয়েছে। বিবর্তনের ধারা বেয়ে আজ আমরা এই শিক্ষা ব্যবস্থায় উপনীত হয়েছি।
বন্ধুগণ, এক প্রেক্ষিতে আমরা পরাধীন! আরেক প্রেক্ষিতে আমরা ৮/১০ হাজার বছরের পূর্বের অবস্থান থেকে মন্দ অবস্থানে। ‘We now live in a nation where doctors destroy health, lawyers destroy justice, universities destroy knowledge, governments destroy freedom, the press destroys information, the religion destroys morals, and our banks destroy the economy’ –Chris Hedges [link], (ক্রিস হেজেজ এখানে ধর্মকে একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে এনেছেন, যা সহজেই বোধগম্য। ক্রিস হেজেজের আরও কিছু বক্তব্য এই ভিডিওর সূত্র ধরে দেখা যেতে পারে)।
আজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান বলে চিৎকার করে লাভ নেই। বিশ্বায়নের মাধ্যমে প্রতিটি দেশ ও সমাজ কাদের হা-করা মুখের দিকে ছুটে চলেছে এবং এত্থেকে তাদের মুক্তি পথ কোথায় –তা নিয়ে চিন্তা করা দরকার।
আজকের শিক্ষাঙ্গনে অনেক কিছু শিক্ষণীয় হয়ে আছে যার প্রভাব ও সংশ্লেষ (implication) অনেককে চিন্তিত করে কিন্তু তাদের করার কিছু নেই। বিপক্ষে দাঁড়াতে গেলে চাকুরীর উপায় থাকে না, কেননা যে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের রুটি-রুজি, তার বাইরে তারা অসহায় -দাঁড়াবার স্থান নেই। সুতরাং এই জিঞ্জির থেকে মুক্তি আসবে কীভাবে? মুক্তির পথ যেন রুদ্ধ। এই গোলামীর জিঞ্জির মনস্তত্ত্বের অতল তলে ঢুকে গিয়েছে। এখান থেকে মুক্তির আশা যেন নিরর্থক, বৃথা! তবে থামুন! নিরাশ হলে চলবে না।
স্টোয়িক (stoic) দর্শনে শান্তির পথ হচ্ছে আপনি যেখানে যেভাবে আছেন, সেই অবস্থান গ্রহণ করে নেবেন, এটাকে মেনে নিয়েই শান্ত হয়ে যাবেন –অবস্থা জুলুমের হোক অথবা গোলামীর। যদিও একটি পরতে এখানে ইসলামের সামান্য ছোঁয়া রয়েছে কিন্তু মূলত তা ইসলামী নয়। মানুষ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না, জুলুম সহ্য করা যেতে পারে না। এখানে নিরাশার স্থান নেই। একটি স্ফুলিঙ্গও বিপুল অগ্নিকুণ্ডের সম্ভাবনাময়ী। এখানে বিশ্বাসী অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েও বিজয়ের আশায় থাকে উদ্দীপ্ত। “‘হে মানুষ, বল, ‘লা ইলাহা ইল্লালল্লাহ, তুফলিহু –বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে’” (হাদিস)। মুসা (আ.) ফিরাউনের জিঞ্জির ছিন্ন করেছিলেন। নবী মুহাম্মাদ (সা) বস্তুতান্ত্রিকতা, ইয়াদী সুদীর জিঞ্জির, তাদের অস্ত্র-বাণিজ্যের জিঞ্জির [১], যুগান্তরের আরব গোত্রীয় রক্তারক্তির অটুট ও অপ্রতিরুদ্ধ হানাহানির জিঞ্জির -যার সংযুক্তিতে ছিল গোত্রীয় কবিদের আবেগ উস্কানো ইন্দন, ব্যঙ্গ কবিতার হীন-জিঘাংসার উত্তেজনা, এসব থেকে মানবতাকে মুক্ত করেছিলেন। কে বলে অসম্ভব? কাল –সে এক বিপুল সম্ভাবনার চলন্ত ধারা। পরিবর্তন এখানে হয়ই হয়। এখানে কিছুই স্থির নয়। ঐ সুদূরের সীমারেখায় যে সুউঁচু পাহাড়, সেও ক্ষয়িষ্ণু। আর পরমাণুতেও রয়েছে চঞ্চল গতি। এই অম্বর, সে সীমাহীন –তেমনই চিন্তার দিগন্ত।
-চার-
মুক্তির সূচনা কোথা থেকে হবে?
