Pages

Thursday, December 17, 2015

বানাতুন্নবী বা নবীদুলালী হযরত যয়নব (রা.) বিনতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)

সব কয়েদীকেই যেহেতু ফিদিয়া নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, আবুল আছ নবীজীর জামাতা বলে তাকে ফিদিয়া ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হবে এটা তো শানে নবুওয়াতের বিরোধী। এটা কি করে হতে পারে? তাই আবুল আছ এর ফিদিয়া এই সাব্যস্ত হয় যে, তিনি মক্কায় ফিরে গিয়ে স্ত্রী যয়নবকে মদীনায় প্রেরণ করবেন। হযরত যয়নবকে মদীনায় নিয়ে আসার জন্য আবুল আছ এর সাথে হযরত যায়েদ ইবনে হারেসাকেও দেয়া হয়। তাকে বলে দেয়া হয় যে, তুমি বতনে এয়াজিজ-এ অপেক্ষা করবে। হযরত যয়নব সেখানে পৌঁছলে তাকে নিয়ে মদীনায় আসবে। আবুল আছ মক্কায় ফিরে যয়নবকে তার ছোট ভাই কেনানার সাথে যাওয়ার অনুমতি দেন।
হযরত যয়নব যখন সফরের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন হিন্দ ইবনে ওতবা তার কাছে এসে বললেন, হে নবী দুলালী! তুমি কি পিতার কাছে যাচ্ছ? তিনি বললেন, আপাততঃ তো তেমন ইচ্ছে নেই, ভবিষ্যতে আল্লাহর মর্জী হলে দেখা যাবে। হিন্দ বললেন, বোন আমার কাছে গোপন করার কি প্রয়োজন? তুমি সত্যিই যদি যেতে চাও এবং পথের সম্বলের কিছু প্রয়োজন থাকে তাহলে বিনা দ্বিধায় বলতে পার, আমি খেদমতের জন্য প্রস্তুত। তখনো নারী সমাজের মধ্যে শত্রুতার বিষ-বাষ্প ছড়ায়নি, যা  পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়েছিল। এ জন্য হযরত যয়নব বলেন যে, হিন্দ যা কিছু বলেছিলেন, সরল মনেই বলেছিলেন। অর্থাৎ আমার কোন জিনিসের প্রয়োজন হলে তিনি অবশ্যই পুরো করতেন।
মোট কথা, সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দেবর কেনানা ইবনে রাবী‘কে সঙ্গে নিয়ে উটের পিঠে আরোহণ করে তিনি মদীনা শরীফ রওয়ানা হন। তখন চারিদিকে ছিল কাফের। তারা পেছনে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কাও ছিল। তাই কেনানা তীর-ধনুক ইত্যাদিও সাথে নেন। তারা রওয়ানা হলে কাফের মহলে হৈ-চৈ পড়ে যায়। কোরাইশের লোকজন তাদেরকে পাকড়াও করার কথাও চিন্তা করতে লাগলো। তাদের সন্ধানে এক দল লোক বেরিয়ে পড়ে।
তারা যি-তুয়া নামক স্থানে এদেরকে ঘেরাও করে ফেলে। ঘেরাওকারীদের দলে হাব্বার ইবনে আসওয়াদ এবং অপর এক ব্যক্তিও ছিল। হাব্বার ইবনে আসওয়াদ ছিলেন হযরত খাদীজার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। ইনি সর্ম্পকে হযরত যয়নবেরও ভাই হন। তার এ অন্যায় আচরণের জন্য মক্কা বিজয়ের দিন নবীজী তাকে হত্যার অনুমতি দেন। কিন্তু তিনি অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের একজন হযরত যয়নবের প্রতি বল্লম দিয়ে হামলা চালায়। তিনি উঠের পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যান। তখন তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা ফলে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। তিনি ভীষণ আঘাত পান। এরপর কেনানা তীর বের করে বলেন, এখন যে কেউ আমার কাছে আসবে, কবর হবে তার ঠিকানা। তার এ ঘোষণার পর সকলে এদিক সেদিক চলে যায়। কোরাইশ সরর্দাদের সাথে আবূ সুফিয়ান সামনে অগ্রসর হয়ে বলে, তুমি ক্ষণিকের জন্য তীর বন্ধ কর। আমরা তোমার সাথে একটু কথা বলে নেই। কেনানা তীর কোশবন্ধ করে জিজ্ঞেস করেন, কি বলতে চাও, বল। আবূ সুফিয়ান বললেন, মুহাম্মদ (সা.) এর হাতে আমাদেরকে যে বিপদ-মুছিবত, পরাজয় এবং লাঞ্ছনা- অবমাননার গ্লানী সইতে হচ্ছে, সে সর্ম্পকে তোমরা বেখবর নও। এখন তোমরা যদি প্রকাশ্যে তার কন্যাকে আমাদের সম্মুখ দিয়ে  নিয়ে নিয়ে যাও, তাহলে মানুষ এটাকে আমাদের দুর্বলতা, কাপুরুষতা বলে অভিহিত করবে এবং এটাকে আমাদের পশ্চাদপসারণের পূর্বাভাষ বলে মনে করবে। তোমরা নিজেরাইতো এটা বুঝতে পার যে, মুহাম্মদ (সা.) এর কন্যাকে বাধা দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই আমাদের। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এখন তোমরা ফিরে যাও। হৈ-চৈ থেমে গেলে মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে, আমরা মুহাম্মদের (সা.) কন্যাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, তখন তোমরা গোপনে তাকে নিয়ে যাবে। কেনানা এটা মেনে নিয়ে ফেরত আসেন। ঘটনাটি সাধারণ্যে প্রচারিত হলে একদিন গোপনে তাকে নিয়ে রওয়ানা হন। তিনি ‘বতনে ইয়াজিজ‘-এ যায়েদ ইবনে হারেসার কাছে পৌছে দিয়ে ফিরে যান। তিনি হযরত যয়নবকে নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারা রওয়ানা হন।
আবূল আছও যয়নবকে অত্যাধিক ভালোবাসতেন। তাদের মধ্যে সুসর্ম্পক বিরাজ ছিলো। তাই হযরত যয়নব চলে গেলে আবূল আছ অত্যন্ত দুঃখ পান। একবার সিরিয়া সফরকালে হযরত যয়নবের কথা মনে পড়লে তিনি দুটি কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতা দৃ‘টি হলো
ذكرت زينب لما دركت ادما *
فقلت سقيا تشخص يسكن الحرما
بنت الأمين جزاها الله صالحة *
وكل بعل يشني ما الذى علما
অর্থ: আমি যখন আরম স্থান অতিক্রম করি, তখন যয়নবকে স্বরণ হয়।
তখন আমি বললাম, সে হেরেম শরীফে বসবাস করছে, আল্লাহ্ তাকে সজীব্ রাখুন।
আল-আমীনের কণ্যাকে আল্লাহ্ শুভ প্রতিদান দিন।
প্রত্যেক স্বামী যা ভালো জানে, তারই প্রশংসা করে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা এবং আমানতদারীর জন্য আবূল আছ খ্যাত ছিলেন। কোরাইশরা তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য আছ এর নিকট প্রেরণ করতো। হিজরী ৬ সালের জমাদিউল আউয়াল  মাসে আবূল আছ কোরাইশদের একটি কাফেলার সাথে শাম দেশ অভিমূখে রওয়ানা হন। সেখান থেকে ফেরার পথে নবীজী জানতে পারেন। তিনি ১৭০ জন ঘোড়া সওয়ারসহ যায়েদ ইবনে হারেসাকে প্রেরণ করেন পশ্চাদগমনের জন্যে। ঈশ নামক স্থানে উভয় কাফেলা মুখোমুখি হয়। নবীজীর প্রেরিত বাহিনী মুশরিক বাহিনীকে গ্রেফতার করে এবং তাদের পণ্যসামগ্রী হস্তগত করে। কিন্তু আবূল আছ এর কোন ক্ষতি করা হয়নি।
