যৌনকর্মীর মেয়ে অন্ধকার অলি-গলি থেকে যেভাবে উঠে এলেন শীর্ষে
ভারতের প্রথম মহিলা আইপিএস
অফিসার এবং জাতিসংঘের পুলিশি উপদেষ্টা কিরণ বেদীর সঙ্গে দেশের হয়ে
প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছেন কলকাতার এক তরুণী কৃষ্ণা সরকার।কিন্তু কৃষ্ণা
কোনও সাধারণ বাঙালি পরিবারের মেয়ে নন। একজন যৌনকর্মীর মেয়ে। যদিও নিজে আজ
তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক পরিচয়। কালীঘাটের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার একটি
হোমের ইনচার্জ তিনি। আর আজ তাঁর সেই কাহিনি শোনাতেই পাড়ি দিচ্ছেন
আমেরিকায়। আগে যে তিনি দেশের বাইরে পা রাখেননি, তা নয়।
কিন্তু নিজের উত্তরণের জীবন কাহিনী শোনাতে
এই প্রথম। আগামী ৯ তারিখ ওয়াশিংটনে ‘ সেট্ল ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের
উওমেন অব দ্য ব্রেকফাসস্ট’এ তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য হাজির থাকবেন বিভিন্ন
দেশের তিনশো জন মহিলা প্রতিনিধি। এঁদের কেউ সাংবাদিক, কেউ সমাজকর্মী আবার
কেউ বা ব্যবসায়ী। আর সেই সভায় বাংলায় নিজের জীবনের উত্তরণের কথা বলতে
চলেছেন কৃষ্ণা।
কিন্তু কে এই কৃষ্ণা সরকার? কী করে সম্ভব হল তাঁর কালীঘাটের অন্ধকার অলি-গলি থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত যাত্রা?
কৃষ্ণা সরকার জানালেন, মা
যৌনকর্মী।কালীঘাটের এক চিলতে ঘরে ছোট থেকেই দেখতেন নিত্যনতুন লোকের
আনাগোনা। তারা কারা তখন খুব একটা বুঝতে না পারলেও, দেখতেন তাঁরা এলেই
দিদিমা তাঁকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন। এভাবেই পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত
কালীঘাটের গলিতেই কেটে গেছে তাঁর।কিন্তু হঠাৎই একদিন দিদিমা তাঁকে নিয়ে
মুর্শিদাবাদের একটি হোমে রেখে আসেন। সেখানেই হোমের ভিতরের স্কুলে পড়াশোনা
করতেন।
সেখানে থাকাকালীনও হোমের লোকজন মারধর
করতেন বলে দিদিমা তাঁকে ফের কলকাতায় নিয়ে চলে আসেন। আর তখনই তাঁর খোঁজ পায়
ওই এলাকার যৌনকর্মীদের শিশুদের নিয়ে কাজ করা এক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী
সংস্থা। এলাকার যৌনকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের সারাদিন নিজেদের কাছে রেখে
পড়াশোনা শেখানো, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবেরই দায়িত্ব নেয় এই সংস্থা।
শুরু হয় নতুন জীবন। নতুন করে স্কুলে ভর্তি
হয়ে পড়াশুনাও শুরু করেন তিনি। তাঁর পরের দুই বোনকেও ওই অন্ধকার জীবন থেকে
বার করে আনে সংস্থাটি। এরই মধ্যে এক দিন বাবাও মাকে ছেড়ে চলে যান। ফলে
বাবার সঙ্গেও যেটুকু যোগাযোগ ছিল, বন্ধ হয়ে যায় তা-ও। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই
হয়ে ওঠে তিন বোনের বাড়ি। এখানে থাকতে থাকতেই কৃষ্ণা মাধ্যমিক পাশ করেন।
এত কিছুর মাঝেও কিছুটা পিছিয়ে পড়েন
কৃষ্ণা। তাই এই বিশ বছর বয়সে যখন স্নাতক স্তরে পড়ার কথা, তখন
উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী তিনি।কারণ একবার কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ, ফের ফিরে
আসা কলকাতায়। এভাবে জায়গা বদল করতে গিয়ে তাঁর অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়।
বয়সটাও বেড়ে যায়। ফলে ২০১২ সালে তাঁকে সংস্থার নাবালিকাদের জন্য যে হোম,
সেখান থেকে বদলি হয়ে যেতে হয় ওই সংস্থারই অন্য এক হোমে। এখন তিনি ওই হোমের
আবাসিক এবং একাধারে ইনচার্জও।
সংস্থার কর্ণধার নিজে তাঁকে এই দায়িত্ব
দিয়েছেন। গান্ধী কলোনি ভারতী বালিকা বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী
কিন্তু শুধু পড়াশোনাতেই নিজেকে আটকে রাখেননি। সংস্থার কাছে নিজের ভাল
লাগার কথাও বলেন। আর তাদেরই সাহায্য নিয়ে ১২ বছর বয়স থেকে শুরু করেন
কত্থকের তালিম নেওয়া। আর এখন তো শুরু করেছেন ফোটোগ্রাফিও!
কৃষ্ণা অবশ্য তাঁর ওয়াশিংটন যাওয়া নিয়ে
খুব যে উচ্ছ্বসিত, তা নয়। বরং রান্না করতে, ঘর সাজাতে ভাললাগা কৃষ্ণার খুব
শান্ত গলায় একটাই বক্তব্য ভবিষ্যতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে চাই। পাশাপাশি
নাচটাও চালিয়ে যাব।ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার উর্মি বসুও জানালেন
কৃষ্ণার আত্মবিশ্বাস এবং নিয়মানুবর্তিতার কথা, যা তাঁকে সাহায্য করেছে
অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ ঘটাতে।
No comments:
Post a Comment