Pages

Thursday, December 17, 2015

ইসলামে শিয়ামতবাদ, শিয়া এবং সুন্নীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য

কারবালার ট্র্যাজেডি গোটা ইসলামী জাহানকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলে। ইমাম হোসাইন (রাঃ)কে ইয়াযিদ বাহিনী যে নিষ্ঠুর এবং নির্মমভাবে হত্যা করেছে তা পৃথিবীর সকল মানবতাকে হার মানিয়েছে। শান্তির ধর্ম ইসলামে ইয়াযিদের পাপিষ্ঠ বাহিনী কালিমা লেপন করেছে। পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজ বা জাতি এ হত্যাকা-কে মেনে নিতে পারেনি। সমরবিদ মুয়াবিয়া (রাঃ) একজন কাতেবে রাসূল বা ওহী লেখক হিসাবে তার পুত্র ইয়াযিদকে কিভাবে খেলাফতের জন্য মনোনীত করলেন এ প্রশ্ন আদৌ আমাদের নিকট পরিষ্কার নয়? তবে ইতিহাস সাক্ষী দেয় মুয়াবিয়া (রা. ) পিতা ছিলেন আবু সুফিয়ান (রা.) ইসলামের এককালের চরম শত্রু। আমাদের প্রিয় নবী (সঃ) কে খুবই কষ্ট দিয়েছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম ও রাসুলের বিরোধী ছিলেন। মুয়াবিয়া (রা.) মাতা হিন্দা ওহুদের যুদ্ধে নিহত মহানবী (স.) চাচা হযরত আমির হামজা (রা.) হৃৎপি- চর্বণ করেছিলেন। ৬৩০ খ্রিঃ মক্কা বিজয়ের পর পিতা ও পুত্র অর্থাৎ আবু সুফিয়ান (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.) দলবলসহ ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। তবে আমাদের মহানবী (স.) মুয়াবিয়া (রা.) সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং মহানবী (স.) তার ভগ্নী উম্মে হাবিবাকে বিবাহ করেছিলেন। (ইসলামের ইতিহাস, অধ্যাপক কে. আলী পৃষ্ঠা- ২৩১) ইতিহাস আরো সাক্ষী দেয় যে, মুয়াবিয়া (রা.) ছেলে ইয়াযিদের পরামর্শে নিজ স্ত্রী কর্তৃক ইমাম হাসান (রা.) কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। হযরত মুহাম্মদ (স.) মুসলিম সমাজে কুরআন ও হাদিস ভিত্তিক যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও আদর্শগত সংঘাতে সে ঐক্য বিনষ্ট হয়। কালক্রমে মুসলিম সমাজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সম্প্রদায়সমুহকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় এ দু, শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। নিম্নে শিয়া সম্প্রদায়ের মতামত উত্থান এবং শিয়া ও সুনি্নর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। শিয়া শব্দটির অর্থ দল। ইসলামের ইতিহাসে হযরত আলী (রাঃ) দল (শিয়াত-ই-আলী, আলীর দল) সাধারণত শিয়া নামে পরিচিত। শিয়া মাজহাব প্রথমে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্ন প্রকাশ করে। কিন্তু পরে ধর্মীয় মাজহাবে পরিণত হয়। ইসলামের খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.)-এর নির্বাচনের সময় হতে শিয়া আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ওফাতের সময় তাঁর জামাতা হযরত আলী (রা.) খলিফা হবেন বলে শিয়ারা আশা করেছিলেন। কিন্তু তাদের এ দাবি উপেক্ষিত হলে হযরত আলী (রা.) সমর্থকগণ নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। এরপর হযরত ওমর ও হযরত ওসমান (রা.) যখন খলিফা নির্বাচিত হলো তখনও হযরত আলী (রা.) এর সমর্থকগণ তাকে নির্বাচন করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। এভাবে হতাশ ও ব্যর্থ হয়ে হযরত আলী (রা.) সমর্থকগণ তাকে না জানিয়ে তার স্বপক্ষে এক গোপন আন্দোলন শুরু করেন। যাহা পরবর্তীকালে শিয়া সম্প্রদায় নামে পরিচিতি লাভ করে। কারবালার নির্মম ও নির্দয় হত্যাকা- হযরত আলী (রা.) সমর্থকদের মাঝে প্রতিহিংসার আগুনে প্রজ্বলিত করেছিল, তারা কোনো ক্রমেই এ শোকাবহ ঘটনা সহ্য করতে পারে নাই, যাহা তুষের আগুনের মতো তাদের অন্তরে এখনো জ্বলছে। অধ্যাপক পি, কে হিট্রি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'আল- হোসাইন (রাঃ) রক্ত শিয়া মাজহাবের বীজ বলে প্রমাণিত হলো এবং দশই মহররম তারিখে শিয়া মতবাদ জন্ম লাভ করলো।' এভাবে ইমাম হোসাইন (রাঃ) নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের ফলে ধর্মীয় 'রাজনৈতিক' সম্প্রদায় হিসাবে শিয়া মতবাদ সৃষ্টি হয়।