মুক্তির সূচনা সেখান থেকেই হতে হবে যেখান থেকে বস্তুমোহে, লোভে ও ক্ষমতাগ্রহে মানুষ তার মানবতা হারিয়েছে। বিত্তের সীমা বৃদ্ধির জন্য যে মোহ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল, সেটিই ছিল তার কালো-নাগ। তার সামনে যারাই বাধা হয়েছিল সে তাদের কবর রচনা করে তবেই তার যাত্রাপথ সুগম করেছিল। জোর-জুলুম নির্যাতন সবই ছিল তার কাছে নৈতিক ও যৌক্তিক। সে দেখেছিল আইন ও পুলিশ তাকে আটকাতে পারে নি। তার সৃষ্টিশৈলী গুণ পুলিশসহ সকলের কৌশল কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল, স্থানভেদে তার শিক্ষা তাকে আরও ধূর্ত করেছিল। সে কৌশলে অন্যের সাথে সংঘবদ্ধও (corporative) হয়ে তার অন্তঃস্থিত কালো-নাগিনীর খোরাক বৃদ্ধি করেছিল। যে ধারণাস্থলে তার অস্তিত্বের প্রকৃতি, আজ সেখান থেকেই মুক্তি খোঁজতে হবে। তার এই খুদিকে (নফসকে) আটকানোর পথ একটিই, যদি পুলিশকে তার মনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, যদি মোহগ্রস্ততার প্রতিকূলে অন্তর্দৃষ্টি স্থাপন করা যায়। ব্যক্তি ও সামাজিক মুক্তির মূল হচ্ছে বিশ্বাস –আল্লাহতে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস। তার কলবে এই ধারণা উপনীত হতে হবে যে সে মরণশীল। অঢেল বিত্ত গড়লেও তাকে মরতে হবে। এই সত্য তার হৃদয়ের গহীন রন্ধ্র স্পর্শ করে আসতে হবে। তবেই মুক্তি, না হলে নেই।
মানুষ বাদশাহর অধীনে সংগঠিত সামাজিক ব্যবস্থা গড়েও নিরাপত্তা লাভ করে নি। বাদশাহর অন্তর্নিহিত ‘রোগ’ তাকে ক্ষমতা লোভী ও ক্ষমতা হারানোর ভীতিতে সচঞ্চল করে করেছিল। ফলশ্রুতিতে, ও কালের ধারায়, সে ও তার আমলারা মিলে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে, মানুষকে তাদের প্রতিভূ বানিয়েছে -ভাল যুক্তি দেখিয়ে, শব্দের খই ফুটিয়েছে, কিতাব রচনা করেছে, শিক্ষা-প্রশিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেশ ও সমাজ যাদের পদপ্রান্তে নিষ্পেষিত হচ্ছে তাদের মিথ্যাচার আর অপশাসনের স্বরূপ এমনই নগ্ন ও রাক্ষসী হয়েছে যে তা দেখলে অনেক ক্লাসিক্যাল বাদশাহও হয়ত বিস্মিত হবে।
আমি এখানে মূলত ধর্মের বিস্তৃত রূপ আলোচনা করছি না। শুধু বিশ্বাসের একটি মৌলিক স্থানে ব্যক্তির নিজ ও সামাজিক অস্তিত্বের বিষয়টি দেখাচ্ছি। এই মরণশীলতার চিন্তা, এর দর্শন ও বিত্তের ঊর্ধ্বের জীবন ও চিন্তার দিগন্তের কথা বলছি। এখানেই হচ্ছে “শিক্ষার” অপর দিক। এই শিক্ষা হারিয়ে মানুষ আজ বস্তুর মোহনীয় জিঞ্জিরে আবদ্ধ। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামও নিস্তব্ধ হয়ে যায় নি। কালের ধারা বেয়ে সেই অনন্ত সংগ্রাম এখনো চলমান. মুক্তি আত্ম-সংযমেই নিহিত, এই শিক্ষায়, এই সাধনায়।
সহজাত প্রকৃতি ও জ্ঞান
