রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ডাকতেন ‘বিজয়া’ নামে। কিন্তু বিজয়া তাঁর আসল নাম ছিল না। নাম ছিল তাঁর ভিক্টোরিয়া[1]।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আর্জেন্টিনার এক নারীবাদী লেখিকা এবং বিগত ত্রিশের
দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করা সুর (Sur) নামের এক
প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদিকা। ধারণা করা হয়, রবীন্দ্রনাথের সাথে এক
‘রহস্যময়’ প্লেটোনিক ধরণের রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। রবিঠাকুরের একেবারে
শেষ বয়সের প্রেম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩। আর ওকাম্পোর ৩৪।
১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছরের বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য জাহাজে উঠলেও মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় তাঁকে[2]। সেখানেই পরিচয় হয় ওকাম্পোর সাথে রবি ঠাকুরের। রবি ঠাকুর আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের এক হোটেলে (প্লাসা হোটেল) ছিলেন তাঁর সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে। সেখানেই একদিন হাজির হন ওকাম্পো। অবশ্য এমনি এমনি রবাহূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের হোটেলে হানা দেননি তিনি। তাঁর রবীন্দ্র-দর্শনের ইচ্ছার পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আসলে প্রথম থেকেই রবীন্দ্র সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথ ততদিনে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। একাধিক ভাষায় লিখন এবং পঠনে পারদর্শী ওকাম্পো ইতোমধ্যেই গীতাঞ্জলি পড়ে ফেলেছেন ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায়। তার মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলির অনুবাদটিই ছিল তাঁর প্রিয়[3]। গীতাঞ্জলি পড়ে শিহরিত হন ওকাম্পো। তাঁর নিজের ভাষ্যেই[4] –
তারপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত সাক্ষাতের কাল, সে প্রায় ‘গীতাঞ্জলির ধাক্কার’ বছর দশেক পরে। দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের নভেম্বরের একটি দিন। পেরুর যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথ বুয়েনোস আইরেসের প্লাজা হোটেলে আছেন জেনে তাঁর ‘গুরুদেব’কে এক ঝলক দেখতে এসেছিলেন ওকাম্পো। হোটেলে এসেই সামনে পেলেন রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টকে। ওকাম্পোর সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে এলমহার্স্ট তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়ে চলে গেলেন। রবি ঠাকুরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটি ভিক্টোরিয়ার লেখায় উঠে এসেছে ঠিক এভাবে[6] –
ওকাম্পোর বাড়িটি নিয়ে কিছু বলা যাক। ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মিরালরিওর যে বাসাটিতে এনে তুলেছিলেন, সেটি বুয়েনোস আইরেস থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সান ইসিদ্রোতে। তবে আজকে কেউ সেখানে গেলে ওকাম্পোর সাথে সম্পর্কিত কোন বাড়ি বলে চিনবেন না। এক ইউরোপনিবাসী দম্পতির ব্যক্তিগত বাড়ি হিসবেই এটি পরিচিত এখন। তবে মিরালরিও নামের এ বাড়িটির ক’ ব্লক পরেই একটি বাড়ি আছে, সেটিই আজ পরিচিত ‘ওকাম্পোর বাড়ি’ হিসেবে; নাম ‘ভিলা ওকাম্পো’। এ বছর (২০১৪) বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন সময়ে সপরিবারে আর্জেন্টিনা এবং পেরু ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ভ্রমণের এক ফাঁকে ওকাম্পোর এ বাড়িটি দেখার যে সৌভাগ্য আমার হল তা অনেকটা তীর্থস্থান ভ্রমণের সাথে তুলনীয় যেন। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই বিখ্যাত ‘ভিলা ওকাম্পো’তে। বাড়িটি আসলে এক সময় ছিল ওকাম্পোর বাবার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময়টুকু যাতে উপভোগ্য হয়ে উঠে, তার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছিলেন তিনি। একটি সাজানো ঘর, নয়নাভিরাম দৃশ্যখচিত অলিন্দ, কবিতা লেখার উপযোগী নিভৃত পরিবেশের বন্দোবস্ত করা থেকে শুরু করে যখন দরকার সঙ্গ দেয়া, দর্শনার্থীদের সাথে রবিঠাকুরের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, রবিঠাকুরের পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সবই করেছিলেন ওকাম্পো। এ সমস্ত করতে গিয়ে ওকাম্পোর যথেষ্টই খরচপাতি হয়েছিল। আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথের প্রথমে সাত দিন থাকার কথা থাকলেও সেটা ক্রমশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি। শোনা যায়, রবিঠাকুরের ভরণপোষণের এই খরচ মেটানোর জন্য ওকাম্পোকে খুব দামী একটি হীরের টায়রা খুব নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হয়েছিল[16]। গয়না বিক্রির টাকা থেকে দশ হাজার পেসো আগাম ভাড়া দিয়ে এসেছিলেন রবিঠাকুরের জন্য বরাদ্দকৃত সেই মিরালরিওর বাড়িটির মালিককে। কেবল তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাতে কোন সমস্যা না হয়, সেজন্য তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফানিকে নিয়োগ দিয়ে দিয়েছিলেন, ফানিকে ব্যস্ত রেখেছিলেন রান্নাবান্না সহ চব্বিশ ঘণ্টা তদারকিতে। এর ফলে ফানির সাথেও কবিগুরুর এক ধরণের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটু রসিকতা করেই লিখেছিলেন, ‘ …তবে ওদের কথাবার্তাটা ঠিক কোন ভাষায় চলতো, তা দুজনের একজনও আমাকে কখনো বুঝিয়ে বলতে পারেননি, কারণ একজন তো আদৌ ইংরেজি বলতে পারতেন না, অন্যজনের স্প্যানিশও ছিল তথৈবচ’।
বাসার অলিন্দ থেকে ওকাম্পোর সাথে মিলে নদী দেখতেন রবীন্দ্রনাথ, দেখতেন নদীর জলে রঙের পরিবর্তনের মায়াবী খেলা। কখনো বা বাসার পাশের তিপা গাছের নীচে চলতো তাঁদের অবিশ্রুত গুঞ্জন। রবিঠাকুর বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন ওকাম্পোকে, ওকাম্পো মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনতেন। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন, সে আবৃত্তিই গান হয়ে উঠতো। শব্দগুলি উনি এমন বিশুদ্ধ স্পষ্টতার সাথে উচ্চারণ করতে পারতেন যে, আমি কিছু কিছু শব্দ স্মৃতিস্থ করে পুনরুচ্চারণ করতে পারতাম’। আর ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’, নামের যে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতটি আমরা আজ অহরহ শুনি, সেটার কথা তো এখানে অবধারিতভাবে এসে পড়বে –
যা হোক, রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে সাথে নিয়ে আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেন ১৯২৫ সালের ৩রা জানুয়ারি। সে বছরের এপ্রিলেই এলমহার্স্ট বিয়ে করেন ডরোথিকে। আর রবীন্দ্রনাথ? ওকাম্পোর স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে তিনি দেশে ফিরলেন। মাস খানেকের মধ্যেই প্রকাশ করেন ঐতিহাসিক ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ। বইটি প্রকাশের পর ওকাম্পোকে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু। ১৯২৫ সালের ২৯শে অক্টোবর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
অবশ্য কেবল ‘পূরবী’ নয়, এর পরে প্রকাশিত যোগাযোগ উপন্যাস (১৯২৮) এবং ‘মহুয়া’(১৯২৯)র অনেক কবিতায় (প্রতীক্ষা, বাপী, প্রচ্ছন্ন, অসমাপ্ত, দূত, আহবান, দীনা ইত্যাদি) ওকাম্পোর ছায়া দেখতে পান কেতকী সহ অনেকে। এমনকি মহুয়া কাব্যগ্রন্থের পরেও নানা কবিতায় কেতকী লক্ষ্য করেছেন ওকাম্পোর সরব উপস্থিতি – নির্বাক, ভীরু, তুমি (পরিশেষ, ১৯২৩); অচেনা, আরশি, প্রভেদ, নীহারিকা, অনাগতা, বিদায়, বেসুর (বিচিত্রিতা, ১৯৩০), শেষ সপ্তকের (১৯৩৫) সকল কবিতা, উদাসীন, বিহ্বলতা, ব্যর্থ মিলন, অপরাধিনী, বিচ্ছেদ, বিদ্রোহী, ক্ষণিক, রাতের দান, অন্তরাত্মা (বীথিকা, ১৯৩৫), মায়া, নারী, হঠাৎ মিলন, দূরবর্তিনী, বিমুখতা, অসময়, মানসী, শেষ কথা (সানাই, ১৯৪০) ইত্যাদি। অবশ্য সে কবিতাগুলোর সবগুলোই কেবল ‘ব্যক্তিপ্রেম’ নির্ভর নাকি একান্তই ‘নৈর্ব্যক্তিক’, এ প্রশ্ন তোলাই যায়, যেমনটি তুলেছেন সাহিত্য সমালোচক নিত্যপ্রিয় ঘোষ, তাঁর ‘সন্ধানের সাহস’ প্রবন্ধে; বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রেমের কবিতাগুলো একমাত্র ওকাম্পো-অনুপ্রাণিত, সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় – রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীকে তাহলে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়’[26]।
ওকাম্পো আরো লিখেছেন[30] –
কিন্তু এবারেও উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সেই ‘সেনিওরা ওকাম্পো’। সৌভাগ্যবশতঃ সেই সময়টা ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। তিনি আসলে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর জীবনের ‘নতুন পুরুষ’ পিয়া দ্রিউ রা হোসেলের সাথে। ওকাম্পো প্যারিসে আছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেছিলেন । হয়তো ভেবেছিলেন এতো মানুষের সাথে সংযোগ রাখা ওকাম্পো কোনভাবে সাহায্য করতে পারবেন।
খবর পেয়েই চলে এলেন ওকাম্পো। রবিঠাকুরের সাথে তাঁর ২য় সাক্ষাৎ এটি (১৯৩০ সালের এপ্রিল)। এসেই খুব কম সময়ের মধ্যে পিগাল গ্যালারিতে রবিঠাকুরের ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। এমনকি তাঁর বন্ধু লেখিকা কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্রসূচীর একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো। এত দ্রুত এবং সুচারুভাবে তিনি কাজগুলো সমাধান করে ফেললেন যে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। ওকাম্পো যে কী অসাধারণ দ্রুততায় এবং দক্ষতায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার সাক্ষ্য সমসাময়িক অনেকের লেখাতেই ছড়িয়ে আছে। যেমন, রথীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ তে উল্লেখ করেছেন[31] –
কেতকী কুশারী ডাইসন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ বইয়ে নানা চিঠিপত্র দলিল উদ্ধার করে দেখিয়েছেন, কবিগুরু আসলে চেয়েছিলেন ওকাম্পো তাঁর সঙ্গে ইংল্যান্ড যান, হিবার্ট বক্তৃতা শোনেন আর তারপর রবীন্দ্রনাথের সাথে ফিরেন ভারতবর্ষে[36]। কিন্তু ওকাম্পোর মাথায় ছিল তাঁর সম্ভাব্য ‘সুর’ পত্রিকা নিয়ে নানা পরিকল্পনা, তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও তিনি রবিঠাকুরের সাথে ভ্রমণে যেতে পারেননি। ইনফ্যাক্ট, আমরা আজ জানি, ওকাম্পো তাঁর সারা জীবনে কখনোই ভারতে গিয়ে উঠতে পারেননি। রবিঠাকুর অবশ্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আশা করে গিয়েছিলেন ওকাম্পো কোন না কোন দিন ভারতে আসবেন, ভারতবর্ষে এসে রবিঠাকুরের কাজকর্মের সাথে পরিচিত হবেন। যেমন, লন্ডনে চিত্রপ্রদর্শনীর পর পরই ওকাম্পোকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ … এ যেন সেই ডেড সী-র ভারি জলের মতো – সব কিছুই ভেসে থাকে যেখানে, তার ওজন যাই হোক না কেন। তুমি কোথায় আছ জানি না, শুধু চাই ভারতবর্ষে তোমার সঙ্গে দেখা হোক’। রবীন্দ্রনাথ যখনই তাঁর ‘বিজয়া’কে চিঠি লিখতেন, তখনই শান্তিনিকেতন ঘুরে যাবার কথা বলতেন। যেমন, ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন –
যে সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম তার সমসাময়িক সময়ে কিংবা তারও অনেক আগে হাইপেশিয়া, এমি নোদার কিংবা মাদাম কুরির মতো উদ্ভাবক এবং বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে আলোকিত করে গেছেন, ক্লিওপেট্রা থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ, রাণী ভিক্টোরিয়া, স্পেনের প্রথম ইসাবেল, রাশিয়ার ক্যাথরিন দ্য গ্রেট, জার্মানির রোজা লুক্সেমবার্গ, সুলতানা রাজিয়া, তুরকান খাতুন কিংবা রাণী লক্ষ্মীবাইরা রাজ্য শাসন করে গেছেন, আর সাহিত্যাঙ্গনে তো নারীরা প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। ‘সমকামিতা’ শিরোনামে একটা বই লিখেছিলাম আমি বছর কয়েক আগে। সে বইয়ে আমি নারী কবি স্যাপোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলাম[38]। গ্রীসের লেসবো দ্বীপের (যেখান থেকে ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে)উল্লেখযোগ্য কবি আর পেশায় শিক্ষিকা স্যাপো খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকেই ফুলের সৌন্দর্য, স্বর্ণ, সূর্যালোক, মন্দিরের বাগান আর সর্বোপরি নারীর সৌন্দর্য নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক সময়ে জেন অস্টিন, শার্লটি ব্রন্টি, এমিলি ব্রন্টি, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, জর্জ এলিয়ট (মেরি অ্যান ইভান্স), এডিথ সোয়ডারগ্রান, আনা আখমাতোভা, মারিনা ৎসভেতায়েভা, কোলেত, এমিলি ডিকিন্সন, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, সুসান বি অ্যান্থনি, এলিজাবেথ স্ট্যান্টন, ভার্জিনিয়া উলফ কিংবা ভারতবর্ষে বেগম রোকেয়ার মতো নারীরা চিন্তাচেতনার ছক উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিবিধ গদ্যে সভ্যতাকে দেখছেন কেবল ‘পুরুষের সৃষ্টি’ হিসেবে, কখনো নির্লিপ্তভাবে বলে দিচ্ছেন নারীর ‘উদ্ভাবনা শক্তি নেই’ বলে। কিছু কিছু উক্তি তো অতিমাত্রায় নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিক: ‘মেয়েদের একরকম চটপটে বুদ্ধি আছে, কিন্তু সাধারণত পুরুষদের মতো বলিষ্ঠ বুদ্ধি নেই। আমার তো এইরকম বিশ্বাস’। অথবা, ‘মেয়েরা হাজার পড়াশুনো করুক, এই কার্যক্ষেত্রে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে নাবতে পারবে না’। এগুলো রবীন্দ্রনাথেরই উক্তি। না, মুখ ফসকে আলগোছে করা চটুল উক্তি নয়,সময় নিয়ে গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা প্রবন্ধেরই উদ্ধৃতি এগুলো। রবীন্দ্রনাথের এ ধরণের বিশ্লেষণ আমাদের অবাক করে, সেই সাথে করে বিমর্ষ। প্রথাবিরোধী লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘নারী’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, যাকে মনে করা হয় নিজের সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রসর, আসলে পিছিয়ে ছিলেন নিজের সময়ের থেকে হাজার বছর’[39]।
নারীদের কবিগুরু ভালবাসেননি তা নয়, কিন্তু মল্লিকা সেনগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, ‘নারীকে ভালবাসতে গিয়ে নারীর সর্বনাশটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই করে গেছেন’[40]। রবীন্দ্রনাথ নারীদের মূলত দেখেছেন প্রেয়সী হিসেবে, তাঁর কাজের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে। কিংবা জননী হিসেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি রচনায় নারীদের জাত বিচার করেছিলেন এভাবে – ‘মেয়েরা দুই জাতের, কোন কোন পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্রধানত মা, আর-এক জাত প্রিয়া’। হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথের এহেন নারী ভাবনার সমালোচনা করে লেখেন, ‘কোন কোন পণ্ডিতের কাছে এটা শোনার তাঁর দরকার ছিলো না, এটা তাঁর নিজেরই কথা। একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি এ কথা প্রমাণ করার জন্যই’[41]। ড. আজাদ ভুল কিছু বলেননি। রবিঠাকুরের ‘দুই বোন’ উপন্যাসের শুরুতেই এই ভাবনার সন্ধান মেলে। সন্ধান মেলে তাঁর অনেক বিখ্যাত কবিতাতেও। যেমন ‘মানসী’ কবিতায় রবি ঠাকুর লিখেছিলেন –
রবীন্দ্রসাহিত্যে নারী চরিত্র চিত্রায়নে ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়। তাঁর এমনি একটি ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি হল কাব্য নাটক ‘চিত্রাঙ্গদা’। ১৮৯২ সালের দিকে প্রকাশিত এ কাব্যনাটকের কাহিনী কবিগুরু চয়ন করেছিলেন মহাভারত থেকে। নাটকের মূল চরিত্র চিত্রাঙ্গদা ছিলেন মণিপুররাজ চিত্রভানুর কন্যা। কিন্তু রাজা তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন পুত্রের মতো। তাঁকে শিখিয়েছিলেন ধনুর্বিদ্যা। শিখিয়েছিলেন রাজনীতি। চিত্রাঙ্গদা এক ভিন্ন জাতের নারী। জন্ম থেকেই; চিত্রাঙ্গদার জন্ম সত্যই ছিল বিস্ময়কর। মণিপুররাজ চিত্রভানুর পূর্বপুরুষ রাজা প্রভঞ্জন তপস্যা করে এক সময় মহাদেবের বর পেয়েছিলেন যে, এই বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। কিন্তু সে বর নস্যাৎ করেই ধরাধামে জন্ম নিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা :
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গেও প্রায় একই ধরণের পন্থা অবলম্বন করেছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনার সরাসরি বিরোধিতা ওকাম্পোর রচনায় আমরা লক্ষ্য না করলেও, তিনি যে আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনার নারী’ থেকে অনেকটাই পৃথক ছিলেন, তা বহুভাবেই জানান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন নারীবাদকে ‘কোলাহল’ বলে অভিহিত করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন মেয়েদের ‘নাকি সুরে ক্রন্দন’ হিসেবে, সেখানে ‘তেস্তিমোনিয়োস্’ গ্রন্থের দশম খণ্ডে পরিষ্কার করেই ওকাম্পো লিখেছিলেন, ‘আমি বরাবরই ফেমিনিস্ট ছিলাম, এখনো আছি। পঞ্চাশ বছর ধরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছি এমন এক অবস্থাকে (পুরুষতন্ত্র), যা টিকে থাকতে পারে না’। আরেক জায়গায় ওকাম্পো বলেন – ‘আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা – কোনদিন আমি হয়তো একজন নারী লেখকের প্রতিভূ হিসেবেই লিখব। আমাকে যদি কেউ একটি আলাদীনের চেরাগ এনে দেয় আর যদি সেটা ঘষা দিয়ে দেখি আমি শেকসপিয়ার, দান্তে, গ্যোতে, কার্ভান্তেস কিংবা দস্তয়েভস্কির মতো লিখতে পারছি, আমি সোজা সেই চেরাগটি ছুঁড়ে ফেলে দিব। একজন সত্যিকার নারী লেখক কখনো পুরুষের কণ্ঠে কথা বলতে পারে না, তাঁকে নারীর চিন্তা, ব্যথা বেদনার সাথে সম্পৃক্ত হতে হয়। … আর একজন নারী তখনই সফল লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন, যখন তিনি (পুরুষতান্ত্রিক) সমাজের আক্রমণের শিকার হন।’[53] ডরিস মায়ার ওকাম্পোকে নিয়ে যে বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থটি লিখেছেন তাতে রবিঠাকুরের ‘অ্যান্টি-ফেমিনিস্ট’ স্ট্যান্ড এর কিছু মৃদু সমালোচনা আছে। মায়ার বলেন, সাহিত্যিক অর্তেগা ই গাসেত্-এর মতো অতিমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা (পুরুষ = সৃজনীশক্তি, নারী = আবেগ) দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ প্রভাবিত না হলেও রবীন্দ্রনাথ সনাতন পুরুষদের মতোই মনে করতেন নারীর স্থান গৃহে বা তার কাছাকাছি[54]। কেতকী কুশারী ডাইসন অনুমান করেছেন, ওকাম্পোই সেই সূত্রগুলো মায়ারকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরো মনে করেন, ‘কবির প্রৌঢ় বয়সের সৃজনকর্মে প্রেরণা জোগানো ছাড়াও নারীবিষয়ক চিন্তনের ক্ষেত্রে তাঁর বিবর্তনকে সূক্ষ্মভাবে খানিকটা প্রভাবিত করেছিলেন ভিক্তোরিয়া’[55]। হয়তো কেতকীর অনুমান মিথ্যে নয়। যে কবিগুরু একটা সময় নারীদের মধ্যে কেবল জায়া আর জননী খুঁজতেন, ‘প্রকৃতির’ দোহাই দিয়ে মেয়েদের গৃহবন্দি রাখার উপদেশ দিতেন, সে কবিই ওকাম্পোর সাথে দেখা হবার চার বছরের মাথায় (১৯২৮ সালে) আঁকলেন এক সবলা নারীর প্রতিচ্ছবি –
