Pages

Monday, December 21, 2015

অসমাপ্ত

তবে আনা যে কথাটা খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছিল, তা কিন্তু না। ও থাকে সবসময় ওর মনে। আর ওর সেই থাকার মধ্যেই আশপাশের প্রত্যেকটা মানুষ জেনে যায় যে, সে আছে কোথাও, আশপাশে। ওর হুটহাট গলা ফাটিয়ে হাসার শব্দে মাঝে মাঝে বুড়োদের গ্লাসের বিয়ার চলকে পড়ে। আমার কাজ ছিল মূলত ওর পাশে বসে বসে ওকে কথা বলতে দেয়া। তার মানে অবশ্য এই না যে, আনা অনবরত বক বক করতে থাকে। বরং ওর কথা শোনাটা অনেক ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার ছিল। পৃথিবীর কোন কোন টপিক থেকে যে সে মজার মজার জিনিস জোগাড় করে আনতে পারতো, তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না।
তবে আমি জানতাম মানুষ ওকে পছন্দ করে ওই কারণেই। সে এমন একজন মানুষ, যে আশপাশে থাকলে আপনি ক্ষণিকের জন্য সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। নেক্সট উইকের প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে ক্ষানিকক্ষণ চিন্তা না করে থাকতে পারেন। অফিসের কাজ সম্পর্কে যে সুক্ষ্ণ ভাবনাটা তলে তলে সবসময় চলতে থাকে, বন্ধ হয় না এক মিনিটের জন্যও; সেটাও হঠাৎ হারিয়ে যায়। বেশি স্পয়লার দিয়ে লাভ নেই বলে এই এক্সাম্পলগুলো বাড়ালাম না।
মাঝে মাঝে সে আমার মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। বিশেষ করে যখন আমি নিজের ভাষায় লিখতাম। সে বলতো, তোমার ভাষাটা যখন বের হয় তখন সেটা দেখতে খুবই কুল লাগে, জানো? মনে হয় ফ্যাক্টরী থেকে মাত্র ম্যানুফ্যাকচার হয়ে একটা একটা শব্দ বের হচ্ছে। মাঝে মাঝে শব্দের ওপর গিয়ে বসে যাচ্ছে নানারকমের শেপ। আমি শুনে ভেতরে ভেতরে হাসতাম কিন্তু বাইরে কিছু বলতাম না। বড়জোর লেখায় একটা ব্রেক নিয়ে একটা বিড়ি বানাতে বসতাম। লেখা বের হওয়ার সময়টায় মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা ম্যাজিকমতো ঘটে, আমিও জানি। অন্য কেউ কখনও সেটা ধরতে পারবে বলে কখনও ভাবি নি। আনা প্রথমবার কথাটা উল্লেখ করে আমাকে ভাল রকমের চমকে দিয়েছিল।
আমি মাঝে মাঝে গভীর রাতে ভয়াবহ ইলেক্ট্রনিক মিউজিক চালিয়ে কানে ফুল ভল্যুয়মের হেডফোন গুঁজে, চোখ বন্ধ করে টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনল মেশানো সিগারেট টেনে দেখেছি। ইদানীংকার ভাল হেডফোনগুলো মাস্টারপিস একেকটা। লেখা বের হতে দেখাটা অনেকটাই সেই সব জাদুকরী রাতের মতো। কিংবা পাহাড়ী ঢল যখন কয়েক মিনিটের মধ্যে নদীর পানিকে হাঁটুর লেভের থেকে দুইতলা পর্যন্ত উঠিয়ে দেয়, সেই সময় নৌকার গলুইয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখার মতো। বিষয়টার স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক মিনিটের, কিন্তু স্পর্শক্ষমতা অপরিসীম। মনে হয়, একটা ছোট্ট আঙ্গুল কোথা থেকে যেন এসে হৃদযন্ত্রের দেয়ালে খুব আস্তে আস্তে আঁচড় কাটছে।
আমার কথাগুলো কখনও আনাকে সেভাবে বুঝিয়ে বলা হয় নি। তার একটা কারণ হতে পারে, নিজের ভাষায় একটা জিনিস বোঝানো যতো সহজ এবং নিজের ভাষা আপনাকে যে বহুমুখী সুযোগটা দেয় একটা জিনিস বোঝানোর সময়, সেটা অন্য ভাষায় সহজে পাওয়া যায় না। অন্য ভাষায় খুব উন্নতি করলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে আনা মাঝে মাঝে আমার কথাগুলো বুঝে ফেলতো। এমনও হয়েছে আমি কোনো এক্সপ্লানেশন ছাড়া একটা লাইন হয়তো বলেছি। সে পরে সেটা ব্যাখ্যা করেছে ঠিক আমার মতো করে। একবার অ্যামি ওয়াইনহাউসের গানের একটা লাইন এনে আমায় বলেছিল, এই লাইনটা না মাঝে মাঝে আমার হৃদযন্ত্রের দেয়ালে আস্তে আস্তে আঁচড় কাটে।