মানুষের জীবন যাত্রার শুরু থেকেই সে বিজ্ঞানী। তার জীবনের মানকে উন্নত করতে, বেঁচে থাকার তাগিদে, সে তার চিন্তা ও কর্মের যে উৎকর্ষ সাধন করেছে তা’ই বিজ্ঞানের অংশ হয়ে আছে। সে আবার কখনো ভুল করেছে, পরে বুঝতে পেরেছে, তারপর শুধরিয়ে নিয়েছে।
যন্ত্রের ব্যবহার তার প্রথম থেকেই। সে অনুসন্ধিৎসু প্রাণী। সে চর্মচক্ষে আকাশ-রাজ্য দেখেছে এবং এক প্রকার জ্ঞান লাভ করেছে; তারপর যন্ত্র ব্যবহার করেছে এবং যান্ত্রিক দেখার জ্ঞান লাভ করেছে। এভাবে চর্মচক্ষে পদার্থের মৌলিক জ্ঞান লাভ করেছে, তারপর যান্ত্রিকভাবে পদার্থের ক্ষুদ্রাংশের জ্ঞান লাভ করেছে। তার বিভিন্ন নতুন যন্ত্র তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত এবং প্রকৃতির ভিন্ন প্রেক্ষিত বুঝার সুযোগ দিয়েছে। এই ধারাতেই তার জ্ঞানের অগ্রগতি ছুটে চলেছে। কিন্তু তার জীবনের সমস্যা ও সমাধান কখনো একান্ত এই বস্তুকেন্দ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিবদ্ধ নয়। অধিকন্তু বস্তুকেন্দ্রিকতা তাকে বার বার বস্তুর জিঞ্জিরেই আবদ্ধ করেছে আর সে বার বার মুক্ত হতে চেয়েছে –এই হচ্ছে তার অনন্তর সংগ্রামের মৌলিক ইতিহাস।
সে বুঝতে সক্ষম হয়েছে, তার চিন্তা চরিত্রে যেমন ভাল দিক আছে তেমনি আছে স্বার্থকেন্দ্রিকতা, হিংস্রতা ও লোভপ্রবণতা, তারপর বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, বিত্তের প্রতি মত্ততা। এগুলোর মধ্যেই সে কালে কালে নিজেই বন্দী হয়েছে এবং এগুলোর সূত্র ধরেই তার এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করেছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা শুধু ভূ-সম্পত্তি দখল করেনি বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কব্জা করেছে। এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব দখল করে নিজেরদের জন্য ‘শিক্ষার’ মাধ্যমে অপর শ্রেণীকে প্রশিক্ষিত দাস-শ্রেণী হিসেবে গড়েছে, যেমন জন্তু জানোয়ারকে নিজেদের স্বার্থে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে সে এক সময় এইসব চক্রান্ত বুঝতে পেরেছে কিন্তু বুঝ-সমঝই যে সবকিছু নয় –এটাও বুঝেছে। প্রভু-শ্রেণীও বুঝেছে ওরা বুঝলেও কাজ হবে না –জিঞ্জির ছিন্ন করতে পারবে না।
মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরেক স্বরূপ লক্ষ্য করেছে। আর তা হল এটাকে যেমন ভাল, তেমনি মন্দ কাজের সাথে জড়িয়ে ব্যবহার করা যায়। সে লক্ষ্য করেছে যে, যে শ্রেণী প্রভু হয়ে বসে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিজেদের উন্নয়ন, ক্ষমতা বৃদ্ধি, নিজ শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই কাজে আমলা-বাহিনী (bureaucrats/staff) গড়ে, অবস্থান সুদৃঢ় করে। মন্দ লোকের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান মন্দের চরম বিস্তৃতি ঘটায়।
