বাঁচুন দীর্ঘদিন
ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে জীবনকে
দীর্ঘায়িত আর সুন্দর করার স্বপ্ন। দীর্ঘ জীবনের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও
চালিয়ে আসছেন গবেষণা। যদিও এখনো পূর্ণ সফলতা পাননি তারা, তবু জীবন
দীর্ঘায়িত হওয়া বা না হওয়ার কিছু কারণ বের করতে পেরেছেন। মানব শরীর একটি
যন্ত্র বটে, যদি যন্ত্রের
অবস্থা ভালো থাকে তাহলে তা পাড়ি দিতে পারবে দীর্ঘ
পথ, আর যদি তা না হয় তাহলে পথেই যাবে নষ্ট হয়ে। এখন প্রশ্ন হলো, আপনার
দেহযন্ত্রটি কেমন আছে, কত দূর পর্যন্ত যেতে পারবে?
জবাবটা হলো আপনার আগে দেখা প্রয়োজন
দেহযন্ত্রটি কতটা প্রশিক্ষণ পেয়েছে। স্বাভাবিক জীবনকাল নির্ভর করে দুটো
অবস্থানের মাঝে। এক. খুব ভালো স্বাস্থ্য সচেতনতা, দুই. খুব খারাপ স্বাস্থ্য
সচেতনতা। অতএব প্রথমেই দেখা প্রয়োজন আপনি কোথায় আছেন। আর চেষ্টা করলে আপনি
সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন। এখানে কিছু প্রশ্নোত্তর দেয়া হলো,
প্রতিটি উত্তরের জন্য যে স্কোর রয়েছে তা যত বেশি হবে, তত বেশি আপনার দীর্ঘ
জীবন লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। আর এসব স্কোর কিভাবে বাড়াতে পারেন তারও
দিকনির্দেশনা দেয়া হলো। সামান্য কিছু ব্যবস্থাই আপনার জীবনকাল আরো ১৫ বছর
বাড়িয়ে দিতে পারে।
মানসিক উদ্বেগ ও চাপ
যদিও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আবেগ সঠিকভাবে
মাপা সম্ভব নয়, তবুও নিশ্চিতভাবে বলা যায় মানসিক চাপের সাথে ব্যাপক মাত্রায়
শারীরিক সমস্যার সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে হৃদরোগের। আপনি কতটুকু মানসিক
চাপে রয়েছেন তার হিসাব করে নিন।
স্কোর
১. আপনাকে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায় সহজ সরল ও উদ্বেগহীন হিসেবে? ৩ যোগ করুন।
২. আপনাকে সঠিকভাবে বর্ণনা করা যায় আগ্রাসী, উদ্বিগ্ন আর সহজেই রাগান্বিত হিসেবে? ৩ বিয়োগ করুন
৩. এমন কাজ চান যেখানে আপনার জবাবদিহিতার প্রয়োজন খুবই কম? ২ বিয়োগ করুন।
৪. আপনি কি গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্রাজুয়েট? ৩ যোগ করুন।
৫. আপনার যোগ্যতা কি এইচএসসি পর্যন্ত? ২ যোগ করুন।
৬. আপনার যোগ্যতা কি এসএসসি পর্যন্ত? ১ যোগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
লক্ষ করুন, সবচেয়ে খারাপ জিনিসটা হলো
আপনার কর্মক্ষেত্রে হতাশা, বিশেষত প্রচণ্ড চাপ আর খাপছাড়া কোনো কাজের
ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা। শিক্ষা আপনাকে পথ দেখাতে পারে। সমীক্ষায় দেখা
গেছে, সত্যিকারের শিক্ষিত লোক আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে পারে যেটা কম শিক্ষিত
লোকের পক্ষে সম্ভব নয়।
পারিবারিক ইতিহাস
আপনার সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য হুমকি জিনের
মধ্যে থেকে যেতে পারে। হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো বড় ঘাতক রোগগুলো হতে পারে
বংশগত। এ ধরনের কোনো একটি ইতিহাস যদি আপনার পরিবারে থাকে, তাহলে তা আপনার
ঝুঁকিকে দ্বিগুণ করে দিতে পারে।
স্কোর
১. দাদা-দাদী, নানা-নানী ৮০ বছর বা তারও বেশি বেঁচে ছিলেন বা আছেন? প্রতিটির জন্য ১ যোগ করুন।
২. বাবা-মাও কি একই সময় বেঁচেছিলেন বা আছেন? প্রতিটির জন্য ৩ যোগ করুন।
৩. মা অথবা বাবা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে ৫০ বছরের মধ্যে মারা গেছেন? প্রতিটির জন্য ৪ বিয়োগ করুন।
৪. আপনার কোনো নিকট আত্মীয়ের যেমন বাবা,
মা, ভাই, বোন, দাদা, দাদী, নানা, নানী কারো হৃদরোগ, ক্যান্সার অথবা অল্প
বয়স থেকেই ডায়াবেটিস ছিল বা আছে? প্রতিটির জন্য ৩ বিয়োগ করুন।