রবীন্দ্রনাথের শেষ দিককার অমর প্রেমের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’য় আগমন ঘটে জ্ঞানী, গুণী, বিদুষী এবং প্রথাভাঙা এক বলিষ্ঠ নারীর। লাবণ্য। অমিতের জীবনে ‘ঘড়ার জল’ হবার চাইতে ‘দীঘি’ হিসেবে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো তাঁর। আমরা জানি রবিঠাকুরের শত আমন্ত্রণ সত্ত্বেও ভারতবর্ষে আসেননি ওকাম্পো। আসেননি শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর সাথে দিনযাপন করতে। হয়তো, রবি ঠাকুরের জীবনে ‘ঘড়ার জল’ হয়ে থাকার চাইতে প্লাতা নদীর মতোই বহমান থাকতে চেয়েছেন তিনি। লাবণ্য-অমিতের বিদায় বেলায় যে বিখ্যাত লাইনগুলো শেষের কবিতায় সন্নিবেশিত হয়েছে – ‘হে ঐশ্বর্যবান / তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান / গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’ -এর সাথে মিল পাওয়া যায় ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির। ওকাম্পো সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন[56], ‘All I received from you has made me so rich in love that the more I spend, the more I have to give. And all I give comes from yourself…. So I feel I am giving nothing.’। স্বভাবতই, ১৯২৮ সালে বাঙ্গালোরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বাংলোয় বসে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি সমাপ্তির প্রাক্কালে রানী মহলানবিশের এক প্রশ্নের উত্তরে কবিগুরু বলেছিলেন, লাবণ্য তাঁর খুব চেনা চরিত্র – ‘লাবণ্যর সঙ্গে যেন আমার চেনাশোনা আছে, খুব যেন কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি’।
প্রায় জীবন-সায়াহ্নে এসে, ১৯৩৬ সালের অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মী সম্মেলনে পড়েছিলেন ঐতিহাসিক ‘নারী’ প্রবন্ধটি। নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের আমন্ত্রণে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এবং পাঠ করেছিলেন তাঁদের সমাবেশে। সে প্রবন্ধটিতেও অবশ্য নারীকে গতানুগতিক ভাবে ‘পুরাতনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, দেখানো করা হয় ‘আদ্যাশক্তি’ হিসেবে, নারীকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয় যে নারী ‘জীবলোকে প্রাণকে বহন করে’, ‘প্রাণকে পোষণ’ করে ইত্যাদি, কিন্তু পাশাপাশি দেখা যায় এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে যে রবীন্দ্রনাথ পিতৃতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠে নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নিতে পেরেছেন:
হয়তো, তাঁর শেষ বয়সে লেডি রাণু, কিংবা ওকাম্পোর মতো মেধাবী নারীরা, আর নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের উদ্দীপনায় ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন নারীদের নিয়ে তাঁর সনাতন সংস্কার, হুমায়ুন আজাদের ভাষায়- তাঁর ‘আযৌবন প্রগতিবিরোধিতা’। হুমায়ুন আজাদ হয়তো যথার্থই বলেছেন, ‘সুখকর হচ্ছে যে পঁচাত্তর বছর বয়সে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, এবং আরো সুখকর হচ্ছে যে নারীরাই রূপান্তরিত করেছিল তাঁকে’।
এর একটা বড় কারণ নিহিত রয়েছে জীববিজ্ঞানে। জৈবিকভাবে একটি মেয়ের প্রজনন ক্ষমতা বিশ বছর বয়সের পর দ্রুত কমতে শুরু করে। চল্লিশের পর সেটা নিম্নমুখী হয়ে যায়, আর পঞ্চাশের পর সেটা চলে যায় শূন্যের কোঠায়। অন্য দিকে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা নারীদের মত এত দ্রুত হারে কমে না। একজন পঞ্চাশ / ষাট বছরের ব্যক্তি খুব সফলভাবেই প্রজননক্ষম থাকেন। এই কারণেই পুরুষদের সারা পৃথিবীতেই প্রবণতা হচ্ছে নিজেদের বয়সের চেয়ে ছোট বয়সী মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে চয়ন করা। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, নিজেদের পৃথিবীতে সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা গড়পড়তা দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে, কিন্তু পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুণ্য এবং সৌন্দর্য। স্ত্রীর কাছ থেকে যথাসম্ভব তারুণ্য আদায় এবং তা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়েই গড়পড়তা ছেলেরা তাদের চেয়ে কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়, সেটা যতই অস্বস্তিকর লাগুক না কেন শোনাতে।
পুরুষেরা যেমন তাদের মেটিং পার্টনার হিসেবে তাদের চেয়ে একটু কম বয়সী নারীকে বিয়ের জন্য নির্বাচন করে, ঠিক তেমনি, নারীরাও তাদের চেয়ে একটু বেশি বয়সী পুরুষকে পাত্র হিসেবে অধিকতর যোগ্য মনে করে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় মেয়েরাও গড়পড়তা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া আর বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ কিংবা স্ট্যাটাস। সাধারণত যে কোন সমাজেই দেখা যায়, বয়সের সাথে সাথে পুরুষের আয় রোজগার ক্রমশ বাড়তে থাকে। আমি আমেরিকার যেখানে থাকি, সেখানে একজন ত্রিশ বছরের যুবক একজন বিশ বছরের যুবকের চেয়ে গড়পড়তা চোদ্দ হাজার ডলার বেশি রোজগার করে। কেবল আমেরিকা নয়, অধ্যাপক বাস ছয়টি মহাদেশ এবং পাঁচটি দ্বীপপুঞ্জের ৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জনের উপাত্ত সংগ্রহ করে উপর সমীক্ষা চালিয়েছেন – একেবারে আলাস্কা থেকে শুরু করে সেই জুলুল্যান্ড পর্যন্ত। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই দেখা গেছে, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আর্থিক প্রতিপত্তিকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে । জাপানে এই ‘চাহিদা’ সবচেয়ে বেশী দেখতে পাওয়া যায় আর হল্যান্ডে সবচেয়ে কম – কিন্তু তারপরেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারী-পুরুষের চাহিদার স্বরূপের প্যাটার্নটি একই রকমই থাকে। বিবর্তনীয় পথের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পুরুষেরা সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে আর বাইরে কাজ করে রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করেছে, সে কারণেই হয়তো একটি নারীর কাছে একটি পুরুষের সম্পদ, ভাল চাকরী, খ্যাতি, সামাজিক প্রতিপত্তি প্রভৃতি সচরাচর ‘আকর্ষণীয়’ বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিভাত হয়। সে কারণে এখনো মেয়েরা বিয়ের সময় তাদের চেয়ে বয়সে বড় একটি ছেলের ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হয়।
একটি জায়গায় একটু ব্যতিক্রম পাওয়া গেছে অবশ্য। ‘ছেলেরা তাদের চেয়ে কম বয়সী মেয়ে পছন্দ করে’ – এ ব্যাপারটা পাথরে খোদাই করা কোন নিয়ম নয়। বরং গবেষক কেনরিক এবং তাঁর দলবলের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশব এবং যৌবনের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে ছেলেরা তার বয়সের চেয়ে বেশি বয়সের মেয়েদের প্রতি আগ্রহী হয়[61]। এখানেও খুঁজলে দেখা যাবে রাজত্ব করে সেই জৈববিবর্তনের নিয়মই। একটি ১৫ – ১৬ বছরের ছেলের কাছে নারীর উর্বরাশক্তির নিরিখে ১২-১৪ বছরের নারীর চেয়ে ১৬/১৭ বছরের নারী অধিকতর আকর্ষণীয় বলে প্রতীয়মান হওয়ার কথা। তাই হয়। তাই এই বয়সে ছেলেদের ঝোঁক থাকে তার চেয়ে একটু বেশি বয়সের নারীকে পছন্দ করার, কিন্তু বিশ বছরের পর থেকেই এটা ক্রমশ ঘুরে যেতে শুরু করে, এবং একজন পরিণত বয়সের পুরুষ সঙ্গিনী হিসেবে তার চেয়ে কম বয়সী নারীকেই প্রেয়সী হিসেবে সনাক্ত করেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রণয়-জীবন যেন বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের এই ‘ক্লাসিক ট্রেন্ডের’ সফল মঞ্চায়ন। রবীন্দ্রনাথের বয়সন্ধিকালীন বা এর আগেকার সময়ে কাদম্বরী দেবী, এবং আনা তড়খড় সহ তাঁর পছন্দের নারীদের বয়স ছিল তাঁর চেয়ে বেশি। অথচ বিশ-বাইশ বছর বয়স অতিক্রম করার পরে যে সমস্ত নারীদের নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন, গান লিখেছেন, যে সমস্ত নারীরা হয়েছেন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তাঁর চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ – তারা সবাই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে ছিলেন নবীন। বোঝাই যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারী সৌন্দর্য অনুধাবন এবং অবগাহনের ক্ষেত্রে চিরন্তন বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের ট্রেন্ডকে অতিক্রম করতে পারেননি। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা পুরুষদের সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর প্যাটার্নের হদিস দিয়েছেন। দেখা গেছে, গড়পড়তা পুরুষেরা ত্রিশ বছর বয়সের দিকে কোন নারীকে সঙ্গী হিসেবে চয়ন করলে, তার সাথে সঙ্গিনীর বয়সের ব্যবধান থাকে পাঁচ বছর। কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিরা পাত্রী নির্বাচনকালে সময় পাত্রীর সাথে তার বয়সের ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায় বিশ বছর[62]।
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরুষদের অপেক্ষাকৃত বয়ঃকনিষ্ঠ নারীকে সঙ্গী হিসেবে পাবার ব্যাপারটি পুরুষদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করার সময় অপেক্ষাকৃত সহজভাবে দৃষ্ট হয়। প্রাপ্ত একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, আমেরিকায় পুরুষদের প্রথম বিয়ের সময় পাত্রীর সাথে গড়পড়তা বয়সের ব্যবধান থাকে তিন বছর, দ্বিতীয় বিয়ের সময় পাঁচ বছর, আর তৃতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে তা গিয়ে দাঁড়ায় অন্ততঃ আট থেকে দশ বছর[63]। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী মৃণালিনীকে হারানোর পর রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বিয়ে থা করেননি, কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর যে সমস্ত নারীদের প্রতি তিনি দুর্বল হয়েছিলেন তাঁদের বয়স এবং সৌন্দর্য বিচারে বলা যায় যে, তিনি পুনর্বার বিয়ে করলে হয়তো সেই ধারাতেই সমাপতিত হতেন। বিশেষত তাঁর শেষ জীবনে অর্থাৎ ষাটোর্ধ রবীন্দ্রনাথের মানসপ্রতিমারা – রাণু অধিকারী, রানী মহলানবিশ কিংবা ওকাম্পোর সাথে তাঁর বয়সের ব্যবধান গোনায় ধরলে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্যভাবে আমাদের মনের আঙ্গিনায় হানা দিতে বাধ্য।
রবীন্দ্রনাথকে এমন জৈবিকভাবে উপস্থাপনের ফলে রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞরা হয়তো গোস্যা করতে পারেন। তারা হয়তো বলবেন, সে সমস্ত নারীদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রেম ঠিক সেভাবে শরীর-নির্ভর ছিলো না। ছিলো অনেকটা আধ্যাত্মিক, প্লেটোনিক। এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথের বহু গান ও কবিতাতেই এ ধরণের ‘নিষ্কাম’ প্রেমের সন্ধান মেলে, কিন্তু আবার অনেক জায়গাতেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দেয় শরীরী আবেদন। তাঁর ‘চুম্বন’ ‘স্তন’ , ‘বিজয়িনী’, ‘বিবসনা’, ‘বলাকা-১৪’, ‘মানস সুন্দরী’, ‘হৃদয়-আসন’, ‘শেষ চুম্বন’ কিংবা ‘দেহের মিলন’-এর মতো কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ ভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। আসলে ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে যৌনতার আনয়নে, শরীরের উপস্থাপনায় কুণ্ঠিত এবং সম্ভোগ-বিমুখ’ – এমন একটি মিথ যে জনমানসে প্রচলিত, তার ব্যবচ্ছেদ করেছেন ইমন ভট্টাচার্য তাঁর সাম্প্রতিক ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে যৌনতা: একটি কিংবদন্তীর পুনর্বিচার’ শীর্ষক প্রবন্ধে[64]। রবীন্দ্র-সাহিত্য সিঞ্চন করে বিশেষতঃ গল্প, কবিতা এবং নাটক থেকে অজস্র উপকরণ তুলে এনে লেখক দেখিয়েছেন,’রবীন্দ্রনাথ যৌনতার বর্ণনায় কুণ্ঠিত ছিলেন না আদৌ। বরং রবীন্দ্রসাহিত্যই সেই ক্ষেত্র যেখানে যৌনতা এতো বিচিত্র রঙে, বিচিত্র মাত্রায় বর্ণিত হয়েছে’। এমন নয় যে, যৌনতার এই ‘বিচিত্র রঙ’ কেবল সাহিত্য কীর্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯২৪ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথকে লেখা রাণু অধিকারীর অন্ততঃ একটি চিঠিতে উল্লেখ আছে যে, একদিন ‘ভানুদাদার সমস্ত আদর’ তিনি পেয়েছিলেন, এবং সে আদর রাণুর ‘মনকে ভরে দিয়েছিল’। সেই চিঠিতে রাণু এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে তিনি আর কখনো কাউকেই বিয়ে করবেন না, কারণ ‘রবীন্দ্রনাথের সাথে তো তাঁর বিয়ে হয়েই গেছে’। ব্যাপারটা ‘ভানুদাদা হয়তো মানবেন না’, কিন্তু রাণু সেটা মানেন[65]। এ ধরণের কিছু ঘটনা কেবল রাণুর ক্ষেত্রেই নয়, আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর গৃহে থাকাকালীন সময়েও ঘটেছিল। এমন একটি ঘটনার উল্লেখ ওকাম্পোর স্মৃতিকথার ফরাসি ভাষ্য (আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত ফরাসি খসড়া) থেকে সরাসরি ইংরেজি অনুবাদ কেতকী কুশারী ডাইসন করেছেন ‘ইন ইয়র ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ বইয়ে[66] :
চিত্র: ওকাম্পোর আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত ফরাসি খসড়ার অনুবাদ যা কেতকী কুশারী ডাইসন লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ (১৯৮৮) বইয়ে। এই নথি থেকে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পো সম্পর্কের এমন একটি দিকের সন্ধান পাওয়া যায় যা তাঁদের মধ্যকার কথিত ‘প্লেটোনিক প্রেমের’ ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কোন এক রহস্যময় কারণে কেতকীর বাংলা বইটিতে (বইটির চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে গেছে) এর উল্লেখ নেই, তবে সম্প্রতি প্রকাশিত সমীর সেনগুপ্তের ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে ওকাম্পোর ডায়েরির বাংলা অনুবাদ সংযুক্ত হয়েছে এভাবে[67]:
বিবর্তন মনোবিজ্ঞান কেবল নারীর পুরুষের বয়সের কথাই বলে তা নয়। বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের কাজে। মানব সমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তিই মোটাদাগে সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের ফল তা অনেক বিজ্ঞানীই আজ মনে করেন[69]। প্রতিভার ব্যাপারটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ যে একজন প্রতিভাধর কবি ছিলেন তাতে কেউই সন্দেহ করবেন না। কেবল নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই নয়, কবিতা গল্প, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প থেকে শুরু করে চিত্রকলা – সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি কলার সর্বত্র তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ সত্যই অনন্য। তাঁর একক অবদানেই বলা যায়, তিনি বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছিয়ে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সত্তর বছরেরও বেশি হল তিনি তিরোহিত হয়েছেন, কিন্তু আজও তিনি প্রবল ভাবেই প্রাসঙ্গিক এবং ততোধিক উজ্জ্বলভাবে দীপ্যমান। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দেখতে শুনতে সুদর্শন এবং সেই সাথে অসম্ভব প্রতিভাধর। যৌবনে তো বহু নারীর হৃদয় হরণ করেছিলেনই, এমনকি শেষ বয়সেও তাঁর খ্যাতি, যশ এবং প্রতিভার জৌলুসে অনেক তরুণের চেয়ে ঢের বেশি পূর্ণযৌবনা নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন, জাগাতে পারতেন অহর্নিশি তাঁদের হৃদয়ে দোলা -‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে,দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়’। ‘লা নুই বেঙ্গলি’ পড়ে আমরা দেখেছি ষোল সতের বছরের মৈত্রেয়ী দেবী প্রায় সত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, খাতা জুড়ে পাতার পর পাতা রবীন্দ্রনাথের নাম লিখতেন। মৈত্রেয়ীর প্রেমিক মির্চা এলিয়াদকে ব্যাপারটা এতোটাই পরশ্রীকাতর এবং উদভ্রান্ত করে তুলেছিল যে, উপন্যাসের নায়ক অ্যালেনের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘[Tagore, that] … disgusting old charlatan! Corrupter of young girls’। এমনকি একটা সময় মৈত্রেয়ী কাউকে বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছিল। এমন একটা ফ্যান্টাসির জগত আরেক কিশোরী রাণু অধিকারীর মধ্যেও আমরা দেখতে পাই। কৈশোরে রাণু ভেবেছিলো ‘পাখি আমার নীড়ের পাখি’ বুঝি তাঁকে নিয়েই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; একটা সময় রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার জ্যোতিতে বিভ্রান্ত হয়ে তাঁকে ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ বানিয়ে বিয়ে থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন রাণু। এহেন প্রতিভার ধাক্কা কেবল মৈত্রেয়ী বা রাণু নয়, ওকাম্পোর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল, নির্দ্বিধায় বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের অমর কীর্তি গীতাঞ্জলি পড়েই ওকাম্পো যে প্রাথমিকভাবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা আমরা জানি। কিন্তু বিপরীতটিও কি সত্য নয়? সেই শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি কম নারী রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসেনি। কিন্তু জ্ঞানে, গুণে, ব্যক্তিত্বে, সৌন্দর্যে এবং কর্মস্পৃহায় বোধ করি ওকাম্পো ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম। একে তো সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, অর্তেগা তাঁকে ডাকতেন ‘La Gioconda del sur’ বা ‘দক্ষিণের মোনালিসা’ বলে; আর মননে এবং প্রজ্ঞাতেও ছিলেন সে অঞ্চলের নারীদের থেকে অগ্রগামী। সেই ১৯২০ সাল থেকেই ‘লা নেসিয়ন’-এর মতো পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। সারা জীবনে লিখেছেন ২৫টির মতো বই। তাঁর অনূদিত লেখকের তালিকায় আছেন কামু, টি ই লরেন্স, ফকনার, ডিলান টমাস, গ্রাহাম গ্রিন, জন অসবোর্ন সহ অনেকেই। ১৯৩১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৪০ বছর ‘সুর’ (Sur) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি, যে পত্রিকাটিতে ক্রমাগতভাবে লিখেছেন হর্হে লুইস বর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জ্যাক মারিত্যাঁ, পল ক্লোদেল, অল্ডাস হাক্সলি, সিমোন ওয়াইল, লিউইস মামফোর্ড, আঁদ্রে জিদ, মার্টিন হাইডেগার, এজরা পাউন্ড, ইভলিন ওয়, লরেন্স ডারেল, জাঁ পিয়াজে, আঁদ্রে ব্রেত, অক্টাভিয়ো পাজের মতো লেখক লেখিকারা। তিনি ছিলেন স্পষ্টবক্তা। নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। তাঁর কাছের মার্কসবাদী বন্ধুবান্ধবদের অনেকে তখন ভাবতেন নারীস্বাধীনতা আর নারীমুক্তি নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করার কিছু নেই। অর্থনৈতিক সাম্য এবং কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হলে নারীমুক্তি এমনিতেই ঘটে যাবে। ওকাম্পো তা মেনে নেননি। তিনি এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না … আগে দুনিয়ার মেয়েদের অবস্থা পাল্টাতে হবে, তারপর তা থেকেই অন্য পরিবর্তনগুলো আসবে; উল্টোটা নয়’। তাঁর এহেন কথাবার্তা আর কাজকর্মের জন্য ডান, বাম, ক্যাথলিক চার্চ সবার দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিলির নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা এক সময় ওকাম্পোকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, অবশ্য সেই নেরুদাই আবার ষাটের দশকে মত বদলে ওকাম্পোর প্রশংসা করেছেন। একবার এক চার্চসংস্থা ওকাম্পোর আগমন এবং বক্তৃতা নিষিদ্ধ করেছিল, তাদের মূল অভিযোগ ছিল ওকাম্পোর বাসায় রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় প্রদান এবং কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লেখক আঁদ্রে মালরোর[70] লেখা তাঁর পত্রিকায় ছাপানোর। অঢেল ধনসম্পদের মধ্যে জন্মানোর কারণে ‘বিদেশভক্ত বুর্জোয়া’ খেতাব যেমন পেতে হয়েছে, ঠিক তেমনি পত্রিকায় ভিন্নধর্মী এবং ভিন্নমতের প্রবন্ধ ছাপানোর কারণে ‘কমিউনিস্ট’, ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘নাৎসি’ প্রভৃতি বলে গালমন্দও শুনতে হয়েছে এন্তার। আর্জেন্টিনার পেরন সরকারের (১৯৪৬-১৯৫৫) আমলে তাঁকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৫৩ সালের ৮ই মে তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী মুক্তমত প্রচার এবং প্রকাশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে থাকতে হয়েছিল ছাব্বিশ দিন। অবশ্য কোন কোন মহল থেকে আক্রান্ত যেমন হয়েছেন, তেমনি প্রশংসাও পেয়েছেন অফুরন্ত। যেমন, স্প্যানিশ সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক হর্হে লুইস বর্হেস ওকাম্পো সম্বন্ধে বলেছিলেন,