শিক্ষা-লাভ, জ্ঞান-লাভ –এসব কথা মূল্যবোধ (value led) তাড়িত। কার শিক্ষা, কার স্বার্থে? ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ কাউকে এমনিতেই ভাল হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ‘ভাল’ শব্দটিও মূল্যবোধ তাড়িত। কার দৃষ্টিতে, কোন সমঝের আলোকে ভাল? মানুষ তো জেনে-বুঝেও তার নিজ স্বার্থে মন্দ কাজ করতে পারে। যে ডাকাতি করে সে জানে ডাকাতি অন্যায়। যে ঠকিয়ে ব্যবসা করে সেও জানে কাজটি মন্দ। কিন্তু স্বার্থাগ্রহ তাকে মন্দের দিকে আগ্রহান্বিত করে। আবার, মন্দ কাজ করার পরও মানুষ মন্দের পক্ষে নানান যুক্তি খোঁজে পায়, তার ভাষিক ও সৃষ্টিশৈলী শক্তি তাকে একাজে সহায়তা করে। সুতরাং একান্ত ‘জানার’ কারণে, বা জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করলেই ‘ভাল মানুষ’ হওয়ার ধারণা ভুল। হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা চিন্তা করুন। এই বোমাগুলো কে তৈরি করেছিল? কারা এগুলোর ‘জ্ঞান’ দিয়েছিল, কারা এই বিধ্বংসী কাজের নির্দেশ দিয়েছিল, কারা এগুলো বাহন-ভর্তি করেছিল, কারা এগুলো নিক্ষেপ করেছিল –এই বিষয়গুলো চিন্তা করুন। যুদ্ধগুলোর শুরু, শুরুপূর্ব রাজনীতি, দুর্নীতি, সমাজের আভ্যন্তরীণ শ্রেণীবিন্যাস, আত্মকলহ, আধিপত্যবাদের আদর্শগত অমানবিকতা, এবং অপর সমাজ ও মানবতাকে পাশবিকতায় দেখার যুগান্তরব্যাপী স্তূপীকৃত ধারণা –এসব কথা খেয়ালে রাখুন।
মন্দ ধারার শিক্ষা
আজকের, এবং অতীতের, জল, স্থল ও বায়ু দূষণের কথা চিন্তা করুন; অতীতের যুদ্ধে ব্যবহৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় ও উপকরণের কথা চিন্তা করুন; মানব চরিত্রের সার্বিক দিকগুলোর কথা চিন্তা করুন। জ্ঞান-বিজ্ঞান সবদিনই ছিল। ক্রমান্বয়েই আমরা আজকের এই স্থানে এসেছি। আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানব চরিত্রের মন্দের পরিব্যাপ্তি, প্রসারণ ও পরিণতি কতটুকু হয়েছে এবং এখন তা কোন গতিতে এবং কোন ধারায় ছুটে চলেছে -এই বিষয়টির উপরও মনোনিবেশ করা হোক। আজকের অস্ত্র ইন্ডাস্ট্রির ৮৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার কথাও মনে রাখা যাক -ক্ষমতার রাজনীতির পরিমণ্ডলকেও। ‘শিক্ষা’ মানুষকে যদি মানুষ করে ফেলত তবে বন্দুকের (দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলছি) নলগুলো কেন এক ‘শিক্ষিত’ জাতি অপর ‘শিক্ষিত’ জাতির প্রতি নিশানা করে রাখছে? কেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমাগুলো সাজিয়ে রেখেছে? “অশিক্ষিত” লোকগুলো কী কারো হুমকি হওয়ার কারণে এসব হচ্ছে? আজ পর্যন্ত এই শিক্ষা ব্যবস্থা কার স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে –কোন শ্রেণী এগুলো করায়ত্ত করে কোন শ্রেণীকে বিভ্রান্ত করছে? আপনার পোষা ময়নাটি যখন গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সভ্যতা ইত্যাদি শব্দ আওড়াবে, তখন কী বুঝতে হবে? বুঝতে হবে ময়নাটির উপর প্রশিক্ষণ কার্যকর হয়েছে।