৫. তাদের কেউ কি ৬০ বছরের আগে ওই সমস্যাগুলোর জন্য মারা গেছেন? প্রতিটির জন্য ২ বিয়োগ করুন।
৬. আপনার নিকট আত্মীয়ের (আগের মতোই) কেউ
কি ৬০ বছরের আগে ক্যান্সারে বা স্বাভাবিক কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন? প্রতিটির
জন্য ১ বিয়োগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
যারা পারিবারিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন,
তারা তাদের ঝুঁকি পরিবর্তন করতে পারেন সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী বিষয়গুলোর
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। প্রতিদিন প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি সমৃদ্ধ খাবার
অন্ত্রের ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। আর ক্যান্সারের
ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের জন্য নিয়মিত চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করলে ক্যান্সারের
প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
রক্ত চাপ
রক্তচাপ মূলত আপনার হৃৎপিণ্ড কত শক্তিতে
সারাদেহে রক্ত সরবরাহ করছে তা নির্ণয় করে। আর এই পাম্প করার জন্য
হৃৎপিণ্ডটি যদি বেশি কাজ করে তাহলে কোনোক্রমেই তাকে ভালো বলা যাবে না। উচ্চ
রক্তচাপ স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের প্রমাণিত কারণও বটে।
স্কোর
১. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কি সব সময় ৮৮ মি.মি. পারদ বা তার নিচে থাকে? ৩ যোগ করুন।
২. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৮৮ মি.মি. পারদ বা এর নিচে থাকলেও এক সময় তা ৯০ বা আরো বেশি হয়ে যায়? ২ যোগ করুন।
৩. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৮৮ মি.মি. পারদ বা তার নিচে থাকলেও কোনো কোনো সময় তা ১০৫ মি.মি. পারদ বা তার বেশি হয়ে যায়? ১ যোগ করুন।
৪. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কি ৯০ থেকে ১০৪ মি.মি. পারদ পর্যন্ত থাকে? ১ বিয়োগ করুন।
৫. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কি ১০৫ মি.মি. পারদের উপরে থাকে? ২ বিয়োগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
আপনার রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক সীমার ওপরে
(ডায়াস্টোলিক ৯০ মি.মি. পারদ) থাকে, তাহলে হালকা ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাস
পরিবর্তন করুন। এর বেশি হলে ওষুধের প্রয়োজন রয়েছে। অবশ্য সব ব্যাপারে
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মেদবহুলতা ও অতিরিক্ত ওজন
কয়েক পাউন্ড বেশি ওজন কমিয়ে দিতে পারে
আপনার জীবনকাল। মেদবহুলতা, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ ও
ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ওজন কিছু কিছু
ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক ওজন ও মেদের
মাত্রা নির্ভর করে উচ্চতা ও লিঙ্গের ওপর এবং এটারও একটা সীমা রয়েছে।
স্কোর
১. আপনি কি সর্বদাই আপনার আদর্শ ওজনের ৫ শতাংশের মধ্যে থাকেন? ২ যোগ করুন।
২. বর্তমানে ৫ শতাংশ আদর্শ মাত্রার মধ্যে অবস্থান করলেও আগে আদর্শমাত্রার ৩০ শতাংশের উপরে অবস্থান করেছিলেন? ১ যোগ করুন।
৩. সব সময় কি ৫ থেকে ৩০ শতাংশ উচ্চ ওজনের মধ্যে অবস্থান করেন? ১ বিয়োগ করুন।
৪. ১৬ বছরের পর থেকেই কি ওজন ৫ কেজির বেশি কয়েকবার ওঠানামা করছে? ২ বিয়োগ করুন।
৫. সব সময় কি ৩০ শতাংশ উচ্চমাত্রায় ওজনে অবস্থান করেন? ৪ বিয়োগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
ওজন কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো
স্বল্পমাত্রার চর্বিযুক্ত খাবারের সাথে মাঝারি পরিমাণ ব্যায়াম করা। এতে
ধীরে ধীরে ওজন কমবে। দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না, তাতে ক্ষতি হবে।
কোলেস্টেরল
উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল হৃদরোগের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্যও এটাকে দায়ী করা হচ্ছে।
স্কোর
১. আপনার রক্তে মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা কি সব সময় ২০০ -এর নিচে থাকে? ৪ যোগ করুন।
২. এই মাত্রা এখন ২০০-এর নিচে, কিন্তু কোনো এক সময় তা ২৪০ থেকে ২৯৯ পর্যন্ত ছিল? ৩ যোগ করুন।
৩. এখন এই মাত্রা ২০০-এর নিচে, কিন্তু এক সময় এটা ৩০০-এর উপরে ছিল? ২ যোগ করুন।
৪. বর্তমানে এই মাত্রা কি ২৪০ থেকে ২৯৯ পর্যন্ত? ১ বিয়োগ করুন।
৫. বর্তমানে এই মাত্রা কি ৩০০-এর উপরে? ২ বিয়োগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
আপনাকে অবশ্যই সম্পৃক্ত চর্বি খাওয়া
কমাতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে বেশি। দেখা গেছে, একজন লোক সপ্তাহে
আড়াই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত হাঁটলে অলস লোকদের চেয়ে তার কোলেস্টেরলের
মাত্রা বাড়ার ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়।
খাদ্যাভ্যাস
শুধু খাদ্যাভাসের কারণে আপনার হৃদরোগ বা
ক্যান্সার হতে পারে। যেমন চর্বিযুক্ত খাবার আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের
মাত্রা বাড়ায়, রক্তচাপ বাড়ায় এবং অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
স্কোর
১. আপনি কি প্রতিদিন প্রচুর ফলমূল বা সবজি খান? ৫ যোগ করুন।
২. আপনি কি প্রতিদিন প্রচুর চর্বিযুক্ত খাবার যেমন গরুর গোশত খান, কিন্তু সেই সাথে প্রচুর ফলমূল ও সবজি খান? ১ যোগ করুন।
৩. প্রচুর চর্বিযুক্ত খাবার খান কিন্তু ফল বা সবজি তেমন খান না? ৪ বিয়োগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
চর্বিযুক্ত খাবার কমিয়ে ফেলুন। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যোগ করুন ফলমূল ও শাকসবজি। চিকিৎসকের পরামর্শে যোগ করুন ভিটামিন সি, ই এবং এ
ধূমপান
সব ঝুঁকির মধ্যে এই ধূমপানটিকেই আপনি
সম্পূর্ণ বর্জন করে পূর্ণ স্কোর অর্জন করতে পারেন। মানুষের অনেক বড় ধরনের
স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ধূমপান। ফুসফুসের
ক্যান্সারের একটি প্রধান কারণ ধূমপান এবং সম্ভবত এটা অন্ত্রের ও
প্রোস্টেটের ক্যান্সারের জন্য সমানভাবে দায়ী। এটা উচ্চ রক্তচাপ ঘটায়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬৫ বছরের উপরে ধূমপায়ীরা অদূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ
হারে মারা যায়।
স্কোর
১. আপনি কখনোই ধূমপান করেননি? ২ যোগ করুন।
২. ১ বছরেরও আগে পাঁচটি বা আরো বেশি সিগারেট খেয়েছেন? ১ যোগ করুন।
৩. দিনে অর্ধেক প্যাকেটের কম সিগারেট খান? ১ বিয়োগ করুন।
৪. নিয়মিত অর্ধেক প্যাকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট খান? ২ বিয়োগ করুন।
৫. দিনে এক প্যাকেট থেকে দু’প্যাকেট ধূমপান করেন। ৩ বিয়োগ করুন।
৬. দিনে দু’প্যাকেটের বেশি ধূমপান করেন? ১০ বিয়োগ করুন।
কিভাবে স্কোর বাড়াবেন
সিগারেট ছাড়ুন, নিশ্চিন্তভাবে এটা ব্যাপক
পরিবর্তন আনবে। যদি ৫ থেকে ১০ বছর ধরে সিগারেট ছেড়ে থাকেন, তাহলে ফুসফুসের
ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এখন মিলিয়ে দেখুন আপনার স্কোর। স্কোর যত বেশি হবে, ততই আপনার দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনা থেকে যাবে। দীর্ঘ ও সুন্দর হবে আপনার জীবন।
No comments:
Post a Comment