Pages

Saturday, November 28, 2015

সন্তানের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে বাবা মায়ের ভূমিকা কী?

বলা হয় শিশুরা কাদা মাটির মত। আপনি যে আকৃতিতে তাদের তৈরি করবেন, তারা সেরকম-ই হবে। তাই, আপনার শিশুর জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে আপনার ভূমিকা কিন্তু অনেক। শাসন এবং আদরের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক পথ দেখানোই প্রত্যেকটি মা বাবার দায়িত্ব।
আপনার সন্তানকে কতটুকু চেনেন?
আপনার সন্তানকে চেনেন তো? অবাক হলেন? আপনারই রক্ত বলে যে সে হুবহু আপনার মতই হবে সেটা ভেবে নেওয়া উচিৎ নয়।
বাচ্চারা একটা বয়স পর্যন্ত যা দেখে তাই করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ প্রবণতা কমে যায় এবং তার নিজস্ব সত্ত্বা বিকশিত হতে থাকে। তাছাড়াও আপনি আপনার সন্তানের সাথে কতটা সময় থাকছেন এবং সে আপনার সাথে কতটা সহজ সেটাও বুঝতে হবে। আপনার সন্তানের জীবনের লক্ষ্য কী হবে সেটা আপনার জায়গা থেকে না ভেবে আপনার সন্তানের জায়গা থেকে ভাবার চেষ্টা করুন। সেজন্য, সর্বপ্রথমে আপনার কাজ হচ্ছে, আপনার সন্তানকে খুব ভাল ভাবে চিনতে চেষ্টা করা।
আপনার অপূর্ণ স্বপ্ন বাচ্চার উপরে চাপাচ্ছেন না তো?
“আমি ইঞ্জিনিয়ার/ডাক্তার হতে পারলাম না! আমার সন্তানকে অবশ্যই ইঞ্জিনিয়ার/ডাক্তার বানাবো।” এরকম অনেক বাবা মা আছেন যারা তাদের নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন তাদের সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেন। আপনার সন্তান এবং আপনি দুইটি ভিন্ন সত্ত্বা। সন্তানের চাওয়াকে প্রাধান্য দিন; আপনি কী চান সেই অনুযায়ী সন্তানের জীবনের লক্ষ্য তার উপর চাপিয়ে দিবেন না। এভাবে অনেক বাচ্চা হতাশায় ভোগে এবং অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
সৃষ্টিশীলতায় বাধা দেবেন না
পড়াশুনার পাশাপাশি বাচ্চাদের অন্যান্য কার্যক্রমেও আগ্রহ দেখা যায়। কেউ গান গাইতে, নাচতে, আবৃত্তি করতে, খেলতে বা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতেও পছন্দ করে। বাবা-মা এটা দেখে অনেক সময় ভাবেন যে তাদের ছেলেমেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; পড়াশুনায় ফাঁকি দিচ্ছে। অবশেষে আপনি মারধর করে তাকে পড়তে বসান।
এর ফলাফল জানেন? আপনার সন্তান হয়ে ওঠে রক্তমাংসের তৈরি একটি পুতুল যে অন্যেরা যা বলে তা রোবটের মত পালন করে। তার মধ্যে নিজস্ব চিন্তা ভাবনার কোন স্থান থাকে না। সে হয়ে ওঠে পরনির্ভরশীল ও যান্ত্রিক।
আপনার সন্তান হয়তো হতে পারতো মাইকেল জ্যাকসন, সাকিব আল হাসান, শামিম আরা নিপা বা সাবিনা ইয়াসমিন। তাকে যে গান, আঁকা বা খেলাধুলা করে স্বীকৃতি পেতেই হবে বা এগুলোকে জীবনের লক্ষ্য বানাতে হবে তা কিন্তু নয়; সখ বলে তো একটা কথা আছে? প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল কাজের প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনার সন্তানের পড়াশুনা ও জীবনযাপনের উপর পড়ে। পড়াশোনা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব সবার প্রথমেই, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই; তবে তা যেন সৃষ্টিশীলতার পরিপন্থী না হয়।
বাচ্চাদের স্বপ্ন পূরণে পথ দেখান
বাচ্চাদের স্বাধীনতায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন। বড় হয়ে সে কী হবে তার আভাস যদি ছোট বেলাতেই পাওয়া যায়, তাহলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আপনার উৎসাহ তাকে আরও সামনের দিকে অগ্রসর করবে। তবে তাদের জীবনের লক্ষ্য যদি ভুল হয় তবে তাতে বাধা দেওয়াও আপনার কর্তব্য।
প্রশংসা করুন
আপনার সন্তান খারাপ কিছু করলে যেমন তাকে শাসন করেন, ঠিক তেমনি ভাল কিছু করলে তার প্রশংসাও করুন; সবার সামনে। সন্তানের দুর্বলতার কথা পরিবারের মধ্যেই রাখতে চেষ্টা করুন। সবাইকে বলে বেড়ালে তারা মানসিকভাবে আঘাত পেতে পারে। এর ফলে আপনার সন্তান জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
অন্যদের সাথে তুলনা করবেন না