এই বিশ্বে যে লুটপাট হচ্ছে সেটার দিকে একটু মনোনিবেশ করুন। এই লুট, ঠকবাজি, এই আধিপত্যের কথা ব্যক্তি থেকে একটু আলাদা করে সামষ্টিক ও আদর্শিকভাবে দেখুন। ব্যক্তির কুযুক্তি কীভাবে সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহ করে, এর পক্ষে কীভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারা যায়, সেই বিষয়টি অনুধাবন করুন। অতঃপর ভাষাকে কীভাবে সৃষ্টিশৈলী রূপ দিয়ে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, মন্দকে ভাল দেখানো যায় –সেটাও দেখুন। এর সবই শিক্ষার অংশ হয়ে আছে। এসবের অনেক কিছু শিক্ষার থিওরিতেও রূপায়িত হয়েছে। যারা শিক্ষা-দর্শনের সাথে পরিচিত তাদের অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন যে এই শিক্ষাব্যবস্থা বস্তুমোহী আধিপত্যচক্রের বৈশ্বিক বিস্তারবাহী মানসিকতা সৃষ্টি করছে। গোলামীকে স্বাধীনতা ভাবার হেয়ালী মানসিকতা তৈরি করছে। স্বার্থ ও লোভের ‘গুণ’ কীর্তনের (celebration) সয়লাব বৃদ্ধি করছে। আজ এই শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হয়েছে যে এক ব্যক্তি কেবল একজন চাকর হওয়ার জন্য ২০/২৫ বছর পড়াশুনা করতে হয়। অতঃপর আরও ২০ বছর চাকুরী করার যখন ‘প্যাচ’ সমঝে আসে, তখন আর ফিরার পথ নেই। ফিরার চিন্তাই বেকারত্বের চরম ভীতি! এই হচ্ছে শিক্ষা। হায় আক্ষেপ। আমরা এখানে।
-দুই-
Privileged শিক্ষা ও হারানো শিক্ষা
এক কালে শিক্ষার ধারণাটি দুটি ধারায় বহমান ছিল। একটি ছিল বাদশাহের হিসেব রক্ষক হওয়া। তার সোনা-দানার অংক কষা। তার কোন্ গোলাম কত পেল আর কত বাকী থাকল –সেই হিসেব লেখা, আর তার চৌদ্দগোষ্ঠীর ইতিহাস রচনা করা, (History মানি His-story, রাজকীয় কাহিনী)। মন্দকেও গৌরবের রঙ চড়িয়ে কীর্তন (glorify) করা, মিথ্যার স্তম্ভ গড়ে অথবা দেয়াল নির্মাণ করে তার রক্তে রাঙানো বাহাদুরির (!) দুটি কথা এঁকে দেয়া। কিন্তু বাদশাহের সংস্পর্শে এসে এই লেখকও, এই হিসেবকারীও তার নিজ সমাজে মর্যাদাবান হয়েছে; সে বাদশাহের চাকর হয়েও আপন সমাজে ক্ষমতা ও দাপটের স্থান পেয়েছে। সে যখন বাড়ি ফিরেছে, তখন তার মা, বাকি ছেলেদেরকে একপাশে রেখে, (যারা তাকে মাছ ধরে খাওয়াত, জমি চষে সংসার চালাত –এই জগতের ‘জ্ঞান’ ছিল বলেই), মুরগী জবাই করে খাইয়েছে, কেননা, “শিক্ষিত” ছেলে ঘরে এসেছে। এভাবে সমাজ নূতনত্বের (of novelty) মোহে এক “শিক্ষাকে” (যেমন আবাস-জ্ঞান (knowledge of the habitat, চাষবাস ইত্যাদি) অপর “শিক্ষার” উপর অগ্রাধিকার দিয়ে বসেছে। একটিকে “শিক্ষা” বলেছে আর হেয়ালীভাবে অপরটিকে “অশিক্ষা” বলে মেনে নিয়েছে!