আমি এবার আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময় লাইব্রেরি এবং রাস্তাঘাটের দোকানের বইপত্তর দেখে নিশ্চিত হয়েছি যে আর্জেন্টিনার প্রথম দশজন প্রথিতযশা সাহিত্যিকের একজন হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভ্রমণের সময় যে ট্র্যাভেল গাইডটি নিত্যসঙ্গী হিসেবে সার্বক্ষণিকভাবে আমার সাথে ছিল সেটা আজ খুলে দেখলাম তাতে হর্হে লুইস বর্হেস, আদোলফো বিয়য় ক্যসেরাসের পরেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম উল্লিখিত হয়েছে[72]:
এই আরাম কেদারাটিকে শান্তিনিকেতনে এনে নিজের শয্যাপাশে স্থান দিয়েছিলেন রবিঠাকুর। তিনি সেই চেয়ারটিতে বসতেন, আর ওকাম্পোকে স্মরণ করতেন। ১৯২৫ সালের ৫ই জানুয়ারিতে লেখা একটি চিঠিতে রবিঠাকুর ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, ‘আমার দিন আর রাতগুলোর একটা বড় অংশ কাটে তোমার চেয়ারে ডোবা অবস্থায়, যে চেয়ারটি আমাকে অবশেষে বুঝিয়ে দিয়েছে তোমার পড়ে শোনানো বোদলেয়রের সেই কবিতাটির লিরিক তাৎপর্য’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, মৃত্যুর আগে পুত্রবধূকে প্রায়ই বলতেন ভিক্টোরিয়ার গল্প[74]। আরাম কেদারায় বসে ভাবতেন, লিখতেন ভালবাসার কবিতা। মৃত্যুর ঠিক চারমাস আগে, ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে কবিগুরু ‘বিদেশের ভালবাসা দিয়ে, যে প্রেয়সী পেতেছে আসন’ এর কথা স্মরণ করে লিখলেন[75]:
১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছরের বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য জাহাজে উঠলেও মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় তাঁকে[2]। সেখানেই পরিচয় হয় ওকাম্পোর সাথে রবি ঠাকুরের। রবি ঠাকুর আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের এক হোটেলে (প্লাসা হোটেল) ছিলেন তাঁর সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে। সেখানেই একদিন হাজির হন ওকাম্পো। অবশ্য এমনি এমনি রবাহূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের হোটেলে হানা দেননি তিনি। তাঁর রবীন্দ্র-দর্শনের ইচ্ছার পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আসলে প্রথম থেকেই রবীন্দ্র সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথ ততদিনে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। একাধিক ভাষায় লিখন এবং পঠনে পারদর্শী ওকাম্পো ইতোমধ্যেই গীতাঞ্জলি পড়ে ফেলেছেন ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায়। তার মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলির অনুবাদটিই ছিল তাঁর প্রিয়[3]। গীতাঞ্জলি পড়ে শিহরিত হন ওকাম্পো। তাঁর নিজের ভাষ্যেই[4] –
‘[তখন] আমার গান শেখার সময়। মাদাম ‘র’ তখনো এসে পৌঁছাননি। ধূসর রেশমে আস্তীর্ণ স্বপ্নালোকিত একটি ঘরে পিয়ানোর গায়ে হেলান দিয়ে কবিতাগুলো পড়ছি। শীতকাল। বুয়েনোস আইরেসের রাস্তাঘাটের হট্টগোল আমাকে অনুসরণ করে এসেছে, আপাতত চাপা পড়ে গেছে বদ্ধ জানালা আর পর্দার আবরণে। পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে আমার যৌবনও:রবীন্দ্রনাথের কবিতার রীতিমত ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এই সময়টাতে ওকাম্পোর নিজের বৈবাহিক জীবনেও চলছিল নানা টানাপড়েন। তাঁর সদ্য বিবাহিত স্বামী মনেকো এস্ত্রাদার সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গনের পথে, এর মধ্যে স্বামীর এক কাজিন জুলিয়েন মার্টিনেজের সাথে গড়ে উঠেছে ‘সমাজ অস্বীকৃত’ এক ধরণের অবৈধ প্রেমের এক সম্পর্ক। ঠিক এই সময়টাতেই [১৯১৪] রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি নিয়ে এলেন তাঁর জীবনে। হয়তো গীতাঞ্জলির আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো তাঁর টালমাটাল জীবনে কিছুটা শান্তির পরশ বুলিয়ে যেতে পেরেছিল সে সময়। ওকাম্পো বুঁদ হয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথের লেখায় পরবর্তী কয়েক বছর। ফরাসি ঔপন্যাসিক প্রুস্তের রচনার সাথে তুলনামূলক আলোচনা করে একটি অসামান্য লেখাও তিনি লিখে ফেলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ শিরোনামে[5]।
আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই-কাঁদতে লাগলাম। পড়তে লাগলাম। মাদাম ‘র’ এলেন এবং বিচলিত হয়ে শুধালেন: “কী হয়েছে?” কী করে বোঝাই, হয়নি যে কিছুই … অথচ …”
যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই।
আমার ঘরেতে নাথ, এইটুকু স্থান-
সেথা হতে যা হারায় মেলে না সন্ধান।
অনন্ত তোমার গৃহ, বিশ্বময় ধাম,
হে নাথ, খুঁজিতে তারে সেথা আসিলাম।
দাঁড়ালেম তব সন্ধ্যা-গগনের তলে,
চাহিলাম তোমা-পানে নয়নের জলে।
কোনো মুখ, কোনো সুখ, আশাতৃষা কোনো
যেথা হতে হারাইতে পারে না কখনো,
সেথায় এনেছি মোর পীড়িত এ হিয়া-
দাও তারে, দাও তারে, দাও ডুবাইয়া।
ঘরে মোর নাহি আর যে অমৃতরস
বিশ্ব-মাঝে পাই সেই হারানো পরশ।
তারপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত সাক্ষাতের কাল, সে প্রায় ‘গীতাঞ্জলির ধাক্কার’ বছর দশেক পরে। দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের নভেম্বরের একটি দিন। পেরুর যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথ বুয়েনোস আইরেসের প্লাজা হোটেলে আছেন জেনে তাঁর ‘গুরুদেব’কে এক ঝলক দেখতে এসেছিলেন ওকাম্পো। হোটেলে এসেই সামনে পেলেন রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টকে। ওকাম্পোর সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে এলমহার্স্ট তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়ে চলে গেলেন। রবি ঠাকুরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটি ভিক্টোরিয়ার লেখায় উঠে এসেছে ঠিক এভাবে[6] –
‘… প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। … তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নীচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে ওপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা।…’।এসেছিলেন কেবল এক ঝলক দেখবার জন্য; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে অনেকটা জোর করেই তাঁকে হোটেল থেকে তুলে নেন ওকাম্পো, থাকার বন্দোবস্ত করলেন তাঁর এক আত্মীয়ের (ভাড়া করা) বাসায় । বাড়িটির নাম ‘মিরালরিও’। সত্তরের দশকে জ্যোতির্ময় মৌলিক এ বাড়িটিকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায় – ‘বিজয়ার করকমলে’ (আমার এ লেখাটিরও একই শিরোনাম রাখা হয়েছে)। লেখাটিতে শ্রীমৌলিক ‘মিরালরিও’ শব্দটির অর্থ করেছিলেন ‘স্রোতস্বিনীকে দেখা’[7] : ‘একটি উঁচু মালভূমির উপর বাসাটি অবস্থিত। এর সামনে আর পেছনে বিশাল প্রাঙ্গণ। সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া এ প্রাঙ্গণটির সৌন্দর্য ছিল অবর্ণনীয়। বাড়ি থেকে উত্তর দিকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই দেখতে পাওয়া যায় তটরেখা-বিহীন বিশাল নদী ‘প্লাতা’। প্লাতা শব্দটির অর্থ রূপা’। রবীন্দ্রনাথ সেই ‘প্লাতা নদীর ধারের’ বাসাটিতে কাটিয়েছিলেন ঘটনাবহুল প্রায় তিন মাস। রবীন্দ্রনাথ যেদিন (১২ই নভেম্বর[8]) ওকাম্পোর সঙ্গে তাঁর জন্য নির্ধারিত বাসাটিতে পৌঁছান, সে দিনটি ছিল এমনিতেই একটু অন্যরকম। ওকাম্পোর ভাষ্যমতে[9] –
‘সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই হলুদ হয়ে আসছিল, আর বিশাল ঘন কালো মেঘ। এমন ভয়ঙ্কর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র ভাস্বর – কখনো এমন দেখিনি। আকাশ কোথাও সীসার মতন ধূসর, কোথাও মুক্তার মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ, আর এতেই আরো তীব্র হয়ে উঠেছে নদীতট, আর তরুশ্রেনীর সবুজ আভা। ঊর্ধ্ব আকাশে যা ঘটেছিল, জলের মধ্যে তাই ফলিয়ে তুলেছিল নদী। কবির ঘরের বারান্দা থেকে দেখছিলাম এই আকাশ, নদী, বসন্তের সাজে ভরা প্রান্তর। বালুচরের উইলো গাছগুলি খেলা করছিল ছোট ছোট হাজারো নম্র পাতায়।এই অলিন্দ যেন হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের নিজেরই অলিন্দ। নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির কটি দিন জুড়ে সে অলিন্দে তিনি দেখেছিলেন ‘গোলাপি কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা বিকেলগুলি’ আর ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর প্রত্যাশিত ‘মন্থর মুহূর্তগুলো’[10]:
ঘরে ঢুকতেই ওঁকে নিয়ে এলাম অলিন্দে, বললাম: নদীটি দেখতেই হবে। সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে দৃশ্যটাকে করে তুলল পরম রমণীয়। আলোর পাড়ে বোনা প্রবল মেঘপুঞ্জের অন্তরালে কে যেন প্রতিফলক সাজিয়ে ধরেছে আকাশে’।
‘যেন আমি আলোকের নিঃশব্দ নির্ঝরেবলতে দ্বিধা নেই, প্লাতা নদীর তীরে এ বিখ্যাত বাড়িতেই হয়তো রচিত হয়েছিল ওকাম্পো আর রবিঠাকুরের মাঝে সেই ‘রহস্যময় প্রেমের’ নান্দনিক উপাখ্যানগুলো। মিরালরিওর বাসায় যেদিন কবিগুরু পৌঁছিয়েছিলেন সেদিনই রচনা করছিলেন ‘পূরবী’র অন্তর্গত বিখ্যাত ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি[11] –
মন্থর মুহূর্তগুলি ভাসায় দিতেছি লীলাভরে’।
এর তিন দিন পরে অর্থাৎ ১৫ই নভেম্বর কবিগুরু লিখলেন ‘অতিথি’ কবিতাটি। ১৬ই নভেম্বর ‘অন্তর্হিতা’, ১৭ তারিখে ‘আশঙ্কা’, ২১ তারিখে ‘শেষ বসন্ত’। এ সমস্ত কবিতায় প্রেমময় অভিব্যক্তি এতোই বেশি ছিল রবীন্দ্রনাথ নিজে পর্যন্ত বিব্রত হয়ে গিয়েছিলেন – এ কবিতাগুলো দেশে (তাঁর পুত্র এবং পুত্রবধূদের কাছে) পাঠানো উচিৎ হবে কিনা ভেবে। এলমহার্স্টকে বললেন, ‘বেশি কিছু তো বলা যাবে না। ওরা খুব বিচলিত হয়ে পড়বে। আমার এই-সব কবিতার কোন মানে করতে পারবে না ওরা। ওদেরকে পাঠিয়ে দাও চিঠিগুলো আর খবরের কাগজের কাটিং গুলো, কিন্তু কবিতাগুলো পাঠিয়ো না’। তাঁর চোখে খেলা করে যাওয়া ‘দুষ্টু ঝিলিক’ আর ‘হাসির বন্যা’ এলমহার্স্টের নজর এড়ায়নি[12]।হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম—‘কী তোমার নাম’,হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরেনামেতে কী হবে।আর কিছু নয়,হাসিতে তোমার পরিচয়।হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরেশুধালেম ‘বলো বলো মোরেকোথা তুমি থাকো’,হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’।বুঝিলাম তবেশুনিয়া কী হবেথাকো কোন্ দেশে।যে তোমারে বোঝে ভালোবেসেতাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,আর কোথা নাই।…হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে শুধাই ‘বলো দেখিমোরে ভুলিবে কি’,হাসিয়া দুলাও মাথা; জানি জানি মোরে ক্ষণে ক্ষণেপড়িবে যে মনে।দুই দিন পরেচলে যাব দেশান্তরে,তখন দূরের টানে স্বপ্নে আমি হব তব চেনা—মোরে ভুলিবে না।
ওকাম্পোর বাড়িটি নিয়ে কিছু বলা যাক। ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মিরালরিওর যে বাসাটিতে এনে তুলেছিলেন, সেটি বুয়েনোস আইরেস থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সান ইসিদ্রোতে। তবে আজকে কেউ সেখানে গেলে ওকাম্পোর সাথে সম্পর্কিত কোন বাড়ি বলে চিনবেন না। এক ইউরোপনিবাসী দম্পতির ব্যক্তিগত বাড়ি হিসবেই এটি পরিচিত এখন। তবে মিরালরিও নামের এ বাড়িটির ক’ ব্লক পরেই একটি বাড়ি আছে, সেটিই আজ পরিচিত ‘ওকাম্পোর বাড়ি’ হিসেবে; নাম ‘ভিলা ওকাম্পো’। এ বছর (২০১৪) বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন সময়ে সপরিবারে আর্জেন্টিনা এবং পেরু ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ভ্রমণের এক ফাঁকে ওকাম্পোর এ বাড়িটি দেখার যে সৌভাগ্য আমার হল তা অনেকটা তীর্থস্থান ভ্রমণের সাথে তুলনীয় যেন। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই বিখ্যাত ‘ভিলা ওকাম্পো’তে। বাড়িটি আসলে এক সময় ছিল ওকাম্পোর বাবার।
চিত্র:
ওকাম্পো বই পড়তে ভালবাসতেন। ভিলা-ওকাম্পোর লাইব্রেরির একাংশ – বাড়িটির
গ্রন্থাগারে প্রায় ১২ হাজারের বেশি স্প্যানিশ, ইংরেজি আর ফরাসি বই আছে।
প্রকৌশলী ভদ্রলোকের নিজের নকশাতেই তৈরি হয়েছিল বাড়িটি। পরে অবশ্য
ওকাম্পো বাড়িটিকে উত্তরাধিকারসূত্রে পান, আর সেখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস
শুরু করেন। বাড়িটির গ্রন্থাগারে প্রায় ১২ হাজারের বেশি স্প্যানিশ, ইংরেজি
আর ফরাসি বই আছে। সেই সঙ্গে আছে ‘সুর’ পত্রিকার পুরনো সব সংখ্যা। আরও আছে
ভিক্টোরিয়ার লেখা পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র ইত্যাদি। ‘ভিলা ওকাম্পো’ একটা সময়
ছিল দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণীজনের চারণ ক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও এ
বাড়িতে বিভিন্ন সময় আপ্যায়িত হয়ে এসেছিলেন ইগোর স্ত্রাভিনস্কি, গ্রাহাম
গ্রীন, ফেড্রেরিকো গার্সিয়া লোরকা, আঁদ্রে ম্যালরাস, হর্হে লুইস বর্হেস,
অ্যাদেলফো বিয়য় ক্যাসেরাস, আলবেয়ার কামু, কাইজারলিঙ, অক্টাভিয়ো পাজ,
ইন্দিরা গান্ধীসহ বহু গুণীজন। বাড়িটি ১৯৭৩ সাল থেকে ইউনেস্কোর সম্পত্তি।
তাই দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। মেয়ের সাথে ‘ভিলা ওকাম্পো’ ভ্রমণ সত্যই
নান্দনিক একটা অভিজ্ঞতা।
চিত্র: ‘ভিলা ওকাম্পো’ একটা সময় ছিল দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণীজনের চারণ ক্ষেত্র। এ বাড়িতে বিভিন্ন সময় আপ্যায়িত হয়ে এসেছিলেন বহু গুণীজন।
তবে বাড়ি দেখে, এবং ওকাম্পোর উপর নথিপত্র ঘেঁটে যা বুঝলাম, রবীন্দ্রনাথ
সম্ভবত ওকাম্পোর জীবনে খুব বড় কোন অধ্যায় ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও আরো
অনেক ‘প্রেমিক’ এসেছিল তাঁর জীবনে। অনেকটা রবিঠাকুরের মতই প্রেম-পিয়াসী
মানুষ ছিলেন ওকাম্পো। জুলিয়েন মার্তিনেজের কথা তো আগেই বলেছি, এর বাইরে
ছিলেন জ্যাক লাকান, ইগোর স্ত্রাভিনস্কি সহ অনেক বিখ্যাত জনই। স্প্যানিশ
সাহিত্যিক অর্তেগা ই গাসেত্, জার্মান দার্শনিক কাউন্ট হার্মান কাইজারলিঙ,
ফরাসি সাহিত্যিক পিয়া দ্রিউ রা হোসেল, আমেরিকান লেখক ওয়ালদো ফ্রাঙ্ক সহ
অনেকেই যে বিভিন্ন সময়ে এই প্রিয়দর্শিনী নারীর প্রণয়াকাঙ্ক্ষি হয়েছিলেন তার
বহু উপকরণ খুঁজলেই পাওয়া যাবে[13]।
ওকাম্পো তাঁদের কাউকে কাউকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, কারো কারে
সাথে স্বল্পস্থায়ী সম্পর্কেও জড়িয়েছিলেন। আরো মজার ব্যাপার হল যে ‘ভিলা
ওকাম্পো’ ভ্রমণের জন্য এত তোড়জোড়, সেটিতে রবীন্দ্রনাথ থেকেছিলেন কিনা তার
কোন প্রমাণ আমি পাইনি। আগেই বলেছি বাড়িটি ছিল আসলে ওকাম্পোর বাবার। ওকাম্পো
বাড়িটিতে থাকা শুরু করেন আসলে ১৯৪০ এর পরে। কাজেই বাবা জীবিত থাকা অবস্থায়
রবীন্দ্রনাথকে সে বাসায় থাকার বন্দোবস্ত না করারই কথা, যদিও দেশের লেখক
বিশ্লেষক এবং বুদ্ধিজীবীরা ওকাম্পোর এ বাড়িটিকেই আর্জেন্টিনায়
রবীন্দ্রনাথের আবাসস্থল ভেবে নেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ এ বাড়িটিতে কখনোই ছিলেন
না, অসুস্থ রবিঠাকুরকে ওকাম্পো নিয়ে এসেছিলেন এ বাড়িটির কয়েক ব্লক দূরে
‘মিরালরিও’ নামের একটি ভাড়া বাড়িতে (বাড়িটির কথা বলা হয়েছে প্রবন্ধের
শুরুতেই)। সেখানে দু’মাসের বেশি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে সে বাড়িটি আজ
কালের গর্ভে হারিয়ে না গেলেও বাড়িটির অদূরে একটি ছোট রাস্তা ছাড়া
রবিঠাকুরের কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই[14]। ‘ওকাম্পো ভিলা’ই আজ আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসুদের তীর্থস্থান[15]।
বহু বিখ্যাত জনের পাশাপাশি রবিঠাকুরেরও অনেক ছবি আছে এ বাসায়। আর আছে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ওকাম্পোর বিখ্যাত বই –
‘তাগোর এন্ লাস্ বার্রাংকাস দে সান ইসিদ্রো’ (Tagore en las barrancas
de San Isidro)। ভিলা-ওকাম্পোর সংগ্রহশালা থেকে বইটির একটা কপি সংগ্রহ
করতেই হল।
চিত্র: ‘ভিলা ওকাম্পো’ থেকে সংগৃহীত ‘তাগোর এন্ লাস্ বার্রাংকাস দে সান ইসিদ্রো’ এবং ‘সুর’ পত্রিকার একটি পুরনো সংখ্যা।
আমার মেয়ে ইদানীং স্প্যানিশ সাহিত্য নিয়ে কিছুটা উৎসাহী হয়েছে। ওকাম্পো
ভিলায় তাকে সার্বক্ষণিক ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে পাওয়ায় একটা অন্তত উপকার হল।
তার কল্যাণে জানলাম এর অর্থ হচ্ছে – ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর’। শঙ্খ ঘোষ অবশ্য তাঁর ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে ওকাম্পোর বইটির
শিরোনামটির অনুবাদ করেছেন ‘সান ইসিদ্রোর শিখরে রবীন্দ্রনাথ’ হিসেবে। কিন্তু
স্প্যানিশে ‘বাররাংকা’ (barranca) শব্দটির অর্থ ঠিক শিখর নয়, ইংরেজিতে
‘গর্জ’ (gorge) বা ‘র্যাভিন’ (ravine) বরং এর অনেক কাছাকাছি। কেতকী কুশারী
ডাইসন তাঁর বইয়ে শব্দটির অনুবাদ করেছেন – ‘গিরিদরি’। পাশাপাশি অবশ্য তিনি
‘সংকীর্ণ উপত্যকা’ কেও অনুমোদন দিয়েছেন। তাই আমার এ লেখায় উপত্যকাই সই!