আপনার সন্তান ভাল না খারাপ তা কখনই অন্যের সন্তানকে দেখে বিচার করবেন না। আপনার সন্তানের ভাল মন্দের মানদণ্ড সে নিজেই; তাই তার ভাল বা খারাপ দিক তার কাজের মধ্য দিয়ে বিচার করুন। পাশের বাসার একজন বা আত্মীয়ের মধ্যে অন্য কেউ প্রথম হয়েছে বলে আপনার সন্তানকে সেই উদাহরণ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করবেন না। সন্তানকে তার নিজের গতি ও পথে সফল হওয়া শিখান; সবাই যেভাবে জীবনের লক্ষ্য অর্জন করে আপনার সন্তান সেভাবে নাও চলতে পারে। সফলতার শিখরে উঠার পরামর্শ দিন; অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে উপরে ওঠার না।
অর্থ ও আগ্রহ বা শখের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখুন
কাজের ক্ষেত্রে শখের গুরুত্ব যেমন; বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজনও তেমন। তাই আপনার সন্তানকে সখ বা ভাল লাগার কাজ ও অর্থ উপার্জনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার শিক্ষা দিন। টাকা বা অর্থের মানদণ্ডে মানুষকে বিচার করা এবং সেই সাথে টাকার পিছনে নিজের সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে ছোটা- এসব অভ্যাস ও উদাহরণ থেকে তাকে সরিয়ে নিয়ে আসুন এবং সঠিক পথে জীবনের লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করুন।
লক্ষ্য অর্জনের অভ্যাস গড়ে তুলুন
আপনার সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলুন। যে লক্ষ্য থাকবে সেটা পূরণ করার সর্বাত্মক সৎ চেষ্টা যেন সে করে। সর্বাত্মক চেষ্টা করে বিফল হয়েছে পৃথিবীতে এর কোন নজির নেই। ছোট ছোট কাজকে লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচন করুন যাতে তার সফলতার অভ্যাস থাকে। যেমন- সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠা, স্কুলে কারো সাথে মারামারি না করা, রাত ৮টার মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ করা ইত্যাদি।
ব্যর্থতা সফলতারই একটি অংশ
Failure is the pillar of success! আপনার সন্তান কোন কাজে ব্যর্থ হতেই পারে। তাই বলে যে সে আর সফল হতে পারবেনা এমন কোন কথা নেই। ব্যর্থতার মধ্যেই সফলতার দিক-নির্দেশনা নিহিত। আশানুরূপ ফল পায় নি বলে তাকে বকাঝকা না করে আপনার সন্তানের সাথে কথা বলুন, তার সমস্যার কথা শুনুন এবং সফলতার অন্তরায় থাকা বিষয়গুলো কাটিয়ে উঠে জীবনের লক্ষ্য অর্জনের রাস্তা বের করুন।
আত্মবিশ্বাসী
তুমিই পারবে! এভাবেই আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন আপনার সন্তানকে। আত্মবিশ্বাস ছাড়া সফলতা ডুমুরের ফুলের মতই অসম্ভব। আপনার সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করুন। তাকে এমন কাজ দিন যা খুবই সহজেই সে পারবে। ধীরে ধীরে কাজের ধরন জটিল করতে থাকুন। তবে খেয়াল রাখবেন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের অহংকারী করে তোলে। আত্মবিশ্বাসকে অহংকারের পর্যায়ে যেতে দেয়া যাবে না। এতে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
সকলকে সমান চোখে দেখা
আমাদের সমাজ ধনী, গরিব, শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত, সাদা, কালো বিভিন্ন ধরনের মানুষ নিয়ে গঠিত। আমাদের সবার প্রথম পরিচয়, আমরা মানুষ। আপনার সন্তান যেন সবাইকে সমান সম্মান দেয়া শেখে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং একজন রিকশাওয়ালার সাথে আচরণ যেন সমান ও স্বাভাবিক হয়। কারও সাথে খারাপ ব্যবহার এবং তোষামোদ- উভয়ই বর্জন করা উচিৎ। সঠিক উপায়ে জীবনের লক্ষ্য অর্জনে প্রত্যেকের আচরণে স্বচ্ছতা থাকা জরুরী।
শুধু তাই নয়, জীবনে চলার পথে পক্ষপাতিত্ব, অসদাচরণ, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া এগুলো সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দেয়া জরুরী। জীবনের লক্ষ্য অর্জন করাই মুখ্য ব্যাপার নয়, কিভাবে বা কোন পথে সেই লক্ষ্য অর্জন করা উচিৎ সে সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দেয়া প্রত্যেকটি পিতামাতার দায়িত্ব।

No comments:

Post a Comment