লাইনটা ছিল ব্যাক টু ব্ল্যাক গানের, ইউ গো ব্যাক টু হার, অ্যান্ড আই গো ব্যাক টু্ ব্ল্যাক। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন কি তোমার কাল্পনিক ভার্সনটা শিরশির করে একটু একটু? সে শিশুদের মতো উপর-নিচে মাথা নেড়ে জানিয়েছিল, হ্যাঁ করে।
আমি ক্ষানিকক্ষণ পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে পরে ধূম্রশলাকায় অগ্নি সংযোগ করেছিলাম। আর সে তার বিয়ার-বোতলের ব্যাকওয়াশটুকু এক চুমুকে শেষ করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে, কোনো পূর্বনোটিশ ছাড়া বোতলটা ছুঁড়ে দিয়েছিল সজলের দিকে। ছুড়ে দেয়ার পর যখন বোতলটা শূন্যে ভাসছিল, সেই সময় সে সজলকে জানিয়েছিল যে, তোমার দিকে একটা বোতল এগিয়ে যাচ্ছে ম্যান, কিছু একটা করো।
সজল হয়তো সে সময় আমাদের সেই রুমের ছোট্ট পৃথিবীটার কোথাওই ছিল না, কিংবা ছিল, আমি জানি না। হয়তো সে ডুবে ছিল আমাদের সংগৃহীত সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ-সাগরের অনেক গভীরে। কোনো একটা রিসার্চ-টুল নিয়ে আপন মনে। সেখান থেকে এক মুহূর্তে বাস্তব জীবনে ফিরে আসা, প্রয়োজনীয় পরিমাণ হাবুডুবু খাওয়া এবং তারপর ব্রেইনের কাছ থেকে আসা বোতল ঠেকানোর আদেশটাকে হাত দিয়ে প্রসেস করা এবং কোনমতে সেটা ঠেকানো; সব কিছু বেচারাকে এত দ্রুত করতে হয়েছিল যে, পুরো বিষয়টা দেখার মধ্যে এক ধরনের স্বার্থপর কিন্তু শিশুতোষ আনন্দ লুকিয়ে ছিল। আমি কোনমতেই নিজেকে সে আনন্দ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারি নি।
আর সজলের বোতলটা ঠেকানোর পর, আনার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া দেখা নিজের হাসিও ঠেকাতে পারি নি। আনা গড়াগড়ি দিয়ে হাসছিল আর বলছিল, বোকাটা বোতলটা ধরার চেষ্টাটাও করে নি। জাস্ট কোনমতে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বলতে বলতে হাসি ঠেকানোর জন্য ফ্লোরে বার বার চাপড় দিচ্ছিল। তাও পুরোপুরি হাসি থামছিল না বেচারার। আর আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বিষম খাচ্ছিলাম বারবার। আর ভাবছিলাম, যদি ঘটনাটাকে একটা ১৫ সেকেন্ডের ভিডিও হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে সেটার ক্যাপশান হিসেবে আনার কথাটা একদম যুৎসই হয়।
আসলে ডেনমার্কের অল্প ক'দিনের ট্রিপল জীবনটা আমাদের অতুলনীয় ছিল। আসার আগের দিন বিকেলে আমরা সৈকতে বসে বসে মার্গারিটা পান করছিলাম। আমি একটা হাওয়াই শাট কিনেছিলাম ওখানে গিয়ে আর একটা অফ হোয়াইট রঙয়ের কার্গো প্যান্ট। সেটা পড়ে ওদের জন্য মার্গারিটা বানাচ্ছিলাম। আনা পড়ে ছিল সবুজ রঙয়ের বিকিনি, যার ভেতরে লাল, হলুদ, আর শাদা রঙয়ের অনেকগুলো বল প্রিন্ট করা ছিল। পাখি আর নারকেল গাছও ছিল, কালো রঙয়ে প্রিন্ট করা। ওর চোখ আর কপালের অর্ধেকটা ঢেকে রাখা বেড়ালের কানের শেপের রোদচশমা, আর কোকড়ানো চুলের গোছাগুলোর কয়েকটার শেষপ্রান্তে ঝুলতে থাকা ছোট ছোট হেয়ারব্যান্ডগুলোর দিকে তাকালে একটা ভালোলাগা টাইপ অনুভূতি হচ্ছিল, তবে সবসময় না। কেবল তখনই, যখন মাঝারি সাইজের এক-একটা মেঘ সূর্যটাকে ঢেকে দিচ্ছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