অন্তত শব্দটি পাঠকদের কাছে অপরিচিত ঠেকবে না। এই বিখ্যাত বইটির কপি ছাড়াও
ওকাম্পোর সম্পাদিত পুরনো ‘সুর’ পত্রিকার একটি কপি বগলদাবা করলাম। মাথায়
ছিলো, ওকাম্পোর উপর যদি কখনো কিছু লেখাটেখা হয়ে উঠে তবে হয়তো এ সংগ্রহগুলো
কাজে আসবে। এই লেখাটির সূত্রপাত সেখান থেকেই।
চিত্র: ভিলা ওকাম্পোর গাইডের হাতে ধরা ভিলা ওকাম্পোর বাগানে বসা ওকাম্পো- রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ছবি
ওকাম্পোর বর্ণাঢ্য জীবনে রবীন্দ্রনাথকে আমি ‘একটি ছোট অধ্যায়’ হিসেবে
চিহ্নিত করলেও সেই ক্ষণজন্মা কালটিকে মোটেই মূল্যহীন বলা যাবে না।
রবিঠাকুরের উপর লেখা ‘তাগোর এন্ লাস্ বার্রাংকাস দে সান ইসিদ্রো’ (১৯৬১)
নামের পূর্ণাঙ্গ বইটিই তার প্রমাণ। এই বইটি ছাড়াও ওকাম্পোর আরো বেশ কিছু
রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যাবার
পর তাঁর ‘সুর’ পত্রিকায় ওকাম্পো লিখেছিলেন দীর্ঘ একটি ‘অবিচ্যুয়ারি’
নিবন্ধ। আসলে ভারতের সমসাময়িক তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তি দিয়ে ওকাম্পো খুবই
প্রভাবান্বিত ছিলেন – গান্ধী, নেহেরু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর মধ্যে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেই কেবল তাঁর দেখা হয়েছিল। তাঁর চোখে রবীন্দ্রনাথ
ছিলেন, ‘মিতবাক, স্নেহপরায়ণ, উদাসীন, পরিহাসপ্রিয়, গম্ভীর, আধ্যাত্মিক,
খামখেয়ালি, প্রশ্রয় দিতে ওস্তাদ, উৎফুল্ল, কঠিন, কোমল, নৈর্ব্যক্তিক,
সুদূর, বিবেকী এবং আবহাওয়ার মতোই পরিবর্তনশীল’ এক মানুষ। তবে
রবীন্দ্র-চিন্তার প্রভাব ছিলো ওকাম্পোর উপরে উল্লেখ করার মতোই। অনেক সময়ই
গান্ধী বনাম রবীন্দ্রনাথের অলিখিত দার্শনিক মনোদ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথকেই
বেছে নিতেন তিনি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময়টুকু যাতে উপভোগ্য হয়ে উঠে, তার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছিলেন তিনি। একটি সাজানো ঘর, নয়নাভিরাম দৃশ্যখচিত অলিন্দ, কবিতা লেখার উপযোগী নিভৃত পরিবেশের বন্দোবস্ত করা থেকে শুরু করে যখন দরকার সঙ্গ দেয়া, দর্শনার্থীদের সাথে রবিঠাকুরের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, রবিঠাকুরের পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সবই করেছিলেন ওকাম্পো। এ সমস্ত করতে গিয়ে ওকাম্পোর যথেষ্টই খরচপাতি হয়েছিল। আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথের প্রথমে সাত দিন থাকার কথা থাকলেও সেটা ক্রমশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি। শোনা যায়, রবিঠাকুরের ভরণপোষণের এই খরচ মেটানোর জন্য ওকাম্পোকে খুব দামী একটি হীরের টায়রা খুব নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হয়েছিল[16]। গয়না বিক্রির টাকা থেকে দশ হাজার পেসো আগাম ভাড়া দিয়ে এসেছিলেন রবিঠাকুরের জন্য বরাদ্দকৃত সেই মিরালরিওর বাড়িটির মালিককে। কেবল তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাতে কোন সমস্যা না হয়, সেজন্য তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফানিকে নিয়োগ দিয়ে দিয়েছিলেন, ফানিকে ব্যস্ত রেখেছিলেন রান্নাবান্না সহ চব্বিশ ঘণ্টা তদারকিতে। এর ফলে ফানির সাথেও কবিগুরুর এক ধরণের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটু রসিকতা করেই লিখেছিলেন, ‘ …তবে ওদের কথাবার্তাটা ঠিক কোন ভাষায় চলতো, তা দুজনের একজনও আমাকে কখনো বুঝিয়ে বলতে পারেননি, কারণ একজন তো আদৌ ইংরেজি বলতে পারতেন না, অন্যজনের স্প্যানিশও ছিল তথৈবচ’।
বাসার অলিন্দ থেকে ওকাম্পোর সাথে মিলে নদী দেখতেন রবীন্দ্রনাথ, দেখতেন নদীর জলে রঙের পরিবর্তনের মায়াবী খেলা। কখনো বা বাসার পাশের তিপা গাছের নীচে চলতো তাঁদের অবিশ্রুত গুঞ্জন। রবিঠাকুর বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন ওকাম্পোকে, ওকাম্পো মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনতেন। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন, সে আবৃত্তিই গান হয়ে উঠতো। শব্দগুলি উনি এমন বিশুদ্ধ স্পষ্টতার সাথে উচ্চারণ করতে পারতেন যে, আমি কিছু কিছু শব্দ স্মৃতিস্থ করে পুনরুচ্চারণ করতে পারতাম’। আর ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’, নামের যে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতটি আমরা আজ অহরহ শুনি, সেটার কথা তো এখানে অবধারিতভাবে এসে পড়বে –
আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী।এ বিখ্যাত গানটির ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবিঠাকুর, আর্জেন্টিনা আসার কয়েকদিনের মধ্যেই। মূল গানটি গানটি কবি লিখেছিলেন শিলাইদহে বহুদিন আগে – সেই ১৮৯৫ সালে। গানটি রচনা করার ত্রিশ বছর পরে রবি ঠাকুর হয়তো ওকাম্পোর মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর পরম আরাধ্য সত্যিকার ‘বিদেশিনী’কে[17]। রবীন্দ্রনাথ যেমন ওকাম্পোকে বাংলা কবিতা আর গানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ওকাম্পো আবার অন্যদিকে রবিঠাকুরকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সঙ্গীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন ক্লান্তিহীনভাবে। যেমন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনীয় কবি রিকার্ডো গ্যিরালডেসের সাথে, কখনো নিয়ে যেতেন ‘ফাকুলতাদ দ্য ফিলসফিয়া ই লেত্রাসে’ কিংবা কখনো ‘চাপাড মালালে’[18]। ওকাম্পো নিজেই বোদলেয়রের ‘পাপের পুষ্পগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করে শোনাতেন[19]; পাশাপাশি শোনানোর ব্যবস্থা করতেন দ্যুবসি, রাভেল কিংবা বোরোদিনের মায়াবী সঙ্গীতও। সব মিলিয়ে এ সময়টুকু ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য যেন এক ধরণের স্বপ্নের লগ্ন । আর্জেন্টিনা থেকে ফিরে বহু বছর পরেও রবিঠাকুর সান ইসিদ্রোর স্মৃতি রোমন্থন করতেন। শান্তিনিকেতন থেকে ওকাম্পোকে প্রায়ই লিখতেন[20] –
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥
‘আমার মন চলে যায় সান ইসিদ্রোর বারান্দাটিতে। স্পষ্ট এখনো মনে পড়ে সকালবেলা আলোয় ভরা বিচিত্র লাল নীল ফুলের উৎসব। আর বিরাট সেই নদীর উপর নিরন্তর রঙের খেলা, আমার নির্জন অলিন্দ থেকে অক্লান্ত সেই চেয়ে দেখা’।ওকাম্পোর ওপর রবিঠাকুরের যেমন প্রভাব ছিল, রবিঠাকুরের সৃষ্টির পেছনেও ওকাম্পোর প্রভাব ছিল অসমান্য। তুলনামূলক বিচারে এই প্রভাব ওকাম্পোর উপর প্রভাবের চেয়ে কম ছিল না, বরং হয়তো ছিল খানিকটা বেশিই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা ওকাম্পোকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন বলে অনুমিত হয়[21]। পূরবীর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ১৯২৫ সালটিকে আজ ‘বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনাকাল’ হিসেবে গণ্য করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। আমরা জানি কবি বুদ্ধদেব বসু’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মর্মবাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল ঐ বছর। শুধু তাই নয় কল্লোল, কালি-কলম, উত্তরা এবং প্রগতির মতো সাহিত্যপত্রের সূচনাও হয়েছিল সমসাময়িক কালেই। পাশ্চাত্যেও এ সময়ই প্রকাশিত হয় টি. এস. এলিয়টের ‘পোড়ো জমি’ (The Waste Land) কাব্যগ্রন্থ এবং নোবেল বিজয়ী কবি ইয়েটসের ‘ভিশন’। রুশ কবি সের্গেই ইয়েসেনিন সে বছরই তাঁর রক্তকে কালি বানিয়ে লিখেছিলেন তাঁর বিদায়ী কবিতা ‘গুড বাই মাই ফ্রেন্ড, গুড বাই’। এটি নিশ্চয় আজ আর কাউকে অবাক করে না যে, রবিঠাকুরও তাঁর এই কবিতার বইটিকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ১৯২৫ সালেই। কিন্তু আমাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ: কাব্যগ্রন্থটি রবিঠাকুর উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে ‘বিজয়ার করকমলে’।
২
‘পূরবী’ কোন সাধারণ কাব্যগ্রন্থ ছিল না। রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বর্ণীল স্ফুরণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ততোদিনে ষাট বছর অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু তাঁর প্রেমের তৃষ্ণা মরেনি। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় যেন, চির তারুণ্যের কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন সায়াহ্নে এসেও প্রেম, সৌন্দর্য আর মাধুর্যের রসে একেবারে টইটম্বুর। এ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘তপোভঙ্গ’, ‘লীলাসঙ্গিনী’, ‘আহ্বান’, কিংবা ‘শেষ বসন্ত’ কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় কবির জীবনে হঠাৎই যেন ‘চির বসন্তের’ আগমন ঘটেছিল সে সময়, আর যৌবনের ‘মানস সুন্দরী’ যেন বার্ধক্যে এসে ‘লীলাসঙ্গিনী’তে রূপায়িত। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ের প্রথম বই ছিল ‘পূরবী’। এ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের চোদ্দ বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই একে তাঁর ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা’ বলে আখ্যায়িত করে ওকাম্পোকে একটি চিঠিতে (১৯৩৯) বলেছিলেন –‘…ইতোমধ্যেই তুমি জানো যে ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রূষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়তো আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। পলাতক স্মৃতিগুলি আজ কথায় বন্দী। ভাষার অপরিচয়ে তুমি কোনদিন একে জানবে না, কিন্তু তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ –কবিতা বেঁচে থাকবে অনেকদিন’।রবিঠাকুর মিথ্যে বলেননি। পূরবী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় নব্বই বছর অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু এর উজ্জ্বলতা ম্লান হয়নি এতোটুকুও। কবিতাগুলোতে রবীন্দ্রনাথ কোথাও সরাসরি ওকাম্পোর নামোল্লেখ করেননি, কিন্তু ‘বিদেশী ফুল’, ‘অতিথি’, ‘আশঙ্কা’, তপোভঙ্গ’, ‘আহ্বান’, ‘অন্তর্হিতা’, ‘মিলন’, ‘বদল’ কিংবা ‘শেষ বসন্ত’ সহ বহু কবিতায় ওকাম্পো যেন প্রবলভাবেই দীপ্যমান। ‘বৈতরণী’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় কবি যেন মিরালরিওর বাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রেয়সীর সাথে মিলে রিও দে লা প্লাতা নদীর সৌন্দর্য উপভোগরত। যতদিন এই প্লাতা নদীর জল বইবে, যতদিন পূরবী কাব্যগ্রন্থ টিকে থাকবে, ততদিন মর্মর সুরে বইবে রবিঠাকুর আর তাঁর প্রেয়সী ওকাম্পোর রোমান্টিক অভিসারের অশ্রুত কলকাকলি। এই ‘প্লাতা নদীর ধারে’ বসে অনেক প্রেমময় কবিতা লিখেছিলেন কবি, কিছু লিখেছিলেন তাঁর বাড়ির অলিন্দে, কিছুবা লিখেছিলেন বাড়ির বাগানে ‘গাছের ছায়ায়’ বসে। ‘বীণাহারা’ নামের একটি কবিতাটির কিছু অংশ শোনা যাক –
কিংবা ‘অতিথি’ কবিতার খানিকটা –“প্রবাসে বনের ছায়েসহসা আমার গায়েফাল্গুনের ছোঁয়া লাগে একি?এ পারের যত পাখিসবাই কহিল ডাকি,‘ও পারের গান গাও দেখি।’ভাবিলাম মোর ছন্দেমিলাব ফুলের গন্ধেআনন্দের বসন্তবাহার।খুঁজিয়া দেখিনু বুকে,কহিলাম নতমুখে,‘বীণা ফেলে এসেছি আমার’।”
প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,তবে একটি কথা এখানে বলা দরকার : প্রেমের এ ‘অশ্রুত গুঞ্জন’ কেবল রবিঠাকুরকে ঘিরেই ঘুরপাক খায়নি, এর সাথে জড়িত ছিলেন একটি ‘তৃতীয় পক্ষও’। এই তৃতীয় পক্ষ আর আর কেউ নন – রবিঠাকুরের তৎকালীন সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্ট স্বয়ং। প্রথম দিকে এলমহার্স্ট ওকাম্পোর ব্যক্তিত্ব আর তাঁর প্রবল দখলদারি মনোভাব নিয়ে বিরক্ত ছিলেন, পরে কিছুটা হলেও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ওকাম্পোর রূপে আর গুণে। অনুরাগের প্রকাশ ছিল ওকাম্পোর দিক থেকেও। কারণ অনুমান করা আমাদের জন্য কষ্টকর নয়। কবি হিসেবে রবিঠাকুরের খ্যাতি যতোই হোক না কেন, আর ওকাম্পোর কাছে তিনি যত কাঙ্ক্ষিতই হোন না কেন, বাস্তবতা হল তিনি সে সময় ছিলেন ষাটোর্ধ প্রৌঢ়। বয়সে একেবারে ওকাম্পোর পিতার কাছাকাছি। অন্যদিকে লেনার্ড তখন বত্রিশ বছরের সুদর্শন যুবক, ওকাম্পোরই কাছাকাছি বয়স। ডরিস মায়ার তাঁর ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা জীবনী গ্রন্থে একটি অবরুদ্ধ সত্যের প্রতি নির্দেশ করেছেন আমাদের – ‘সুদর্শন পুরুষের প্রতি ওকাম্পোর মোহ ছিল সারা জীবনের’[22]। ওকাম্পো তাঁর বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বামী মোনাকো এস্ত্রাদার প্রতি একসময় তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন অনেকটা তাঁর সুদর্শন চেহারা আর নীল চোখের কারণেই। আর তাঁর গোপন প্রেমিক জুলিয়েন মার্তিনেজেরও খ্যাতি ছিল ‘অঞ্চলের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ’ হিসেবে। কাজেই লেনার্ড এলমহার্স্ট – যিনি ছিলেন একাধারে ‘বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিবান সাহিত্যরসিক’ এবং সেই সাথে আবার ‘নীলাক্ষ, খড়গনাসা, মেদবর্জিত দীর্ঘদেহী’- তিনি ওকাম্পোর ভালবাসার রসায়নে কোন ছাপ রাখবেন না তা তো হয় না। এর মধ্যে এলমহার্স্ট আবার তাঁর বাগদত্তা ডরোথি স্ট্রেটকে বিয়ে করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কেতকী কুশারী তাঁর ইংরেজি (‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’) এবং বাংলা (‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’) বইয়ে বেশকিছু দলিলপত্র হাজির করে দেখিয়েছেন, সে সময় ওকাম্পোর আবেগঘন আর মান অভিমানপূর্ণ বেশ কিছু চিঠি এলমহার্স্টের উপরে নানারকমের ‘চাপ সৃষ্টি করেছিল’। তাঁদের এই ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে তাঁর বাগদত্তা স্ত্রী ডরোথির জীবনভর এক ধরণের অস্বস্তি ছিল। আর কবিগুরুও উভয়ের প্রতি পারস্পরিক মুগ্ধতার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন। এমনকি একটি আলাপচারিতায় এও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, এলমহার্স্ট চাইলে ওকাম্পোকে বিয়ে করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতে পারেন[23]। আবার ওকাম্পোকে বলেছিলেন, ‘এলমহার্স্টের ডরোথিকে বিয়ে করার কথা থাকলেও তোমাকেই সে ভালবাসে’। এ যেন হিন্দি সিরিয়ালে নিত্য দেখা সেই ত্রিভুজ-প্রেমের চালচিত্র। অবশ্য এলমহার্স্টকে নিয়ে এধরণের জটিলতা রবীন্দ্রনাথের জন্য নতুন নয়। ওকাম্পোর আগে রবীন্দ্রনাথের ষোড়শী বান্ধবী রাণু অধিকারীর সাথে রবিঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সেই সাথে এলহার্স্টের প্রতি ঈর্ষা ইত্যাদি নিয়েও এক ধরণের বিচিত্র টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল তা বিভিন্ন নথিপত্র থেকে স্পষ্ট হয়[24]। এবারেও আমরা দেখব, জটিল এই ত্রিভুজ সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতেই হয়তো, ওকাম্পো পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে যে বইটি লিখবেন, তা উৎসর্গ করবেন তাঁর প্রিয় ‘ইংরেজ বন্ধু’ লেনার্ড এলমহার্স্টকে।
মাধুর্যসুধায়; কত সহজে করিলে আপনারই
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা; নির্জন এ বাতায়নে
একেলা দাঁড়ায়ে যবে চাহিলাম দক্ষিণ-গগনে
ঊর্ধ্ব হতে একতানে এল প্রাণে আলোকেরই বাণী—
শুনিনু গম্ভীর স্বর, ‘তোমারে যে জানি মোরা জানি;
আঁধারের কোল হতে যেদিন কোলেতে নিল ক্ষিতি
মোদের অতিথি তুমি, চিরদিন আলোর অতিথি।’
যা হোক, রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে সাথে নিয়ে আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেন ১৯২৫ সালের ৩রা জানুয়ারি। সে বছরের এপ্রিলেই এলমহার্স্ট বিয়ে করেন ডরোথিকে। আর রবীন্দ্রনাথ? ওকাম্পোর স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে তিনি দেশে ফিরলেন। মাস খানেকের মধ্যেই প্রকাশ করেন ঐতিহাসিক ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ। বইটি প্রকাশের পর ওকাম্পোকে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু। ১৯২৫ সালের ২৯শে অক্টোবর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
‘বাংলা কবিতার একটা বই তোমায় পাঠাচ্ছি, যেটা তোমার হাতে নিজে তুলে দিতে পারলেই খুশি হতুম। বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না। এই বইয়ের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছিল সান ইসিদ্রোয় থাকার সময়ে’।এর বহুদিন পরে ১৯৪০ সালের জুন মাসে ওকাম্পো চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন : ‘কবি, যে বইটি তুমি আমাকে উৎসর্গ করেছিলে তার নাম কি?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ সালের ১০ই জুলাইয়ের চিঠিতে এর উত্তরে জানিয়েছিলেন, ‘যে বইটি তোমাকে উৎসর্গ করেছিলাম তার নাম জানতে চেয়েছ। এর নাম পূরবী; মানে পূর্বদিক -স্ত্রী লিঙ্গে।’[25]