শিয়া মতবাদ : মহানবী (সঃ)-এর পর হযরত আলী (রা.) খিলাফত স্বীকৃতি এবং আলী ও ফাতেমা (রা.) বংশধরদের মধ্যে পুরুষানুক্রমিক খিলাফতের অধিকার নিয়ে শিয়া মতবাদের সূচনা হয়। শিয়াদের মতে, ইমাম বা নেতৃত্ব হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বংশধরদের বংশগত অধিকার এবং সে কারণে তা হযরত আলী (রা.) এবং তার পত্নী নবী নন্দিনী ফাতেমা (রা.) বংশধরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইমামতের মতবাদ শিয়াদের নিকট ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত হয়। শিয়ারা হযরত আলী (রা.) ব্যতিত আর সকল খলিফা অবৈধ। অর্থাৎ হযরত আলী (রা.) ব্যতিত কোনো খলিফাকে তারা মানেনা। আবার তারা উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফাদ্বয়কে অবৈধ দাবিদার বলে মনে করেন। শিয়ারা কালেমার সঙ্গে হযরত আলী (রা:) নাম সংযোজন করে পড়েন। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নামের সঙ্গে আলী খলিফাতুল্লাহ কথাটি সংযোজন করে পড়ে। শিয়ারা মনে করে ইমাম স্বর্গীয় নিয়োগ । শিয়ারা আরো মনে করে ইমাম মুসলিম সমাজের একচ্ছত্র সঙ্গত নেতা। তিনি আল্লাহর নিযুক্ত এবং তার নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের কোনো অধিকার নেই। কারণ, মানুষের নির্বাচন কখনও কখনও ত্রুটিপূর্ণ হয়। শিয়াদের মতে, ইমাম শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নেতাই নন, পার্থিব নেতাও বটে। তারা ধারণা পোষণ করে যে, দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মদ আলী মুনতাজার মাহিদী হয়ে সত্যিকার ইসলামের পুনরুদ্বারে সমগ্র বিশ্ব বিজয় ও কিয়ামতের পূর্ববর্তী সহস্্রাব্দের সূচনা করার জন্য আবির্ভূত হবেন। হযরত আলী (রা.) বিশেষ বংশধর সম্পর্কে তাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। শিয়াদের বিশ্বাস হযরত আলী (রা.) হযরত মুহাম্মদ (স.) নিকট হতে আধ্যাত্মিক শক্তির আলোক পেয়েছিলেন এবং তার দেহে আল্লাহর পবিত্র রৌশনী প্রতিফলিত হয়েছিল। তারা আবার গুপ্ততার নীতিতে বিশ্বাসী। উমাইয়া, আব্বাসীয়দের শাসনামলে শিয়ারা চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। এ কারণে তারা গোপনে তাদের মতামত প্রচার করতে থাকেন। তারা আবার ত্রিত্ত্ববাদ নীতিতে বিশ্বাসী। হযরত মুহাম্মদ (স.) হযরত আলী (রা.) হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) কে তিন অবতার বলে মনে করে। খ্রিস্টানদের ত্রিত্ত্ববাদের সঙ্গে তাদের মিল আছে। তারা আবার জন্মান্তর বাদেও বিশ্বাসী।

শিয়া ও সুনি্নর মধ্যে পার্থক্য : শিয়া ও সুনি্ন উভয় মাযহাবের মুসলমানগণ আল্লাহর একত্ব এবং হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নবুয়তে বিশ্বাসী হলেও উভয়ের মধ্যে কতগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ: ১) সুনি্নরা খোলাফায়ে রাশেদীনের ইমামতে সমভাবে বিশ্বাসী। শিয়ারা হযরত আলী (রা.) কে রাসূলে করিম (স.)-এর একমাত্র ন্যায় সংগত উত্তরাধিকারী । প্রথম তিন খলিফাকে খিলাফতের অবৈধ দাবিদার মনে করে।

২) সুনি্নরা সুন্নাহ ও হাদিসের সমর্থক, শিয়ারা সুন্নাহ ও হাদিস অগ্রাহ্য করে এবং তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বা আখবার মেনে চলে।

৩) সুনি্নদের বিশ্বাস হযরত মুহাম্মদ (স.) আখেরী নবী এবং তারপরে আর কোনো নবী আসবে না। অথচ শিয়াদের একটি বিরাট অংশবিশেষ মনে করে ইসমাঈলীয়দের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস যে, ইমাম ইসমাঈল আখেরী নবী ছিলেন।