আমি কয়েকটা তরতাজা লেবু জোগাড় করেছিলাম স্থানীয় বাজারের চার-পাঁচটা দোকান ঘুরে। আর আগাভে নেকটার, যেটা মূলত মার্গারিটার স্বাদটা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্টিয়ারিং হুইল হিসেবে কাজ করে, সেটা কিনতে হয়েছিল গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ নারীটির কাছ থেকে। বুড়ি একলা থাকে ৪৫ বছর যাবত। মধ্য জীবনে স্বামী কলেরায় ভুগে মারা যাওয়ার পর তার জীবনটা একলা হয়ে যায়। একটা সন্তান ছিল। মেয়েটা জন্মেছিল পোলিও নিয়ে। তারপর মরে গেছে মাত্র কয়েক বছর পরই। বুড়ি ওই মৃত্যু দুটোর পর আর কারও সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর নাকি সাহস করতে পারে নি। তার ভাষায়, মৃত্যুরা সবচেয়ে ভয়ংকর যখন তারা হানা দেয় কাছের মানুষের ভেতর।
তবে বুড়ি বেশ শক্ত সমর্থ। এই বয়সেও দিব্যি বিশাল এক আঙুর ক্ষেতের দেখভাল চালিয়ে যাচ্ছে একহাতে। শুধু মাঝে মাঝে প্রতিবেশির ছেলেটার সাহায্য নিতে হয় ভারি জিনিসপত্র টানাটানির কাজে। বুড়ির সংগ্রহশালায় নিজের হাতে বানানো ৫০ বছরের পুরোনো ওয়াইনও আছে। কোনো একদিন খুব মুড আসলে নাকি বুড়ি বারান্দায় একটা আরামকেদারা টেনে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ওয়াইনটা পান করবে।
সজল আমাদের মধ্যেই বসে ছিল এবং সারপ্রাইজিংলি চোখের সামনে বিশাল এক খোলা ল্যাপটপ ছাড়া। ফলে আমরা তিনজন মাঝে মাঝে গল্প করছিলাম। সজলটা নার্ড বলেই কিনা কে জানে, অনেক মজার মজার জিনিস জানে। ঘুমের সময় প্রতি নব্বুই মিনিট পর পর নিউরণগুলোতে ক্যামিক্যাল রিচার্জ হয়। সে সময় কয়েক মিনিটের জন্য শরীরের ওপর মস্তিষ্কের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ওই সময় যদি ভুলক্রমে ব্রেইন শরীরের কোনো অংশে সিগন্যাল পাঠানোর চেষ্টা করে, তাহলে সেটা কাজ করতে চায় না বা করলেও খুব ধীরগতিতে করে। আর মস্তিষ্ক সেটা দেখে ফ্রীকড্ আউট হয়ে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ যে ভয় পায়, সেটা মূলত এই ঘটনার ফলাফল।
জিনিসটা যখন সজল ব্যাখ্যা করেছিল অনেকগুলো খুঁটিনাটি ফ্যাক্ট আর রেফারেন্স সহকারে, তখন সেটা শুনতে দারুণ লেগেছিল। আনা আর আমি সাগরে কয়েকটা ডানপিটে ছেলে আর মেয়েকে সার্ফিং করতে দেখতে দেখতে, এবং চারকোণা গ্লাসে টাকিলা আর কয়েন্ট্রো দিয়ে বানানো ওই ক্লাসিক পানীয়টায় চুমুক দিতে দিতে; খুব আরাম করে গল্পটা শুনেছিলাম। তারপর আনা শিশুদের মতো সরল মুখ করে, আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, দেখেছো, এই ছেলেটা স্বাভাবিক দশজনের মতো গল্পও বলতে জানে?
ফিরে আসার সময়কার কোনো গল্প নেই। আমরা জাস্ট কয়েকটা দিন নিজেদেরকে ভিন্ন এক মাত্রায় আবিস্কার করেছিলাম। জেনেছিলাম, পারিপার্শ্বিকতা থেকে বের হয়ে নিজের কাল্পনিক ভার্সনটা হয়ে নিজেকে দেখার একটা উপকারিতা আছে। আমি নিজে আসলে কেমন, আমার পারিপার্শ্বিকতা আমাকে কিভাবে দেখে এবং নেয়, সেটা বোঝা যায়।
আনার সাথে তারপর এখনও দেখা হয় নি। ও বলেছিল, আবার দেখা হবে। হয়তো কথাটা ওর মনে আছে। কিংবা নেই, জানি না। আমার ভাবতে ভাল লাগে যে কথাটা ওর মনে আছে। তাই সেটা ভাবি। এই যেমন আজ সকালে ব্যাক টু্ ব্ল্যাক গানটা শুনতে শুনতে ক্ষানিকক্ষণ ভেবেছি।
আচ্ছা ক্ষানিকক্ষণ শব্দটার সঠিক বানান কি? জানি না। জানবো কোনো একদিন। আজকে না।

No comments:

Post a Comment