Pages

Monday, December 21, 2015

লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছে সে!




প্রথমে ভেবেছিলাম যাবো না। কেন যাবো আমি? কেন ??

তোমার না-থাকার আকস্মিকতা যখন মেনে নিতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে, তখন বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে। জীবিত তোমার উপর মান অভিমান করে থাকা যায়, কিন্তু যে আর বেঁচে নেই তার সাথে রাগ করা মানায় না। এই তো শেষ বার। আর কখনো তোমাকে দেখবো না, কোনোদিন নয়। কোনোদিনও নয়!

যখন লাশ কাটা ঘরের সামনে গিয়ে দাড়ালাম তখন রাত ১১ টা। অদ্ভুত বিষন্ন একটা ঘর, আধো আলো আধো অন্ধকার, চারিদিক সুনশান নিরবতা, দায়িত্বে থাকা মানুষ টি যখন সামনে এসে দাড়ালো, আমার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল্, আমি আসলে ‘কাকে’ দেখতে এসেছি সেটা বলতে। কী বলবো আমি? তুমি আমার কে হও!

লো পাওয়ারের বাল্ব এর, আলোতে দেখলাম মেঝে তে শুয়ে আছে ২/৩ টা লাশ। সাদা প্যাকেটে মোড়ানো লাশ গুলো থেকে রক্ত গড়িয়ে জমেছে আছে মেঝেতে। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম “ফ্রিজের” কাছে। পা কেঁপে কেঁপে উঠছে, গা-গুলানো তীব্র গন্ধ। তোমার আমার শেষ দেখাটা এভাবে হবে ভাবিনি। বাস্তবতা বোধহয় মাঝে মাঝে কল্পনাকেও হার মানায়।

ফ্রিজের প্রথন ড্রয়ারটা টান দিলো লোকটা। আমি সাথে সাথে ভিতরে তাকালাম। না তুমি নও। লোকটা ‘ওহ’ বলে ড্রায়ারটা লাগিয়ে দ্বিতীয়টা টান দিলো। আমি প্রথম বারের চেয়েও দ্রুততার সাথে তাকালাম ড্রায়ারের গভীর বরফে। প্রায় দশ বছর পরে দেখলাম সেই চেনা মুখ। তোমার মুখ! নিথর, শিরশিরে কপালে হাত রাখতেই আমার সাম্রাজ্য টলে উঠলো। কালো পাপড়িতে বন্ধ চোখ দুটোতে কী বিষাদ! এরপর আবারো পরম মমতায় ছুঁয়ে দেখলাম তোমার মুখ। না, আমার কান্না পায়নি। অদ্ভুত শুন্যতা অনুভব করছিলাম। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাড়ানোর শক্তি পাচ্ছিলাম না বলে ড্রয়ার টা ধরে দাঁড়িয়ে স্পষ্টত তাকিয়ে দেখলাম তোমাকে। তোমার নাথাকা ‘তোমাকে’।

প্রচন্ড কষ্টে তোমার চেহারা জুড়ে ছিল হাহাকার। চোখ একবারের জন্যও ঝাপসা হয়ে ওঠেনি আমার। আমার ভালোবাসার মানুষ, কতদিন বাদে তাকে দেখছি! কেন কাদঁবো আমি, কেন! কিছুক্ষণ বাদে নিজেই মর্গ থেকে বের হয়ে আসলাম। নিজেকে আড়াল করতে চাইলাম। কত স্মৃতি আমাদের। শীতার্ত স্মৃতিদের আনাগোনায় তীব্র গরমেও আমার কেমন জানি শীত শীত অনুভূত হতে লাগলো। ভালোবাসার মানুষ টার নিথর শরীর ফ্রিজে রেখে কিভাবে বাসায় যাবো আমি?

কী অদ্ভুত জীবন আমাদের। ভীষণ হাসি খুশি মানুষ টা আজ শুয়ে আছে লাশ কাটা ঘরে। কোথাও কেউ নেই। তীব্র বিভৎস গন্ধের মাঝে বসে থাকলাম আরো কিছুক্ষন। যেন আমারও কোথাও যাবার নেই। কিচ্ছু করার নেই। কান্না নেই, বেদনা নেই, আপোস নেই, উপোস নেই। খুব কঠিন কিছু আটকে আছে পাজর জ়ুড়ে। আমি নত মুখে বের হলাম মর্গ থেকে। তুমি শুয়ে থাকলে একা! সকালে পোষ্ট মার্টেমের অপেক্ষায়।

দেখা না হওয়া দশ বছর কত দ্রুত গেছে। না কিচ্ছু বদলাই নি। তুমিও না- আমিও না। অনেক গুলো প্রশ্নের উত্তর মেলাতে ইচ্ছে করছে আজ। আচ্ছা ডোম লোকটা নিশ্চয় জেনে গেছে, তোমার হৃদয় জুড়ে কত খানি বাস্তবতা ছিলো আর কতখানি না-পাওয়া। কতখানি অন্যরা ছিলো আর কতখানি আমি। তোমার কি জমানে কোনো কথা ছিলো? যা আমাকেই বলবে বলে রেখে দিয়েছিলে!

তোমার নিথর হয়ে থাকা দেহে কী অদ্ভুত অচঞ্চলতা। আমি তোমার কপালে যখন হাত রাখলাম, ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছিলো আমার। কামহীন-ক্রোধহীন-বেদনাহীন স্পর্শ। অন্যরা দোয়া পড়ার তাগাদা দিচ্ছিলো। বিড় বিড় করে আমি কেবলি বলে চলেছি ভালোবাসি-ভালোবাসি-ভালোবাসি। তোমার চোখার পাতা দুটো কি একটু কেঁপে উঠেছিলো। তুমি কি প্রাণপনে তোমার কষ্ট লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে! তোমার ঠোটে ছিল “হারিয়ে দিয়ে গেলাম ধরনের ‘বিদ্রুপের’ হাসি”। নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম, যেন আমার কোথাও যাওয়ার নেই।
তুমি তো সবকিছু থেকে লুকাতে চেয়েছিলে, হারিয়ে গেলে কেন? সকালেই স্থায়ী ঠিকানার উদ্দেশ্যে এ শহর ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবে তুমি। চেনা রাস্তা টুকু পেরিয়ে গিয়ে তোমার নিশ্চয় ফিরে আসতে ইচ্ছে করবে অচেনা ভুবন থেকে।

আমাকে গল্প শুনাতে ইচ্ছে করলে, যখন খুশি চলে এসো। পুরোনো গল্প নতুন করে শুনবো। এবার অন্তত নিজের কথা ভেবো আর ভালাবাসার দাবীটুকু রেখো। প্রাপ্তিযোগে, পুনরায় একলা হলাম আমি!

No comments:

Post a Comment