আজ দুঃখজনকভাবে সত্য যে আবহমানকালের বেঁচে থাকার জ্ঞানকে ধ্বংস করে, যা স্বনির্ভরশীলতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, সবকিছু প্রায় ইন্ডাস্ট্রিয়েলাইজ হয়ে গিয়েছে। ব্যক্তি ও পরিবার শিক্ষিত হয়ে তার বংশ পরম্পরায় অর্জিত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরিচিত (alienate) হচ্ছে এবং সবকিছু আরেক শ্রেণীর হাতে দিয়ে তারা ওদের চাকর-বাকর হচ্ছে।
আক্ষরিক শিক্ষার ধারাকে প্রাধান্য দিয়ে (by orienting it on a privileged position), অনেক প্রাচীন স্বনির্ভরশীল জীবন ধারা ধ্বংস করে, আজ স্বেচ্ছায় পরনির্ভরশীল জীবনকে বরণ করা হয়ে গিয়েছে। তা একদিনে নয় বরং ধনতান্ত্রিকতার কব্জায় ধীরে ধীরে, ড্রাকুলারের কুকুর দাঁত (canine teeth) গজাতে শতাব্দীর ধারাবাহিকতা এসেছে। আজকের অনেক বুদ্ধিজীবী ধনতন্ত্র ও বস্তুবাদের দালাল, অনেক আবার ঘিলুহীনও। দেখতে দেখতে এই বিশ্বটি, হেয়ালীভাবে, আবার ফিরাউনের শিক্ষায়, ফিরাউনের গোলামীতে আত্মাহুতি দিল!
কীভাবে কী হল?
চিন্তা করুন, বাদশাহর চাকর হয়েও যে লোকটি দাপটের স্থান পেয়েছিল, তার মূলে কী ছিল? সেটা ছিল এই আক্ষরিক শিক্ষা। বাদশাহ এই শিক্ষিত গোলামদের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য টিকিয়েছে। সেনানী শিক্ষার কথাও মনে রাখতে হবে। অতঃপর, কালান্তরে, বাদশাহের যাবতীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় গোলামগণ দাখিল হয়ে সেই ব্যবস্থাকেই প্রসার করেছে। বাদশাহের অর্থায়নে এই শিক্ষার দরজা দিয়ে পতঙ্গপাল প্রবেশ করে গোলামীর শিক্ষাকে প্রথাগত রূপ দিয়েছে। তা’ই আজ মহীরূপে বিরাজিত। (কিছু কথা এখানে সাধারণী (generalised) মাত্রায় বলছি, কেননা নানান ব্যতিক্রমের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এখানে সম্ভব নয় –এটি সেই মেজাজের লেখা নয়)। আবার চিন্তা করুন, আজ এক ব্যক্তির ২০ বছরের পড়াশুনার পর, তার শেষ অবস্থানটি কী হয় (what end product does s/he become) -স্বনির্ভরশীল, না পরনির্ভরশীল? বাস্তবতা হচ্ছে এই যে এই শিক্ষা একজনকে আমলা বানায়, অথবা প্রাইভেট সেক্টরে চাকর বানায়, অথবা সুদ-বন্দী ব্যবসায় দাখিল হয়, এবং ভাগ্য ভাল হলে এক সময় প্রভু শ্রেণীতে একাত্ম হয়ে প্রভু শ্রেণীর সাজানো খেলায় অংশ নেয়। আজকের মানবতা এই স্থানে উপনীত হয়েছে।
-তিন-
এক সময় যখন সংঘবদ্ধ (organised) সমাজ ব্যবস্থা ছিল না তখন প্রকৃতিতে মানুষ স্বাধীন ছিল। তখন সে স্বনির্ভরশীল ধারায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা রপ্ত করছিল। কিন্তু কিছু দুষ্ট মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হয়ে জোরপূর্বক অপরের অর্জন ছিনিয়ে নেবার বাস্তবতা দেখিয়েছে, তখন তারা গোত্রপতি, সমাজপতি, এবং পরে, বাদশাহের অধীনে নিজেরাই সংঘবদ্ধ (organised) হতে হয়েছে, নিজেদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে অন্যভাবে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু বাদশাহের কাঠামোগত আমলাতন্ত্রে (structural bureaucracy) যারাই ঢুকেছে তারাই পরবর্তীতে মানুষকে পরাধীন করেছে, মানুষের প্রভু হয়ে বসেছে এবং কালান্তরে এটাকেই “শিক্ষার” রূপ-ধারায় সাজিয়ে নিয়েছে। বিবর্তনের ধারা বেয়ে আজ আমরা এই শিক্ষা ব্যবস্থায় উপনীত হয়েছি।