অবশ্য কেবল ‘পূরবী’ নয়, এর পরে প্রকাশিত যোগাযোগ উপন্যাস (১৯২৮) এবং ‘মহুয়া’(১৯২৯)র অনেক কবিতায় (প্রতীক্ষা, বাপী, প্রচ্ছন্ন, অসমাপ্ত, দূত, আহবান, দীনা ইত্যাদি) ওকাম্পোর ছায়া দেখতে পান কেতকী সহ অনেকে। এমনকি মহুয়া কাব্যগ্রন্থের পরেও নানা কবিতায় কেতকী লক্ষ্য করেছেন ওকাম্পোর সরব উপস্থিতি – নির্বাক, ভীরু, তুমি (পরিশেষ, ১৯২৩); অচেনা, আরশি, প্রভেদ, নীহারিকা, অনাগতা, বিদায়, বেসুর (বিচিত্রিতা, ১৯৩০), শেষ সপ্তকের (১৯৩৫) সকল কবিতা, উদাসীন, বিহ্বলতা, ব্যর্থ মিলন, অপরাধিনী, বিচ্ছেদ, বিদ্রোহী, ক্ষণিক, রাতের দান, অন্তরাত্মা (বীথিকা, ১৯৩৫), মায়া, নারী, হঠাৎ মিলন, দূরবর্তিনী, বিমুখতা, অসময়, মানসী, শেষ কথা (সানাই, ১৯৪০) ইত্যাদি। অবশ্য সে কবিতাগুলোর সবগুলোই কেবল ‘ব্যক্তিপ্রেম’ নির্ভর নাকি একান্তই ‘নৈর্ব্যক্তিক’, এ প্রশ্ন তোলাই যায়, যেমনটি তুলেছেন সাহিত্য সমালোচক নিত্যপ্রিয় ঘোষ, তাঁর ‘সন্ধানের সাহস’ প্রবন্ধে; বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রেমের কবিতাগুলো একমাত্র ওকাম্পো-অনুপ্রাণিত, সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় – রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীকে তাহলে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়’[26]।
৩
রবীন্দ্র-জীবনে ওকাম্পোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ বয়সে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠা[27]। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি আঁকার শখকে উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর ভিত্তিটি গড়ে উঠেছিল ওকাম্পোর বাড়িতেই, সেই ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ তৈরির সময়। ওকাম্পো লিখেছেন[28] –‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন-তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা … এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’ওকাম্পোর বাসায় বসে কবিতা লিখতে গিয়ে কবিগুরু যে সমস্ত বিচিত্র কাটাকুটি করতেন, তা দেখে মাঝে সাঝে ওকাম্পো ঠাট্টা করে বলে বসতেন[29] – ‘সাবধান, তোমার কবিতায় যত ভুলভ্রান্তি থাকবে, তুমি তো তত বেশিই ছবি এঁকে মজা পাবে। শেষে দেখবে যে, নিজে ইচ্ছে করেই বাজে কবিতা লিখছো’।
ওকাম্পো আরো লিখেছেন[30] –
‘… তাঁর এই আঁকিবুঁকিতে তো আমি মেতে গেলাম। ব্যাপারটায় ওঁকে উশকে দিলাম। সান ইসিদ্রোর ছ’ বছর পর প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’।তবে ওকাম্পো যত সহজে বলেছেন ‘প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’ – ব্যাপারটা আসলে এতো সহজ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মাথায় তাঁর ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর সুপ্ত একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল বটে, আর সেজন্য ১৯৩০ সালে প্যারিসে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর হাতে আঁকা চারশো ছবি; কিন্তু সেখানে গিয়ে বুঝলেন, সেখানে ছবির প্রদর্শনী করা অত সহজ নয়। ভাল গ্যালারি এমনিতেই চট করে পাওয়া যায় না, আর তার মধ্যে আবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনাও ছিল কম।
কিন্তু এবারেও উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সেই ‘সেনিওরা ওকাম্পো’। সৌভাগ্যবশতঃ সেই সময়টা ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। তিনি আসলে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর জীবনের ‘নতুন পুরুষ’ পিয়া দ্রিউ রা হোসেলের সাথে। ওকাম্পো প্যারিসে আছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেছিলেন । হয়তো ভেবেছিলেন এতো মানুষের সাথে সংযোগ রাখা ওকাম্পো কোনভাবে সাহায্য করতে পারবেন।
খবর পেয়েই চলে এলেন ওকাম্পো। রবিঠাকুরের সাথে তাঁর ২য় সাক্ষাৎ এটি (১৯৩০ সালের এপ্রিল)। এসেই খুব কম সময়ের মধ্যে পিগাল গ্যালারিতে রবিঠাকুরের ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। এমনকি তাঁর বন্ধু লেখিকা কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্রসূচীর একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো। এত দ্রুত এবং সুচারুভাবে তিনি কাজগুলো সমাধান করে ফেললেন যে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। ওকাম্পো যে কী অসাধারণ দ্রুততায় এবং দক্ষতায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার সাক্ষ্য সমসাময়িক অনেকের লেখাতেই ছড়িয়ে আছে। যেমন, রথীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ তে উল্লেখ করেছেন[31] –
‘১৯৩০ সালে বাবা আবার যখন প্যারিস যান, সঙ্গে ছিল তাঁর আঁকা কিছু ছবি। ছবি দেখে কয়েকজন ফরাসি শিল্পী বাবাকে একটা চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, চট করে প্যারিস শহরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা অসম্ভব বললেই হয়। মোটামুটি একটা পছন্দসই হল পেতে হলে বছর খানেক আগে থেকে চেষ্টাচরিত্র করতে হয়। বাবা সেনিওরা ওকাম্পোকে তারযোগে অনুরোধ জানালেন তিনি এসে যেন বাবার সহায় হন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হল বিনা আয়াসেই প্রদর্শনীর সব রকম ব্যবস্থা তাঁর সাহায্যে হয়ে গেল’।এ ধরণের অনেক সাক্ষ্যই পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের সেই সময়কার নতুন সেক্রেটারি আরিয়ম উইলিয়ামস কিংবা রথীন্দ্রনাথকে লেখা আঁদ্রে কার্পেলেসের চিঠিতে। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রতিমা দেবীকে ২ মে, ১৯৩০ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন,
‘ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, তাহলে ছবি ভালই হোক আর মন্দই হোক, কারো চোখে পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনিই ঘটে – অত্যন্ত ভুল। এর এত কাঠখড় আছে যে, সে আমাদের অসাধ্য- আঁন্দ্রের পক্ষেও। খরচ কম হয়নি – তিন চারশো পাউন্ড হবে। ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্চে। এখানকার সমস্ত বড় বড় গুণীজনদের ও জানে – ডাক দিলেই তারা আসে। কঁতেস দ্য নোয়াইও উৎসাহের সঙ্গে লেগেচে – এমনি করে দেখতে দেখতে চারিদিক সরগরম করে তুলেচে। আজ বিকেলে দ্বারোদঘাটন হবে – তারপরে কি হয় সেটাই দ্রষ্টব্য…’পরে যেটা হল, সেটা সামান্য নয়। চিত্রকর আঁদ্রে কার্পেলেস কিংবা পল ভেলেরি এবং আঁদ্রে জিদের মতোন কলা-বিশেষজ্ঞ রা ছবিগুলোকে চিহ্নিত করলেন ‘আগামী যুগের আর্ট’ হিসেবে[32], দেশে অবনীন্দ্রনাথ কিংবা শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর মত চিত্রকররা সেগুলোকে ‘অনন্যসাধারণ’ বলে রায় দিলেন। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সমালোচনা যে হয়নি তা নয়। রবীন্দ্রনাথের কাছের বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই মুখটিপে হেসেছিলেন[33]। তা সত্ত্বেও প্রদর্শনী থেমে থাকেনি। প্যারিসে প্রদর্শনীর পর রবিঠাকুরের চিত্র-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হল লন্ডনে এবং বার্লিনেও। কবিগুরু প্রায় শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে সে সময়কার আরেক ‘গুণমুগ্ধা’ রানী মহলানবিশকে (ভারতের বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী যিনি নির্মলকুমারী নামে সমধিক পরিচিত) লিখলেন[34],
‘আজ আমার জার্মানীর পালা সাঙ্গ হল, কাল যাব জেনিভায়। এ পত্র পাবার অনেক আগেই জানতে পেরেছ যে, জার্মানিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতকটা আশা করি তোমরা বোঝো। ইন্দ্রদেব যদি হঠাৎ তাঁর উচ্চৈঃশ্রবাঃ ঘোড়া পাঠিয়ে দিতেন আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য তা হলে আমার নিজের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতুম’।ওকাম্পোর থেকে বিদায় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের ১১ই মে। প্যারিসের গার্ দ্যু নর্ রেলস্টেশনে ধারণ করা আছে তাঁদের সেই শেষ বিদায়ের দৃশ্য। প্যাট্রিশিয়া স্টেইনারের ভাষ্য অনুযায়ী, রেলস্টেশনে তোলা বিখ্যাত সেই ছবিতে তাঁদের দেখাচ্ছিল ম্লান এবং বেদনার্ত[35]।
কেতকী কুশারী ডাইসন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ বইয়ে নানা চিঠিপত্র দলিল উদ্ধার করে দেখিয়েছেন, কবিগুরু আসলে চেয়েছিলেন ওকাম্পো তাঁর সঙ্গে ইংল্যান্ড যান, হিবার্ট বক্তৃতা শোনেন আর তারপর রবীন্দ্রনাথের সাথে ফিরেন ভারতবর্ষে[36]। কিন্তু ওকাম্পোর মাথায় ছিল তাঁর সম্ভাব্য ‘সুর’ পত্রিকা নিয়ে নানা পরিকল্পনা, তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও তিনি রবিঠাকুরের সাথে ভ্রমণে যেতে পারেননি। ইনফ্যাক্ট, আমরা আজ জানি, ওকাম্পো তাঁর সারা জীবনে কখনোই ভারতে গিয়ে উঠতে পারেননি। রবিঠাকুর অবশ্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আশা করে গিয়েছিলেন ওকাম্পো কোন না কোন দিন ভারতে আসবেন, ভারতবর্ষে এসে রবিঠাকুরের কাজকর্মের সাথে পরিচিত হবেন। যেমন, লন্ডনে চিত্রপ্রদর্শনীর পর পরই ওকাম্পোকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ … এ যেন সেই ডেড সী-র ভারি জলের মতো – সব কিছুই ভেসে থাকে যেখানে, তার ওজন যাই হোক না কেন। তুমি কোথায় আছ জানি না, শুধু চাই ভারতবর্ষে তোমার সঙ্গে দেখা হোক’। রবীন্দ্রনাথ যখনই তাঁর ‘বিজয়া’কে চিঠি লিখতেন, তখনই শান্তিনিকেতন ঘুরে যাবার কথা বলতেন। যেমন, ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন –
‘প্রিয় বিজয়া, … সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই তুমি তোমার ভ্রমণসূচীতে ভারতবর্ষে রাখো একবার, আমার নিজের জায়গা শান্তিনিকেতনে এসে আমাকে দেখে যাও। অসম্ভব কেন হবে? নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া খুব ভাল এখানে, এবং তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবার চেষ্টায় আমার কোন ত্রুটি হবে না সে তুমি নিশ্চয় জানো।এখানে উল্লেখ্য, এ চিঠির নীচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভালবাসা’ লিখেছিলেন এবং সাক্ষর করেছিলেন বাংলায়। ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পত্র আদান প্রদান হয়েছে অনেক – নথি থেকে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ৩২টি, ১৯২৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৪টি, ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ৬টি,আর ১৯৩৯ সাল থেকে রবিঠাকুর মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৮টি চিঠির কথা জানা যায়। আর ওকাম্পোকে লেখা রবিঠাকুরের বহু চিঠিতেই এভাবে বাংলায় লেখা ‘ভালবাসা’ র হদিস মেলে। কখনো রোমান হরফেও ‘bhalobasha’ লিখে চিঠি শেষ করতেন রবিঠাকুর। এখানে একটি ব্যাপারও বলা দরকার, তাঁর দীর্ঘ রবি-জীবনে জীবনে ওকাম্পোই কেবল একমাত্র ‘অনুরাগী বিদেশিনী’ ছিলেন না। বিশ্বভ্রমণে তিনি বহু নারীর সংস্পর্শেই এসেছিলেন; কারো সাথে সখ্যতা হয়েছে, কারো সাথে বন্ধুত্ব, আঁদ্রে কার্পেলেসের মতো কারো সাথে জীবনভর চিঠি চালাচালি করে রঙ্গ-রসিকতা-নির্দোষ ফ্লার্টিংও করেছেন,কিন্তু ওকাম্পোর মতো কাউকেই ‘ভালবাসা’ সম্বোধন করে চিঠি শেষ করেননি তিনি।
সম্প্রতি সিলোনে তোলা আমার একটি ছবি তোমাকে পাঠাই, আশা করি তোমার হাতে পৌঁছুবে।
আমার ভালবাসা সহ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৪
রবীন্দ্র-জীবনের আরেকটি জায়গায় ওকাম্পোর অবদানের খোঁজ পাওয়া যায়। খুব প্রচ্ছন্ন ভাবে হলেও। সেটি হল রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার ক্রমিক উন্নয়নে, অন্তত কেতকী কুশারী ডাইসন তাই মনে করেন। ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের যে সময়টাতে দেখা হয়েছিল, তার আগেকার কিংবা সমসাময়িক প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, ডায়েরি কিংবা চিঠিপত্র পাঠ করলে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় নারী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও সনাতন, ঐতিহ্যপন্থি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উদগ্রভাবেই পুরুষতান্ত্রিক। নারী সম্পর্কে রবীন্দ্র ভাবনার চালচিত্র খুব সার্থকভাবে ধরা পড়ে তাঁর ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (১৮৮৯) নামক প্রবন্ধে। সে সময় মহারাষ্ট্রের এক বিদুষী নারীবাদী রমাবাই পুনায় একটা বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুরুষ শ্রোতাদের গণ্ডগোলের কারণে বক্তৃতাটি শেষ করতে পারেননি। কিন্তু যতটুকুই তিনি বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন (যেমন, “মেয়েরা সকল বিষয়ে পুরুষদের সমকক্ষ কেবল মদ্যপানে নয়”), সভাস্থলে উপস্থিত থাকা রবীন্দ্রনাথকে বিব্রত করার জন্য ছিল যথেষ্ট। ঘরে ফিরে তিনি দিলীপ কুমার রায়কে প্রেরিত নিবন্ধে উল্লেখ করেন[37] –“মেয়েরা সকল বিষয়েই যদি পুরুষের সমকক্ষ, তা হলে পুরুষের প্রতি বিধাতার নিতান্ত অন্যায় অবিচার বলতে হয়”। সেই একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নারী স্বাধীনতা এবং নারী অধিকারকে ‘কোলাহল’ হিসেবে উল্লেখ করে লেখেন:‘আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল উঠেছে, সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়। পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত; তাতে এই হত যে, চরিত্রের উপরে অধীনতার কুফল ফলতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমন-কি, অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত্বসম্পাদন করত। প্রভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তা হলে ভৃত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না। রাজভক্তি সম্বন্ধেও তাই বলা যায়’।নারী অধিকার চাওয়ার প্রচেষ্টাকে ‘নাকী সুরে ক্রন্দনের’ সাথে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ এও বলেছিলেন:
‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগত নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষের আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতা প্রাপ্ত হচ্ছে; অথচ সে-বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই’।খুব সনাতন এবং প্রথাগত মানুষের মতোই প্রকৃতির দোহাই দিয়ে মেয়েদের গৃহবন্দী রাখার পক্ষে সুচিন্তিত মত দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ –
‘যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাহিরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হত, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাত’।প্রকৃতিকে পুঁজি করে যুদ্ধ জয়ের প্রচেষ্টা রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কেবল রমাবাইয়ের সাথেই করেননি, এ ধরণের অহেতুক তর্ক বিতর্ক করেছেন অন্য সময়ে সরলা দেবী কিংবা কৃষ্ণাভাবিনী দেবীর সাথেও। কৃষ্ণভাবিনীকে সে অর্থে নারীমুক্তিবাদী বলা যায় না, পুরুষতন্ত্রের আরোপিত ছকের মধ্যে থেকেই নারীদের জন্য সামান্য একটু শিক্ষা দীক্ষা চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন এক রত্তি স্বাধীনতা (‘শিক্ষিতা নারী’, ১৮৯১), কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই ‘প্রকৃতির দোহাই’ পেড়েই তাঁকে নিবৃত্ত করতে সচেষ্ট হন –
‘প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কার্য্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন – পুরুষের সার্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে – অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না’।তিনি কৃষ্ণভাবিনীকে অবলীলায় মনে করিয়ে দেন, ‘পুরুষের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া অর্থোপার্জ্জন স্ত্রী লোকের কার্য্য নহে’। নারী সম্পর্কে এ ধারণার প্রতিফলন কেবল একটি দুটি প্রবন্ধে নয়, এ মানস ধারণার প্রতিফলন পাওয়া যাবে তাঁর য়ুরোপ যাত্রীর ডায়রি (১৮৯০), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৮৯১), স্ত্রীশিক্ষা (১৯১৫), পারসোনালিটি (১৯১৭), জাপানযাত্রী (১৯১৯), নারী প্রসঙ্গ(১৯২৩), পশ্চিম-যাত্রীর ডায়রি (১৯২৪), ভারতবর্ষীয় বিবাহ (১৯২৫) সহ নানা রচনায়। ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়রি’ প্রবন্ধটির এক জায়গায় সভ্যতা নির্মাণে নারীর অবদান প্রায় অস্বীকার করে লেখেন – ‘সাহিত্যে, কলায়, বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে, বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে আমরা যাকে সভ্যতা বলি সে হল পুরুষের সৃষ্টি।’ আবার জাপানযাত্রী প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন, ‘যে সমস্ত কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে-সব কাজে পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার, সে-সব কাজ মেয়েদের’।