আবূল আছ কাফেলার এ পরিণতি দেখে তখনই মদীনা মুনাওয়ারা চলে যান এবং সেখানে পৌঁছে হযরত যয়নবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেন। হযরত যয়নব তাকে আশ্রয় দেন। নবীজী তখন ফজরের নামাযে ছিলেন। হযরত যয়নব বুলুন্দ আওয়াযে বলেন, আমি আবূল আছকে আমার আশ্রয়ে নিয়েছি।
নবীজী নামায শেষ করে বললেন, লোক সকল! তোমরা কিছু শুনলে? সকলে আরয করেন, জি হ্যাঁ, শুনেছি। তিনি বললেন, ইতোপূর্বে এ ঘটনা সম্পর্কে আমার কিছু জানা ছিল না। কি বিস্ময়ের ব্যাপার! মুসলমানদের দুর্বল লোকেরা দুশমনদেরকে আশ্রয় দেয়।
নবীজী ঘরে তাশরীফ আনলে হযরত যয়নব তাঁর খেদমতে হাযির হলেন। তিনি আরয করলেন, আবুল আছ এর আটককৃত পণ্য ফেরত দেয়া হোক। তিনি অভিযাত্রী দলের কাছে খবর পাঠালেন, আবূল আছ এর সাথে আমার কি সর্ম্পক, তোমরা তা জানো। তোমরা তার প্রতি দয়া করে তার মলামাল ফেরত দিলে তা আমার খুশির কারণ হবে। অন্যথায় তোমাদের ইখতিয়ার রয়েছে। তারা সবাই বললো, আমরা সব কিছু ফেরত দিতে প্রস্তুত। তাই হয়েছে। তার সব কিছুই ফেরত দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে কন্যা যয়নবকে বললেন, আবূল আছ এর আদর-যতœ, সম¥ান-মর্যাদায় ত্রুটি করবে না। কিন্তু যতক্ষণ সে মুশরিক থাকে, তার নৈকট্য থেকে দূরে     থাকবে। কারণ, ইসলাম ও কুফর একত্র হতে পারে না।
বাহ্যত এ বর্ণনা দ্বারা প্রথম বর্ণনা অর্থ্যাৎ সর্ম্পক ছিন্ন না করার প্রতিবাদ হয়। কিন্তু আসলে যেহেতু এখন ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, অতি সহজেই দুশমনদের মোকাবিলা করা যায়। তাই এমন নির্দেশ না দেয়ার কোন কারণ থাকে না নবীজীর জন্য। যেহেতু আগের সময়টি ছিল সত্যিকার অর্থেই নাযুক। তাই তখন বিবাহ বিচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়নি।
এরপর আবূল আছ তার পণ্যসম্ভার নিয়ে মক্কা মুয়ায্যমা রওয়ানা হন।  মক্কা পৌঁছে সকলের দেনা-পাওনা পরিশোধ করেন। একদিন তিনি কোরাইশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখন আমার কাছে কারো কোন দাবি তো অবিশিষ্ট নেই? তারা বললো; না, এখন তোমার কাছে আমাদের কোন দাবি নেই। আল্লাহ্ তোমাকে নেক প্রতিদান দিন। তুমি একজন ওফাদার এবং ভদ্র ব্যক্তি। আবূল আছ বললেন, তোমরা শুনে রেখো, এখন আমি ইসলাম গ্রহণ করছি। এই বলে তিনি পাঠ করলেন,
أشهد أن لاإله إلا الله   وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده و رسوله
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (চলবে)

No comments:

Post a Comment