বন্ধুগণ, এক প্রেক্ষিতে আমরা পরাধীন! আরেক প্রেক্ষিতে আমরা ৮/১০ হাজার বছরের পূর্বের অবস্থান থেকে মন্দ অবস্থানে। ‘We now live in a nation where doctors destroy health, lawyers destroy justice, universities destroy knowledge, governments destroy freedom, the press destroys information, the religion destroys morals, and our banks destroy the economy’ –Chris Hedges [link], (ক্রিস হেজেজ এখানে ধর্মকে একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে এনেছেন, যা সহজেই বোধগম্য। ক্রিস হেজেজের আরও কিছু বক্তব্য এই ভিডিওর সূত্র ধরে দেখা যেতে পারে)।
আজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান বলে চিৎকার করে লাভ নেই। বিশ্বায়নের মাধ্যমে প্রতিটি দেশ ও সমাজ কাদের হা-করা মুখের দিকে ছুটে চলেছে এবং এত্থেকে তাদের মুক্তি পথ কোথায় –তা নিয়ে চিন্তা করা দরকার।
আজকের শিক্ষাঙ্গনে অনেক কিছু শিক্ষণীয় হয়ে আছে যার প্রভাব ও সংশ্লেষ (implication) অনেককে চিন্তিত করে কিন্তু তাদের করার কিছু নেই। বিপক্ষে দাঁড়াতে গেলে চাকুরীর উপায় থাকে না, কেননা যে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের রুটি-রুজি, তার বাইরে তারা অসহায় -দাঁড়াবার স্থান নেই। সুতরাং এই জিঞ্জির থেকে মুক্তি আসবে কীভাবে? মুক্তির পথ যেন রুদ্ধ। এই গোলামীর জিঞ্জির মনস্তত্ত্বের অতল তলে ঢুকে গিয়েছে। এখান থেকে মুক্তির আশা যেন নিরর্থক, বৃথা! তবে থামুন! নিরাশ হলে চলবে না।
স্টোয়িক (stoic) দর্শনে শান্তির পথ হচ্ছে আপনি যেখানে যেভাবে আছেন, সেই অবস্থান গ্রহণ করে নেবেন, এটাকে মেনে নিয়েই শান্ত হয়ে যাবেন –অবস্থা জুলুমের হোক অথবা গোলামীর। যদিও একটি পরতে এখানে ইসলামের সামান্য ছোঁয়া রয়েছে কিন্তু মূলত তা ইসলামী নয়। মানুষ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না, জুলুম সহ্য করা যেতে পারে না। এখানে নিরাশার স্থান নেই। একটি স্ফুলিঙ্গও বিপুল অগ্নিকুণ্ডের সম্ভাবনাময়ী। এখানে বিশ্বাসী অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েও বিজয়ের আশায় থাকে উদ্দীপ্ত। “‘হে মানুষ, বল, ‘লা ইলাহা ইল্লালল্লাহ, তুফলিহু –বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে’” (হাদিস)। মুসা (আ.) ফিরাউনের জিঞ্জির ছিন্ন করেছিলেন। নবী মুহাম্মাদ (সা) বস্তুতান্ত্রিকতা, ইয়াদী সুদীর জিঞ্জির, তাদের অস্ত্র-বাণিজ্যের জিঞ্জির [১], যুগান্তরের আরব গোত্রীয় রক্তারক্তির অটুট ও অপ্রতিরুদ্ধ হানাহানির জিঞ্জির -যার সংযুক্তিতে ছিল গোত্রীয় কবিদের আবেগ উস্কানো ইন্দন, ব্যঙ্গ কবিতার হীন-জিঘাংসার উত্তেজনা, এসব থেকে মানবতাকে মুক্ত করেছিলেন। কে বলে অসম্ভব? কাল –সে এক বিপুল সম্ভাবনার চলন্ত ধারা। পরিবর্তন এখানে হয়ই হয়। এখানে কিছুই স্থির নয়। ঐ সুদূরের সীমারেখায় যে সুউঁচু পাহাড়, সেও ক্ষয়িষ্ণু। আর পরমাণুতেও রয়েছে চঞ্চল গতি। এই অম্বর, সে সীমাহীন –তেমনই চিন্তার দিগন্ত।
-চার-
মুক্তির সূচনা কোথা থেকে হবে?