যে সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম তার সমসাময়িক সময়ে কিংবা তারও অনেক আগে হাইপেশিয়া, এমি নোদার কিংবা মাদাম কুরির মতো উদ্ভাবক এবং বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে আলোকিত করে গেছেন, ক্লিওপেট্রা থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ, রাণী ভিক্টোরিয়া, স্পেনের প্রথম ইসাবেল, রাশিয়ার ক্যাথরিন দ্য গ্রেট, জার্মানির রোজা লুক্সেমবার্গ, সুলতানা রাজিয়া, তুরকান খাতুন কিংবা রাণী লক্ষ্মীবাইরা রাজ্য শাসন করে গেছেন, আর সাহিত্যাঙ্গনে তো নারীরা প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। ‘সমকামিতা’ শিরোনামে একটা বই লিখেছিলাম আমি বছর কয়েক আগে। সে বইয়ে আমি নারী কবি স্যাপোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলাম[38]। গ্রীসের লেসবো দ্বীপের (যেখান থেকে ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে)উল্লেখযোগ্য কবি আর পেশায় শিক্ষিকা স্যাপো খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকেই ফুলের সৌন্দর্য, স্বর্ণ, সূর্যালোক, মন্দিরের বাগান আর সর্বোপরি নারীর সৌন্দর্য নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক সময়ে জেন অস্টিন, শার্লটি ব্রন্টি, এমিলি ব্রন্টি, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, জর্জ এলিয়ট (মেরি অ্যান ইভান্স), এডিথ সোয়ডারগ্রান, আনা আখমাতোভা, মারিনা ৎসভেতায়েভা, কোলেত, এমিলি ডিকিন্সন, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, সুসান বি অ্যান্থনি, এলিজাবেথ স্ট্যান্টন, ভার্জিনিয়া উলফ কিংবা ভারতবর্ষে বেগম রোকেয়ার মতো নারীরা চিন্তাচেতনার ছক উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিবিধ গদ্যে সভ্যতাকে দেখছেন কেবল ‘পুরুষের সৃষ্টি’ হিসেবে, কখনো নির্লিপ্তভাবে বলে দিচ্ছেন নারীর ‘উদ্ভাবনা শক্তি নেই’ বলে। কিছু কিছু উক্তি তো অতিমাত্রায় নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিক: ‘মেয়েদের একরকম চটপটে বুদ্ধি আছে, কিন্তু সাধারণত পুরুষদের মতো বলিষ্ঠ বুদ্ধি নেই। আমার তো এইরকম বিশ্বাস’। অথবা, ‘মেয়েরা হাজার পড়াশুনো করুক, এই কার্যক্ষেত্রে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে নাবতে পারবে না’। এগুলো রবীন্দ্রনাথেরই উক্তি। না, মুখ ফসকে আলগোছে করা চটুল উক্তি নয়,সময় নিয়ে গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা প্রবন্ধেরই উদ্ধৃতি এগুলো। রবীন্দ্রনাথের এ ধরণের বিশ্লেষণ আমাদের অবাক করে, সেই সাথে করে বিমর্ষ। প্রথাবিরোধী লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘নারী’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, যাকে মনে করা হয় নিজের সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রসর, আসলে পিছিয়ে ছিলেন নিজের সময়ের থেকে হাজার বছর’[39]।
নারীদের কবিগুরু ভালবাসেননি তা নয়, কিন্তু মল্লিকা সেনগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, ‘নারীকে ভালবাসতে গিয়ে নারীর সর্বনাশটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই করে গেছেন’[40]। রবীন্দ্রনাথ নারীদের মূলত দেখেছেন প্রেয়সী হিসেবে, তাঁর কাজের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে। কিংবা জননী হিসেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি রচনায় নারীদের জাত বিচার করেছিলেন এভাবে – ‘মেয়েরা দুই জাতের, কোন কোন পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্রধানত মা, আর-এক জাত প্রিয়া’। হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথের এহেন নারী ভাবনার সমালোচনা করে লেখেন, ‘কোন কোন পণ্ডিতের কাছে এটা শোনার তাঁর দরকার ছিলো না, এটা তাঁর নিজেরই কথা। একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি এ কথা প্রমাণ করার জন্যই’[41]। ড. আজাদ ভুল কিছু বলেননি। রবিঠাকুরের ‘দুই বোন’ উপন্যাসের শুরুতেই এই ভাবনার সন্ধান মেলে। সন্ধান মেলে তাঁর অনেক বিখ্যাত কবিতাতেও। যেমন ‘মানসী’ কবিতায় রবি ঠাকুর লিখেছিলেন –
‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী-একই কবিতায় রবিঠাকুর নারীর সংজ্ঞায়ন করে শেষ করেন এই বলে –
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার ‘পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।…’
‘[নারী,] অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা’।রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা এহেন ‘স্বপ্নের’ – ‘অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক কল্পনা’র। তিনি নারীদের দেখেছিলেন রোমান্টিকের দৃষ্টিতে। তাঁর দৃষ্টিতে নারী ছিল – তরুণী, রূপসী, মানসসুন্দরী কিংবা দেবী। এ রবীন্দ্র-নারীরা ক্ষেতে খামারে কাজ করে না, অংশীদার হয় না রাষ্ট্র কিংবা বৈশ্বিক রাজনীতি কিংবা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে, তারা কেবল চোখে কাজল, কপালে টিপ আর হাতে দু-গাছি বালা পরে গৃহকোণ উজ্জ্বল করে রাখে। রবীন্দ্রনাথ হয়তো জানতেন তাঁর আরাধ্য নারীরা সামাজিক শৃংখলে ‘বন্দী’, কিন্তু এই বন্দিত্বই ছিল তাঁর চোখে কমনীয়, চির-কল্যাণকর – ‘বন্দী হয়ে আছো তুমি সুমধুর স্নেহে … দুইটি সোনার গণ্ডী, কাঁকন দুখানি’ (‘সোনার বাঁধন’, ১৮৯২)।
রবীন্দ্রসাহিত্যে নারী চরিত্র চিত্রায়নে ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়। তাঁর এমনি একটি ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি হল কাব্য নাটক ‘চিত্রাঙ্গদা’। ১৮৯২ সালের দিকে প্রকাশিত এ কাব্যনাটকের কাহিনী কবিগুরু চয়ন করেছিলেন মহাভারত থেকে। নাটকের মূল চরিত্র চিত্রাঙ্গদা ছিলেন মণিপুররাজ চিত্রভানুর কন্যা। কিন্তু রাজা তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন পুত্রের মতো। তাঁকে শিখিয়েছিলেন ধনুর্বিদ্যা। শিখিয়েছিলেন রাজনীতি। চিত্রাঙ্গদা এক ভিন্ন জাতের নারী। জন্ম থেকেই; চিত্রাঙ্গদার জন্ম সত্যই ছিল বিস্ময়কর। মণিপুররাজ চিত্রভানুর পূর্বপুরুষ রাজা প্রভঞ্জন তপস্যা করে এক সময় মহাদেবের বর পেয়েছিলেন যে, এই বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। কিন্তু সে বর নস্যাৎ করেই ধরাধামে জন্ম নিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা :
‘দিয়াছিলা হেন বর দেব উমাপতিনিঃসন্দেহে চিত্রাঙ্গদা রবীন্দ্রনাথের আগেকার ‘একজাত প্রধানত মা, আর অন্য জাত প্রিয়া’ ঘরনার নারীদের থেকে উজ্জ্বলভাবেই ব্যতিক্রম। এ রমণী ‘স্নেহে নারী, বীর্যে সে পুরুষ’। তিনি আমাদের চিরচেনা কোমল-প্রেয়সী-প্রিয়ার মতো নন, বরং তাঁর ‘কঠিন সবল বাহু বিঁধিতে শিখেছে লক্ষ্য, বাঁধিতে পারে না বীরতনু হেন সুকোমল নাগপাশে’। এ নারী তাঁর পাণিপ্রার্থী বীর অর্জুনকে অবলীলায় শর্ত দিতে পারে – তাঁদের মিলনজাত সন্তানকে হতে হবে মণিপুর রাজ্যের বংশধর। গবেষক সাদ কামালী ‘রবীন্দ্রনাথের বিবাহভাবনা’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত ‘পুরাণের অনন্য চিত্রাঙ্গদা রবীন্দ্রকাব্যেও অনন্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই লিখেছেন[42]:
তপে তুষ্ট হয়ে। আমি সেই মহাবর
ব্যর্থ করিয়াছি । অমোঘ দেবতাবাক্য
মাতৃগর্ভে পশি দুর্বল প্রারম্ভ মোর
পারিল না পুরুষ করিতে শৈব তেজে,
এমনি কঠিন নারী আমি’।
‘সচেতন চিন্তার বিপরীতে বা উদাসীন থেকে কেবল শিল্পের স্বার্থে, গল্পের খাতিরে ভিন্ন নারীসত্তা ও সামাজিকতা সৃষ্টি করতে রবীন্দ্রনাথকে দেখা প্রায় যায় না। বিশেষ ব্যতিক্রম হল ভাদ্র ১২৯৮ বাংলা সালে লেখা ভাদ্র ১২৯৯ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত চিত্রাঙ্গদা কাব্য নাটক’।রবীন্দ্রনাথের এ বিখ্যাত নাটকটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ‘চিত্রা’ নামে ১৯১৩ সালে। সাহিত্যরসিক এবং পরবর্তীকালে নারীবাদীতে রূপান্তরিত হওয়া ওকাম্পোর যে এই নাটিকাটিকে ‘সবচেয়ে সুন্দর’ আর ‘স্বতন্ত্র’ মনে হবে, তা আর বিচিত্র কি? ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সব নাটকের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে স্বতন্ত্র হলো চিত্রা’। শুধু তাই নয়, ওকাম্পো নির্ভুল লক্ষ্যভেদে সনাক্ত করেছিলেন অর্জুনের প্রতি উচ্চারিত চিত্রাঙ্গদার সেই লাইনগুলো, যেগুলো আজও নারীমুক্তির ইশতেহার হবার যোগ্যতা রাখে:
যে সময়টিতে ওকাম্পোর সাথে রবিঠাকুরের সাক্ষাৎ ঘটেছিল, তখনো তিনি কেবল সাহিত্য অনুরাগী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে, বিশেষত ১৯৩৪ সালে প্রখ্যাত নারীবাদী ভার্জিনিয়া উলফের সাথে সাক্ষাৎ এবং আরো কিছু আনুষঙ্গিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওকাম্পো নারীবাদকে উপজীব্য করে লেখালিখি এবং কাজকর্মে মনোনিবেশ করেন বেশ গুরুত্ব দিয়েই। ভার্জিনিয়ার বাসায় বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন ওকাম্পো; তাঁর সাথে বন্ধুত্ব অটুট ছিল ১৯৪১ সালে আত্মহত্যায় উলফ তাঁর জীবন উৎসর্গ করার আগ পর্যন্ত। মৃত্যুর পর ভার্জিনিয়া উলফকে নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন ওকাম্পো – ‘স্মৃতিতে ভার্জিনিয়া’[43]। সে বইটিতে নয় শুধু, ওকাম্পোর নিজের দশ খণ্ডে প্রকাশিত ‘তেস্তিমোনিয়োস্’ গ্রন্থে সমকালীন নারীবাদের বহু উপকরণ পাওয়া যায়[44]। ১৯৩১ সালে ‘সুর’ পত্রিকা প্রকাশের পর নারীদের অধিকার নিয়ে বহু লেখা লিখেছিলেন। ১৯৩৫ সালে শুরু করেছিলেন ‘ভার্জিনিয়া উলফের প্রতি খোলা চিঠি’ নামের একটি সিরিজ[45]। ‘সুর’ কোন নারীবাদী পত্রিকা ছিল না, পত্রিকাটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ আর দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্যের সেতুবন্ধন তৈরি, তারপরেও শেষদিকে পত্রিকার পুরো একটা সংখ্যা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন মেয়েদের নিয়ে। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী প্রবন্ধ – ‘নারী, তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’[46]। সেই একই বছর তিনি লেখেন ‘নারী এবং তার প্রকাশভঙ্গী’[47]। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন আরেকটি বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘নারী: অতীত এবং বর্তমান’[48] । তিনি তাঁর এ সমস্ত রচনায় নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেছেন, নারীর ভোটাধিকার চেয়েছেন (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না), নারীর মেধা এবং মনন – যেগুলোকে পুরুষতন্ত্র বরাবরই অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে – ইতিহাস এবং পারিপার্শ্বিক সমাজ থেকে সেগুলোর নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, নারীর যৌনতা এবং যৌনস্বাধীনতার কথা বলেছেন, বিয়ে এবং পরিবার নিয়ে লিখেছেন, যুগে যুগে নারীদের উপর পুরুষদের ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন, এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ, একক মাতৃত্ব (single motherhood),গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও কথা বলেছেন – যা সেদিনকার তুলনায় তো বটেই, আজকের যুগের জন্যও বিপ্লবী। তবে, ওকাম্পো কখনো পুরুষদের ‘শত্রু’ হিসেবে গণ্য করেননি। তাঁর নারীবাদ ছিল এক অর্থে চিরন্তন মানবতাবাদেরই অংশ। এ প্রসঙ্গে ওকাম্পোকে নিয়ে রচিত গ্রন্থে প্যাট্রিশিয়া স্টেইনারের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য –দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই;অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবেপিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখোমোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তারযদি অংশ দাও, যদি অনুমতি করকঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরীআমার পাইবে তবে পরিচয়।
‘ওকাম্পো সমসাময়িক অন্যান্য নারীবাদীদের থেকে যে জায়গাটিতে পৃথক ছিলেন তা হল, ওকাম্পো পুরুষদের শত্রু হিসেবে দেখেননি। যদিও পিতৃতান্ত্রিক নিবর্তনমূলক শোষণের বিরোধিতায় কলমের কালি ওকাম্পো কম খরচ করেননি, কিন্তু তাঁর নারীবাদ মোটাদাগে ছিল সহিষ্ণু এবং জীবনকে গঠনমূলক ভাবে গ্রহণ করার প্রয়াস’।ওকাম্পোর বন্ধুবান্ধবদের সবাই যে প্রগতিশীল মানসিকতার ধারক ও বাহক ছিলেন তা অবশ্য নয়। বরং অনেকেই ছিলেন প্রথাগত চিন্তাচেতনা দিয়ে আচ্ছন্ন। কঁতেস দ্য নোয়াই, যিনি প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রসূচীর একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন, তিনি নারী হওয়া সত্ত্বেও নারীবাদ বিরোধী ধারণা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। যুদ্ধবাজ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন কঁতেসের আদর্শ পুরুষ। এর সমালোচনায় ওকাম্পো কঁতেসের নাম উল্লেখ না করে লিখেছিলেন, “কেবল নারীপ্রগতি বিরোধী মানুষজনই নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে হিরো ভাবতে পারে, যিনি ‘সিভিল কোড’ প্রবর্তন করে নারীদের অক্ষম করে তুলেছিলেন। এই কোড অনুযায়ী মেয়েরা স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ভ্রমণ করতে পারবে না, শিক্ষায় কিংবা কারিগরী পেশায় আত্মনিয়োগ করতে পারবে না, এমনকি লাভ করবে না উত্তরাধিকারসূত্রে কোন সম্পদও”[49]। ওকাম্পোর আরেক সাহিত্যিক বন্ধু অর্তেগা ই গাসেত্-এরও নানা ধরণের পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ছিল, যার সাথে ওকাম্পো একমত পোষণ করেননি। অর্তেগা ভাবতেন, নারীরা স্বভাবত নিষ্ক্রিয়, তারা ইতিহাস রচনার অংশীদার হলেও একে প্রভাবিত করার সামর্থ্য নারীদের নেই। ওকাম্পো অর্তেগাকে সরাসরি আক্রমণ না করলেও বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে অধ্যায়, ভার্স, এবং ঐতিহাসিক উদাহরণ সামনে এনে দেখিয়েছিলেন যে নারীরা মোটেই নিষ্ক্রিয় নয়, তাদেরও আছে সক্রিয় মননশীল মন, এবং পুরুষদের মতো তারাও পারে ইতিহাসের চাকাকে গতিশীল এবং প্রভাবিত করতে[50]। এদিকে ওকাম্পোর আরেক বন্ধু আঁদ্রে জিদ, যার গীতাঞ্জলির অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ওকাম্পো একসময়, ভাবতেন ‘যৌনাকাঙ্ক্ষা কেবল পুরুষদেরই হয়’। ওকাম্পো তাঁর একটি লেখায় জিদের এই ধারণা খণ্ডন করেন হ্যাভলক অ্যালিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘স্টাডিস ইন দ্য সাইকোলজি অব সেক্স’-এর উল্লেখ করে[51]। ওকাম্পোর আরেকজন গুণগ্রাহী (এবং প্রণয়াকাঙ্ক্ষি) পরিব্রাজক এবং দার্শনিক হারমেন আলেকজান্ডার কাইজারলিঙ তাঁর ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে (এবং কিছুটা ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে) তাঁর একটি গ্রন্থে দক্ষিণ আমেরিকান নারীদের নিয়ে কিছু বক্রোক্তি করলে (‘এখানকার নারীরা নিগৃহীত হবার জন্য মুখিয়ে থাকে’), ওকাম্পো এর প্রতিবাদ করেন এই বলে, ‘এটা এমন একটা স্পর্শকাতর ব্যাপার যে আমি বিনা প্রতিবাদে যেতে দিতে পারি না’। তিনি তাঁর লেখায় সুসান ব্রাউনমিলারের ‘আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ শিরোনামের ধর্ষণবিষয়ক কালজয়ী গ্রন্থটিকে কাইজারলিঙের জন্য ‘উচিৎ জবাব’ হিসেবে চিহ্নিত করেন[52]। কাইজারলিঙকে নিয়ে ওকাম্পো পরবর্তীকালে ‘পথিক ও ছায়াদের একটি: আমার স্মৃতিকথায় কাইজারলিঙ’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থও লিখেছিলেন, যেটিকে আজ নারীচেতনার উন্নয়নে অন্যতম পথিকৃৎ গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গেও প্রায় একই ধরণের পন্থা অবলম্বন করেছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনার সরাসরি বিরোধিতা ওকাম্পোর রচনায় আমরা লক্ষ্য না করলেও, তিনি যে আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনার নারী’ থেকে অনেকটাই পৃথক ছিলেন, তা বহুভাবেই জানান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন নারীবাদকে ‘কোলাহল’ বলে অভিহিত করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন মেয়েদের ‘নাকি সুরে ক্রন্দন’ হিসেবে, সেখানে ‘তেস্তিমোনিয়োস্’ গ্রন্থের দশম খণ্ডে পরিষ্কার করেই ওকাম্পো লিখেছিলেন, ‘আমি বরাবরই ফেমিনিস্ট ছিলাম, এখনো আছি। পঞ্চাশ বছর ধরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছি এমন এক অবস্থাকে (পুরুষতন্ত্র), যা টিকে থাকতে পারে না’। আরেক জায়গায় ওকাম্পো বলেন – ‘আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা – কোনদিন আমি হয়তো একজন নারী লেখকের প্রতিভূ হিসেবেই লিখব। আমাকে যদি কেউ একটি আলাদীনের চেরাগ এনে দেয় আর যদি সেটা ঘষা দিয়ে দেখি আমি শেকসপিয়ার, দান্তে, গ্যোতে, কার্ভান্তেস কিংবা দস্তয়েভস্কির মতো লিখতে পারছি, আমি সোজা সেই চেরাগটি ছুঁড়ে ফেলে দিব। একজন সত্যিকার নারী লেখক কখনো পুরুষের কণ্ঠে কথা বলতে পারে না, তাঁকে নারীর চিন্তা, ব্যথা বেদনার সাথে সম্পৃক্ত হতে হয়। … আর একজন নারী তখনই সফল লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন, যখন তিনি (পুরুষতান্ত্রিক) সমাজের আক্রমণের শিকার হন।’[53] ডরিস মায়ার ওকাম্পোকে নিয়ে যে বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থটি লিখেছেন তাতে রবিঠাকুরের ‘অ্যান্টি-ফেমিনিস্ট’ স্ট্যান্ড এর কিছু মৃদু সমালোচনা আছে। মায়ার বলেন, সাহিত্যিক অর্তেগা ই গাসেত্-এর মতো অতিমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা (পুরুষ = সৃজনীশক্তি, নারী = আবেগ) দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ প্রভাবিত না হলেও রবীন্দ্রনাথ সনাতন পুরুষদের মতোই মনে করতেন নারীর স্থান গৃহে বা তার কাছাকাছি[54]। কেতকী কুশারী ডাইসন অনুমান করেছেন, ওকাম্পোই সেই সূত্রগুলো মায়ারকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরো মনে করেন, ‘কবির প্রৌঢ় বয়সের সৃজনকর্মে প্রেরণা জোগানো ছাড়াও নারীবিষয়ক চিন্তনের ক্ষেত্রে তাঁর বিবর্তনকে সূক্ষ্মভাবে খানিকটা প্রভাবিত করেছিলেন ভিক্তোরিয়া’[55]। হয়তো কেতকীর অনুমান মিথ্যে নয়। যে কবিগুরু একটা সময় নারীদের মধ্যে কেবল জায়া আর জননী খুঁজতেন, ‘প্রকৃতির’ দোহাই দিয়ে মেয়েদের গৃহবন্দি রাখার উপদেশ দিতেন, সে কবিই ওকাম্পোর সাথে দেখা হবার চার বছরের মাথায় (১৯২৮ সালে) আঁকলেন এক সবলা নারীর প্রতিচ্ছবি –
এছাড়াও ‘আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা, গড়িব না ধরনীতে’ কিংবা ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি’ সহ বেশ কিছু গান কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে নারীপুরুষের চিরন্তন ছকের বাইরে গিয়ে তাদের সম্পর্ককে দেখতে পেরেছিলেন রবিঠাকুর।‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারকেন নাহি দিবে অধিকারহে বিধাতা?’