৪) সুনি্নদের মতে, ইমাম মুসলিম সমাজের ভেতর হতে নির্বাচিত হবেন এবং তিনি তার কার্যকলাপের জন্য মুসলমানদের কাছে জবাব দিহি করবেন। ইমামের পদ কোনো পরিবার বা গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত থাকবেনা। যে কোনো মুসলমান, এমনকি গোলামও উপযুক্ত যোগ্য বলে বিবেচিত হলে তাকে সবার ইমাম নির্বাচন করবেন।

পক্ষান্তরে, শিয়াদের মতে, ইমাম মুসলিম উম্মতের একচ্ছত্র নেতা। তিনি আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত এবং তাকে নিযুক্ত করা মানুষের কোনো অধিকার নাই। কারণ তাদের নির্বাচন ত্রুটিযুক্ত হতে পারে। তারা আরো যুক্তি দিয়ে বলে যে, ইমামতের অধিকার একমাত্র হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর বংশধরদের প্রাপ্য।

৫) সুনি্নরা হযরত ফাতেমা (রা.) কোনো বিশেষ বংশধরকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস করেনা। অথচ শিয়ারা বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস করে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, ইমাম মাহদী ফাতেমার বংশধর এবং বহু শতাব্দী গায়েব থাকার পর তিনি আবির্ভূত হবেন।

৬) সুনি্নরা ইমামকে আল্লাহর প্রতিচ্ছায়া মনে করে না। অথচ শিয়ারা ইমামকে আল্লাহর প্রতিচ্ছায়া মনে করে।

৭) সুনি্নরা জুম'আর নামাজ জামা'আতে আদায় করে, কিন্তু শিয়াদের মতে, এ নামাজ ব্যক্তিগতভাবে পড়া যায়। শিয়ারা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের স্থলে তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।

৮) ধর্মীয় পর্ব উদযাপনের ব্যাপারেও সুনি্ন ও শিয়াদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। শিয়ারা প্রাচীন পার্সি সালের নববর্ষের দিনে নওরোজ উৎসব পালন করে। তারা আরও এমন কতগুলো পর্ব উদযাপন করে। সুনি্ন কানুনে যার কোনো স্থান নেই। শিয়ারা ইমাম হুসাইনের শাহাদাত বরণ স্মৃতি রক্ষার্থে মহররম পর্ব উদযাপন করে তাজিয়া মিছিল বের করে এবং শোকের মাতম হিসেবে নিজের শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করে। অথচ সুনি্নরা কেবল দশই মহররম দিনে বিশেষ ইবাদত বন্দেগী করে।

৯) শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে মু'তা (অস্থায়ী) বিবাহ বৈধ। পক্ষান্তরে সুনি্ন কানুনে এ ধরনের বিবাহের কোনো স্থান নেই। সুনি্ন কানুনে এ ধরনের বিবাহ একটি জঘন্যতম ঘটনা এবং ব্যভিচারের সামিল।

পরিশেষে আমি এ কথা বলতে পারি যে, হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন তোমাদের উচিত আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নার অনুসরণ করে চলা। তিনি আরো বলেছেন, আমার সাহাবারা আকাশের তারকা রাজির মতো। তোমরা তাদের যেকোনো একজনকে অনুসরণ করলে আমাকে পাবে। সেই হিসাবে মুয়াবিয়া (রা.) রাসূল (স.) একজন উচ্চস্তরের সাহাবী ছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমরা সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়া (রা.) সমালোচনা করা ঠিক হবে না। আবার হযরত আলী (রা.) ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা। হযরত মুহাম্মদ (স.) তার সম্পর্কে বলেছেন, আমি হলাম জ্ঞানের শহর, আর হযরত আলী (রা.) হলেন সেই শহরের দরজা সরূপ। তিনি কখনো তার পূর্ববর্তী তিন খলিফার বিরুদ্ধাচারণ করেননি। বিধি মোতাবেক তিনি খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাকে পছন্দ করে না জানিয়ে একদল লোক অতি রঞ্জিত করে ইসলামের ক্ষতি করেছে। আবার তার বিরুদ্ধাচারণ করে আরেক দল লোক ইসলামের আরো ক্ষতি করেছেন। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয় এ দুটি দলের কোনটিকে তিনি পছন্দ করেননি। তাই আমরা আজ বিশ্বায়নের যুগে ইসলামে অনেক দল বা মতবাদ থাকা সত্ত্বেও ইসলাম কখনো আল্লাহর কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী দলকে সমর্থন করে না। সুতরাং মহান আল্লাহ যেন সকল মুসলমানকে ইসলামের সঠিক পথে চলার তওফিক দান করেন এ মিনতি করছি। আমীন!

No comments:

Post a Comment