মুক্তির সূচনা সেখান থেকেই হতে হবে যেখান থেকে বস্তুমোহে, লোভে ও ক্ষমতাগ্রহে মানুষ তার মানবতা হারিয়েছে। বিত্তের সীমা বৃদ্ধির জন্য যে মোহ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল, সেটিই ছিল তার কালো-নাগ। তার সামনে যারাই বাধা হয়েছিল সে তাদের কবর রচনা করে তবেই তার যাত্রাপথ সুগম করেছিল। জোর-জুলুম নির্যাতন সবই ছিল তার কাছে নৈতিক ও যৌক্তিক। সে দেখেছিল আইন ও পুলিশ তাকে আটকাতে পারে নি। তার সৃষ্টিশৈলী গুণ পুলিশসহ সকলের কৌশল কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল, স্থানভেদে তার শিক্ষা তাকে আরও ধূর্ত করেছিল। সে কৌশলে অন্যের সাথে সংঘবদ্ধও (corporative) হয়ে তার অন্তঃস্থিত কালো-নাগিনীর খোরাক বৃদ্ধি করেছিল। যে ধারণাস্থলে তার অস্তিত্বের প্রকৃতি, আজ সেখান থেকেই মুক্তি খোঁজতে হবে। তার এই খুদিকে (নফসকে) আটকানোর পথ একটিই, যদি পুলিশকে তার মনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, যদি মোহগ্রস্ততার প্রতিকূলে অন্তর্দৃষ্টি স্থাপন করা যায়। ব্যক্তি ও সামাজিক মুক্তির মূল হচ্ছে বিশ্বাস –আল্লাহতে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস। তার কলবে এই ধারণা উপনীত হতে হবে যে সে মরণশীল। অঢেল বিত্ত গড়লেও তাকে মরতে হবে। এই সত্য তার হৃদয়ের গহীন রন্ধ্র স্পর্শ করে আসতে হবে। তবেই মুক্তি, না হলে নেই।
মানুষ বাদশাহর অধীনে সংগঠিত সামাজিক ব্যবস্থা গড়েও নিরাপত্তা লাভ করে নি। বাদশাহর অন্তর্নিহিত ‘রোগ’ তাকে ক্ষমতা লোভী ও ক্ষমতা হারানোর ভীতিতে সচঞ্চল করে করেছিল। ফলশ্রুতিতে, ও কালের ধারায়, সে ও তার আমলারা মিলে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে, মানুষকে তাদের প্রতিভূ বানিয়েছে -ভাল যুক্তি দেখিয়ে, শব্দের খই ফুটিয়েছে, কিতাব রচনা করেছে, শিক্ষা-প্রশিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেশ ও সমাজ যাদের পদপ্রান্তে নিষ্পেষিত হচ্ছে তাদের মিথ্যাচার আর অপশাসনের স্বরূপ এমনই নগ্ন ও রাক্ষসী হয়েছে যে তা দেখলে অনেক ক্লাসিক্যাল বাদশাহও হয়ত বিস্মিত হবে।
আমি এখানে মূলত ধর্মের বিস্তৃত রূপ আলোচনা করছি না। শুধু বিশ্বাসের একটি মৌলিক স্থানে ব্যক্তির নিজ ও সামাজিক অস্তিত্বের বিষয়টি দেখাচ্ছি। এই মরণশীলতার চিন্তা, এর দর্শন ও বিত্তের ঊর্ধ্বের জীবন ও চিন্তার দিগন্তের কথা বলছি। এখানেই হচ্ছে “শিক্ষার” অপর দিক। এই শিক্ষা হারিয়ে মানুষ আজ বস্তুর মোহনীয় জিঞ্জিরে আবদ্ধ। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামও নিস্তব্ধ হয়ে যায় নি। কালের ধারা বেয়ে সেই অনন্ত সংগ্রাম এখনো চলমান. মুক্তি আত্ম-সংযমেই নিহিত, এই শিক্ষায়, এই সাধনায়।
অতঃপর, যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে
দণ্ডায়মান হতে ভয় করে [২] এবং (তার) অন্তরকে কামনা-বাসনা হতে নিবৃত্ত রাখে,
নিশ্চয়ই (তার) বাসস্থান হবে জান্নাত (৭৯:৪০-৪১)।
No comments:
Post a Comment