রবীন্দ্রনাথের শেষ দিককার অমর প্রেমের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’য় আগমন ঘটে জ্ঞানী, গুণী, বিদুষী এবং প্রথাভাঙা এক বলিষ্ঠ নারীর। লাবণ্য। অমিতের জীবনে ‘ঘড়ার জল’ হবার চাইতে ‘দীঘি’ হিসেবে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো তাঁর। আমরা জানি রবিঠাকুরের শত আমন্ত্রণ সত্ত্বেও ভারতবর্ষে আসেননি ওকাম্পো। আসেননি শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর সাথে দিনযাপন করতে। হয়তো, রবি ঠাকুরের জীবনে ‘ঘড়ার জল’ হয়ে থাকার চাইতে প্লাতা নদীর মতোই বহমান থাকতে চেয়েছেন তিনি। লাবণ্য-অমিতের বিদায় বেলায় যে বিখ্যাত লাইনগুলো শেষের কবিতায় সন্নিবেশিত হয়েছে – ‘হে ঐশ্বর্যবান / তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান / গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’ -এর সাথে মিল পাওয়া যায় ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির। ওকাম্পো সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন[56], ‘All I received from you has made me so rich in love that the more I spend, the more I have to give. And all I give comes from yourself…. So I feel I am giving nothing.’। স্বভাবতই, ১৯২৮ সালে বাঙ্গালোরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বাংলোয় বসে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি সমাপ্তির প্রাক্কালে রানী মহলানবিশের এক প্রশ্নের উত্তরে কবিগুরু বলেছিলেন, লাবণ্য তাঁর খুব চেনা চরিত্র – ‘লাবণ্যর সঙ্গে যেন আমার চেনাশোনা আছে, খুব যেন কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি’।
প্রায় জীবন-সায়াহ্নে এসে, ১৯৩৬ সালের অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মী সম্মেলনে পড়েছিলেন ঐতিহাসিক ‘নারী’ প্রবন্ধটি। নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের আমন্ত্রণে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এবং পাঠ করেছিলেন তাঁদের সমাবেশে। সে প্রবন্ধটিতেও অবশ্য নারীকে গতানুগতিক ভাবে ‘পুরাতনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, দেখানো করা হয় ‘আদ্যাশক্তি’ হিসেবে, নারীকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয় যে নারী ‘জীবলোকে প্রাণকে বহন করে’, ‘প্রাণকে পোষণ’ করে ইত্যাদি, কিন্তু পাশাপাশি দেখা যায় এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে যে রবীন্দ্রনাথ পিতৃতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠে নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নিতে পেরেছেন:
‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এসিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে। যে-সকল দেশ আপন আপন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক প্রাচীরের মধ্যে একান্ত বদ্ধ ছিল তাদের সেই বেড়া আজ আর তাদের তেমন করে ঘিরে রাখতে পারে না– তারা পরস্পর পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। স্বতঃই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়েছে, দৃষ্টিসীমা চিরাভ্যস্ত দিগন্ত পেরিয়ে গেছে। বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, নূতন নূতন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার-বিচারের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে’।যে রবীন্দ্রনাথ এক সময় ভাবতেন, প্রকৃতিই নারীকে ‘বিশেষ কার্য্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া’ গৃহবন্দী করেছে, সে ধারণা নিজেই বাতিল করে ‘নারী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মেয়েরা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন এই বৃহৎ সংসারের দায়িত্ব তাদের স্বীকার করতেই হবে…ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই উপলক্ষে মানুষের সৃষ্টিশীল চিত্তে এই-যে নূতন চিত্তের যোগ, সভ্যতায় এ আর-একটি তেজ এনে দিলে’ ।
হয়তো, তাঁর শেষ বয়সে লেডি রাণু, কিংবা ওকাম্পোর মতো মেধাবী নারীরা, আর নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের উদ্দীপনায় ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন নারীদের নিয়ে তাঁর সনাতন সংস্কার, হুমায়ুন আজাদের ভাষায়- তাঁর ‘আযৌবন প্রগতিবিরোধিতা’। হুমায়ুন আজাদ হয়তো যথার্থই বলেছেন, ‘সুখকর হচ্ছে যে পঁচাত্তর বছর বয়সে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, এবং আরো সুখকর হচ্ছে যে নারীরাই রূপান্তরিত করেছিল তাঁকে’।
৫
রবীন্দ্রনাথের প্রণয়-জীবনের যে দীর্ঘ পথপরিক্রমার সন্ধান আমরা পাই তাতে দেখা যায় যে তাঁর প্রথম জীবনে অন্তত যে চারজন নারীর (দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী ‘কবি-মানসী’ কাদম্বরী দেবী, আত্মারাম পাণ্ডুরঙের মেয়ে আনা তড়খড়, আর বিলেতে সার্জন স্কটের দু কন্যা ফ্যানি এবং লুসি প্রমুখ) প্রতি তাঁর আসক্তি দেখা গিয়েছিল, তারা সবাই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। কিন্তু মধ্যবয়সের পর থেকে (বিশেষত কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার পর থেকে) তাঁর স্ত্রী সহ যে নারীরা রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তারা সবাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে ছোট। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী – যাকে আড়াইশোর উপরে চিঠিপত্র লিখেছিলেন কবিগুরু[57], ছিলেন তাঁর স্ত্রীর বয়সীই (বারো বছরের কনিষ্ঠ), আর শেষ বয়সের নারীদের সাথে তাঁর বয়সের ব্যবধান ছিল বিস্তর। ওকাম্পোর সাথে তাঁর বয়সের ব্যবধান ছিল ২৯ বছরের, রাণু অধিকারীর সাথে বয়সের ব্যবধান ছিল বিয়াল্লিশ বছরের। এই প্যাটার্ন কি আমাদের কাছে কোন সত্য তুলে ধরে? বাংলাদেশ এবং ভারতের রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ এবং বুদ্ধিজীবীরা এর ব্যাখ্যা দেন ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই ঘাটতি পূরণের জন্য নাকি ছেলেবেলায় তার চেয়ে বেশি বয়সের নারীদের সান্নিধ্য তিনি কামনা করেছিলেন। পরে বয়সের সাথে সাথে এই প্রবণতা কমে আসে। যেমন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং গবেষক অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ ‘ভালবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলেছেন[58] –‘৬৫ বছরের তাঁর প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ [রবীন্দ্রনাথ] অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালবেসেছিলেন, তাঁদের সবার বয়সই, তার চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তাঁর যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই ঘাটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।ড. মুরশিদের কথায় কিছুটা সত্য থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আধুনিক জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অসম্পূর্ণ এবং প্রায় অপাংক্তেয় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ২০১২ সালে আমি একটা বই লিখেছিলাম ‘ভালবাসা কারে কয়?’ নামে[59]। অবশ্য কেবল ভালবাসা নয়, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাগ অভিমান, ঈর্ষা, সংঘাত প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলীর উদ্ভব এবং পরিস্ফুটনেরও বিশ্লেষণ হাজির করার প্রয়াস ছিল বইটিতে। সারা বিশ্ব জুড়ে জন টুবি, লিডা কসমাইডস, স্টিভেন পিঙ্কার, রিচার্ড ডকিন্স, ডেভিড বাস, ম্যাট রিডলী, জিওফ্রি মিলার, র্যাণ্ডি থর্নহিল, রবার্ট টিভার্স, মার্গো উইলসন, সারাহ ব্ল্যাফার হার্ডি, হেলেন ফিশার, রবিন বেকার সহ বহু গবেষকদের বিবর্তন মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা গবেষণা আজ বিজ্ঞানের অন্যতম আকর্ষণীয় এবং গবেষণার সজীব ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তাঁদের সেই কষ্টার্জিত আধুনিক গবেষণাগুলোকেই সহজ ভাষায় বাঙালি পাঠাকদের কাছে তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াস নিয়েছিলাম আমার এই বইয়ের মাধ্যমে। উদাহরণ হিসেবে প্রখ্যাত বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী ডেভিড বাসের কিছু কাজের কথা বইটিতে উল্লেখ করেছিলাম। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৩৭টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে ছেলে এবং মেয়েদের পছন্দের উপর নানা ধরণের জরিপ চালিয়েছিলেন অধ্যাপক বাস[60]। সেই সমস্ত জরিপ থেকে মানব সমাজে নারী-পুরুষের পছন্দ অপছন্দের কিছু চিত্তাকর্ষক প্যাটার্নের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। দেখা গেছে পরিণত বয়সের পুরুষেরা তাদের সঙ্গী নির্বাচনে সচরাচর তার চেয়ে সামান্য কম বয়সী নারীকে ‘মেটিং পার্টনার’ হিসেবে চয়ন করে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চালানো জরিপে দেখা গেছে পুরুষ এবং নারীর গড়পড়তা বয়সের পার্থক্য থাকে মোটামুটি ২.৫ বছর (অর্থাৎ পঁচিশ বছরের এক যুবক হয়তো বিয়ের সময় ২২.৫ বয়সী মেয়েকে বিয়ে করবেন)। এই বয়সের পার্থক্যের ব্যাপারটায় হেরফের থাকতে পারে, কিন্তু বিয়ের সময় পুরুষেরা তার চেয়ে কিছুটা কম বয়সী নারীকে যে পাত্রী হিসেবে চয়ন করে তা সংস্কৃতি নির্বিশেষে মানব সমাজের (গড়পড়তা) প্যাটার্ন। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় রক্ষণশীল দেশগুলোতে এবং যে সমাজে এখনো বহুগামিতা বিদ্যমান, সেখানে পাত্র-পাত্রীর বয়সের পার্থক্য বেশি থাকে। যেমন নাইজেরিয়ায় একজন ২৩ বছরের যুবক যখন পাত্রী সন্ধান করেন, তিনি তাঁর চেয়ে অন্তত ছয় বছরের ছোট, অর্থাৎ ১৭ বছর বয়সী পাত্রীর খোঁজ করেন। যুগোস্লাভিয়ায় একজন ২১.৫ বছরের যুবক পাত্রী হিসেবে চান ১৯ বছর বয়সী কন্যাকে। জাম্বিয়াতে বয়সের ব্যবধান ছয় বছর, আর ইরানে পাঁচ ইত্যাদি।
কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তাঁর সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য দিয়ে…’।
এর একটা বড় কারণ নিহিত রয়েছে জীববিজ্ঞানে। জৈবিকভাবে একটি মেয়ের প্রজনন ক্ষমতা বিশ বছর বয়সের পর দ্রুত কমতে শুরু করে। চল্লিশের পর সেটা নিম্নমুখী হয়ে যায়, আর পঞ্চাশের পর সেটা চলে যায় শূন্যের কোঠায়। অন্য দিকে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা নারীদের মত এত দ্রুত হারে কমে না। একজন পঞ্চাশ / ষাট বছরের ব্যক্তি খুব সফলভাবেই প্রজননক্ষম থাকেন। এই কারণেই পুরুষদের সারা পৃথিবীতেই প্রবণতা হচ্ছে নিজেদের বয়সের চেয়ে ছোট বয়সী মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে চয়ন করা। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, নিজেদের পৃথিবীতে সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা গড়পড়তা দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে, কিন্তু পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুণ্য এবং সৌন্দর্য। স্ত্রীর কাছ থেকে যথাসম্ভব তারুণ্য আদায় এবং তা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়েই গড়পড়তা ছেলেরা তাদের চেয়ে কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়, সেটা যতই অস্বস্তিকর লাগুক না কেন শোনাতে।
পুরুষেরা যেমন তাদের মেটিং পার্টনার হিসেবে তাদের চেয়ে একটু কম বয়সী নারীকে বিয়ের জন্য নির্বাচন করে, ঠিক তেমনি, নারীরাও তাদের চেয়ে একটু বেশি বয়সী পুরুষকে পাত্র হিসেবে অধিকতর যোগ্য মনে করে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় মেয়েরাও গড়পড়তা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া আর বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ কিংবা স্ট্যাটাস। সাধারণত যে কোন সমাজেই দেখা যায়, বয়সের সাথে সাথে পুরুষের আয় রোজগার ক্রমশ বাড়তে থাকে। আমি আমেরিকার যেখানে থাকি, সেখানে একজন ত্রিশ বছরের যুবক একজন বিশ বছরের যুবকের চেয়ে গড়পড়তা চোদ্দ হাজার ডলার বেশি রোজগার করে। কেবল আমেরিকা নয়, অধ্যাপক বাস ছয়টি মহাদেশ এবং পাঁচটি দ্বীপপুঞ্জের ৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জনের উপাত্ত সংগ্রহ করে উপর সমীক্ষা চালিয়েছেন – একেবারে আলাস্কা থেকে শুরু করে সেই জুলুল্যান্ড পর্যন্ত। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই দেখা গেছে, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আর্থিক প্রতিপত্তিকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে । জাপানে এই ‘চাহিদা’ সবচেয়ে বেশী দেখতে পাওয়া যায় আর হল্যান্ডে সবচেয়ে কম – কিন্তু তারপরেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারী-পুরুষের চাহিদার স্বরূপের প্যাটার্নটি একই রকমই থাকে। বিবর্তনীয় পথের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পুরুষেরা সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে আর বাইরে কাজ করে রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করেছে, সে কারণেই হয়তো একটি নারীর কাছে একটি পুরুষের সম্পদ, ভাল চাকরী, খ্যাতি, সামাজিক প্রতিপত্তি প্রভৃতি সচরাচর ‘আকর্ষণীয়’ বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিভাত হয়। সে কারণে এখনো মেয়েরা বিয়ের সময় তাদের চেয়ে বয়সে বড় একটি ছেলের ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হয়।
একটি জায়গায় একটু ব্যতিক্রম পাওয়া গেছে অবশ্য। ‘ছেলেরা তাদের চেয়ে কম বয়সী মেয়ে পছন্দ করে’ – এ ব্যাপারটা পাথরে খোদাই করা কোন নিয়ম নয়। বরং গবেষক কেনরিক এবং তাঁর দলবলের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশব এবং যৌবনের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে ছেলেরা তার বয়সের চেয়ে বেশি বয়সের মেয়েদের প্রতি আগ্রহী হয়[61]। এখানেও খুঁজলে দেখা যাবে রাজত্ব করে সেই জৈববিবর্তনের নিয়মই। একটি ১৫ – ১৬ বছরের ছেলের কাছে নারীর উর্বরাশক্তির নিরিখে ১২-১৪ বছরের নারীর চেয়ে ১৬/১৭ বছরের নারী অধিকতর আকর্ষণীয় বলে প্রতীয়মান হওয়ার কথা। তাই হয়। তাই এই বয়সে ছেলেদের ঝোঁক থাকে তার চেয়ে একটু বেশি বয়সের নারীকে পছন্দ করার, কিন্তু বিশ বছরের পর থেকেই এটা ক্রমশ ঘুরে যেতে শুরু করে, এবং একজন পরিণত বয়সের পুরুষ সঙ্গিনী হিসেবে তার চেয়ে কম বয়সী নারীকেই প্রেয়সী হিসেবে সনাক্ত করেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রণয়-জীবন যেন বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের এই ‘ক্লাসিক ট্রেন্ডের’ সফল মঞ্চায়ন। রবীন্দ্রনাথের বয়সন্ধিকালীন বা এর আগেকার সময়ে কাদম্বরী দেবী, এবং আনা তড়খড় সহ তাঁর পছন্দের নারীদের বয়স ছিল তাঁর চেয়ে বেশি। অথচ বিশ-বাইশ বছর বয়স অতিক্রম করার পরে যে সমস্ত নারীদের নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন, গান লিখেছেন, যে সমস্ত নারীরা হয়েছেন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তাঁর চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ – তারা সবাই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে ছিলেন নবীন। বোঝাই যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারী সৌন্দর্য অনুধাবন এবং অবগাহনের ক্ষেত্রে চিরন্তন বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের ট্রেন্ডকে অতিক্রম করতে পারেননি। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা পুরুষদের সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর প্যাটার্নের হদিস দিয়েছেন। দেখা গেছে, গড়পড়তা পুরুষেরা ত্রিশ বছর বয়সের দিকে কোন নারীকে সঙ্গী হিসেবে চয়ন করলে, তার সাথে সঙ্গিনীর বয়সের ব্যবধান থাকে পাঁচ বছর। কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিরা পাত্রী নির্বাচনকালে সময় পাত্রীর সাথে তার বয়সের ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায় বিশ বছর[62]।
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরুষদের অপেক্ষাকৃত বয়ঃকনিষ্ঠ নারীকে সঙ্গী হিসেবে পাবার ব্যাপারটি পুরুষদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করার সময় অপেক্ষাকৃত সহজভাবে দৃষ্ট হয়। প্রাপ্ত একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, আমেরিকায় পুরুষদের প্রথম বিয়ের সময় পাত্রীর সাথে গড়পড়তা বয়সের ব্যবধান থাকে তিন বছর, দ্বিতীয় বিয়ের সময় পাঁচ বছর, আর তৃতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে তা গিয়ে দাঁড়ায় অন্ততঃ আট থেকে দশ বছর[63]। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী মৃণালিনীকে হারানোর পর রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বিয়ে থা করেননি, কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর যে সমস্ত নারীদের প্রতি তিনি দুর্বল হয়েছিলেন তাঁদের বয়স এবং সৌন্দর্য বিচারে বলা যায় যে, তিনি পুনর্বার বিয়ে করলে হয়তো সেই ধারাতেই সমাপতিত হতেন। বিশেষত তাঁর শেষ জীবনে অর্থাৎ ষাটোর্ধ রবীন্দ্রনাথের মানসপ্রতিমারা – রাণু অধিকারী, রানী মহলানবিশ কিংবা ওকাম্পোর সাথে তাঁর বয়সের ব্যবধান গোনায় ধরলে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্যভাবে আমাদের মনের আঙ্গিনায় হানা দিতে বাধ্য।
রবীন্দ্রনাথকে এমন জৈবিকভাবে উপস্থাপনের ফলে রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞরা হয়তো গোস্যা করতে পারেন। তারা হয়তো বলবেন, সে সমস্ত নারীদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রেম ঠিক সেভাবে শরীর-নির্ভর ছিলো না। ছিলো অনেকটা আধ্যাত্মিক, প্লেটোনিক। এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথের বহু গান ও কবিতাতেই এ ধরণের ‘নিষ্কাম’ প্রেমের সন্ধান মেলে, কিন্তু আবার অনেক জায়গাতেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দেয় শরীরী আবেদন। তাঁর ‘চুম্বন’ ‘স্তন’ , ‘বিজয়িনী’, ‘বিবসনা’, ‘বলাকা-১৪’, ‘মানস সুন্দরী’, ‘হৃদয়-আসন’, ‘শেষ চুম্বন’ কিংবা ‘দেহের মিলন’-এর মতো কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ ভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। আসলে ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে যৌনতার আনয়নে, শরীরের উপস্থাপনায় কুণ্ঠিত এবং সম্ভোগ-বিমুখ’ – এমন একটি মিথ যে জনমানসে প্রচলিত, তার ব্যবচ্ছেদ করেছেন ইমন ভট্টাচার্য তাঁর সাম্প্রতিক ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে যৌনতা: একটি কিংবদন্তীর পুনর্বিচার’ শীর্ষক প্রবন্ধে[64]। রবীন্দ্র-সাহিত্য সিঞ্চন করে বিশেষতঃ গল্প, কবিতা এবং নাটক থেকে অজস্র উপকরণ তুলে এনে লেখক দেখিয়েছেন,’রবীন্দ্রনাথ যৌনতার বর্ণনায় কুণ্ঠিত ছিলেন না আদৌ। বরং রবীন্দ্রসাহিত্যই সেই ক্ষেত্র যেখানে যৌনতা এতো বিচিত্র রঙে, বিচিত্র মাত্রায় বর্ণিত হয়েছে’। এমন নয় যে, যৌনতার এই ‘বিচিত্র রঙ’ কেবল সাহিত্য কীর্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯২৪ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথকে লেখা রাণু অধিকারীর অন্ততঃ একটি চিঠিতে উল্লেখ আছে যে, একদিন ‘ভানুদাদার সমস্ত আদর’ তিনি পেয়েছিলেন, এবং সে আদর রাণুর ‘মনকে ভরে দিয়েছিল’। সেই চিঠিতে রাণু এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে তিনি আর কখনো কাউকেই বিয়ে করবেন না, কারণ ‘রবীন্দ্রনাথের সাথে তো তাঁর বিয়ে হয়েই গেছে’। ব্যাপারটা ‘ভানুদাদা হয়তো মানবেন না’, কিন্তু রাণু সেটা মানেন[65]। এ ধরণের কিছু ঘটনা কেবল রাণুর ক্ষেত্রেই নয়, আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর গৃহে থাকাকালীন সময়েও ঘটেছিল। এমন একটি ঘটনার উল্লেখ ওকাম্পোর স্মৃতিকথার ফরাসি ভাষ্য (আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত ফরাসি খসড়া) থেকে সরাসরি ইংরেজি অনুবাদ কেতকী কুশারী ডাইসন করেছেন ‘ইন ইয়র ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ বইয়ে[66] :
চিত্র: ওকাম্পোর আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত ফরাসি খসড়ার অনুবাদ যা কেতকী কুশারী ডাইসন লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ (১৯৮৮) বইয়ে। এই নথি থেকে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পো সম্পর্কের এমন একটি দিকের সন্ধান পাওয়া যায় যা তাঁদের মধ্যকার কথিত ‘প্লেটোনিক প্রেমের’ ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কোন এক রহস্যময় কারণে কেতকীর বাংলা বইটিতে (বইটির চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে গেছে) এর উল্লেখ নেই, তবে সম্প্রতি প্রকাশিত সমীর সেনগুপ্তের ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে ওকাম্পোর ডায়েরির বাংলা অনুবাদ সংযুক্ত হয়েছে এভাবে[67]:
‘…মাঝে মাঝে যখন আমি দেখতাম তিনি তাঁর রহস্যময় বাংলা হরফে লিখছেন, লিখছেন লিখেই যাচ্ছেন, কখনো কখনো আমি তাঁকে অনুরোধ করতাম কবিতাটির একটি অংশ আমার জন্য তরজমা করে শোনাতে। একদিন বিকেলে আমি ফুলদানিতে ফুল সাজাবার জন্য তাঁর ঘরে ঢুকেছি, তিনি বললেন যে তিনি তর্জমা করছেন। টেবিলে খোলা পৃষ্ঠাটির উপরে আমি ঝুঁকে পড়লাম। আমার দিকে মুখ না তুলে তিনি হাত বাড়ালেন, এবং যেভাবে লোকে গাছের ডালে একটি ফলকে ধরে, সেইভাবে আমার একটি স্তনের উপরে হাত রাখলেন। আমার মনে হল, আমার সমস্ত শরীরের ভেতর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল, আমি কুঁকড়ে গেলাম – একটা ঘোড়াকে যেন তাঁর মালিক আদর করছে এমন এক সময়ে যখন সে সেটা আশা করছে না। আমার ভিতরের জন্তুটা চিৎকার করে উঠল:‘না! না!’। কিন্তু আমারই ভেতর আরেকটা মানুষ যেন সাবধান করে দিল জন্তুটাকে: ‘শান্ত হয়ে দাঁড়াও, মূর্খ! বহুদেববাদী ধর্মের স্নেহপ্রকাশের শরীরী ভঙ্গি এটি, জরাগ্রস্তের লালসা নয়’। প্রায় বিদেহীভাবে আমাকে আদর জানিয়ে হাতটি সরে গেল, আমি কবিতাটি পড়লাম। … কিন্তু তিনি পরে আর কখনো এরকম করেননি। প্রতিদিন তিনি আমার কপালে অথবা গালে চুম্বন করতেন, আমার হাত ধরে বলতেন, ‘কী স্নিগ্ধ হাত তোমার’! ’কেতকী কুশারী ডাইসন অবশ্য তার বইয়ে এই ঘটনার কিছু নিজস্ব বিশ্লেষণ হাজির করেছেন ওকাম্পোর জীবনের আগেকার কিছু ঘটনা উল্লেখ করে – তাঁর গোপন প্রেমিক জুলিয়েন মার্টিনেজ যখন প্রথমবার ওকাম্পোর হাত ধরতে চেয়েছিলেন, তখন রূঢ়ভাবে হাত সরিয়ে নিয়েছিলেন, এলমহার্স্টের মুখের ওপর গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কাইজারলিঙের শরীরী ইঙ্গিতও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেখানে ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথকে বাধা দেননি, তাঁর হাত সরিয়ে দেননি। তবে কি তাঁর এতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল? তাঁর বইয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেতকী। তবে কেতকীর অনুমান এবং প্রশ্ন যাই হোক না কেন উপরের অনুচ্ছেদ থেকে এটা স্পষ্ট যে তাঁর স্তনের ওপর ঋষিপ্রতিম রবীন্দ্রনাথের সহসা আগ্রাসনে ওকাম্পো হতচকিতই হয়েছিলেন, এবং সেটাকে ‘এক্সোটিক’ ভারতীয় সংস্কৃতির তথাকথিত ‘বহুদেববাদী ধর্মের স্নেহপ্রকাশের শরীরী ভঙ্গি’র উপমায় নিজেকে প্রবোধ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু যে কেউ জানে, ভারতবর্ষ কেন, কোন সংস্কৃতিতেই নারীর স্তনের উপর পুরুষালী হাতের অযাচিত আগ্রাসনকে অন্তত ‘নিষ্কাম স্নেহ’ বলার অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথ হয়তো ওকাম্পোর দিক থেকে কোন ‘সুস্পষ্ট’ সাড়া না পেয়ে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেননি, কিন্তু এটি নিঃসন্দেহ যে, রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় কীর্তি এবং কাজকর্মকে কেবল ‘স্পিরিচুয়াল’ আর ‘প্লেটোনিক’ আখ্যায় আখ্যায়িত করলে বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হবে না। আমার ‘ভালবাসা কারে কয়’ বইটি লেখার প্রাক্কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের খোঁজ পেয়েছিলাম; রবার্ট রাইটসের লেখা ‘মরাল অ্যানিম্যাল’[68] । বইটিতে রাইটস বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে চার্লস ডারউইনের জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহকে ব্যাখ্যা করেছেন। ডারউইনের শৈশব এবং কৈশোর জীবন, এমার সাথে তাঁর প্রণয়, বিয়ে, মধুচন্দ্রিমা, স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা, সন্তানের জন্ম, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, তাদের মৃত্যুতে দুঃখ প্রভৃতি বহু কিছু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের কাঠামোতে ফেলে বিশ্লেষণ করেছেন। আমি আশাবাদী হয়তো একদিন কোন সাহসী এবং বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ কেবল ‘প্লেটোনিক প্রেম’ এবং ‘মাতৃস্নেহের খিদে’ দিয়ে বিশ্লেষণ সমাপ্ত করবেন না, বিশ্লেষণকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন আধুনিক বিজ্ঞানের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে।
বিবর্তন মনোবিজ্ঞান কেবল নারীর পুরুষের বয়সের কথাই বলে তা নয়। বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের কাজে। মানব সমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তিই মোটাদাগে সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের ফল তা অনেক বিজ্ঞানীই আজ মনে করেন[69]। প্রতিভার ব্যাপারটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ যে একজন প্রতিভাধর কবি ছিলেন তাতে কেউই সন্দেহ করবেন না। কেবল নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই নয়, কবিতা গল্প, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প থেকে শুরু করে চিত্রকলা – সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি কলার সর্বত্র তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ সত্যই অনন্য। তাঁর একক অবদানেই বলা যায়, তিনি বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছিয়ে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সত্তর বছরেরও বেশি হল তিনি তিরোহিত হয়েছেন, কিন্তু আজও তিনি প্রবল ভাবেই প্রাসঙ্গিক এবং ততোধিক উজ্জ্বলভাবে দীপ্যমান। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দেখতে শুনতে সুদর্শন এবং সেই সাথে অসম্ভব প্রতিভাধর। যৌবনে তো বহু নারীর হৃদয় হরণ করেছিলেনই, এমনকি শেষ বয়সেও তাঁর খ্যাতি, যশ এবং প্রতিভার জৌলুসে অনেক তরুণের চেয়ে ঢের বেশি পূর্ণযৌবনা নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন, জাগাতে পারতেন অহর্নিশি তাঁদের হৃদয়ে দোলা -‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে,দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়’। ‘লা নুই বেঙ্গলি’ পড়ে আমরা দেখেছি ষোল সতের বছরের মৈত্রেয়ী দেবী প্রায় সত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, খাতা জুড়ে পাতার পর পাতা রবীন্দ্রনাথের নাম লিখতেন। মৈত্রেয়ীর প্রেমিক মির্চা এলিয়াদকে ব্যাপারটা এতোটাই পরশ্রীকাতর এবং উদভ্রান্ত করে তুলেছিল যে, উপন্যাসের নায়ক অ্যালেনের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘[Tagore, that] … disgusting old charlatan! Corrupter of young girls’। এমনকি একটা সময় মৈত্রেয়ী কাউকে বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছিল। এমন একটা ফ্যান্টাসির জগত আরেক কিশোরী রাণু অধিকারীর মধ্যেও আমরা দেখতে পাই। কৈশোরে রাণু ভেবেছিলো ‘পাখি আমার নীড়ের পাখি’ বুঝি তাঁকে নিয়েই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; একটা সময় রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার জ্যোতিতে বিভ্রান্ত হয়ে তাঁকে ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ বানিয়ে বিয়ে থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন রাণু। এহেন প্রতিভার ধাক্কা কেবল মৈত্রেয়ী বা রাণু নয়, ওকাম্পোর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল, নির্দ্বিধায় বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের অমর কীর্তি গীতাঞ্জলি পড়েই ওকাম্পো যে প্রাথমিকভাবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা আমরা জানি। কিন্তু বিপরীতটিও কি সত্য নয়? সেই শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি কম নারী রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসেনি। কিন্তু জ্ঞানে, গুণে, ব্যক্তিত্বে, সৌন্দর্যে এবং কর্মস্পৃহায় বোধ করি ওকাম্পো ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম। একে তো সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, অর্তেগা তাঁকে ডাকতেন ‘La Gioconda del sur’ বা ‘দক্ষিণের মোনালিসা’ বলে; আর মননে এবং প্রজ্ঞাতেও ছিলেন সে অঞ্চলের নারীদের থেকে অগ্রগামী। সেই ১৯২০ সাল থেকেই ‘লা নেসিয়ন’-এর মতো পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। সারা জীবনে লিখেছেন ২৫টির মতো বই। তাঁর অনূদিত লেখকের তালিকায় আছেন কামু, টি ই লরেন্স, ফকনার, ডিলান টমাস, গ্রাহাম গ্রিন, জন অসবোর্ন সহ অনেকেই। ১৯৩১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৪০ বছর ‘সুর’ (Sur) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি, যে পত্রিকাটিতে ক্রমাগতভাবে লিখেছেন হর্হে লুইস বর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জ্যাক মারিত্যাঁ, পল ক্লোদেল, অল্ডাস হাক্সলি, সিমোন ওয়াইল, লিউইস মামফোর্ড, আঁদ্রে জিদ, মার্টিন হাইডেগার, এজরা পাউন্ড, ইভলিন ওয়, লরেন্স ডারেল, জাঁ পিয়াজে, আঁদ্রে ব্রেত, অক্টাভিয়ো পাজের মতো লেখক লেখিকারা। তিনি ছিলেন স্পষ্টবক্তা। নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। তাঁর কাছের মার্কসবাদী বন্ধুবান্ধবদের অনেকে তখন ভাবতেন নারীস্বাধীনতা আর নারীমুক্তি নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করার কিছু নেই। অর্থনৈতিক সাম্য এবং কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হলে নারীমুক্তি এমনিতেই ঘটে যাবে। ওকাম্পো তা মেনে নেননি। তিনি এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না … আগে দুনিয়ার মেয়েদের অবস্থা পাল্টাতে হবে, তারপর তা থেকেই অন্য পরিবর্তনগুলো আসবে; উল্টোটা নয়’। তাঁর এহেন কথাবার্তা আর কাজকর্মের জন্য ডান, বাম, ক্যাথলিক চার্চ সবার দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিলির নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা এক সময় ওকাম্পোকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, অবশ্য সেই নেরুদাই আবার ষাটের দশকে মত বদলে ওকাম্পোর প্রশংসা করেছেন। একবার এক চার্চসংস্থা ওকাম্পোর আগমন এবং বক্তৃতা নিষিদ্ধ করেছিল, তাদের মূল অভিযোগ ছিল ওকাম্পোর বাসায় রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় প্রদান এবং কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লেখক আঁদ্রে মালরোর[70] লেখা তাঁর পত্রিকায় ছাপানোর। অঢেল ধনসম্পদের মধ্যে জন্মানোর কারণে ‘বিদেশভক্ত বুর্জোয়া’ খেতাব যেমন পেতে হয়েছে, ঠিক তেমনি পত্রিকায় ভিন্নধর্মী এবং ভিন্নমতের প্রবন্ধ ছাপানোর কারণে ‘কমিউনিস্ট’, ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘নাৎসি’ প্রভৃতি বলে গালমন্দও শুনতে হয়েছে এন্তার। আর্জেন্টিনার পেরন সরকারের (১৯৪৬-১৯৫৫) আমলে তাঁকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৫৩ সালের ৮ই মে তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী মুক্তমত প্রচার এবং প্রকাশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে থাকতে হয়েছিল ছাব্বিশ দিন। অবশ্য কোন কোন মহল থেকে আক্রান্ত যেমন হয়েছেন, তেমনি প্রশংসাও পেয়েছেন অফুরন্ত। যেমন, স্প্যানিশ সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক হর্হে লুইস বর্হেস ওকাম্পো সম্বন্ধে বলেছিলেন,
‘সারা পৃথিবী এবং তার অমিতসম্পদ যে আমাদের উত্তরাধিকার তা ওকাম্পো জানতেন। এই স্বনামধন্য আর্জেন্টিনীয় লেখক কোন ধরণের কূপমন্ডুকবৃত্তিতে বিশ্বাস করেন না, সারা পৃথিবীর সংস্কৃতিকেই তাঁর আপন উত্তরাধিকার বলে গণ্য করেন’।আরেক সাহিত্যিক ওয়ালদো ফ্রাঙ্ক বলেন,
‘ভিক্টোরিয়ার জীবনে রূপ, বিত্ত এবং ধীশক্তি – তিনটিই যেন ছিল অভিশাপতুল্য। কিন্তু তিনটি অভিশাপকেই তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন। … ভিক্টোরিয়া কোন পরিস্থিতিতেই বাইরে থেকে সহজবোধ্য নন। তাঁরা নিটোল, সুন্দর দীর্ঘদেহ আড়াল করে রাখে তাঁর স্বভাবের সংবেদনশীলতা আর লাজুকতা। তাঁর নারীসুলভ বেদিত্ব ঢেকে রাখে তাঁর সাহসকে, যা প্রায়শই দুঃসাহস। তাঁর নাগরিক বৈদগ্ধের নীচে ঢাকা থাকে আসল মানুষটা – যিনি সহজিয়া হৃদয়াবেগে কৃষাণীর মতো, দাক্ষিণ্য আর প্রতিক্রিয়ার তীব্রতায় শিশুর মতো। আর তাঁর আর্থিক ক্ষমতাকে নিবেদিত করেছেন তাঁর তাঁর মূল্যবোধের সেবায় : শিল্পীর মূল্যের ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠায়’।এ সবের পাশাপাশি ওকাম্পো ছিলেন আধুনিকা, আর ফ্যাশন সচেতন। সে সময়কার ফ্যাশন সম্রাজ্ঞী কোকো শ্যানালের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। বন্ধুত্ব এবং পরিচয় ছিল ভার্জিনিয়া উলফ, কঁতেস দ্য নোয়াই, সিলভিয়া বিচ, ন্যান্সি এস্টর, ইন্দিরা গান্ধী এবং সুসান সোনট্যাগের মতো নারীদের সাথে। অবশ্য কার সাথে যে বন্ধুত্ব ছিল না সেটাই প্রশ্ন। ইগোর স্ত্রাভিন্সকি, মরিস রাভেল, এরনেস্ট আনসার্মে, পল ভ্যালোরি, ল করবুসিয়ের, আলবেয়র কামু, আদ্রিয়েন মোনিয়ের, আলডাস হাক্সলি,ভিটা স্যাকভিল ওয়েস্ট, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল সহ সেসময়কার খ্যাতিমান লোকজনের সাথে পরিচয় ছিল তাঁর। এমনকি সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রিন্স অব ওয়েলস এডওয়ার্ড-৮, য়ুং এবং মুসোলিনির সাথেও। তাঁর এই বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ পরিচয়ের সূত্র কাজে এসেছিল পেরন সরকারের আমলে কারাগারে থাকা সময়গুলোতে। পেরনের এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন ওয়ালদো ফ্রাঙ্ক, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ওকাম্পোর বন্ধুবান্ধবেরা। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পর্যন্ত ওকাম্পোর মুক্তিতে কূটনৈতিক ভূমিকা পালনে নেমে পড়েছিলেন। তাঁদের সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে পেরন সরকার ওকাম্পোকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি দিতে বাধ্য হন, যদিও তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে রাখা হয়েছিল ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত, আটকে দেয়া হয়েছিল তাঁর বিদেশে ভ্রমণ।
চিত্র:
ভিলা ওকাম্পোর একটি টেবিলে রাখা ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। ১৯৬৭ সালে ইন্দিরা
গান্ধী আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময় ওকাম্পোর বাসায় এসেছিলেন। এ সময়েই ওকাম্পো
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দেশিকোত্তম’ পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর এই জীবন-সংগ্রামের ফসল তিনি সার্থকভাবেই ঘরে তুলেছিলেন। ১৯৭৯ সালে
মারা যাবার আগ পর্যন্ত সারা জীবনে বহু পুরস্কারই পেয়েছেন তিনি। তাঁর কাজের
স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৭ সালে বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেয়া
হয়েছিল। একই বছর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রী লাভ
করেন, যা বিগত ৩৩০ বছরে মাত্র দশজন নারীকে দেয়া হয়েছে। ১৯৭৭ সালে
আর্জেন্টাইন একাডেমি অব লেটার্স’ এর সভানেত্রী (Alberdi Chair) নির্বাচিত
হয়েছিলেন যা কেবল এতোদিন পুরুষদেরই করায়ত্ত থাকতো[71]।
এর বাইরে আমি ওকাম্পোর একটি বিশেষ অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব। এ
ব্যাপারটি হয়তো অনেকেই জানেন না। ওকাম্পো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন
সহমর্মী-বান্ধব ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী গণহত্যার প্রতিবাদে ওকাম্পো
প্রতিবাদলিপি দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সরকারের কাছে। অবশ্য উনি একা নন,
হর্হে লুইস বর্হেস সহ অন্যান্য লেখকেরাও অংশ নিয়েছিলেন সেই সহমর্মিতায়।
জীবদ্দশায় তিনি বাংলাদেশ থেকে কোন সম্মাননা না পেলেও ২০১২ সালের ১৫
ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে মুক্তিযুদ্ধ
মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) দিয়ে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ
পুরস্কার হয়তো ওজনে বিশ্বভারতী কিংবা হার্ভার্ডের সমকক্ষ নয়, কিন্তু আমাদের
জন্য এ সত্যই গর্বের।আমি এবার আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময় লাইব্রেরি এবং রাস্তাঘাটের দোকানের বইপত্তর দেখে নিশ্চিত হয়েছি যে আর্জেন্টিনার প্রথম দশজন প্রথিতযশা সাহিত্যিকের একজন হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভ্রমণের সময় যে ট্র্যাভেল গাইডটি নিত্যসঙ্গী হিসেবে সার্বক্ষণিকভাবে আমার সাথে ছিল সেটা আজ খুলে দেখলাম তাতে হর্হে লুইস বর্হেস, আদোলফো বিয়য় ক্যসেরাসের পরেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম উল্লিখিত হয়েছে[72]:
চিত্র:
যে ট্র্যাভেল-গাইডটি (EYEWITNESS TOP 10 TRAVEL GUIDE) আর্জেন্টিনা
ভ্রমণের সময় আমার নিত্যসঙ্গী ছিল, সেটি খুলে আর্জেন্টিনার প্রথম দশ জন
বিখ্যাত সাহিত্যিকের মধ্যে ওকাম্পোকে খুঁজে পেলাম তিন নম্বরে।
আমার সাম্প্রতিক আর্জেন্টিনা ভ্রমণ, ভিলা-ওকাম্পো দর্শন এবং আনুষঙ্গিক
ইতিহাস পাঠ থেকে যতটুকু ওকাম্পোকে বুঝেছি, তাতে মনে হয় – তিনি খুব জটিল
চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। একরোখা, জেদি। ভীষণ আবেগী। কিন্তু পাশাপাশি আবার
মানবতা এবং নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন এবং যৌক্তিক। আবার কোন কোন
দিকে মানসিকতায় ছিলেন শিশুর মতোই সরল। আর্জেন্টিনায় থাকাকালীন সময়ে
রবীন্দ্রনাথের লেখালিখিতে যাতে কোন বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য ‘অখণ্ড অবসরের’
ব্যবস্থা করেছিলেন ওকাম্পো, কিনে দিয়েছিলেন একটি আরাম কেদারাও। আর্জেন্টিনা
থেকে চলে আসার সময় ভিক্টোরিয়া সেটিকে জোর করে জাহাজে তুলে দেন। এ নিয়ে
জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে তাঁর মহা বাকবিতণ্ডা হয়। কারণ চেয়ারটি কবিগুরুর
জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে ঢুকছিল না। কিন্তু ওকাম্পো বরাবরই নাছোড়বান্দা।
মিস্ত্রী ডাকিয়ে জাহাজের কেবিনের দরজা খুলে চেয়ারটিকে ভিতরে ঢুকানোর
ব্যবস্থা করলেন তিনি[73]।এই আরাম কেদারাটিকে শান্তিনিকেতনে এনে নিজের শয্যাপাশে স্থান দিয়েছিলেন রবিঠাকুর। তিনি সেই চেয়ারটিতে বসতেন, আর ওকাম্পোকে স্মরণ করতেন। ১৯২৫ সালের ৫ই জানুয়ারিতে লেখা একটি চিঠিতে রবিঠাকুর ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, ‘আমার দিন আর রাতগুলোর একটা বড় অংশ কাটে তোমার চেয়ারে ডোবা অবস্থায়, যে চেয়ারটি আমাকে অবশেষে বুঝিয়ে দিয়েছে তোমার পড়ে শোনানো বোদলেয়রের সেই কবিতাটির লিরিক তাৎপর্য’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, মৃত্যুর আগে পুত্রবধূকে প্রায়ই বলতেন ভিক্টোরিয়ার গল্প[74]। আরাম কেদারায় বসে ভাবতেন, লিখতেন ভালবাসার কবিতা। মৃত্যুর ঠিক চারমাস আগে, ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে কবিগুরু ‘বিদেশের ভালবাসা দিয়ে, যে প্রেয়সী পেতেছে আসন’ এর কথা স্মরণ করে লিখলেন[75]:
আরো একবার যদি পারিখুঁজে দেব সে আসনখানিযার কোলে রয়েছে বিছানোবিদেশের আদরের বাণী।…বিদেশের ভালোবাসা দিয়েযে প্রেয়সী পেতেছে আসনচিরদিন রাখিবে বাঁধিয়াকানে কানে তাহারি ভাষণ।ভাষা যার জানা ছিল নাকো,আঁখি যার কয়েছিল কথা,জাগায়ে রাখিবে চিরদিনসকরুণ তাহারি বারতা।
No comments:
Post a Comment